হলদে_প্রজাপতি পর্ব-২৯

0
218

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

উনত্রিশ

( আগের অধ্যায়গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

শীত শেষ হয়ে বসন্তের দিকে পা বাড়িয়েছে সময় । এখন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিক । আর মাস খানেক পরেই আমার এখানে আসার বর্ষপূর্তি হয়ে যাবে । এই সময়টা দক্ষিণবঙ্গে ভরা বসন্ত চললেও এখানে এখনও বেশ শীত শীত আমেজ রয়েছে । আবার শীতের কামড়টাও নেই । ঋতু হিসেবে একেবারে আদর্শ । এর মধ্যে অবশ্য আমার জীবনে আর তেমন কোনো উত্থান পতন হয়নি বা বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাও ঘটেনি । মাঝে একবারই বাবা-মায়ের কাছে যেতে পেরেছিলাম । এবার ঠিক করেছি , ঠান্ডাটা আর নেই তো, বাবা-মাকে এবার এখানে নিয়ে এসে বেশ কিছুদিন রাখবো । গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়েছি সবকিছু । আশেপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতিও চেনা-জানা হয়ে গেছে । বড়োসড়ো কোনো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে অবশ্য সেই কলকাতায় নিয়ে ছুটতে হবে , তবে ছোটখাটো অসুস্থতার ক্ষেত্রে ইন্দ্রাশিষ বাবু তো রয়েইছেন । তাই ঠিক করেছি , মাসখানেকের মধ্যেই বাবা-মাকে এখানে নিয়ে আসব এবং এখন বেশ কিছুদিন রেখে দেবো ।

ভ্যারাইটিজ চা গাছের ওপর যে নার্সারিটা বানিয়েছিলাম , সেটা এখন আর ছোট নেই । আয়তনও বেড়েছে আর গাছগুলোর সাইজও। কিছু গাছকে বাড়তে দিয়েছি। সেগুলো থেকে বীজ সংরক্ষণ করবো। আমার নিজের হাতে এবং নিজের বুদ্ধিতে তৈরি করা এই চা গাছের নার্সারিটা আমার খুব প্রিয় । মাঝে মাঝে গিয়ে গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে আসি । চা’গাছের ফুলগুলো ভারী সুন্দর। ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ফুল। ঠিক যেন কুঁড়ির মত । আমার ভারী ভালো লাগে । মাঝে মাঝে দু-একটা তুলে বেলফুলের মতো মাথার চুলে গুঁজে রাখি । আমার এখানকার ‘চা-সংসারে’ও আর কোনো পরিবর্তন হয়নি । কমলা সেই যে এসেছিলো , এখনো রয়ে গেছে । যাওয়ার কোনো তাগিদ দেখায় না । ও চলে যাক , এমন কোন তাগিদ আমারও নেই। তাই সে রয়েই গেছে । সে থাকলে টগরেরও একটু সুবিধা হয় । কাজ সামলাতেও বটে , আবার গল্পগাছাও করতে পারে।

