#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
সাত
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
(পূর্বকথা : তরুশী একটি ছোট টি এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে নর্থ বেঙ্গল এ আসে । সে অবিবাহিতা । অবিবাহিত একজন মহিলার চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে আসা নিয়ে সেখানে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন রয়েছে । বিশেষ করে ওই রকম ফাঁকা জায়গায় একটা বাংলায় একজন মহিলা হয়ে সে কি করে একা থাকবে? এস্টেটের লেবার’রাও মহিলা একজন ম্যানেজারকে পেয়ে খুশি নয় । তরুশীর চা-বাগানে প্রায় দেড় যুগ আগের অনেক স্মৃতি রয়েছে । সে এস্টেটের কাজকর্ম সামলানোর পাশাপাশি সেই সমস্ত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। )
হারানদা সেদিন সকালে বাংলোর সামনের দিকের ফুল গাছগুলোর গোড়ার মাটি আলগা করে দিচ্ছিল । টগর চা দিয়ে গেল দু’কাপ। আমারটা সাদা, হারান দা’রটা কালো। সারাদিনে আর যত বারই চা খাই, দু তিনবার তো হয়েই যায় , অফিস টাইমে এক বা দু’বার, বাড়িতে ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা একবার, প্রতিবারই র’চা খেলেও , সকাল বেলায় চা’টা বেশ ঘন করে দুধ দিয়ে না হলে আমার চলে না । হারানদা চা খেতে চাইত না । আমিই ওকে সকাল বেলায় চা ধরিয়েছি । তবে র’চা খায় । বাগানের ট্যাপ কলে হাত ধুয়ে এসে হারানদা উবু হয়ে আমার সামনে মাটিতে বসে পড়লো । আমাদের দুজনের সকালের চা খাওয়ার ব্যবস্থাটা এই লনেই করা হয়। দুটো চেয়ার , একটা বেতের টুল ।
— আরে ! আরে ! কি করছো ! এই তো চেয়ার রাখা রয়েছে পাশে । মাটিতে বসলে কেন ?
— আর দিদিমুনি , মাটিতেই আমাদের কাজ । এই মাটির ‘বাস যে কি ভালো লাগে, তা আপনারা বুঝবেন না ।
— বোঝালে বুঝবো বৈকি ! বুঝবো না কেন ?
চায়ের কাপটা তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। বিস্কুটের ডিশটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, হারানদা দুটো নাও ।
হারানদা দুটো বিস্কুট তুলে নিয়ে চায়ে ডুবিয়ে এক কামড় দিল ।
আমিও চায়ের কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললাম , হ্যাঁ হারানদা, বলো-
হারানদা বিস্কুট চিবোতে চিবোতে বলল, এই মাটির বুকেই জম্মেছি । কত ধুলো-মাটি-কাদা মেখে হেলেদুলে বড়টা হয়েচি । আজকে যে এই বুড়োটা হয়েচি, সেও তো সেই মাটি কুপায়ে । মাটি ঠিকঠাক না রাখলে কি আর গাছ হয় দিদিমুণি?
বললাম, নতুন কিছু গাছ এনে লাগাবে নাকি হারানদা?
— তা লাগাবো বৈকি। এই এখানে বর্ষার মৌসুমে কত পেঁয়াজ ফুল ফুটবে দেকবেন না। একেবারে ঝকঝকে ।
— পেঁয়াজ ফুল মানে কি তুমি রেন লিলির কথা বলছো?
— আমি অতো সব ইংরিজি-টিংরিজি নাম জানিনা বাপু। ফুল-ফল ভালোবাসি। গাছ সব চিনি । আমাদের বাংলা নাম না কেন? বাংলা নাম কম কিসে? সব সময় এত ইংরিজি কপচানো কিসের ?
হেসে বললাম , যস্মিন দেশে যদাচার। তুমি এদিকে তাও বাংলা নাম বললে সবাই বুঝবে হারানদা । কলকাতার দিকে বেশিরভাগ সবাই এই ইংরেজি নামগুলোই জানে যে। তা এখানে কোন কালারের রেন লিলি লাগাবে শুনি ?
— গোলাপি, গোলাপি হয় না যেটা ? সেইটা বড় সুন্দর । লাগাবো দেখবেন না, কেমন গোটা মাঠটা ভর্তি হয়ে গোলাপি গোলাপি ফুল ফোটে।
— হুঁ, জ্যাফাইরানথিস রোজিয়া। পিঙ্ক রেন লিলি। বড় সুন্দর ফুল। খুব প্রিয় ফুল আমার ।
শেষের দিকের কথাগুলো যেন স্বগোতক্তির মত বললাম। মনে পড়ে গেল সেই কলেজে পড়ার সময়ের কথা । একজন , সেই ‘সে’জন দিয়েছিল একটা পিংক রেন লিলি । বড় ভালোবেসে বুকে করে রেখেছিলাম ।
হারানদা বলল , কাল রাতে বিষ্টি হয়েচে। গাছগুনোর সব ডালপালা পাতায় বিষ্টির জল পেয়েচে দেখলে বড় আনন্দ পাই দিদিমুণি । গাছগুনোর কত্ত আরাম হয় বলুন দিকিন। ওরা নাইতে পায় । আরাম পায়। খুশি হয়ে ওঠে । আমিতো মোটে ওদের গোড়াতেই জল দিই কিনা ? মোটে গোড়ায় জল পেয়ে কি হয় ? জল যে ওদের খাবার । সেই খাবার টুকুন পায়। নাইতে পায় তো ওরা বিষ্টি হলে। ভগবান জল ঢালেন আকাশ থেকে । ওরা নেয়ে নেয় ।
— ওরা যে আনন্দ পায়, তা তুমি বোঝো হারানদা ?
