হলদে প্রজাপতি পর্ব-১৩

0
358

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

তেরো

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতি-নমস্কার করার পরে একটু গলা তুলে টগরকে ডাকলাম, টগর ! দুটো চেয়ার দিয়ে যাও তাড়াতাড়ি।
— ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই ।
অল্প হেসে ভদ্রলোক বললেন ।
আমি মুখ ফিরিয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম , এখন আপনার এখানে এই বাইরের লনে বসতে ভালো লাগবে বলে মনে হল । তাই এখানে চেয়ার দিতে বললাম । তবে আপনি চাইলে ভেতরে গিয়েও আমরা বসতে পারি ।
ভদ্রলোক অল্প হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আরে না না, একদম যা ভেবেছেন ঠিক ভেবেছেন । আমার এখানেই বসতে ভাল লাগবে ।
পরক্ষণেই টগর দুটো বেতের চেয়ার, একটার ওপর আরেকটা চাপিয়ে নিয়ে দেখা দিল বাংলোর সদর দরজার সিঁড়ির কাছে । সেগুলো নিয়ে তাড়াতাড়ি করে এসে সে আমার চেয়ারের সামনে দুটো পেতে দিল।
আমি বললাম , চেয়ার দুটো কিছুটা সরিয়ে পাতো, আর ছোট বেতের টেবিলটা এখানে দিয়ে যাও ।
টগর ততক্ষণে আগন্তক দুজনের দিকে পর্যায়ক্রমে একবার করে চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিয়েছে। তারপরেই জিভের ডগাটা দাঁতে করে কেটে লজ্জা লজ্জা মুখে ঘাড় হেঁট করে বলল, ওমা ! ডাক্তারবাবু যে !
ডক্টর ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলী তার নত মুখের দিকে চেয়ে বললেন , তুমি আমাকে চেনো নাকি?
টগর জিভটাকে আরও একটু বাইরে বার করে শব্দ করে কেটে বললো , ওমা ! আপনাকে একিনে তো সবাই চিনে, সব্বাই –
— তাই বুঝি?
— হ্যাঁ ডাক্তারবাবু ।
— তুমি কি আমার চেম্বারে গেছো কোনদিন ? তোমাকে কখনো দেখেছি বলে তো মনে করতে পারছিনা।
— আমি নয়, তবে আমার দাদার ছেলেটা তো এই এত্তটুকুন আয়ুতেই এক্কেবারে মরতে বসেছিল কিনা । এত্ত পইসা দিয়ে ডাক্তার দেখানোর কি সাদ্দ আছে আমাদের, বলুন ডাক্তার বাবু ? আপনিই তো তাকে ওষুধ দিই এক্কেবারে পরাণে বাঁচালেন। দাদার আমার এমন একটা দিনও কাটেনা, যেদিন আপনার নাম না করে । তাদের ওই একটাই ছেলে কিনা? বাকি তো সবই মেয়ে , এই তিন-তিন’টা । তপন গো ডাক্তারবাবু । আমার দাদার ছেলের নাম। মনে আছে আপনার?
তিনি হাসলেন। বললেন, তা কি হয়েছিল তোমার দাদার ছেলের?
— ওই যে, ডাক্তারবাবু, জ্বর হয়েছিল না-। সে কি জ্বর! কি জ্বর। চোখ এই লাল টকটকে। রাতে জ্বর আসে, ছাড়ে, আবার আসে, ছাড়ে আর আসে। সেই ভুতে পাওয়া জ্বর তো আপনিই ছাড়ালেন কিনা?