পাতারানী ইদানিং এত বেশি করে আমার ন্যাওটা হয়েছে যে, মাঝেমধ্যে রাতের বেলাও আমার কাছেই থেকে যায় । তার এখন পরীক্ষা চলছে। সন্ধের দিকটায় তার পড়াশোনা নিয়েই বেশিরভাগ সময়টা আমার কেটে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি পেটে ধরিনি বটে , তবে মেয়েটা আমারই। এক বছরও হয়নি, এরইমধ্যে পাতার সঙ্গে আমি যে কেন এত মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছি কে জানে ! এই ‘মায়ার বন্ধন’ ব্যাপারটাকে আমি খুব ভয় পাই । সমস্ত দুঃখ কষ্টের মূলে থাকে । সত্যি কথা বলতে কি, আজকাল যৌবনের প্রায় প্রান্তে এসে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন মাঝেমধ্যে দেখি । নেশার মত লাগে স্বপ্নটা দেখতে, ভালো লাগে অসম্ভব। সময় থাকতে, বয়স থাকতে, লাবণ্য থাকতে, মাঝের দেড় যুগ সময় ধরে যে স্বপ্ন আমাকে কখনো টানে নি, যে স্বপ্ন থেকে আমি শত যোজন দূরে সরে থাকতে চেয়েছি, যে স্বপ্ন আমার কাছে বিভীষিকার মতো মনে হয়েছে , বিয়ে করতে ভয় পেয়েছি, একজন মানুষের সঙ্গে সংসার পাততে ভয় পেয়েছি, সেই বন্ধ দরজার আগল খুলে গিয়ে আজ সেই নিষিদ্ধ স্বপ্ন আমার হঠাৎ কখনো কখনো বড় প্রিয় মনে হয়! পাতা আমার মেয়ে, আমারই মেয়ে । আর ইন্দ্রাশিষ বাবু.. ? আমার স্বামী .. ? চমকে উঠি যখন এসব ভাবি । নিজেকে শাসন করি । স্বপ্ন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসি । কিন্তু আবারও অগোছালো কোন অবসর সময়ে মনের অজান্তেই এই স্বপ্নটাই চুপি চুপি দেখি। জেগে জেগে দেখি । পাতা যখন আমার বুকে ওমের কাছে আমার বালাপোষের তলায় শুয়ে ঘুমোয় , ওর মাথা থেকে যে মিষ্টি গন্ধটা আসে, সেটা যেন মনে হয় আমার জন্মজন্মান্তরের পরিচিত । সেই গন্ধটাকে এমনি করে সারাটা জীবন আঁকড়ে ধরে থাকতে মন চায় । ইন্দ্রাশিষ বাবু আজকাল মাঝেমধ্যে সময় বার করে আমার সাথে গল্প করতে আসেন । আমি বুঝি, আমার সাথে গল্প করতে, সময় কাটাতে , ওনার ভালো লাগে । আমি এও বুঝি, আমাকে ওনার ভালোলাগে । আমরা দুজনে লনে বসে , কখনো ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে গল্প করি । অনেক গল্প করেছি – জীবনের গল্প, কর্মক্ষেত্রের গল্প, সুখ-দুঃখের গল্প। আমি মাঝে মাঝেই ওনার স্ত্রী সম্পর্কে দু’ একটা প্রশ্ন করে ফেলি । একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি মানুষটার মধ্যে। তিনি কখনও নিজের প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে একটিও অসম্মানজনক কথা বলেন না । বলানো যায় না । সত্যি কথা বলতে কি, বললে আমার ভালো লাগতো । কেন লাগতো, তা আমি জানিনা । পাতার মাকে আমি দেখিনি কখনো , দেখবোও না কোনোদিন। আমার সঙ্গে তার কোনো রাগারাগি , সংঘর্ষের ব্যাপারও নেই । অথচ কেন জানিনা, আমি সেই না দেখা মানুষটাকে একেবারেই পছন্দ করিনা। কেন এতটা অপছন্দ করি, আমি জানিনা। আমি তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী সম্পর্কে যা যা জানতে চাই, সব প্রশ্নেরই উত্তর তিনি আমাকে দেন। কিন্তু যে মানুষটা তার জীবনটা আপাতভাবে কিছুটা ছন্নছাড়া করে দিয়ে সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে ,তার সম্পর্কে মানুষটার কোন অভিযোগ নেই ! অদ্ভুত! আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি , তিনি কখনোই আমাকে আমার অতীত জীবন সম্পর্কে বা আমি কেন বিয়ে করিনি , এই ধরনের প্রশ্ন কখনো করেননি । সত্যি কথা বলতে কি, ইন্দ্রাশিষ বাবুই আমার জীবনে দেখা প্রথম একজন মানুষ , যার সঙ্গে আমি অনেকখানি সময় কথা বলে, গল্প করে কাটিয়েছি, কিন্তু কখনও তিনি আমাকে এই প্রশ্নটা করেননি -আমি আমি কেন এতখানি বয়স পর্যন্ত বিয়ে করিনি, নাকি আমার বিয়ে হয়নি ?

