হলদে প্রজাপতি পর্ব-৯

0
381

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

নয়

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

(পূর্বকথা : তরুশী একটি ছোট টি এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে নর্থ বেঙ্গল এ আসে । সে অবিবাহিতা । অবিবাহিত একজন মহিলার চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসা নিয়ে সেখানে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন রয়েছে । বিশেষ করে ওই রকম ফাঁকা জায়গায় একটা বাংলায় একজন মহিলা হয়ে সে কি করে একা থাকবে? এস্টেটের লেবার’রাও মহিলা একজন ম্যানেজারকে পেয়ে খুশি নয় । তরুশীর চা-বাগানে প্রায় দেড় যুগ আগের অনেক স্মৃতি রয়েছে । সে এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি সেই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। )

বান্টি তার শৌণকদা’কে ছোট করে সোনুদা করে নিয়েছে । আমিও তার দেখাদেখি তাই বলি । যদিও সোনুদা’র সঙ্গে কথা আমি মোটেও বলি না । গল্প তো একেবারেই না । স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে বান্টি ঠিক একবার করে ম্যানেজারের বাংলোর দিকে যেত । তারপর বেশিরভাগ দিনই তার সোনুদা’কে পাকড়াও করে নিয়ে আসতো। তারপর যথারীতি সেই প্রথম দিনের মতোই সে তার সোনুদার সঙ্গে কলর বলর করে বকতে বকতে পাশে পাশে যেত। আমি কিছুটা দূরত্ব মেনটেন করতাম। তবে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে আমাকে ডাক দিত – তরু দিদি ! দূরে কেন ? এখানে এসো ।
তখন নিতান্ত নিরুপায় হয়েই আবার কিছুটা কাছে যেতে হতো। তবে ওদের কথাবার্তা বা গল্পে কখনোই আমি অংশগ্রহণ করতাম না । গল্প করার মতো কথাই খুঁজে পেতাম না। বান্টি যে অত কি করে কলকল করে বকে সেটাও ভেবে পেতাম না। তবে সপ্তাহে দুদিন ওর বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে গান শেখা আর আঁকা শেখা থাকতো । সেই দুদিন ও বাইরে বের হতে পারত না। আমিও সেই দুটো দিন আর কলেজ থেকে ফিরে এসে বাংলো থেকে বের হতাম না ।

সেদিন কলেজ যাইনি । পরেরদিন খুব সম্ভবত একটা ক্লাসটেস্ট ছিল । তাছাড়া, কলেজে সেদিন তেমন ইম্পরট্যান্ট কোনো ক্লাসও ছিল না। সেদিন বিকেলে বান্টির কাকলি মিস গান শেখাতে এসেছিলেন । সেই কারণে সে আর বেরোয়নি । কিন্তু সেদিন সারাদিন ঘরের মধ্যে থেকে আমার বিকেলের দিকে একটু বাইরে বেরোনোর জন্য মনটা টানছিল । তাছাড়া সারাদিন ধরে বোটানির ট্যাক্সোনমি, সাইন্টিফিক নেম গলাধঃকরণ করে মাথাটাও ছাড়ানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল ।

একা একাই বেরোলাম বাংলো থেকে । বেরিয়েই পা দুটো নিজের অজান্তেই যেন ম্যানেজারের বাংলোর দিকে টানছিলো । কিরকম যেন একটা চুম্বক আছে সেদিকে । যেতে না পারলেই নয় । কেন এমনটা হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারলাম না । মনকে বোঝালাম বাংলোটার পিছনের রক্তকাঞ্চন গাছটার নিচের দিকের ডালটার কাছে যে ঝোপটা রয়েছে, সেখানে বুলবুলি পাখির যে বাসাটা দেখেছিলাম দুদিন আগে , সেটা ঠিক তেমনি আছে কিনা দেখতে হবে । সেই কারণেই যাচ্ছি । মোট পাঁচটা ডিম ছিল । ডিমগুলো কি সব তেমনিই আছে, নাকি ফুটে ছানা বেরোলো ? এইসব দেখার জন্যই আগ্রহ হচ্ছে । কিন্তু মাথা যে অন্য কথা বলছে । মাথা বলছে , আমি নাকি বুলবুলি পাখির বাসার থেকেও বেশি কৌতুহল নিয়ে দেখতে চাইছি সোনু দা তার বাসার মধ্যে কি করছে । এই দুই পরস্পর বিরোধী কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে করতে পায়ে পায়ে কখন বাংলোর প্রায় কাছে চলে এসেছি । বুঝতে পারলাম , বুকটা অসম্ভব দুরুদুরু করছে । কেমন যেন ভয় করছে । ওই বাংলোর ভেতরে যেন কোন মানুষ থাকে না , ভূত বেরিয়ে আসবে সেখান থেকে। বুঝলাম , এতোখানি দুরুদুরু বুকে হঠাৎ করে সোনুদা’র সামনে গিয়ে পড়লে মুশকিল । তার মুখের মধ্যে কেমন একটা ছেলেমানুষি মিশ্রিত কৌতুকের ভাব, যেন আমার একরকম অসহায় অবস্থাটা খুব এনজয় করছে । সে কারণেই আমি তার সংস্পর্শ আরো বেশি করে এড়িয়ে চলি । সেটা মনে হতেই খুব তাড়াতাড়ি , প্রায় ছুটে সেখান থেকে চলে এলাম ।

