#অশান্ত বসন্ত।
(২৪ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
***********************
কলেজ থেকে ফিরে মুখ- হাত-পা ধুয়ে ড্রেস পালটে নিলো পিউ। তারপর দাদাভাইয়ের মতো এক মাগ কফি বানিয়ে ব্যলকনিতে এসে বসলো। দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটের এই ব্যলকনিটা পিউয়ের দারুণ পছন্দের। কফির চুমুকের সাথেই মাকে ফোন করলো পিউ। রোজই এই সময়টা মায়ের সাথে ফোনে গল্প না করলে মন ভরেনা পিউয়ের।
পিউ জানে ও ব্যাঙ্গালোরে দাদাভাইয়ের কাছে থেকে যাওয়ার কারনে ওর মা বড্ড একা হয়ে পরেছে। পিউয়ের বাবা তো শুধু পিউ আর দাদাভাইয়ের বাবা নয়,মায়ের বাবার ভূমিকাটাও নিখুঁত ভাবে পালন করে চলেছে মানে সারাদিন শুধু খিটমিট।
অবশ্য পিউয়ের অন্য বন্ধুর বাবারা এইরকম খিটখিটে নয়।ওদের বাবারা কতো ফ্রেন্ডলি।সেই কারনে ওরাও মায়ের চাইতে বাবাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় জীবনে।তবে ওদের দুই ভাইবোনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা।মা ই ওদের সবচেয়ে কাছের জন।
ফোনটা একবার বাজতেই মায়ের মিষ্টি স্বর।’ তুমি কি ফোনের পাশেই বসেছিলে মা?’,সীমা বললো,’ ফোনটা হাতেই ছিলোরে।অঞ্জনা ফোন করেছিলো,তোর নাম্বার চাইলো’,পিউ বললো,’তুমি দাওনি তো?’,সীমা হেসে বললো,’কি বলে না বলতাম?অঞ্জনা তো শুধু আমার বন্ধু নয়।তোর হবু শ্বাশুড়ি বলে কথা’।
পিউ বললো,’কেন দিতে গেলে ফোন নাম্বার?ফোন করলে কি কথা বলবো আমি শুনি ?’,সীমা হেসে বললো,’কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবি।তবে আমার মনে হয় সৃঞ্জয়কে দেবে তোর নাম্বার’।সৃঞ্জয় হয়তো অঞ্জনা মাসির ছেলের নাম!কথাটা মাথায় আসতেই পিউ লজ্জা পেলো একটু।তাও কপট রাগ দেখিয়ে মাকে বলে,’না দিলেই পারতে নাম্বারটা’।
সীমা হেসে বললো, ‘আমি চাই তুই সৃঞ্জয়কে একটু জেনেনে।তোর বাবার স্বভাবের মনে হলে জানাস আমায়। আমি নিজেই তখন উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে ভেঙে দেবো’।
পিউ মায়ের কথা শুনে কি যেন ভেবে একটু উদাস হয়ে পরলো। তারপর বললো,’ঠিক আছে মা। সৃঞ্জয় ফোন করলে আমি পরিচিতিটা বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করবো’।আরো বেশ কিছু কথাবার্তার পর ফোন রেখে স্নানে ঢুকলো পিউ।
পুরো ফ্ল্যাটে এই সময়টা একাই থাকে পিউ। একলা দুপুর, স্মৃতির ভাড়ে মন খারাপ বয়ে আনে। পিউয়ের মনে পরে গেলো পরাগের শেষ কথা গুলো। ‘বড্ড সেকি তুমি।সেই মান্ধাতা আমলের মাসিমাদের মতো মানসিকতা তোমার।তোমার সাথে পোষাবে না আমার।আমি আধুনিক মানসিকতার মানুষ, আর তুমি পিছিয়ে পরা দলের’ ,পরাগের কথাগুলো মনে পরতেই চোখ ফেটে জল আসতে চাইছে পিউয়ের।কতোদিন আগের কথা,অথচ মনে হয় এই তো সেদিন।
একাদশ শ্রেণীতে উঠেই দাদাভাইয়ের থেকে নতুন স্মার্টফোন পায় ভাইফোঁটায়। আর একাউন্ট ও খোলে ফেসবুকে ।সেখানেই পিউ পরিচিত হয়েছিলো পরাগের সাথে। বাবা মায়ের চোখ এড়িয়ে রাতের দিকেই কথা হতো দুজনের। শুরুতে টুকটাক কথা, এই কে কোথায় থাকে? কি পড়াশোনা করে এসব। তারপর সেই টুকটাক কথা থেকেই হাজার কথার আদান-প্রদান।
আর তারপরেই একদিন এলো সেই মুহুর্ত টা যখন পরাগ জানালো,’ ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় পিউ”।ভালো লাগার পারদ বাড়ছিলো পিউয়ের দিক থেকেও। নতুন সম্পর্কটা পিউকে যেন রঙিন প্রজাপতি বানিয়ে দিলো।
