ভালো থেকো পর্ব-২

0
406

ভালো থেক
রেশমী রফিক
পর্ব – ২
আর কিছু বলার নেই। বলা উচিত নয়। নিজেকে সতর্ক করল রুপা। এই বেলা মানে-মানে কেটে পড়তে হবে। আশিকের সাথে গালগল্প করার সময় নয় এটা। ব্যস্ত শপিংমল। চারপাশে কতশত মানুষ ঘুরঘুর করছে। এদের মধ্যে পরিচিত কারও চোখে পড়ে গেলে ঝামেলা ডালপালা মেলবে বেলাহাজের মতো। বাবার বাড়ির কাছে, এজন্যই ভয়টা বেশি। তাছাড়া, এখানে সে কাজে এসেছে। ছেলে ফারিজের জন্য খেলনা কিনতে হবে, যেটা কি না ভাতিজা সমুর খেলনার মতোই হুবহু দেখতে।
গত সপ্তাহে রুপার বোনের বাসায় দাওয়াত ছিল। বোনের মেয়েটার জন্মদিন। সেখানে ভাই-ভাবী গিয়েছিল তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। সমুর হাতে তখন একটা পিচ্চি হেলিকপ্টার ছিল। ওটা দেখেই ফারিজের ঘ্যানঘ্যান শুরু হয়ে গেল। ওই হেলিকপ্টার তার চাই। এদিকে সমু কিছুতেই তার খেলনা হাতছাড়া করবে না। এই নিয়ে দু’জন শুরু করে দিল হাঙ্গামা। রুপা অত পাত্তা দেয়নি। বাসায় ছেলের টয় রুমে কম করে হলেও বিশ-পচিশটা হেলিকপ্টার আছে। ফারিব কিনে এনেছে একেক সময়ে। কোনোটা দেশের সবথেকে দামী শপিং সেন্টার থেকে কেনা, আবার কোনোটা দেশের বাইরে থেকে আনা। সমুর হাতে যে হেলিকপ্টার, তার চেয়ে হাজারগুণে ভালো আর দামী খেলনা ফারিজের আছে। কিন্তু ওসবে তার মন নেই। সে সমুর খেলনাটা চায়। রুপা সেদিন ফারিজকে মানানোর অনেক চেষ্টা করেছে। না পারতে জন্মদিনের কেক কোনোরকমে কেটেই এক টুকরো খেয়ে অমনি বাসার পথে রওনা হয়েছে। ফারিজ চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করেছিল। ওই বাসায় আর টেকার উপায় ছিল না। এমনিতে এরকম কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সাথে ফারিব থাকে। কিন্তু সেদিন ফারিব ব্যস্ত ছিল ব্যবসায়ের কাজে। তারও যাবার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে কী একটা কাজে আটকে গেছে। রুপাকে টেক্সট করে দিয়েছে, যেন সে ফারিজকে নিয়ে চলে যায়।
রুপা ভেবেছিল, বাসায় পৌঁছুলেই ছেলের কান্না থামবে। টয় রুমের এত-এত খেলনা পেয়ে সে ভুলে যাবে সমুর খেলনার কথা। কিন্তু না, ফারিজের মাথা থেকে সমুর ওই খেলনা হেলিকপ্টারের ভুত নামল না। অতঃপর ছেলের কান্নাকাটি ফারিবের নজরে পড়ল। সে ভ্রু কুঁচকে রুপাকে বলল,
– এত করে চাচ্ছে। কিনে দিচ্ছ না কেন? একটা হেলিকপ্টারই তো!
রুপা বলল,
– আমি বেশ কয়েকটা দোকানে খুঁজেছি। পাইনি। ফারিজের হুবহু ওরকমই লাগবে।
– তাহলে তোমার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করো, কোথা থেকে নিয়েছে।
– আশ্চর্য! সামান্য একটা হেলিকপ্টার কোথা থেকে কিনেছে, সেটা কি জিজ্ঞেস করা যায় নাকি? দেখতে আহামরিও না। সস্তা প্লাস্টিকের তৈরি। দাম খুব বেশি হলে হাজার-বারোশ টাকা হবে!