তারপর, বাংলো থেকে সোজা যে রাস্তাটা চলে গেছে উত্তরের দিকে শিমুল গাছটার কাছে , সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম । ঠিক শিমুল গাছটার নিচে একটা কাঠের বেঞ্চ ছিল বসার জন্য । এখানে বসলে চোখের সামনে শুধু সবুজ , সবুজ আর সবুজ । পশ্চিম আকাশে গোধূলি নেমে আসছে । বিভিন্ন ধরনের পাখি ঝাঁক বেঁধে তাদের সন্ধ্যের আস্তানার দিকে ফিরে চলেছে । পাখিদের ডাক, ইতস্তত ওড়াউড়ি, ডানা ঝাপটানো , কা-কা , কিচিরমিচির, ফড়িং আর প্রজাপতিদের ডানায় ভর করে চক্কর কাটা – এ যেন সূর্যের গোলাপী আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগে প্রত্যেকের শেষবেলার চঞ্চলতা । শিরিষ গাছের নিচে বসে প্রকৃতি দেখতে বড় ভাল লাগে । আমি কিছুটা তন্ময় হয়েই পড়েছিলাম ।

হঠাৎ করে ঠিক ঘাড়ের পেছনে থেকে কে যেন চাপা গলায় বলে উঠলো, ম্যাডাম বুঝি খুব চিন্তায় রয়েছেন?
হঠাৎ করে চমকে উঠলাম । তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সোনুদা’কে দেখেই একেবারে ঘাবড়ে গেলাম । বুঝলাম, অকারণে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে। সোনু দা কাঠের বেঞ্চটার ঠিক যেখানটাতে আমি পিছনে হেলান দিয়ে বসেছিলাম, সেখানে আমার কাঁধের পিছনে কাঠের ধার বরাবর দুটো হাত রেখে ঝুঁকে প্রায় আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে কথাগুলো বলেছিল । পিছন দিকে ডানপাশে মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখেই একেবারে কাঠের মত হয়ে গেছিলাম । বুঝেছিলাম , আমার ঘাড়ের কাছে রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে । আমার মুখ থেকে তার মুখের দূরত্ব সম্পূর্ণ একহাতের তালুর সমানও নয় , আরো কাছে । এত কাছ থেকে কোন পুরুষের সঙ্গে কোন দিন কথা বলিনি আজ পর্যন্ত । প্রশ্নটা সে যে কি করেছিল মাথায় রইলোনা । প্রশ্নকর্তাই একটা বিশাল বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে তখন । সে কেন ? সে কখন ? সে কিভাবে ? .. তখন সেখানে? আমার অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হেসে সোনু দা বেঞ্চটার ব্যাকরেস্টের ধার থেকে হাত তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো ।
আমার দিকে তাকিয়ে চোখের কোনে একটু হেসে ডানহাতটা বাড়িয়ে বলল , আমি কি বসতে পারি ?
— আ্যঁ..হ্যাঁ .. হ্যাঁ নিশ্চয়ই .. বসুন ।
— যাক।
বলে এগিয়ে এসে আমার ডানপাশে বসল সে । আড়চোখে দেখলাম একটা হলুদ রঙের গোল গলা টি-শার্ট আর একটা ব্ল্যাক ক্যাজুয়াল ট্রাকসুটের প্যান্ট পরেছে সে। মুখে সেই মিটিমিটি হাসিটা লেগেই রয়েছে।
বসে বলল, তাহলে বসার অনুমতি পেয়েছি।
যদিও বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করছিল , তবুও তার কথা বলার ধরনে হেসে ফেললাম ।
বললাম , অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন ?
সে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল । আমিও তার অবাক মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলাম। কেন যে সে অবাক হয়েছে বুঝতে পারলাম না ।
কয়েক সেকেন্ড পর বলল , যাক, একটুও না ভেবে তাহলে একটা কথা বলতে পেরেছ।
— কি?
— কী আবার ? অনুমতি না নিয়েই আমি বসতে পারি, বলেছ । এবার থেকে তাহলে আর নো আস্কিং, আই মিন নো নিড অফ টেকিং পারমিশন , রাইট? সরাসরি এসে ঝপ্ করে বসে পড়তে পারি , তাইতো ?
অল্প একটু হেসে মুখ নামিয়ে ফেললাম । এই সমস্ত পরিস্থিতিতে আমি খুব আতান্তরে পড়ে যাই । একটা ছেলে আমার সাথে স্মার্টলি কথা বলছে, আমি কিভাবে তার সাথে স্মার্টলি আলাপচারিতা চালিয়ে যাব , সেটা তখনও অভ্যাস হয়নি। খুবই বেকায়দায় পড়ে যেতাম ।