টগর আরো নানাভাবে ডাক্তারবাবুর সুখ্যাতি করে যেতে লাগলো। হাসি পেল আমার। ওর ডাক্তারবাবু সম্পর্কে আমাকে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো । আমি সেই অবসরে ডাক্তার ইন্দ্রাশিষ গাঙ্গুলীর প্রতি একবার ভালো করে চোখও বুলিয়ে নিলাম । ভদ্রলোকের সেভাবে বিশেষ কোনো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নেই । সাদামাটা বাঙালি কাঠামো । না রোগা, না মোটা । তবে ভুঁড়ি নামক বাঙালি-সুলভ বৈশিষ্ট্যটি গরহাজির । গায়ের রং মাজা মাজা । ঠিক যেমনটা উপমার । মাথার চুল সামনের দিকে বেশ পাতলা হয়ে এসেছে, ফাঁক ফাঁক । অর্থাৎ এখন টাক না থাকলেও, অদূর ভবিষ্যতে সেটা দৃশ্যমান হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা । উচ্চতা গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের মতোই । না দীর্ঘ না খর্ব , পাঁচ ছয়-সাত হবে । মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । চোখ মুখ বেশ কাটা কাটা । নাকটা টিকালো । পরনে একটা ক্যাসুয়াল সাদা আর হলুদ চেক কাটা শার্ট , তার সাথে নীলরঙা একটা ক্যাসুয়াল ট্রাউজার ।
টগর একনাগাড়ে কি সব বকেই যাচ্ছিল । মুখ একবার খুললে ও মোটে বন্ধ করতেই চায় না ।
আমি ওকে আস্তে করে বললাম, টগর এখন যাও এখান থেকে । টেবিলটা এখানে দিয়ে যাও। চায়ের ব্যবস্থা করো গিয়ে।
বলে ইন্দ্রাশিষ বাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি র’চা চলে, নাকি দুধ চা?
— দুটোই চলে , যেটা খুশি । তবে এত তাড়াতাড়ি করার তো-
— আরে না না, হাতে একটা চা বা কফির কাপ না থাকলে কি কথাবার্তা জমে, বলুন ?
বলে হাসলাম।
উনিও হাসলেন । বললেন, তা ঠিক অবশ্য ।
আমি টগরকে বললাম, দুধ চা’ই করে আনো ।
উপমা ততক্ষণে লনের ওইপাশের ধারে গিয়ে বেড়াগাছগুলোর ওপরে ঝুঁকে কি যেন দেখছে । আমি তার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবুর উদ্দেশ্যে বললাম , কিন্তু আমাদের উপমা নিশ্চয়ই চা খায় না?
— না না, শুধু চা কেন? বাচ্চা মানুষ, চায়ের প্রমোশন এখনই পাবে কি করে ? তবে দুধও খেতে চায় না । ইভেন কোন হেলথ ড্রিংকসও না। মুশকিল।
আমি প্রত্যুত্তরে অল্প হেসে হাত বাড়িয়ে বললাম, আসুন, বসুন । তবে, উপমার জন্য কি করা যায় আমি দেখছি ।
টগরকে বললাম, আপাতত দু’কাপ চা করে আন।
টগর চলে গেল ।
উনি চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন যে । বসুন ।
আমি বসলাম।
উনি বললেন, একচুয়ালি আমার আগেই আসা উচিত ছিল। কিন্তু, আসা হয়নি।
বলে উনি পায়ের স্যান্ডেলটা খুলে পাশে রেখে ঘাসের লনে মা পা রেখে ডান পা ক্রস করে বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর তুলে বললেন, এমন সুন্দর লন ছেড়ে কেউ ঘরের ভেতরে গিয়ে বসে?
আমি অল্প হেসে বললাম , আপনার বুঝি প্রকৃতি দেখার বা ফিল করার সময় আছে ?
চোখ কুঁচকে উনি জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে তাকালেন আমার দিকে ।
আমি বললাম , আসলে টগরের কাছে আপনার ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি । উপমা যে আপনারই মেয়ে , সে তো আমায় টগরই বলেছে । ওর কথা শুনে মনে হল আপনি ভীষণ রকম ব্যস্ত । কাজের মানুষ । তাই বলছিলাম, এই সমস্ত প্রকৃতি দেখার সময় কি আপনার হয় ?