সেদিন সন্ধ্যাবেলা পাতা আমার কাছে বসে পড়াশোনা করল । পরের দিন ওর অংক পরীক্ষা আছে । বেশিক্ষণ পড়াইনি । অংক পরীক্ষার আগের দিন আর বেশি অংক প্র্যাকটিস করার কোন মানেই হয়না । তিন-চারটে ডিফারেন্ট প্যাটার্নের অংক একটু প্র্যাকটিস করিয়ে , ওকে জগন্নাথ দাকে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। খাওয়া-দাওয়া করে রাতে বিছানায় শুয়ে সেদিন বেশ অনেকক্ষণ ধরে পুরুলিয়ার কথা মনে পড়ছিল । পুরুলিয়ায় এই সময়ে মাঠ-ঘাট, পথের দু’পাশ, একেবারে স্বর্গ ব’নে যায় । অশোক-পলাশে রাঙা স্বর্গ । সে দৃশ্য যে একবার দেখেছে, তা আর সারাজীবনেও ভোলার নয় । ছোটবেলার কথা ভাবতেই আজকাল সবচেয়ে ভালো লাগে । একটা বয়সের পরে সমস্ত মানুষেরই তাই হয় হয়তো । ছোটবেলা থেকে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়ে, তারপর বড় হতে হতে একসময় বুড়িয়ে যাওয়া , এই দীর্ঘ সময়কালের মধ্যে উপলব্ধি হয় এইটুকুই – স্বপ্ন যা কিছু সব সঞ্চিত ছিল সেই শৈশবকালে ।

