ভালো থেকো পর্ব – ১

0
892

ভালো থেক
রেশমী রফিক
পর্ব – ১
মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, কপালের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কত বছর চুলে চিরুনি পড়েনি। চুলগুলো রুক্ষ। রঙটাও পাল্টে লালচে হয়ে গেছে। হয়তো রোদে পুড়ে-পুড়ে এই অবস্থা! গায়ের রঙয়ের কথা বলার জো নেই। একসময়ে ফর্সা ত্বক এখন তামাটে রঙ ধারণ করেছে। কপালের ঠিক নিচেই একজোড়া চোখ। বেশ বড়সড়। ওটাই পালটায়নি। ওই চোখ দেখলেই মানুষটাকে চেনা যায়।
রুপার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। কেমন একটা মোচড়ানো অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে লাগল সাপের মতো। আশিক!
হ্যাঁ, ওটা আশিক। এই ক’বছরে যত পরিবর্তন হোক না কেন, যতই পাল্টে যাক, রুপার কখনো চিনতে ভুল হবে না। এই চোখজোড়ার প্রতিটা দৃষ্টি সে চেনে। এই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ভালোমন্দ খবর সে জানে। সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটার মন সে খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলতে পারে এক ঝটকায়, কম্পিউটারের চেয়েও অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে! নাহ, আগে পারত। আগে আশিকের উপর তার পূর্ণ অধিকার ছিল। আশিক শুধুমাত্র তারই ছিল। কিংবা সে আশিকের। এখন দুজনের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব। এতটাই, তা আর কখনো কমবে কি না সন্দেহ। এই জাগতিক দুনিয়াতে অন্তত সেই সম্ভাবনা নেই।
রুপা বজ্রাহতের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পাজোড়া যেন মাটির সাথে পাকাপোক্তভাবে লেগে আছে। বহু চেষ্টা করেও একদন্ড সরাতে পারছে না। যেন পেরেক দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে কেউ। অথচ সে এখানে থাকতে চাইছে না আর একমুহূর্ত। আশিকের চোখে চোখ রাখতে চাইছে না। ছুটে পালাতে অস্থির হয়েছে মন সেই কখন। কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। হাজার নয়, লক্ষ-কোটি টন ওজনের পাথর সমান ভারী হয়ে আছে।
আশিক অবশ্য খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই এগিয়ে এলো কয়েক কদম। স্মিত হেসে বলল,
– রুপা! তুমি এখানে? আমি তো জানি, তুমি এদিকে থাকো না। আই মিন, তোমার বাবার বাড়ি কাছাকাছি হলেও তুমি নাকি আসো না। আজ এলে হঠাৎ! ভালোই হলো। অনেকদিন পর দেখা হয়ে গেল তোমার সাথে।
এক নিঃশ্বাসে একাই কথাগুলো বলল আশিক। রুপা প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে রাখতে। অনেকগুলো দিন, মাস, বছর পেরিয়ে গেছে। তবু কেন যেন আশিককে দেখলেই বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। আলাভোলা এক কিশোরীর ওড়না হুট করে বাইকে চড়ে যাওয়া এলাকার সবথেকে সুদর্শন আর ভদ্র ছেলেটা ছলেবলে একটু উড়িয়ে দিয়ে যায়, ঠিক সেরকম। বাইকটা চলে যায় বহুদূর। পেছনে রয়ে যায় মুগ্ধতা চুইয়ে পড়া একজোড়া রঙ্গিন দৃষ্টি। বুকের ভেতর তুমুল তুফান বইতে থাকে। তিরতির করা অনুভূতিটা উথলে পড়তে চায়। কিন্তু তা হতে দেয়া যাবে না। কৈশোরে তুমুল উন্মাদনার দিনগুলো পার করা কিশোরী এমনিতে আলাভোলা হলেও তার মন মুহূর্তেই বুঝে ফেলে, এ এক নিষিদ্ধ অনুভূতি। একে কিছুতেই লোকগোচর হতে দেয়া যাবে না। সযত্নে লুকিয়ে রাখতে হবে মনের গহীনে।
আশিকের সাথে রুপার এগারো বছরের প্রেম। সেই কিশোরীবেলা থেকে শুরু। তারপর দাম্পত্য জীবন কেটেছে সাত বছর। সব মিলে আঠারোটা বছরে রুপার এই অনুভূতির কোনো হেরফের হয়নি। প্রথম দেখার সেই ক্ষণটার মতোই আশিকের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিত। অদ্ভুত এক সুখানুভূতি! কিন্তু আজ কেন সেই সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হবে মন? আশিক তো কেউ না এখন। সত্যি, কেউ না। একটা স্বাক্ষর যেমন ওদের দুজনকে এক করে দিয়েছিল, তেমনি আরেকটা স্বাক্ষর ওদের দুই প্রান্তে ছিটকে ফেলেছে।
রুপা কোনোমতে বলল,
– হ্যাঁ মানে, বহুদিন পর আসা হলো।
– কেমন আছ তুমি?
– এই তো। আছি। ভালোই আছি। তু-তুমি?
আশিককে এই মুহূর্তে ‘তুমি’ সম্বোধন করা যাবে কি না, তা নিয়ে রুপার বুকের ভেতর আলোড়ন চলছে। সদ্য চল্লিশ পেরুনো জীবনে যতগুলো মানুষের সাথে তার পরিচয় বা আত্মীয়তা হয়েছে, চেনাজানার পর্ব চলছে, সে আঁতিপাঁতি করে স্মৃতির ভান্ডার খুঁজতে লাগল এর মধ্যে ডিভোর্সী কেউ আছে কি না এবং সে প্রাক্তনকে কী সম্বোধন করে। তুমি নাকি আপনি? আশিক যদিও ‘তুমি’ই সম্বোধন করছে।
– তুমি যেমন রেখেছ!