— সেটা ঠিক । সময় হয় না । বা আরো ভালো করে বলতে গেলে, আমি সময় বার করার চেষ্টা করি না । তবে সময় পেলে যে দেখবো না বা ফিল করবো না , তেমনটা নয় ।
বলে হাসলেন।
আমিও অল্প হেসে বললাম, দেখুন ভুলটা আমারই হয়েছে। আমি তার জন্য ক্ষমাও চাইতে যাবো ভেবেছিলাম আপনাদের বাড়িতে। একচুয়ালি , এই উইক এ কাজের চাপে আমার একদম যাওয়া হয়নি । তবে উপমাকে সেদিন ওইভাবে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে আসাটা আমার একদম উচিত হয়নি।

আমার কথা শুনে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, আমি সেদিন ফিরে এসে সবটাই শুনলাম মায়ের কাছে । সেদিন আপনি যদি পাতা’কে ঘরের সামনে নামিয়ে দিয়ে না যেতেন , ইনসিডেন্ট যা ঘটেছিল, ঘটনাটা সত্যিই চিন্তার। আপনি সেদিন লাকিলি ফিরছিলেন ওই রাস্তা দিয়ে। সে কারণেই আপনার সঙ্গে পাতার দেখা । তবে দেখা না হলে যে কি হত ! একচুয়ালি আমার মা বাতের ব্যথায় একেবারেই সেভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না । মেয়েটা যে কোথায় কোথায় খেলে বেড়ায় –
আমি বললাম, বাঃ, উপমার ডাকনামটা তো ভারি মিষ্টি- পাতা । বেশ একটা নেচার-নেচার গন্ধ আছে ।
— হ্যাঁ , আমি ওকে ওই নামেই ডাকি । মা বলে তুয়া ।
আমি উপমাকে ডাকলাম , উপমা ! একবার এদিকে এসো তো । দেখি তোমার পা’টা কেমন আছে ।
উপমা ছুটে এসে আমার কোলের কাছে দাঁড়ালো । ও পা থেকে চটি খুলে ফেলেছে । নরম ঘাসের ওপর ছুটতে ওর অসুবিধা হচ্ছে না, যা বুঝলাম । আমার কাছে এসে বাঁ পা’টা ডান হাতে করে তুলে দেখালো । দেখলাম , শুকিয়ে এসেছে বটে, তবে একেবারে সারেনি ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, পায়ের তলায় কিভাবে কাঁটা ফুটল উপমা ? তুমি কি খেলার সময় চটি খুলে ফেলেছিলে?
রিনরিনে গলায় সে বলল, ছুটছিলাম যে । পা থেকে কখন খুলে গেছিল । তারপরেই , দেখতে পাইনি , কাঁটা ফুটে গেছে ।
— তুমি বাড়ি থেকে অতদূরে খেলতে কেন গেছিলে ?
— আমার তো কোনো বন্ধু নেই –
একেবারে আমার গা ঘেঁষে , প্রায় আমার চেয়ারের সঙ্গে মিশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ নামিয়ে বলল , বন্ধু থাকলে বাড়িতেই খেলতাম। আমি তো গাছগুলোর সঙ্গে খেলি ।

হেসে ফেললাম ।
— গাছগুলোর সঙ্গে খেলো কিরকম ? ওরা তোমার সঙ্গে খেলতে পারে ?
— হ্যাঁ পারে তো । ওরা তো সবাই আমায় স্টুডেন্ট। আমি ওদের পড়াই।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে বললো সে ।
— বাব্বাহ্! এই এত্ব স্টুডেন্ট তোমার !
আমি উপমাকে দুহাতে করে জড়িয়ে নিলাম । বললাম , স্টুডেন্টরা পড়াশোনা করে কিনা বোঝো কি করে ?
— বাহ্, আমি ওদের পড়া ধরি, না ?
— পড়া পারে ওরা?
— না পারলে আমি ওদের বকে দিই । হাতে লাঠি থাকে-
–ওমা! মারো নাকি ?
