হলদে_প্রজাপতি পর্ব-২৮

0
232

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

আঠাশ

( আগের অধ্যায়গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল চাপড়ামারি বনবাংলোর সামনে । শান্ত নিস্তব্ধ জঙ্গলে ঘেরা এক ফালি সবুজ জমি । বাংলোর সামনে বেশ কিছুটা দূরে একটা ছোট জলাশয় । আসার পথে জঙ্গলের মধ্যে দু’তিনটে ময়ূর দেখতে পেলাম । চকিত পা’য় তারা আমাদের গাড়ির শব্দ পেয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেল । চাপড়ামারি জঙ্গল পাখিদের স্বর্গরাজ্য। আমরা যখন বনবাংলো পৌঁছলাম তখন বিকেল চারটে । শীতের বেলায় জঙ্গলে বিকেল চারটে মানে পুরোপুরি অন্ধকার হতে আর খুব একটা দেরি নেই । ঝুপ করে কখন অন্ধকার নেমে আসবে তার ঠিক নেই । তবে আমাদের থাকার জায়গাটা যেখানে, সেখানে সামনে কিছুটা ফাঁকা মাঠের মতো, তাই সেখানে তখনও চিকচিকে রোদ খেলছে । জলাশয়ের ওপর হালকা হাওয়ার দোলায় অজস্র সোনার কুঁচি তৈরি হচ্ছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে । জলাশয়ের ওপারে একটা হরিন সজাগ চোখের দৃষ্টি এদিকে মেলে দাঁড়িয়েছিল । আমরা যখন বাংলোয় ঢুকলাম, এই বিকেল সন্ধ্যের দিকটায় পাখিদের সক্রিয়তা কিছু বেশি লক্ষ্য করা যায় । ভোরের দিকে কাজে বেরোনোর পালা, সন্ধ্যের দিকে বাসায় ফেরার পালা । ডানার ঝটপটানি, কিচিরমিচির, কুহু কুহু ডাক, টুঁই টুঁই , পাতার খসখস্, বিভিন্ন শব্দ । যার বেশিরভাগই পাখিদের সক্রিয়তার কারণে । কিছু দেখা যায় , বাকি শোনা যায় ।

কিছু টুকটাক লাগেজ ছিল সাথে । সেগুলো রুমে রেখে দিয়ে আবার বেরিয়ে এলাম। আমাদের রুম বুক করা হয়েছে মোট তিনটে। একটাতে টগর আর কমলা থাকবে। একটায় আমি আর পাতা আর একটায় ইন্দ্রাশিষ বাবু । বাইরে বেরিয়ে এসে বুঝলাম হঠাৎ করে ঠাণ্ডা বেশ কিছুটা বেড়ে গেছে । নদীর ধারে পিকনিক যতক্ষণ করছিলাম রোদ ছিল। তার সাথে কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, সব মিলিয়ে ঠান্ডা বুঝিইনি একেবারে । গাড়িতে করে যখন আসছিলাম, তখন শিরশিরে অনুভূতি হলেও সেটা এভাবে পেয়ে বসেনি। এখন যেহেতু পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও একবার রিসোর্টের রুমের ভেতরে ঢুকেছিলাম, তাই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মালুম হলো বাইরে বেশ ঠাণ্ডা রয়েছে । একটা শাল জড়ানো ছিল গা’য় । হাতের যে অংশটা বেরিয়ে রয়েছে, বুঝলাম সেই অংশটুকুতে হঠাৎ করে যেন কাঁপুনি ধরে গেল । নিজের বুকের ওমের ভেতর হাত দুটোকে চাদরের নিচ দিয়ে চালান করে দিলাম । তাতেও যেন শিরশিরানি যেতে চায়না । মুখের সামনে হাতের তেলো দুটোকে খানিক ঘষে ভাপ দিলাম ।