নানারকম ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি । হঠাৎ করে কর্কশ কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো । ধড়ফড় করে উঠে বসলাম বিছানার ওপর । কলিংবেলের শব্দ ! এখন! সঠিক শুনেছি কিনা বোঝার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রইলাম । কয়েক সেকেন্ড পর আবার! হ্যাঁ , কলিংবেলটা বাজছে। সঙ্গে সঙ্গে খানিকগুলো দুঃশ্চিন্তা মাথায় ভিড় করে এলো । এতো রাতে কলিংবেল ! কে ডাকছে ? রাত এখন কটা? বেডসুইচ অন করে দেখলাম, রাত একটা বাজতে দশ । এত রাতে কলিংবেল বাজছে, অথচ টগর দরজা খোলেনি ! হয়তো ভয় পেয়েছে । আমি তাড়াতাড়ি করে গায়ে একটা ওড়না নাইট স্যুটের ওপর চাদরের মতো করে জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার লাইটটা জ্বালালাম । তারপর , বারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে টগরদের শোয়ার ঘরের দিকে তাকালাম। দরজা ভেজানো । কই টগর বা কমলা কেউ উঠে আসেনি তো । এসব ভাবতে ভাবতেই আবার কর্কশ শব্দে বেজে উঠলো কলিংবেলটা । এগিয়ে গেলাম সদর দরজার কাছে। গিয়ে যা দেখলাম, তাতে করে চমকে উঠলাম । একী! দরজা তো খোলা ! হাট করে খোলা নয়, একটা পাল্লা ভেজানো আর একটা পাল্লা তীর্যকভাবে খোলা রয়েছে ।
কি করি, কি করি ভাবতে ভাবতেই বেশ জোরে বলে উঠলাম , কে !
— আমি । যদু !
একটু চাপা গলাতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো ।
— যদু ! এত রাতে তুমি এখানে ? ভেতরে এসো । দরজা খোলা কেন ?
আমার পারমিশন পেয়েই দরজার আধখোলা পাল্লাটা আরেকটু খুলে সরীসৃপের মতো শরীরটাকে বেঁকিয়ে ভেতরে ঢুকে এলো যদু।
— কি ব্যাপার ? তুমি এখানে ? দরজা খোলা কেন ?
উত্তরে সে ঠোঁটের ওপর নিজের তর্জনী রাখল। তারপর চোখের ইশারায় টগরদের ঘরের দিকে দেখালো । আমার কাছে ব্যাপারটা ক্রমশই একটা উত্তেজক ধাঁধা হয়ে উঠছিল । এত রাতে কলিংবেলের শব্দ , তারপর এসে দেখি দরজা খোলা , যদু আবার এখন টগরদের ঘরের দিকে কি দেখাচ্ছে ?
আমার কাছে আরো দু’ পা এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, দরজা ঠেলে দেখেন দিদিমণি , ঘরের ভেতর কেউ আছে কিনা।
— মানে !
— দেখেন না !
আমি সন্ধিগ্ধ চোখে টগরদের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে সেটা অল্প ফাঁক করে দেখলাম। যেটুকু আবছা আলো ডুকছে ঘরের ভিতরে, সেই আলোয় কাউকে দেখা গেল না । দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে এবার ভেতরে ঢুকলাম । পাশে সুইচ বোর্ড ছিল । আলো জ্বালালাম। ওমা ! ঘরে কেউ নেই । বিলকুল ফাঁকা ঘর । মাঝরাত পেরিয়ে গেছে । রাত একটা বাজে এখন । এই সময় টগর আর কমলা কোথায় গেল ? আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সন্ধিগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকালাম ।
ও ফিসফিস করেই বললো , দেখলেন তো দিদিমণি ।
— ওরা কোথায় গেছে তুমি জানো?
— আজ্ঞে-
— জানো তুমি !
— আজ্ঞে দিদিমণি ।
— কোথায় গেছে ?
আমার প্রশ্নের উত্তরে যদু কিছু বলল না । ইশারায় সদর দরজার দিকে দেখালো ।
— বাইরে বেরিয়েছে! এত রাতে !