বিজ্ঞের মতো সে বললো, কাউকে কাউকে মারতে হয় ।

আমি কিছুক্ষণ স্মিতমুখে তাকিয়ে দেখলাম উপমার মুখের দিকে । মেয়েটা বন্ধুর অভাবে নিজের মতো করে অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্ত খেলা উদ্ভাবন করেছে । কল্পনাপ্রবণ । শিশু-কিশোর মন তো কল্পনাপ্রবণই হয়।
জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি স্কুলে যাওনা?
— যাই তো । বাবা যে আমাকে প্রতিদিন সকালে স্কুলে পৌঁছে দেয়।
— কোন ক্লাসে পড়ো তুমি ?
— ক্লাস ফাইভ । এবার আমি ক্লাস ফাইভে উঠে গেছি ।
— বাঃ, তুমি প্রতিদিন স্কুলে পড়া পারো ?
— হ্যাঁ পারি তো ।
আমার দিকে বড় বড় দুটো চোখ মেলে সে বলল , আমি তো স্কুলে ফার্স্ট হই।
— বাব্বা, ফার্স্ট হও! ইউ আর এ গুড গার্ল । কার কাছে পড়াশোনা করো তুমি ?
— ঠাম্মার কাছে ।
মেয়েটির বাবা বললেন, হ্যাঁ ওর পড়াশোনার খুব ঝোঁক । তবে মা আর পড়াতে পারবে বলে মনে হয় না । ক্লাস ফাইভ হয়ে গেল তো ।
আমি তাঁর দিকে তাকে বললাম , আপনার বোধ হয় মেয়েকে পড়ানোর সময় হয় না একেবারেই?
ভদ্রলোক কিভাবে আমার কথাটা নিলেন জানিনা, মনে হলো, উনি ভাবলেন , আমি ওনাকে কোন অনুযোগ করছি ।
উনি কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ পাতাকে একেবারেই দেখা হয় না ঠিক । কিছু একটা অল্টারনেটিভ ভাবতে হবে ।
আমি উপমাকে বললাম, আচ্ছা স্কুলের কথা পরে হবে । তুমি এখন বলোতো কি খাবে ?
বলতে বলতেই টগর চায়ের ট্রে হাতে দেখা দিল ।
উপমার চটপট জবাব, আমি মোমো খাই । আমার মোমো খেতে খুব ভালো লাগে ।
— তাই নাকি ?
টগর চায়ের ট্রে-টা সিঁড়ির ধারের সিমেন্টের কার্নিশে নামিয়ে রেখে ভেতর থেকে একটা বেতের ছোট টেবিল নিয়ে এসে আমাদের চেয়ারগুলোর মাঝখানে রাখল । তারপরে চায়ের ট্রে নিয়ে এসে টেবিলের ওপরে চায়ের কাপ দুটো নামিয়ে রাখল ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, টগর তুমি মোমো বানাতে পারো নাকি ?
— করতে পারি মেম , কিন্তু মোমো করার বাসন-কোসন নেই কিনা ?
আমি উপমাকে বললাম, উপমা মোমো তো হবেনা মনে হচ্ছে । তুমি আর কি খাও বলো । চাউমিন খাও তুমি ?
ঘাড় কাত করে সে বলল , হ্যাঁ।
আমি ইন্দ্রাশিষ বাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, কি মেয়ের সঙ্গে একটু চাউমিন খেতে অসুবিধা নেই তো ?
তিনি বললেন, ছেলেমানুষের সঙ্গে আবার আমাকে টানা কেন ? এই চা’ই ঠিক আছে।
অল্প হেসে বললাম , শুধু উপমা নয় । উপমার মাসীমণিও ছেলেমানুষ । সে’ও খাবে যে ।
উনিও হেসে উত্তর দিলেন, তাহলে উপমা আর তার মাসীমণিই খান । আমার এই বেশ ।
বলে চায়ের কাপটা তুলে দেখালেন ।
— বা রে! তা বললে কি হয় ? আমি যে শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে ঢুকছি । আর আপনি অমনি গোটাগুটি শিং নিয়ে বসে থাকবেন, তা কি হয় ? আপনাকেও নাম লেখাতে হবে আমাদের দলে।
হাসি হাসি মুখে মাথার মধ্যে দিয়ে একবার আঙুল চালনা করে তিনি বললেন , বেশ, তাই হোক তবে ।
আমি টগরকে বললাম, বেশি করে চাউমিন বানাবে। তুমি আর যদুও নেবে । ঠিক আছে?