সে আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল, কি ব্যাপার ? ওইদিকে ম্যানেজারের বাংলোর দিকে যাওয়া হলো, তারপরে ফিরে চলে আসা হলো কেন , শুনি ?
মাথার মধ্যে কেমন যেন ঝনঝন্ করতে লাগলো । মনে হল কি বিশাল একটা অপরাধ করতে গিয়ে যেন ধরা পড়ে গেছি ।
আমি মুখটাকে নিচু করে প্রায় বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে বললাম , ওইদিকে .. ওই একটু .. একটা দরকার-

ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম ও মুচকি মুচকি হাসছে ।
বলল, হ্যাঁ দরকার তো কিছু একটা ছিলই। তবে দরকারটা না সেরে ফিরে চলে এলে কেন ?
আমতা আমতা করে বললাম, ওই যে ওখানে পিছনে একটা ঝোপের মধ্যে পাখির বাসা আছে । সেটা দেখতে যাব ভাবছিলাম।
— সো ইউ থট, আ্যন্ড দেন রিটার্নড ব্যাক । তা তোমার পাখির বাসাটা দেখে এলে না কেন ?
কিরে বাবা? এ যে একেবারে গোয়েন্দাদের মতো জেরা করছে! বিষয়টা ছাড়তেই চাইছে না । অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। বুঝতে পারলাম না কি উত্তর দেব ।
তারপর বললাম, ওই দিকটাতে একটু জঙ্গল মত আছে তো । তাই আর –
— কিন্তু তুমি তো ওদিকে যাও, রাইট ? তবেই না জানলে ওখানে একটা পাখির বাসা আছে ? সো লেট মি নো, কি আছে বাসার মধ্যে ?
— কি আবার থাকবে ? ডিম-
— বুঝলাম ।
— কি বুঝলেন?
— দুটো জিনিস ।
বলে হাসল ও । বলল, নাম্বার ওয়ান , ইউ আর এ নেচার লাভার । নাম্বার টু , ইউ আর গেটিং টু বি এ লিটিল বিট ফ্র্যাঙ্ক উইথ মি ।
আমার হাতের তেলো দুটো ঘামতে লাগলো। ইংলিশ কনভারসেশন স্টার্ট হলেই ঘামতো । সবই বুঝতে পারতাম, মনের মধ্যে রিপ্লাই দেবার জন্য কিছু একটা ঘোরাফেরাও করত, কিন্তু মুখ ফুটে সেটা আর কিছুতেই বলতে পারতাম না । তাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতাম যেন ইংলিশ কনভারসেশন আর না এগোয় ।
ও বলল , লিভ ইট । আচ্ছা , আজকে একটু তাড়াতাড়ি বৈকালিক ভ্রমণে বেরোনো হয়েছে মনে হচ্ছে যেন ।
আমি বললাম , আজকে কলেজ যাইনি বাড়িতেই ছিলাম তাই।
— তা কলেজে যাওয়া হয়নি কেন ?
— কালকে একটা ক্লাস টেস্ট আছে। তাই পড়াশোনা করছিলাম ।
— ওহো স্টুডিয়াস স্টুডেন্ট।
বলে চোখ নাচিয়ে বলল, ইউ আর এ স্টুডেন্ট অফ বোটানি অনার্স, রাইট ?
‘ই’ বলেও ‘ইয়েস’টা বেরোলো না মুখ থেকে । বললাম, হ্যাঁ।
— ওকে । কি পড়ছিলে? কিসের পরীক্ষা আছে কালকে ?
— ট্যাক্সোনমির ওপর ।
কিরকম যেন একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল তার দুটো চোখে ।
বলল, আচ্ছা দেখি । তোমার সাবজেক্টের একটা কোশ্চেন করি তোমায় । ভেরি ইজি। বলতো , এই যে চোখের সামনে এত সবুজ আর সবুজ ,টি প্লান্ট ,রাইট ? টি প্লান্টের সাইন্টিফিক নাম কি বলতো ?