যদু আবার চাপা গলায় বলল , আপনি আসেন আমার সাথে । আমি দেখাতে পারি।
কি দেখাতে চাইছে যদু ? টগর আর কমলা বা কোথায় এত রাতে ? বুকের ভেতরটা কেমন যেন উত্তেজনাময় আশঙ্কায় টিপটিপ করে উঠলো । যদু আমাকে কথাটা বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো। আমাকে ইশারা করলো তার সাথে যেতে । একবার ভাবলাম এই এতো রাতে বাংলো থেকে বাইরে বেরোনো কি ঠিক হবে ? তারপরে ভাবলাম, টগর আর কমলা আমার বাড়ির সদস্য । তারা এই এত রাতে কোথায় কি করছে জানাটা প্রয়োজন । দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে সদর দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিলাম ।
চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম , কত দূরে যেতে হবে ? কোথায় ওরা ?
— বেশি দূরে নয় দিদিমণি । আসেন না । এই আপনার চত্বরের মধ্যেই । আসেন –
যদযদু এক’পা এক’পা করে আমার বাংলোর পিছন দিকটায় এগিয়ে চললো । আমিও চললাম ওর পিছন পিছন । একটা সময় এসে শিশিরের দু’ঘরের কোয়ার্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো ।
আমি গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াতে প্রায় ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, আপনাকে আমি এক্কেবারে হাতেনাতে ধরে দেখাবো । তার ব্যবস্থা করেছি। কিছুদিন ধরেই আমি ওসব জানি । কিন্তু আজকে ব্যবস্থা করে রেখেছি দেখাবো বলে ।
শিশিরের ঘরের দুহাত বারান্দাটা পেরিয়ে যদু ওর ঘরের কপাটে গিয়ে চোখ রাখলো। আমার বাংলোর সামনের দিকে যে উজ্জ্বল আলোটা জ্বলে , তারই প্রতিফলিত আলোয় আমি শুধু বিমুর্ত দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি । এসব কি ঘটছে ! শিশিরের ঘরে টগর নাকি কমলা ! নাকি ওরা দুজনেই! এসব কী ! শিশিরের ঘরে ! এত রাতে একজন পুরুষের ঘরে মহিলা আসার একটাই মানে হয় । অন্য কোন মানে আর এর নেই , করা যায় না । তা বলে শিশিরের ঘরে! শিশির তো উঠতে-বসতে মুখ বেজার করে আমাকে চা শ্রমিক, গরীব , কাজের লোক , আদিবাসী , এসব নিয়ে জ্ঞান দেয় , আর এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলে। সেই শিশির! টগর বা কমলা কোন একজনের সাথে এখন নিজের ঘরে দরজায় আগল দিয়ে রতিক্রিয়া করছে ! এ কিভাবে সম্ভব হলো ! ও তো বিবাহিত , তাহলে কিভাবে একজন মহিলার সঙ্গে নিজের স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে এভাবে যৌনাচার সম্ভব – এসমস্ত কথা ভেবে লাভ নেই । এসমস্ত সামাজিক প্রশ্ন এখানে ফালতু টেনে আনা । মানুষ প্রকৃতির সৃষ্টি । প্রকৃতি মানুষকে সমাজবদ্ধ জীব করে পাঠায় নি । সমাজ মানুষের সৃষ্টি । সমাজের প্রয়োজনেই মনোগ্যামি । প্রকৃতি আসলে আমাদের প্রত্যেককেই পলিগেমাস , পলিয়ানড্রাস করে পাঠিয়েছে । সমাজ তো কৃত্রিম । তবে শিশিরদের মতো সামাজিক , বলা ভালো অতি-সামাজিক , যারা কিনা একমাত্র নিজের ক্যাটাগরি ছাড়া অন্য কারো সাথে মেলামেশাটুকুও পছন্দ করে না, তাদের জন্য এসব ভাবাই যায় না । বুঝলাম যৌনতা বড় বালাই। হাতের সামনে বিরিয়ানির প্লেট বসানো, অথচ সেটা না খেয়ে শুকনো মুখে বসে থাকা যায় না ।