— আচ্ছা মেম ।
ঘাড় কাত করে টগর চলে গেল ।
উপমাকে সেই যে জড়িয়ে ধরেছিলাম , এখনো দুহাতে করে ধরেই রয়েছি । সেও আমার বুকের কাছটাতে মাথা ঘেঁষে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম, যাও উপমা, খেলা করবে তো করো গিয়ে।
উপমা এক অদ্ভুত প্রশ্ন করল। অদ্ভুত নয় হয়তো, খুবই সাধারণ । আমার সঙ্গে শিশুমনের খুব বেশি পরিচয় নেই বলে অদ্ভুত শোনালো ।
ও বললো, তুমি খেলবে আমার সঙ্গে ?
আমি তার উজ্জ্বল আশা ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম , আজ নয় উপমা । আজকে তুমি একা একাই খেলো। আমি তোমার বাবার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই । পরের দিন যখন আসবে, আমি খেলবো তোমার সঙ্গে ।
— আচ্ছা ।
ঘাড় নেড়ে ছুটে চলে গেল সে ।
ইন্দ্রাশিষ বাবু বললেন, আমার মেয়ের ভারি পছন্দ হয়েছে আপনাকে। সেদিন আপনার সঙ্গে বাড়ি ফেরার পর থেকে ও যে কতবার আমাকে, আর ওর ঠাকুমাকে আপনার কথা বলেছে, তার ঠিক ঠিকানা নেই ।
আমি বললাম, আচ্ছা ও তো আমাকে চেনে না। সেদিনই প্রথম দেখলো । ও বলতে পারল , মানে আমি কে সেটা জানলেন কেমন করে? সেটাই আর কি-
তিনি অল্প ঠোঁট টেনে হেসে বললেন, না না, সে তো কিছু বলতে পারেনি। শুধু বলল, আপনি ওকে গাড়িতে করে ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। তা , এই তল্লাটে আর কেই বা গাড়ি চালাবে? নতুন কেউ এলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাই । চা বাগানে নতুন জয়েন করা ম্যানেজার ম্যাডাম, তিনি যে গাড়ি চালান সেটাও কারোর জানতে বাকি নেই। তাই ও বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলাম ।
কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল । মনটা একটা আমেজে ভরে উঠলো । আমার সাথে পরিচিত হওয়ার আগেই, শুধু একজন মহিলা ম্যানেজার জয়েন করেছেন, তিনি ড্রাইভ করতে জানেন, এই খবর এখানে ছড়িয়ে পড়েছে । অনেকেই এ খবর জানেন, যারা আমাকে আদৌ দেখেননি । আমিও যে স্পেশাল, আমিও যে খবর হতে পারি, লোকে যে আমার ব্যাপারেও আলোচনা করতে পারে, এই অনুভূতি জীবনে প্রথমবার হল ।
— আচ্ছা আচ্ছা-
একটু থেমে বললাম, একচুয়ালি শুধু উপমা’র নয়, আমারও উপমাকে খুব ভালো লেগেছে । আমিও সেদিনের ঘটনার পর থেকে সময়ে-অসময়ে আপনার মেয়ের কথা বহুবার ভেবেছি । যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি আর কি । খুব ভালো লাগলো আপনারা এলেন যে ।
— দেখুন, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি বটে । কিন্তু, সেটা জানাতেও আমার খুব সংকোচ হচ্ছে ।

বলে ভদ্রলোক মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বাবা হিসেবে কোনো দায়িত্বই যে ওর প্রতি আমি নিতে পারি না , সেটা জানি আমি ।
ওনার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বললাম , জানেন যখন , তখন দায়িত্ব নেন না কেন? একচুয়ালি ওকে ঐভাবে অন্ধকার চা বাগানের মধ্যে সন্ধ্যেবেলায় দেখে আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। কত ধরনের বিপদ হতে পারে । তার ওপর মেয়ে , না ? ছেলে হলেও বা কথা ছিল। আমাদের দেশ, তার মানুষজন , কি আর বলব বলুন?