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল । না ,চা গাছের সাইন্টিফিক নেম’টা তো মনে পড়ছে না । পড়েছিলাম কোথাও একটা । কিন্তু এখন তো একেবারেই মনে পড়ছেনা । কি লজ্জা ! কি লজ্জা ! চোখের সামনে সারাক্ষণ ধরে যে গাছগুলো দেখছি, সেগুলোর সাইন্টিফিক নামটা তো আগে জেনে রাখা উচিত ছিল । ‘কি করিস তুই তরু, মাথায় কি গোবর ভরা ! একফোঁটা বুদ্ধিও নেই ?’ – নিজের মনে মনে নিজেই নিজেকে বলতে লাগলাম । কিন্তু , প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। চুপ করে লজ্জায় প্রায় বেঞ্চের সঙ্গে মিশে বসে রইলাম।
— কই?
আমি চুপ।
ভুরু নাচিয়ে সে বলল, কই? বোটানি অনার্সের স্টুডিয়াস স্টুডেন্ট, বল ?
শুকনো গলায় চিঁচিঁ করে কোনরকমে বললাম, এখন ঠিক মনে পড়ছে না।
অল্প নরম হেসে সে বলল, আচ্ছা ! ঠিক আছে । বলতো, এইযে আমরা চা খাই , তুমি জানো সেটা কিভাবে প্রসেসিং হয় ?
‘প্রসেসিং? ‘ বিড়বিড় করে বললাম । বলতে পারলাম না কিছু ।
ও বললো, হ্যাঁ প্রসেসিং । চা খাও তো তুমি ? চা পাতা কেমন হয় বলতো দেখতে ?
খুব নিচু গলায় কোনরকমে বললাম , ঐতো , গুঁড়ি গুঁড়ি বা পাতা পাতা , দু’রকম হয় ।
হেসে ফেলল ও। বলল, কি কালারের হয়?
— কালার তো কালো।
— কালো হয় কি করে জানা আছে? কিভাবে চা পাতার প্রসেসিং হয়?
এই ব্যাপারে অজিত কাকুর কাছে অনেক বার অনেক কিছু শুনেছি । কিন্তু তখন কিছুই মাথায় এলো না । চুপচাপ মুখ নীচু করে বসে রইলাম।
ও বলল, আচ্ছা , বল, চা গাছের কোন অংশটা তোলা হয় চা পাতা বানানোর জন্য ?
এইটা এতোবার শুনেছি যে ঠোঁটের ডগায় থাকে । বললাম , দুটো পাতা একটা কুঁড়ি ।
— এগজ্যাক্টলি । তারপরে সেটা কালেক্ট করার পর ড্রাই করা হয় । দেন প্রসেসিং । প্রসেসিং এর মধ্যে স্টীম ট্রিটমেন্ট , দেন কাটিং , শেপিং, এভরিথিং । যেটাকে তুমি গুঁড়ি গুঁড়ি আর পাতা পাতা বললে । সেই রকম করা হয় । দেন প্যাকিং । লং প্রসেস । স্টেপ বাই স্টেপ হয়, বুঝলে?
ঘাড় নিচু করে অল্প মাথা ঝাঁকালাম । বললাম, হুঁ।
বলল , চা গাছ কি ধরনের গাছ বল তো?
— কি ধরনের ?
ওর প্রশ্নটাই ঘুরিয়ে আবার ওকে করলাম । মাথাটা তখন ব্ল্যাংক হয়ে গেছে । সে যে আমাকে হঠাৎ করে মাস্টারমশায়ের মতো প্রশ্ন করতে আরম্ভ করবে ভাবতে পারিনি । ওই প্রশ্নটাই আর একবার উচ্চারণ করে নিজের মাথায় ঢোকালাম , ঠিক কি জিজ্ঞাসা করতে চাইছে।
তারপর কোনরকমে বললাম, চিরহরিৎ –
ফিক করে হাসল ও। বলল , তোমাদের বোটানি অনার্স কি বাংলায় পড়াচ্ছে ?
আমি প্রায় লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে বললাম , না মানে.. তা নয় ।
— তাহলে ?
জানি সব জানি আমি – এভারগ্রীন শ্রাব। তবুও বলার সময় এতদিন ধরে বাংলায় পড়ে আসার অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনা । মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় ‘চিরহরিৎ গুল্মজাতীয় ‘।
এবার জোর করেই বললাম , এভারগ্রীন।
বেশ একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে, এইতো ! এভারগ্রীন । এইবার আসল ওয়ার্ডটা বেরিয়েছে মুখ থেকে। আচ্ছা , ডোন্ট ইউ থিংক , এভরি পার্সনস্ হার্ট শুড বি অলওয়েজ এভারগ্রীন ?