পরাগ দেখা করতে চাইলো। বললো,প্লেটোনিক লাভে বিশ্বাসী নয় সে।তাই সম্পূর্ণ ভাবে পেতে চায় পিউকে।
পিউ অরাজী ছিলো এমন নয়,পিউ ও চাইতো পরাগকে।তবে একটু সময় চেয়েছিলো।
পরাগ বিরক্ত হলেও রাজি হয়েছিলো পিউয়ের কথায়। তবে যতো দিন যেতে থাকে পরাগের ব্যবহারে পিউয়ের মনে হচ্ছিলো পরাগ বোধহয় ওকে কাটাতে চাইছে। পরাগ সুযোগ পেলেই পিউকে জানাতো যে ওর আগের গার্লফ্রেন্ড অতীব সুন্দরী ছিলো।পিউ তার ধারেকাছেও যায়না।এমনকি তার ড্রেসিং সেন্স ও অনেক উন্নতমানের,পিউয়ের মতো নয়।
তাছাড়া মাঝেমাঝেই পিউ পরাগকে অনলাইনে দেখে মেসেজ করলেও পরাগ রিপ্লাই দিতো অনেক দেরিতে।মেসেজ চলাকালীন ও বারবার বেরিয়ে যেতো ইনবক্স থেকে।পিউ প্রশ্ন তুললে বলতো,’সন্দেহপ্রবন,পাগল, হিংসুটে’।
পিউ ভিতরে ভিতরে ভেঙে পরছিলো।বুঝতে পারছিলো কোথাও ভীষণ একটা ভুল করে ফেলেছে।কিন্তু তাও পরাগের ওপর অন্ধপ্রেমে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলো ওকে। পিউ এটাও বুঝেছিলো,এই সম্পর্ক চলতে থাকলে ও নিজেকে হারিয়ে ফেলবে পরাগের ইচ্ছের তীব্রতার উন্মাদনায়।তবুও সরে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাবতে পারছিলোনা।
কিন্তু যেদিন পরাগ পিউকে সেকি,মান্ধাতা আমলের বললো, সেদিন পিউ বুঝেছিলো আর বাড়িয়ে লাভ নেই সম্পর্কটা।
রাতের পর রাত বালিশ ভিজিয়েছে কিন্তু পরাগের কাছে আর যায়নি।পরাগকে মুক্তি দিয়ে সরে গিয়েছিল সম্পর্কটা থেকে।পরাগ খুঁজে পাক ওর নিজের মতো উদার আধুনিক মানসিকতার সুন্দর ড্রেসিং সেন্স আর আদিম উদ্দামতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো সঙ্গিনী।
কলিংবেলটা বেজে উঠলো। পিউ ভেজা গায়েই ঢোলা টিশার্ট আর প্যান্ট পরে বেরিয়ে আসলো।দরজা খুলতেই পুরো হাঁ মুখ পিউয়ের।সামনে দাদাভাই আর বহ্নিদি দাঁড়িয়ে।পিউ বহ্নিকে বললো,’আজ অফিস যাওনি তোমরা? ‘পল্লব হেসে বললো,’আগে দরজা ছেড়ে ঢুকতে দে আমাদের’।পিউ হেসে বললো,”হ্যাঁ এসো’।
দরজা থেকে পিউ সরে দাঁড়াতেই,বহ্নি সোজা বাথরুমে গিয়ে হাত পা ধুয়ে টাওয়াল নিয়ে আসলো।পিউকে বললো,’এবার বুঝেছি তোর ঠান্ডা কেন লাগে!তুই তো চুলটাও মুছিস না স্নান সেরে’।তারপর আলতো হাতে পিউয়ের চুল মোছাতে থাকে।পিউয়ের মায়ের কথা মনে যাওয়াতে চোখ ছলছল করে ওঠে।বলে,’আসলে এগুলো তো মা খেয়াল রাখতো’।
পল্লব ব্যাপারটা খেয়াল করে।বলে,’আচ্ছা আগামীকাল থেকে সকালের দিকে কলেজ যাওয়ার আগে স্নান করিস,আমি না হয় তোর চুল মুছিয়ে দেবো।এবার চোখের জলটা মুছে একটা সিরিয়াস কথা শোন’।
পিউ বললো,’মোটেও কাঁদছিনা আমি।বল কি বলবি?’বহ্নি বললো,’আসলে দারুণ একটা সমস্যায় পরে গেছি, হঠাৎই আমাকে ছয় মাসের ট্রেনিং এ মুম্বাইতে পাঠানো হচ্ছে।’ দিদিয়াকে নিয়ে চিন্তায় পরে গেছি’।পিউ হেসে বললো,’এতে চিন্তার কি আছে?শিখাদি তো আমাদের সাথেই থাকতে পারবে’।
পল্লব বললো,’সেটা আমিও বলেছি। আর আমার মনে হয় আজ কালের মধ্যেই তোমরা এখানে শিফট হয়ে যাও।পরশুদিন আমিই তোমায় ফ্লাইট ধরিয়ে দেবো’।
পিউ বললো,’আচ্ছা শিখাদির থেরাপির কি হবে?’বহ্নি বললো,’বরুন সাহার সাথে আমরা কথা বলে নিয়েছি।তবে উনি ওনার সময় সুযোগ মতো আসবেন,নির্দিষ্ট সময় দিতে পারেননি’। ঠিক তখনই পিউয়ের ফোনটা বেজে উঠলো।
(চলবে)