যদু শিশিরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দরজার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় চোখ রাখলো । আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে দম দেওয়া পুতুলের মত শুধু ওর কাজকারবার দেখছি । তারপর মাথা তুলে নিঃশব্দে আমাকে সেই ফুটোয় চোখ রাখতে বলল । আমি স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম । এটা বললে মিথ্যা হবে যে দরজার ওই ফুটোটায় চোখ রাখতে আমার ইচ্ছা করছে না । কল্পনায় এক ঝলক দেখতেও পেলাম, ঘরের কৃত্রিম নীলচে পর্নোগ্রাফিক আলোয় নগ্ন শরীর দুটো, একটা পুরুষ একটা নারীর । তারা যৌনতায় লিপ্ত । কল্পনায় আমি শিশিরের আর টগরের শরীরের নগ্নতা দেখতে পেলাম স্পষ্ট । ওর কালো চিকন ত্বকের ওপর পড়েছে নীলচে আলো । নিটোল উরুর খাঁজ, নাভীর ভাঁজ, বুকের গরিমার ওপর তীক্ষ্ণ দুটো খয়েরী বৃন্ত । যৌনতা ক্ষিপ্ত রসালো ফুলো ফুলো দুটো ঠোঁট । কেন জানিনা সে কল্পনামাত্র ঘেন্নায় আমার গা গুলিয়ে উঠলো । ওই দরজার ফুটোটায় চোখ রাখব, ভাবতে নিজেকে খুব ছোট লাগলো । নিমেষের মধ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে হনহন করে এগিয়ে চললাম নিজের বাংলোর দিকে । কিন্তু এভাবে গা গুলিয়ে উঠলো কেন আমার ? নারী-পুরুষের প্রেম , যৌনতা এসবই তো ঘটে থাকে নতুন প্রাণ সৃষ্টির জন্য । এইতো বরঞ্চ সৃষ্টির মূল কথা । তবে এই যৌনতার কল্পনামাত্রই আমার কেন গা ঘিনঘিন করে উঠল ? তবে কি জগতের সব যৌনতা সুন্দর হয় না ? নাকি এ আমার নিজের বিকৃত ভাবনা চিন্তা? আমি কি ওদের ঈর্ষা করছি? আমি কি টগরের যৌনজীবন সহ্য করতে পারছিনা ? আমি কি ঈর্ষাকাতর? আমার কোন যৌনজীবন নেই , অথচ আমারই সামনে আমারই বাড়ির কাজের লোক, সে একটা যৌনজীবন উপভোগ করছে বলে? কিন্তু এ তো আমার স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া জীবন । আমি তো স্বেচ্ছায় বিয়ে করিনি । তবে কেন আজ এসে এমনটা মনে হচ্ছে ? তবে কি স্বেচ্ছায় করছি ভেবে যা করেছি, তাতে আদৌ আমার নিজের মত ছিল না? কে জানে ! মানুষের মন বড় জটিল । সে যে আসলে কি চায় , নিজেও জানেনা ।