পাতা এরইমধ্যে ওর ফিনফিনে দুটো পা মেলে যেন উড়ে চলে গেছে বেশ কিছুটা । দূরে জলাশয়ের ওপাশে দুটো চিতল হরিণ আর একটা বাইসনের দেখা পেলাম । পাতা এক ছুটে বেশ অনেকটা চলে গেছে। আমি ওকে ছুটতে বারণ করতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই হরিণ দুটো ছুটে পাশের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল । শেষবেলার গোলাপি আলো তাদের চিকন ত্বকে পিছলে বেরিয়ে গেল। বাইসনটা কান খাড়া করে সজাগ দৃষ্টিতে তাকাল এদিকে।
আমি গলা তুলে তাকে বললাম, ওভাবে ছুটতে নেই জঙ্গলে । এভাবে ছুটলে সব জন্তুরা পালাবে, পাতা-
পাতা থমকে দাঁড়ালো ।
— ইস্! মণি, দুটো হরিণ ছিল পালিয়ে গেল-
— জঙ্গলে কোন আওয়াজ করতে নেই । ছোটাছুটি, চিৎকার-চেঁচামেচি করলে ওরা ভয় পাবে না ? পালিয়ে যাবেই তো-
— কিন্তু ওরা তো অনেকটা দূরে ।
— ওদের কান আমাদের থেকে অনেক শার্প । অনেক সূক্ষ্ম শব্দও ওরা শুনতে পায় ।

— কি ? শীত করছে বুঝি খুব ?
পাশে তাকিয়ে দেখলাম কখন ইন্দ্রাশিষ বাবু নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন ।
— তা একটু করছে । হঠাৎ করে এখানে এসে পড়ে কিরকম যেন একটা গা শিরশির করে শীত করে উঠলো ।
— কোন জায়গা খুব ভালো লাগলেও শিরশিরে অনুভূতি হয় জানেন তো ? আপনার ঠিক শীতই করছে, নাকি খুব ভালো লাগছে জায়গাটা, কোনটা?
— দুটোই।
বলে পিছন ফিরে একবার আমাদের দোতলা বাংলোটার দিকে চোখ বুলোলাম । জঙ্গলের নিঝুম গণ্ডির মধ্যে একটা আস্তানা। কি ভীষণ মন কাড়া! নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
বললাম , সেইতো ! কেন যে আমরা ছুটে মরি ! এই নিঝুম জঙ্গলে একটা কুটীর থাকতো । কুটীরের চালে পাখিরা লাফালাফি করত ,ঝগড়া ঝাঁটি করত । হরিণগুলো আমাকে দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে যেত । আমাকে তাদের বন্ধু ভাবতো, ভয় পেত না মোটেও । গাছের ডালে লম্বা পেখম ঝুলিয়ে ময়ূর বসে থাকতো । আরো কত রকম কাণ্ডই যে ঘটতো । বাঁদরের হুপহাপ্ , বৃষ্টির ঝুপঝাপ । জীবনে কি পাবার আশায়, কোন সুখের লোভে, মানুষ যে কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়েছে, প্রকৃতিকে শেষ করেছে, কে জানে !
— আপনি তো দেখছি মুখে মুখে ইনস্ট্যান্ট রূপকথার গল্প লিখে ফেলছেন । তবে স্বীকার করতেই হয়, আপনার রূপকথার রাজ্যটি ভীষণ লোভনীয় ।
পাতা গুটিগুটি পায়ে ফিরে এসেছে । আমাকে বলল, মণি, ওদিকে কি যাব না?
— তা বলিনি তো । ছোটাছুটি কোরো না , কোনো রকম শব্দ কোরো না। আর বেশি দূরে যেওনা, কাছাকাছি থাকো । কোন অসুবিধা নেই ।
পাতা গুটি গুটি পায় এগিয়ে গেল কিছুটা ।
— চলুন আমরা বরঞ্চ একটু এগোই ।
— চলুন ।
লঘু পা’য় প্রায় নিঃশব্দে এগোতে লাগলাম এক’পা এক’পা করে জলাশয়টার দিকে। দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে মাঝে মাঝে এক আধটা মাছরাঙ্গা হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন জল থেকে ঠোঁটে করে একখন্ড সোনা তুলে নিয়ে উড়ে পালাচ্ছে। গোলাপি হতে হতে একটা সময় ক্রমশ মিলিয়ে গেল আলো। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো । পাখিদের কোলাহল যেন কিছুটা বেড়ে গেছে । অসম্ভব কিচিরমিচির শব্দে চারিদিক মুখরিত । এ তাদের বাসা, তাদের এলাকা, এখানে তাদের অধিকার । আমরা এখানে অবাঞ্ছিত । আমাদের তাই কথা বলা মানা । চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম জলাশয়ের ওপর চোখ রেখে । সেখানে ক্রমশ যেন দলা পাকানো অন্ধকার আর কুয়াশা মিলে মিশে যাচ্ছে।
স্বগতোক্তির মতো বলে ফেললাম, বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে হয়ে গেল । আজকের দিনটা শেষ ।
পাশ থেকে ইন্দ্রাশিষ বাবু প্রায় ফিসফিসে গলায় বললেন , দিন শেষ তো কি হয়েছে? সন্ধ্যা, রাত, সবই তো এখনো বাকি । কালকে পূর্ণিমা । আজকেও প্রায় তাই ধরে নিতে পারেন । আকাশে মেঘ নেই। চাঁদকে পাকাপাকিভাবে তার সাম্রাজ্য দখল করতে দিন আগে, তারপর দেখবেন মজা!
কথাটা শুনে মনটা এক নিমেষে ভাল হয়ে গেল । সত্যিই তো, এখনও পূর্ণিমার রাত বাকি । দিনের আলো মিলিয়ে গেলেই কী সব আনন্দ মাটি হয়ে যায় নাকি ? কিছুক্ষণ পর ফিরে এলাম রিসোর্টে । রিসোর্টের আলো জ্বলে উঠেছে। বাইরে অন্ধকার । আকাশে নিশ্চয়ই চাঁদ উঠেছে, কিন্তু এখান থেকে তা দেখা যাচ্ছে না , চাঁদের আলো এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমাদের ঘরগুলো সব ব্যালকনি বরাবর। সামনে বেশ চওড়া লম্বা ব্যালকনি, রেলিং দিয়ে ঘেরা। ধোঁয়া ওঠা চা আর স্ন্যাক্স নিয়ে বারান্দায় চেয়ারের ওপর বসলাম । ইন্দ্রাশিষ বাবুও ছিলেন । আমাদের পাতারানীও ছিল। টগর আর কমলাও ছিল । ওদের সারাদিন ভালই খাটাখাটনি গেছে। এখন দুজনে বসে মন খুলে গল্প করছিল । পাতাও ওদের তালে তাল মেলাচ্ছিল অল্পস্বল্প । আমি আর ইন্দ্রাশিষ বাবু চুপচাপ বসে চা, পকোড়া আর প্রকৃতির আমেজ নিচ্ছিলাম। আস্তে আস্তে চাঁদের আলোয় বনভূমি চোখের সামনে ভেসে উঠলো । বনভূমি এখন শান্ত । শুধু আমাদের কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই । এই রিসোর্টে আর কোনো ফ্যামিলি আসেনি, শুধু আমরাই ।