আবার অসহায় ভাবে তাকালাম ওর দিকে। এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আমার কাছে ।
ও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, কিন্তু আমাদের ম্যাডাম তো কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালীনই একেবারে জেঠিমা । এভারগ্রীন-এর তো কোন বালাই নেই ।
বলে মুখটা একটু ফুলিয়ে একরকম মুখ ভঙ্গি করে বলল , ‘আমার কালকে ক্লাস টেস্ট রয়েছে, তাই জন্য আমি কলেজে যাইনি, আজকে ঘরে বসে পড়ছিলাম’ ; জেঠিমা না তো ? কি বলবো? কলেজে তো লোকে যায় প্রেম করতে। দু’চারটে বয়ফ্রেন্ড থাকবে । তাদের সাথে দেখা না হলে কি আর ভালো লাগে?
আমি মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠলাম । বললাম , সবাই কলেজে প্রেম করতে যায় না।
ও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই বুঝি ? তুমি কলেজে কি করতে যাও শুনি ?
গম্ভীর হয়ে বললাম , পড়াশোনা।
ও ফিফ করে হেসে বলল , তাই বুঝি ? কই দেখি তোমার হাত দেখি ।
— মানে ?
— দেখাও না হাতটা , দেখি । তোমায় বলে দিচ্ছি।
— কি বলবেন ?
— বলে দেব কলেজে কারো সঙ্গে তোমার প্রেম হবে কিনা।
— ওসব আমার হাত দেখে বলতে হবেনা । আমিই আপনাকে বলে দিচ্ছি , আমার ওসব কিচ্ছু হবে না ।
— এসব কি আর কিছু বলা যায় ? হতেই পারে। দেখি না, তোমার হাতটা-
বলে নিজের ডানহাতটা বাড়িয়ে আমার বাঁহাতটা টেনে নিল । তারপর আমার হাতের পাতাটা নিজে চোখের তলায় মেলে ধরে যেন খুব বিজ্ঞের মত কিছু দেখল । আমি বুঝতে পারলাম আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল হচ্ছে , যেন সমুদ্রের ঢেউ। এমনটাও হয় ? একজন শুধু হাত ধরলে এমনটা হয় বুঝি ? কি হয় ? কেন হয় ? কিভাবে হয়? এমন কেন হয় ?
আমি উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলাম । যদি বুকের উত্তাল ঢেউয়ের প্রতিচ্ছবি মুখে ভেসে ওঠে? ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম ও মিটিমিটি হাসছে।
কিছুক্ষণ পর আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, শুনবেনা কি দেখলাম ?
সে যে সত্যিই আমার হাত দেখেছে , সেটা ঠিক বিশ্বাস না করলেও বা সে যে আদৌ হাত দেখতে পারে বা হাত দেখা বস্তুটা কী , সে সমস্ত সম্পর্কে ঠিক বিশ্বাস বা অবিশ্বাস’ কোনটাই আমার না থাকলেও, সে যে কিছু একটা দেখেছে, সেটা অস্বীকার করতে পারলাম না।
মুখ নিচু করে এক হাতে করে অন্য হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বললাম , কি দেখলেন শুনি ?
— দেখলাম তোমার এক্ষুনি একটা প্রেম হবে । এক্কেবারে জবরদস্ত প্রেম !
আমি কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে ওর দিকে তাকালাম । হাত দেখতে পারে কি না পারে, আমার বয়েই গেল । কিন্তু আজকে যে সে আমার হাত ধরেছে ! কেমন যেন একটা হল আমার হাতের মধ্যে , শরীরের মধ্যে , বুকের মধ্যে । ও আমার হাতটা ধরার সঙ্গে সঙ্গে হল । এই অনুভুতির নাম কি?

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here