একেবারে নিজের বাংলোয় দরজার সামনে এসে পৌঁছেছি এমন সময় দেখলাম , পেছন থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে যদু।
বলছে, কি হলো দিদিমণি, চলে এলে যে ? আপনেরই বাড়িতে বসে ওরা কি করছে দেখে আসলেন না? আরো বেশি করে সাহস পাবে আপনে কিচ্ছুটি না বললে ।
রাগ ধরছে , ভীষণ রাগ হচ্ছে । এই যদুটার ওপরেও রাগ ধরছে । ওর কী প্রয়োজন ছিল আমাকে মাঝরাতে ডেকে তুলে খুঁচিয়ে ওখানে নিয়ে যাওয়ার ? আমাকে ও কি ভেবেছে কি ! আবার এত বড় আস্পর্ধা , দরজার ফাঁকে চোখ রেখে ভেতরে কি হচ্ছে দেখতে বলে !
আমি পিছন ফিরে ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম , তোমার যা করার ছিল করেছ। আমার যা করার আমি করব । তুমি এখন যাও ।
যদু আমার ঠিক ওর ওপর কি কারনে রাগ অনুধাবন করতে না পেরে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে রইল । আমি বাংলোর ভেতর ঢুকতে যাবো, এমন সময় হঠাৎ করে ঠিক দরজার সামনে কোথা থেকে ছুটে এল টগর । প্রায় আমার পায়ের ওপর পড়ে আর কি ! আমি ছিটকে কয়েক পা সরে গেলাম ।
বিকৃত গলায় ও বলল , দিদি গো ! অ দিদি ! সত্যি কইচি, সত্যি সত্যি সত্যি , তিন সত্যি। আমি কিন্তু ওকেনে ছিনু না । আমার সাতে চলো গো দিদি , আমি পেমাণ করে দিব , ওকেনে ওই হারামজাদি কমলা আচে । ওকে একেনে লি আসেই আমার সব্বোনাশ হল , দিদি গো ! সত্যি কইচি , আমি মরতে ঐ হারামজাদা নোকের ঘরে মুট্টে যাই নি । আমি আজ রেতে, এই আজকেই দেখতে যাইচি, ওই হারামজাদি কোন চূলোয় যায় ।
আমার বাংলোর সামনে উবু হয়ে বসে পড়ল সে , তুমি বিশ্বাস করো গো দিদি ! আমি বুইচিলাম ওই শালী কোতাও যায় নিঃসারে রেতের আন্ধারে । ফি রেতে ভাবি কিনে আজ টিক ধরব শালীকে , মাজরেতের পিরিতি চুটকে চেড়ে দিব , কিন্তু ঘুমায় পড়ি গো! আজ অনেক কষ্টে জেগেচি । চোকের পাতা দু’খান মোট্টে নাগতে দিইনি । মরার মত পড়েচিলাম । ঠিক বুইলাম হারামজাদি পাশ থেকে উটে বিড়াল পায়ে যায় দোরের পানে। ওর পিচু নিইচিলাম কিনা, ওকেনে ওই পিছ পানে খাড়ায়ে ভাবচি, কি করি , কি করি , এমন সময় দেখি কিনে তুমি আইচো ! ওই হারামজাদীকে কালই আমি চুলের মুট্টি ধুরে পিট্টে পিট্টে পাট পিটে না করে ঘাড় ধরে বার করিচি তো আমার নাম মুট্টে টগর লয়-
আমি ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। যাওয়ার সময় বলে গেলাম , টগর আর যদু! তোমরা দুজনেই খুব ভালো করে শোনো । আমি গোটা ব্যাপারটা যা দেখার দেখেছি, বুঝেছি। যা করার আমিই করব । তোমরা এর মধ্যে একটা কথাও বলবেনা। অনেক রাত হয়েছে । যে যার ঘরে শুতে যাও । টগর , ঘরের ভেতরে ঢুকে সদর দরজা ভেতর থেকে ভালো করে ছিটকিনি দিয়ে দেবে ।
বলে আর একবারও পিছন ফিরে না দেখে হনহনিয়ে , দপদপিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দড়াম্ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার ওপর গিয়ে বসলাম । আমার সারাটা শরীর, মাথা , থেকে যেন উত্তাপ বের হচ্ছে ! প্রায় আধ ঘন্টার ওপর ওই ভাবেই বসে রইলাম। এত রাগ কেন হচ্ছে আমার ? এ কি ব্যভিচার ? একে কি ব্যভিচার বলা চলে? যখন দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী এবং পুরুষ পরস্পর স্বেচ্ছায় যৌনতায় লিপ্ত হয়, তখন আমরা, আমাদের সমাজ তাকে খুব সহজে ব্যভিচার বলে আখ্যা দিয়ে দিই। কিন্তু, কেন ? এ তো প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে । খুবই সহজ, স্বাভাবিক, যৌনতার আকর্ষণ থেকে দুজন মানুষ কাছাকাছি আসে। এরমধ্যে ব্যভিচারের কি আছে ? এতক্ষন ভাবছিলাম টগর, কিন্তু টগর নয়, টগর যা বলেছে সত্যি কথাই বলেছে । আমি বুঝতে পেরেছি । কমলা । কমলা একটি বিধবা মহিলা , সে সামাজিকভাবে কোন পুরুষের সংস্পর্শ পায়না । সে যদি একজন পুরুষের সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হয়, নিজের শারীরিক চাহিদা মেটায়, এতে আপত্তির কি আছে? আমার কি রাগটা তবে শিশিরের ওপর হচ্ছে? ওর ওই ভীষণ ভদ্রলোক মার্কা মুখোশের আড়ালে একটা ব্যভিচার মাখা মুখ লুকানো রয়েছে বলে? কিন্তু আমার রাগটা সম্পূর্ণ গিয়ে পড়েছে কমলার ওপরে। আমি বুঝেছি, ঠিকই বুঝেছি। নিজের মনের সঙ্গে ছলচাতুরি চলে না । কিন্তু কমলার ওপর আমার রাগ হচ্ছে কেন ? এটা কি রাগ, নাকি – ? আমি কি তবে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত দু’জন নারী-পুরুষকে সহ্য করতে পারছিনা? সেটা কি নিজের জীবনের অপূর্ণতা থেকে আসছে? না, একথা কিছু অংশে সত্যি হলেও সম্পূর্ণ সত্যি নয় । নিজের ঘোলা মন’টা একটু থিতিয়ে আসতে আমি এবার আমার মনটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । আমার আসলে নিজেকে ভীষণ ছোট লাগছে । নিজের চোখেই নিজে ছোট হয়ে যাচ্ছি। কারণটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো । এর কারণ খুঁজতে গেলে হঠাৎ করে এক নিমেষে ফিরে যেতে হয় আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে । আজ চল্লিশ, সেদিন ছিলাম কুড়ি । সেই আমার ব্যর্থ প্রেম .. সেই সোনু দা.. সেই স্মৃতি.. সেই বিষাদ.. সেই বিচ্ছেদ .. আর সেই সেদিনের সেই রাত…!

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/

কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/

একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/

বাইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1019125995544131/

তেইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1021798458610218/

চব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1024967944959936/

পঁচিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1031476470975750/

ছাব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1034632350660162/

সাতাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1038754843581246/

আঠাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1046967802759950/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here