টগর নানা রকম গল্প করছে। একেবারে তার ছোটবেলা থেকে শুরু করেছে। সে নাকি ছোটবেলায়, তাদের গ্রামের পাশে একটা মাঝারি জঙ্গল মত ছিল, সেখানে হারিয়ে গেছিল । ওর বাড়ির লোকেরা কিভাবে ওকে গরু খোঁজা খুঁজেছিল, সেই গল্প। তারপর ও যখন ছোট , তখন নাকি ওর মা একবার ভূত দেখেছিল। পুকুরধারে বাসন মাজতে গিয়ে একটি অপরিচিত মেয়ে সাদা ঘোমটা টেনে ওর মায়ের পাশে বসে বাসন মাজছিল আর নানারকম গল্প করছিল । তারপরই হঠাৎ সন্ধের মধ্যে সে নাকি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এরকম কত রকম ভুতুড়ে, অদ্ভুতুড়ে সব গল্প ! সাধারণ ঘটনাও আছে , যেগুলো বিশ্বাসযোগ্য । পাতা তো গল্প পেলে আর কিছুই চায় না। হাঁ করে শুনছে। আমাদের এই রিসোর্টৈর নিজস্ব কৃত্রিম আলোটুকু বাদ দিলে বাইরে প্রকৃতির সেই মায়াবী আলো, তার সাথে টগরের গল্প- সময় কোথা দিয়ে কেটে যেতে লাগলো খেয়ালই রইলো না । এমনিভাবেই একটা সময় রাতে ডিনারের টাইমও হয়ে গেল।

রুটি , আলু ভাজা আর কষা কষা করে চিকেন কারি -এই ছিল ডিনার । ডিনার সারা হতে যে যার রুমে ঢুকে পড়লাম । পাতা ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই । আমার চোখের সামনে সারাদিনের সমস্ত বিক্ষিপ্ত ঘটনা আর দৃশ্যাবলী যেন খন্ড খন্ড আকারে ফিরে আসতে লাগলো । তারই সঙ্গে এই নিঝুম রাতের অরণ্য প্রবল আকর্ষণে টানতে লাগলো বাইরে। নাইট স্যুট এর ওপর চাদরটা খুব ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম ।