— একচুয়ালি ওই ঘটনাটা আমারও চোখ খুলে দিয়েছে। মেয়েটাকে এইভাবে ঠিক যেন গার্জেন-লেস্ হিসেবে ছেড়ে দেওয়া খুবই অন্যায় ।
— এগজ্যাক্টলি সো। দেখুন আমি আনম্যারেড । কোনো সন্তান নেই । হয়তো আমার কথাটা বলা ঠিক হচ্ছে না । কিন্তু , আমার মনে হয়, সন্তানকে পৃথিবীতে আনলে , তাদের প্রতি মিনিমাম কিছু কর্তব্য আমাদের থেকেই যায় । তাই না ?
ভদ্রলোক লজ্জিত ভাবে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। আমি ওনাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে যেটুকু বুঝেছিলাম, চেহারার মধ্যে একটা খুব সাদামাটা ভাব থাকলেও ওনার চেহারাকে ছাপিয়ে যেটা প্রকট হয়েছে সেটা ওনার ব্যক্তিত্ব । অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্ব ওনার । সমস্ত সত্তাটাকে যেনো বাকি পাঁচটা মানুষের থেকে ঘিরে রেখেছে । চাইলেও সেই শান্ত ব্যক্তিত্বটুকুকে অতিক্রম করে ওনার মনের কাছাকাছি পৌঁছানো যেকোনো মানুষের পক্ষে দুষ্কর। জানিনা কি করে এখানকার মানুষজন ওনাকে ‘পাগল ডাক্তার’ বলে। হয়তো, ওনার ওই অত সংখ্যায় রোগী দেখার পাগলামির কারণে । ওনার ভয়েস-টাও খুব সুন্দর । একেবারে ভরাট । আমি নিশ্চিত , উনি আবৃত্তি করলে খুব সুন্দর আবৃত্তি করতেন । জানিনা অবশ্য সে নেশা ওনার আছে কিনা । তবে এই মানুষটার সম্পর্কে যতটুকু আমি শুনেছি , মানুষের রোগ বালাই সারিয়ে তোলার অদ্ভুত নেশা রয়েছে । প্রায় বিনামূল্যে শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে রোগগ্রস্ত মানুষকে দেখতে ওনার ভালোলাগে । কি জানি, আমার তো বাবার এই কয়েক মাসের অসুস্থতাই কেমন যেন দমবন্ধ অবস্থা করে দিয়েছে । নিজে ঘুরে ঘুরে যে রোগী দেখে বেড়ান, তার ছাপ ওনার চেহারাতেও রয়েছে । আমি লক্ষ্য করে দেখছিলাম , ওনার পায়ের পাতার উপরে যে অংশটা জুতোয় ঢাকা থাকে, সেই অংশটা যথেষ্ট ফর্সা । যে অংশটা এক্সপোজড থাকে সেটা তামাটে রং হয়ে গেছে । অর্থাৎ , ট্যান পড়েছে শরীরে । সারাদিন ধরে ঘুরে বেড়ালে এমনটাই হওয়ার কথা ।

ধীরে ধীরে দিনের আলো কমতে লাগলো । টুকটাক বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে সময় গড়াতে গড়াতে আকাশে সন্ধ্যারাগ ছড়িয়ে পড়ল। টগর এসে তিন প্লেট চাউমিন দিয়ে গেল । আমি উপমাকে ডেকে একটা প্লেট তার হাতে ধরিয়ে, খালি চেয়ারটা আমার পাশে টেনে নিয়ে তাকে বসতে বললাম । সে বসে পা দোলাতে দোলাতে চাউমিন খেতে লাগলো । এই নতুন পরিবারটির সঙ্গে আলাপ হয়ে মনটা বেশ ভালো লাগছে । নতুন কারো সঙ্গে আলাপ হলে ভালোলাগে । তবে , এই ভালোলাগাটা যেন একটু অন্যরকম । কিভাবে ‘অন্যরকম’ , ঠিক জানি না আমি । তবে অন্যরকম । ছন্নছাড়া ভাবে