রুপা ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলল। সমুর ওই খেলনার দাম দুইশ টাকার কাছাকাছি। বেশি হলে তিনশ-চারশ হতে পারে। কিন্তু ফারিবকে সেটা বলা যাবে না। এই দামের মধ্য দিয়ে আচমকা বাবার বাড়ির দৈন্যতা সামনে চলে আসতে পারে। ফারিব বলল,
– দাম যেটাই হোক। তুমি অবশ্যই তোমার ভাই-ভাবীর কাছ থেকে জেনে নিবে কোথা থেকে ওটা কিনেছে। তারপর সেই দোকান থেকে ফারিজের জন্যও কিনবে।
অতঃপর সেই খেলনা হেলিকপ্টার কিনতেই বাবার বাড়ির কাছে এই শপিংমলে আসা। যথারীতি হেলিকপ্টার কেনা হয়েছে। এরপরই ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ফারিজ বায়না ধরল, প্লে-জোনে খেলবে। অগত্যা ওকে খেলতে পাঠিয়ে ঠিক পাশে একটা টেবিলে বসেছে। ওদিকে সারি-সারি খাবারের দোকান। একটা কফিশপ থেকে ক্যাপাচিনো কিনে এনেছে, যেন তাতে চুমুক দিয়ে খানিকটা সময় ক্ষেপণ করতে পারে। এর মধ্যে আচমকা আশিক উপস্থিত হবে, ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
আশিক একটুক্ষণের বিরতি নিয়েছিল। হয়তো কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল, বলার আগে। তার গলা খাঁকারি শুনে রুপার সংবিৎ ফিরল। তড়িঘড়ি করে টেবিল ছেড়ে উঠার পাঁয়তারা করছে, এমন সময় আশিক বলল,
– আম্মার কথাই ঠিক, জানো? আম্মা সবসময় একটা কথা বলত না? ওই যে, বউ গেলে বউ পাবি। কিন্তু মা গেলে মা পাবি না। তোমাকে শুনিয়ে বলত। তুমি কষ্ট পাবে শুনলে, এটা জেনেই বলত আমাকে। কথাটা তখন আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এখন হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি, কতটা সত্যি!
রুপা বরফের মতো জমে গেল। যেখানে, যেভাবে বসা ছিল, ওভাবেই রইল ঠায়। ওই মুহূর্তে মুর্তির সাথে তার একটাই পার্থক্য, সে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হোক ধীরে। তবু তো নিচ্ছে! আশিক ওকে লক্ষ করল না। স্বগতোক্তির সুরে বলল,
– তুমি ঠিকই আমাকে ছেড়ে চলে গেছ। কিন্তু আম্মা যায়নি। আম্মা আমাকে বরাবরই আঁকড়ে ধরে রেখেছে।
রুপার বুকের ভেতরকার সুপ্ত আগনেয়গিরি আচানক জেগে উঠতে লাগল। লাভা উদগীরণ হলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– হ্যাঁ, তোমার মায়ের মতো মানুষ হয় না! উনি তো ফেরেশতার মতো। উনার কাজকর্ম কথাবার্তা সব ঠিক। উনি অবশ্যই ঠিক কথা বলেছেন। বউ গেলে বউ পাওয়া যায়। কিন্তু মা গেলে আর পাওয়া যায় না। তুমি নিশ্চয়ই এখন খুব ভালো আছ, আশিক। তোমার জীবন থেকে রুপা নামের বাঞ্জা মেয়েমানুষ বিদায় হয়েছে। হয়তো উর্বর জরায়ুর অধিকারিণী কোনো নারী এসেছে। তোমার অন্ধকার জীবনকে আলোকিত করে তুলেছে। ইজন্ট?
আশিক ম্লান হাসল। বলল,
– তুমি একদম আগের মতো আছ, রুপা। একটুও পাল্টাওনি।
– তাই বুঝি?
রুপার কন্ঠে ব্যঙ্গাত্মক সুর। আশিক বলল,
– হু।
– তোমার কি সত্যিই মনে হচ্ছে আমি পাল্টাইনি?