প্রায় রাত বারোটা বাজে। মাঝরাতের কুহকিনী মায়াময় রুপোলী আভায় দেখা দিল উন্মুক্ত প্রান্তর , তারপরে অরণ্য .. । আমি ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্ব হারাতে লাগলাম । আমাদের এই রিসোর্টটা আর রইল না । আমি যেন অন্য মানুষ । জন্মের আদি লগ্ন থেকে আদিম অরণ্যে লালিত-পালিত । দূরের জলাশয়ের ওপর বাতাসের স্রোতে আঁকা রুপোলী আঁকাবাঁকা রেখা । একটা বাইসন জলাশয়ের একেবারে কাছেই রয়েছে । আলো-আঁধারিতে আকৃতি দেখে বোঝা যায় সেটা বাইসনই বটে । আর কিছু নেই । দু’চারটে হরিণ তো অন্তত থাকার কথা । খুঁজতে লাগলাম বিভোর হয়ে । সেদিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছি খেয়াল নেই ।
হঠাৎ করে পেছন থেকে খুব চাপা গলার আওয়াজ পেলাম , কি ব্যাপার ! ওখানে যেতে মন চাইছে বুঝি ?
নিঝুম রাতে পরিচিত গলার স্বরেও চমকে উঠলাম । পাশে তাকিয়ে দেখি, ইন্দ্রাশিষ বাবু কখন উঠে এসেছেন।

অল্প হেসে বললাম, মন তো আমার সব সময় ওদের কাছেই যেতে চায় । তা আর হচ্ছে কই !
— পঞ্চ ইন্দ্রিয় , মন, সবকিছু দিয়ে ওদের জগৎটাকে ফিল করাও কিন্তু ওদের কাছে যাওয়াই।
— তা হয়তো কিছুটা ঠিক। কিন্তু তাই বা বারে বারে ঘটার সুযোগ কোথায়?
— নিশ্চয়ই ঘটবে । আপনি চাইলে কেন ঘটবে না ?
— এই আপনাদের এখানে আছি, হাত বাড়ালেই চাঁদ ছোঁয়ার মতো আমার স্বপ্নের জগৎটাকে ছুঁতে পারি । কিন্তু আবার কলকাতায় ফিরে গেলে তা সম্ভব হবে না ।
— সেরকম সম্ভাবনা রয়েছে বুঝি?
— না , ঠিক সে সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি। আমি এখানে বেশ আছি। সত্যি কথা বলতে কি , খুবই ভালো আছি । আমার ওই শহুরে কর্পোরেট কালচার একেবারেই ভাল লাগেনা, এইটুকুনি নিশ্চয়ই আপনি বুঝে গেছেন এতদিনে। তবে চিন্তা হয় বাবা-মাকে নিয়ে। বাবার শরীরটা খারাপ । এখানে নিয়ে এলে ট্রিটমেন্টের অসুবিধা হবে তো ।
— আপনি কিছুদিনের জন্য ওনাদের আনতেই পারেন । বরাবরের জন্য তো ভরসা দিতে পারি না । তবে ছোটখাটো কোন ট্রাবেল হলে আমি আছি, এটুকু বলতে পারি।
— সে আর আপনাকে বলতে হবে কেন ? আপনি যে আছেন , প্রতিটা অসুস্থ মানুষের জন্য সবসময় আছেন, সে তো এখানে ছেলে-বুড়ো সবাই জানে ।
তিনি অল্প একটু হেসে মুখটা নামিয়ে বললেন , তবে আপনাকে এখানে ধরে রাখার মত বড় আশ্বাস দিতে পারিনা । ডাক্তারি বিদ্যায় অতখানি দখল নেই ।
— সে আপনার কতখানি দখল আছে আপনি বুঝবেন , তবে আমি যে বাবা-মাকে নিয়ে আসব ভাবছি কিছুদিনের জন্য, আপনার ভরসাতেই যে নিয়ে আসবো, সে একেবারে নির্ভেজাল সত্যি ।
তিনি চুপ করে রইলেন , বললেন না কিছু ।
আমিও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছুটা অভিমানের সুরে বললাম , আপনি যে এত সুন্দর গান করেন, কই আগে বলেননি !
— তা তো জানিনা কেমন করি । তবে আপনার যে ভালো লেগেছে এবং সে কথা যে একেবারে খাঁটি তা আমি বুঝতে পেরেছি। আমার এতেই আনন্দ ।
এরপর দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে সামনের জোছনা ধোয়া মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