ইতস্তত খেলে বেড়ানো মেয়েটার আমার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ানো , একজন রোগী দেখার নামে পাগলপারা ডাক্তার কোনো দিকে যার কোনো খেয়াল নেই, নিজের সংসারের প্রতি খেয়াল না থাকলেও শয়ে শয়ে অনাত্মীয় মানুষজনের কি অপরিসীম সেবা করে চলেছেন -! এদের এই আপাত ছন্নছাড়া জীবন যাত্রার সঙ্গে আমার এই আপাত গোছানো অথচ কোথাও যেন প্রবলভাবে অগোছালো জীবনের কোনো সূক্ষ্ম মিল রয়েছে । মেয়েটির কমলা রঙের জামার ওপর সন্ধ্যারাগ ছড়িয়ে পড়ে তার মুখখানাকেও যেন জামার কিছুটা রং ধার নিয়ে রাঙিয়ে দিল ।
ইন্দ্রাশিষ বাবু চাউমিনের প্লেট শেষ করে টেবিলের ওপরে রেখে বললেন , পাতা আপনার কাছে এসে ভারী আনন্দ পেয়েছে । আমি ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছি ।
আমি হঠাৎই ফস করে বলে ফেললাম , এমন আনন্দ আপনি ওকে বারবার দিতে পারেন ।
উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলেন। বললেন, হ্যাঁ মাঝে মাঝে আপনার কাছে অবশ্যই নিয়ে আসা যায় । এটুকু তো করতেই পারি ।
দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে উপমাও তার বাবার হাত ধরে আমার চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল । যাওয়ার আগে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল , তুমি আমাদের বাড়ি যাবে তো ?
— হ্যাঁ , যাবো তো ।
— ঠিক যাবে?
— হ্যাঁ , ঠিক যাব ।
এরপরে সে যখন তার বাবার স্টার্ট দেওয়া স্কুটারটায় চেপে বসে বাবাকে একহাতে খামচে ধরে , আর একহাত নেড়েছিল আমার উদ্দেশ্যে , তখন আমি হঠাৎই ডাক্তারবাবুর উদ্দেশ্যে বলে ফেলেছিলাম ,
— উপমার তো মর্নিং স্কুল । তারপরে তো ঘরেই থাকে –
— ঘরে মানে ওই আর কি। আপনি তো দেখেছেন কেমন ঘরে থাকে ।
— আমার বাংলোর সামনের লনটায় ও তো বেশ ভালই খেলছিল । আমার যে কাজের মেয়েটি টগর, ওর যে কোনো ব্যাপারে খুব দায়িত্বজ্ঞান রয়েছে । আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি তাহলে মাঝে মাঝে আপনার বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি । দুপুর-বিকেল করে চলে এল আমার বাংলোয় । তারপরে তো আমি বিকেলবেলা কাজ শেষ করে চলেই আসি । তখন ওর সঙ্গে গল্প করতে পারবো । আবার সন্ধ্যে হলে পৌঁছে দিয়ে আসবো আপনার বাড়িতে ।
উনি সৌজন্যমূলক হেসে বললেন, প্রস্তাব তো খুবই লোভনীয় । পাতা যদি আসতে চায়, আমি অবশ্যই পাঠিয়ে দেবো ।
আমি এগিয়ে গিয়ে উপমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, আবার এসো , ঠিক আছে ?
একগাল হাসল মেয়েটা, ঝুঁটি দুলিয়ে দুলিয়ে। মনটা ভরে গেল।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here