কথাটা বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দেবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু রুপা এই যাত্রায় টলে গেল না। ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে সে। সরাসরি আশিকের দিকে তাকায়নি। ওই চোখের দিকে তাকানোর সাহস ওর নেই আসলে। উত্তরটা খেয়াল না করার ভান করে বলল,
– ওহ। তো, কী অবস্থা? কী করছ এখন?
– একটা অ্যাডভারটাইজিং ফার্মে জয়েন করেছি তিন বছর হলো।
– আচ্ছা।
– এখনো স্টেবল হতে পারিনি। কমফোরটেবল ফিল করছি না। আসলে কাজ করে শান্তি পাচ্ছি না। তুমি তো জানো, আমার কাজের ফিল্ড কেমন হয়। একদম অপোজিট।
– হ্যাঁ, মানে তাহলে জবটা ছেড়ে সুইটেবল কোনো কোম্পানীতে অ্যাপ্লাই করছ না কেন? তোমার রিজুমি তো অনেক ভালো।
– ভয় করে।
– ভয়?
রুপা এবার অবাক দৃষ্টি মেলে তাকাতে বাধ্য হলো বলা চলে। আশিক আগের মতোই স্বাভাবিক সুরে বলল,
– তুমি চলে যাবার পর আসলে চাকরি ছাড়াটা আমার কাছে আতঙ্কের মতো হয়ে গেছে। এই চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটাই তো আমার সবকিছু উলটপালট করে দিল। একটা রিজাইন, একটা লেটার। বসের হাতে ধরিয়ে দিলাম। চোটপাট দেখিয়ে চলে আসলাম বাসায়। আর…
আশিক খানিক অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে কী? স্মৃতিচারণ করছে এখন? রুপা তড়িঘড়ি রাশ টেনে ধরল কথোপকথনের। এখন স্মৃতিচারণ করা মানায় না। আশিকের কথার তালে সে নিজেও টলে যেতে পারে বৈকি! গত আট বছরে সে নিজেকে অনেকটা শক্ত করে ফেলেছে। চারপাশে দুর্ভেদ্য দেয়াল দাঁড় করিয়েছে। কারও সাহস নেই সেই দেয়াল ভাঙ্গার। দেয়ালের খবর কেউ জানেও না অবশ্য। বিচ্ছেদের পর প্রথম দু’বছরে সে যতগুলো বিভীষিকার সামনে পড়েছে, তারপর একটু-একটু করে নিজেকে গড়ে তুলেছে। অভিনয়ে দক্ষতা জাহির করার সেটাই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। আট বছরে এই দক্ষতাকে রীতিমতো পৃষ্ঠপোষকতা করে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এর জন্য ওর অস্কার পাওয়াটা ঠেকাতে পারবে না কেউ। পার্থক্য এখানেই, এই অভিনয় প্রতিভাকে মুল্যায়ন করার জন্য কানে কোনো অস্কার অনুষ্ঠান হয় না। অথচ দর্শকের সংখ্যা লক্ষ-কোটি ছাড়িয়ে যাবার মতো। তাদের হাততালিও খুব জোরে কানে বাজে। তাদের প্রশংসাবাক্য শুনতে-শুনতে এখন মাথা ধরে যায় রীতিমতো। তবু সে ক্লান্ত হয় না একটু। একটু বিরক্তি বোধ করে না। বরং নতুন উদ্যমে জীবন নামের এই স্টেজ শোতে নেমে পড়ে আরও ভালো অভিনয় দক্ষতা প্রদর্শন করতে।
– তোমার ফ্যামিলি মানে তোমার আম্মা, বোন ওরা কেমন আছে?
– জানি না। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ হয় না।
– কেন?
বলেই মনে-মনে দাঁতে জিভ কাটল রুপা। নিজেকে কষে একটা ধমক দিল সে। কী দরকার ছিল এই প্রশ্নটা করার? আশিকের জীবনে যাচ্ছেতাই হোক, ওর এখন কিছুতেই যায় আসে না। সে এখন অন্য জগতের বাসিন্দা। অন্য আকাশে সে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু মন খুবই নাছোড়বান্দা। উত্তর তাকে জানতে হবেই। আশিককে দেখে মনে হচ্ছে না, রুপার মতো এত দ্বিধা-অস্বস্তি তাকে গ্রাস করেছে। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
– সব কেনর উত্তর হয় না, রুপা। (চলবে)
কয়েকজন লেখক মিলে সম্প্রতি ”প্রাক্তন” থিমে ছোট গল্প লিখতে শুরু করেছেন। আমাকেও লিখতে বলা হয়েছে। কিন্তু ছোট গল্প আর আমি? এ যেন দক্ষিণ মেরু আর উত্তর মেরু। কারণ এক লাইন লিখতে বসলেই রচনা হয়ে আমার। তাই ছোট গল্প লেখার আহবান আমি বরাবরই উপেক্ষা করতে যাই। কিন্তু এই থিমটাকে উপেক্ষা করতে পারছিলাম না। অলরেডি একটা প্লট মাথায় ঘুরছে। উপন্যাস লিখে ফেলব সময়-সুযোগ হলেই। তারপর হয়তো কোনো এক বইমেলায় কী কোনো শুভ উপলক্ষ্যে বই প্রকাশ করে ফেলব। তাই বলে এই সময়ে গল্প লেখাটা বাদ দেয়া যায়? অবশ্যই না।
তাই ছোট গল্প না হলেও বড় গল্প লিখে ফেললাম। মাত্র কয়েক পর্বের হবে গল্পটা।
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে নেয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here