কিছুক্ষণ পর বললাম, একটাই বাইসন দেখতে পাচ্ছি তখন থেকে। আর কিছু তো নেই ।
— ভোরের দিকে উঠে দাঁড়িয়ে থাকবেন । আশা করা যায় বেশকিছু জন্তু-জানোয়ার দেখতে পেতে পারেন ।
— বাইসনটা ঘুরছেই যখন, একা-একা ঘুরছে কেনো? দু’চারটে সঙ্গী-সাথীকেও তো নিয়ে আসতে পারতো ।
— এভাবে দলছুট একা একা যে সমস্ত বাইসন ঘোরাঘুরি করে তাদেরকে কি বলে বলুনতো? মূলজারিয়া । এরা কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ করে খুব ফেরোশাস হয়ে ওঠে । ধরুন আপনি হঠাৎ করে সামনে পড়ে গেলেন , তখন এরা হঠাৎ ছুটে এসে আ্যটাক করতে পারে । একচুয়ালি ইনসিকিউরিটি থেকে হয় এটা। দলের সঙ্গে থাকলে এরা অনেক বেশি সিকিওরড ফিল করে।
আমি চুপ করে তাঁর কথা শুনছিলাম । বেশ লাগছিল।
তিনি বললেন, এই ধরনের পূর্ণিমার রাতে বা ভরা চাঁদের আলোয় বাইসন , হাতি এই ধরনের জানোয়াররা কোর্টশিপের জন্য খুব আগ্রহী থাকে জানেন তো ?
— তাই নাকি ? ওরাও তো তাহলে দেখছি আমাদের থেকে রোমান্টিক কম কিছু নয় ।
— অন্তত আপনার-আমার দুজনের থেকেই যে বেশি রোমান্টিক , এটা বলাই চলে ।
আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না , তবে তাঁর কথার ধরণে হেসে ফেললাম ।
উনিও আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাততাড়াতাড়ি বলে উঠলেন , ওরা কিন্তু ওদের কোর্টশিপ টাইমে প্রাইভেসি চায় । আপনি-আমি তখন যদি কাছ থেকে ছবি তুলতে যাই বা সেরকম কিছু অ্যাক্টিভিটি দেখাই, ওরা হঠাৎ করে খুব ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে আসতে পারে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ওদের কথা তো অনেক হল। এবার কিছু নিজের কথা বলুন ।
— যেরকম ?
— যে রকম , এই ধরুন , শুনেছি আপনি আপনার কলেজ লাইফে একটি মেয়েকে ভালবাসতেন । তাকে বিয়ে করায় আপনার মায়ের অমত ছিল , তাই আর শেষমেশ আপনার তাকে বিয়ে করে ওঠা হয়নি ।

একটু থেমে বললাম , আপনার সম্পর্কে কোনো পার্সোনাল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে রাগ করবেন কি ?
— একেবারেই না । আমার মধ্যে দ্বিতীয় রিপু যে একেবারে আ্যবসেন্ট তা বলছি না, তবে প্রভাব বেশ কম । আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন । মানে , নিজের মনে যা প্রশ্ন আছে ঝেড়ে করে ফেলতে পারেন , নো প্রবলেম ।