– হ্যাঁ, সত্যি। তুমি সেই আগের রুপা রয়ে গেছ। আলাভোলা, অভিমানিনী। যে কি না হুটহাট রেগে যায়। এরপর অভিমানের ডালা খুলে বসে। মনগড়া কিছু ভেবে নেয়। তাতে তার অভিমানের পশরা জমজমাট হয়। একটা সময়ে সেই পশরা আমাকেই ভাঙ্গতে হতো।
– এক্সকিউজ মি…
– প্লিজ, একদম রাগবে না। এতকাল বাদে কোনো রাগারাগি হোক, চাই না।
কী ভেবে রুপা নিজেকে সামলে নিল। আশিকের কথা সত্যি। চট করে রেগে যায় সে। এখনো রাগ উঠে গেছে মাথায়। কপালের দু’পাশের রগ দপদপ করছে। মুখটা লাল হয়ে আছে। কিছু কথা মুখ-নিঃসৃত হতে আঁকুপাঁকু করছে খুব। কিন্তু সে সায় দিল না তাদের। এই মুহূর্তে রাগটাকে উগরে দেয়া যাবে না। বরং চটজলদি এই জায়গাটা ছেড়ে গেলেই ভালো। ফারিজকে ডাকা দরকার। কতক্ষণ তো খেলাধুলা করল। এখন বাসায় ফেরা যাক!
টেবিল ছেড়ে প্লে-জোনের ওদিকে এগোল রুপা। আশিক পিছু নিয়েছে। বুঝতে পেরে হাঁটার গতি বাড়াল সে। আশিক পেছন থেকে কিছু বলছিল। সে এড়িয়ে যাবার ভান করল। তবে কানজোড়া অবধারিতভাবে আশিকের কণ্ঠ শুনতে উদগ্রীব। ততক্ষণে প্লে-জোনের সামনে চলে এসেছে। উঁকিঝুঁকি মেরে ফারিজকে খুঁজছিল রুপা। এই প্লে-জোনে এত-এত বাচ্চা এসেছে খেলতে। দূর থেকে ফারিজকে খুঁজে বের করাই দায়। এর মধ্যেই হঠাৎ শুনল আশিকের কণ্ঠ,
– রুপম!
রুপার মনে হলো, কানে গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে কেউ। ‘রুপম’ নামটাকে খুব যত্নে সে লুকিয়ে রেখেছে মনের ঘরে। কখনো উচ্চারণ করেনি মুখ দিয়ে। আট বছরে কাউকে বলতেও শুনেছে বলে মনে হয় না। আজ হুট করে কেন আশিক এই নামটা উচ্চারণ করল? কী চায় সে? কেন ওর পেছনে পড়ে আছে? এত বছর বাদে ওকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে তার কী লাভ? তবে কি ওর নতুন জীবন শুরু করাটা আশিকের পছন্দ হয়নি? তা কেন, ওর মা তো একরকম উঠেপড়ে লেগেছিলেন রুপাকে ছেলের জীবন থেকে উৎখাত করতে। আশিক নিজেও তখন মায়ের পক্ষে কথা বলেছে। এখন কেন ওর জীবনে নাক গলাচ্ছে?
চট করে ঘুরে দাঁড়াল রুপা। নাহ, আর নয় দুর্বলতা। আশিক নামের মানুষটা একসময়ে ওর জীবনে সবথেকে দামী কেউ হতে পারে। কিন্তু এখন তার কোনো মুল্যই নেই ওর কাছে। তাকে সে বহু আগেই মনের ঘর থেকে উচ্ছেদ করেছে। মনের একটা অংশ অবশ্য বিরোধিতা করল। জোর দাবি জানাল, এটা মিথ্যে কথা। আশিক এখনো মনের ঘরে স্ব-স্থানে রয়েছে। ফারিব জীবনবাড়ির চৌকাঠের ভেতর পা রাখলেও মন নামক ঘরে তার ঠাঁই হয়নি। ওই ঘরটা কেবলই আশিকের। আশিক আর রুপমের!
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here