একটু উদাস গলাতে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
বললাম, আপনার স্ত্রী যে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছেন , সেটা কি আপনার কলেজ লাইফের প্রেমের জন্য ? মানে আমি বলতে চাইছি , আপনি কি আপনার কলেজ লাইফের রিলেশনশিপটা থেকে বেরিয়ে আপনার স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালবাসতে পারেননি ?
— একেবারেই সেরকম কিছু নয় । আপনি হয়তো আমার মায়ের কাছে শুনেছেন। নিশ্চয়ই তাই হবে । মা আপনাকে ঠিক কি বলেছেন আমি জানিনা । তবে আমার কলেজ লাইফে ঠিক কোন প্রেম ছিল না । কিছুটা ইনফ্যাচুয়েশন বলতে পারেন। ভীষন ভালো লাগতো । প্রপোজ করেছিলাম । সে আ্যকসেপ্ট করেছিল । কিন্তু আমাদের ইন ডেপ্থ কোন রিলেশনশিপ তৈরিই হয়নি । দুজনেই দুজনের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সম্পর্ক বিল্ড আপ হয়নি বলতে পারেন । মায়ের কাছে বিয়ের কথাটা একবারই তুলেছিলাম। মা ভীষণ রকম আপত্তি জানিয়েছিলেন । ব্যাস । সেইদিনই , ইনফ্যাক্ট তারপর থেকেই ব্যাপারটা ইম্পসিবল বুঝে সম্পূর্ণটাই নিজেদের মধ্যে ডিসকাস করে আমরা আমাদের ইমোশন থেকে বেরিয়ে আসি । একটা ইমোশনাল অ্যাট্রাকশন আর সত্যিকারের গভীর সম্পর্কের মধ্যে অনেক পার্থক্য । বলতে পারেন দুটো সম্পূর্ণই আলাদা। তাই সেই ব্যাপারের রেশ থেকে আমার আনহ্যাপি ম্যারেড লাইফের কোন কারণই ছিল না । তবে আপনি যখন প্রশ্নটা করলেনই, তখন পরিষ্কার করেই বলি , আমি যে আমার স্ত্রীকে খুব ভালবাসতে পেরেছিলাম, তা নয়। যদিও সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কই ছিল। অন্তত আমি তাই ভাবতাম । তার মনে যে অন্যকিছু ছিল, আমি অনেকদিনই বুঝিনি । তবে হ্যাঁ, একটা কথা – একটা মানুষকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে তার সঙ্গে ঘর-সংসার করা আর সেই মানুষটার নেচার’টাকে সত্যি করে পছন্দ করা, তার মধ্যে এমন কিছু কোয়ালিটি যা সত্যি করে আকর্ষণ করে, তা সে যাই হোক না কেন, সে রকম কিছু আমার পাতার মায়ের প্রতি ছিলনা । ওর সঙ্গে আমার নেচার সম্পূর্ণ আলাদা । আমার একটা প্রবলেম হচ্ছে, কখনো মানুষের বাইরের রূপ’টা আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনা । যদি পারত , আমি অতখানি সুন্দরী স্ত্রী পেয়ে নিশ্চয়ই প্রাউড ফিল করতে পারতাম। কিন্তু সে সব কিছুই নয়। একচুয়ালী আপনাকে ঠিক আমি বোঝাতে পারবো না, আমি মন থেকে তাকে ঠিক সেভাবে পছন্দ কোনওদিনই করে উঠতে পারিনি । ভালোবাসার কথা যদি বলেন, যখন সংসার করছিলাম তার সঙ্গে, তখন ভাবতাম ভালো হয়তো বাসি । ছেড়ে চলে যাওয়ায় যে আমি কোন শক পাইনি , তাও ঠিক নয় । আবার খুব যে দুঃখ পেয়েছিলাম, তাও নয় । একটা সম্পর্ক ভাঙার দুঃখ ছিল বটে । তবে আমার অনেক কিছু হারিয়ে গেল, শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল, এরকম কিছু মনে হয়নি । আমি কি বোঝাতে পারছি ?
— আমি কিছুটা কিছুটা বুঝতে পেরেছি । আপনি আপনার জীবনে দুজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেই প্রেম-অপ্রেমের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলেন ।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন , কি জানি ! কোনটা যে প্রেম, কোনটাই বা অ-প্রেম, এ জীবনে বোধহয় বোঝা হয়ে উঠলো না ।
আমি তির্যক চোখে একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললাম , জীবনের কি আপনার সবটুকু দেখা হয়ে গেছে ? দেখতে থাকুন জীবন আপনাকে আর কি কি দেখায় । ক্রমশ প্রকাশ্য ।
তিনি আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন , জীবনের যদি এই বিষয়ে আর সত্যিই কিছু দেখানোর থাকে , তবে প্রেম দেখাক। অ-প্রেম আর দেখতে চাই না ।

তাঁর কথা শুনে আপনা আপনি আমার চোখ দুটো নিচের দিকে নেমে পড়ল ।
তিনি আর কিছু বললেন না । আমিও তাঁর দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারলাম, তিনি আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দূরে জোছনার রাজ্যে চোখ মেলেছেন।

কিছুক্ষণ পর খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে আমায় বললেন, সামনে তাকিয়ে দেখুন ! আপনি তখন থেকে যে বাইসনটাকে দেখছেন , সে এখন আর একা নেই।
আমি সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক চোখ তুললাম । দেখলাম , তাইতো , আর একটি সমগোত্রীয় ছায়া তার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে!

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/

কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/

একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/

বাইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1019125995544131/

তেইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1021798458610218/

চব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1024967944959936/

পঁচিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1031476470975750/

ছাব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1034632350660162/

সাতাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1038754843581246/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here