মানুষটার এই কথাগুলো বড় ভালো লাগলো । উনি অনুভব করেন শুধু গাছের যে প্রাণ আছে তাই নয়, গাছের অনুভূতি , ভালোলাগা-মন্দলাগা, আবেগ , সবকিছু মিলিয়ে গাছগুলো যেন এক একটা মানুষ !
হারানদা বলল , দিদিমুণি বুঝতে পারি বৈকি। ছোট ছোট গাছগুনোয় ঝাড়ি দিয়ে জল আমি দিয়ে দিই । কিন্তু বড় বড় গাছের ডাল পাতায় কি আর হাত পাই মোটে ? এই বিষ্টির জলে নেয়ে নেয় ওরা। পাতাগুলো কেমন ধারা ঝকঝক্ করে । ফুলের পাপড়িতে জল জমে থাকে শিশিরের মতো । ওরা ভারি খুশি হয়ে যায়। আমি দেখতে পাই তো।
নরম হাসি হেসে তাকালাম হারান’দার দিকে। কত বড় মনের মানুষ না হলে এমন ভাবে গাছেদের ভালোবাসা যায় , অনুভব করা যায়। সমাজ স্ট্যাটাসের একটা ডিফারেন্স রেখেছে তাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারলাম না । মনে মনে প্রণাম জানালাম হারান’দাকে ।
— গুড মর্নিং ম্যাডাম ।
ঘাড় তুলে তাকিয়ে দেখি শিশির এসেছে। শিশির ছেলেটি একেবারে ধোপদুরস্ত হিট বাবুটি। সবসময় ফিটফাট হয়ে থাকে । মাথায় হালকা কোঁকড়ানো চুল । বাঁদিকে সিঁথি করে পেতে আঁচড়ানো । গায়ের রং ফর্সা । না রোগা , না মোটা দোহারা চেহারা । চামড়ায় বেশ একটা চকচকে ভাব আছে । ক্লিন শেভড। বেশিরভাগই সাদা বা হালকা রঙের শার্ট পরতে পছন্দ করে । কথাবার্তা বেশ মার্জিত । আমার থেকে হয়তো বছর দুই তিনেকের ছোট হবে ।
–আরে গুড মর্নিং, শিশির । বোসো বোসো। টগর-
একটু গলা তুলে ডেকে বললাম , আর একটা চা দিয়ে যাও।
— যাই মেম।
বলার সঙ্গে সঙ্গে সে একেবারে কান পর্যন্ত হেসে এসে হাজির হলো । বলল, ওমা ! শিশিরবাবু এয়েচেন । তাইলে , আর এক কাপ দুধ চা করে আনি মেম?
— হ্যাঁ আনো।
শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললাম, কি? কি চলবে বলো? সাদা না লাল?
— ম্যাডাম , আবার চা-টা কি দরকার?
— সে আবার কি ? আমার আর হারান’দার তো খাওয়া হয়ে গেল । গল্প করতে করতে দুজনে মিলে খেয়ে নিয়েছি । আর একটু আগে এলে তিনজনে এক সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতাম। তবে সকাল বেলায় তো কখনই এই সময়ে আসো না এদিকে। নিজের ঘরে বসেই যা পারো করে নাও । আজকে এসেছ যখন, এক কাপ চা, দুটো বিস্কুট খাও।
— আচ্ছা ম্যাডাম, দুধ চা’ই বলে দিন তবে।
— টগর, তাহলে একটা দুধ চা’ই করে আনো।
— আচ্ছা মেম ।
একটা লাজুক লাজুক হাসি ফুটে উঠল টগরের মুখে । চায়ের খালি কাপগুলো নিয়ে সে চলে গেল।
আমি শিশির’এর দিকে ফিরে বললাম, বোসো।
সে বসল চেয়ারে ।
বললাম, তারপর বলো । কাজকর্ম সব ঠিকঠাক চলছে তো? আজকে কিন্তু একমাসের রিপোর্ট’টা পাঠাতে হবে হেড অফিসে । ওখানে যে পয়েন্টগুলো তোমাকে বলেছিলাম সেগুলো আ্যড করে দিয়ে আজকে আমাকে ফরোয়ার্ড করে দিও। আমি সেন্ড করে দেব ।
— হ্যাঁ ম্যাডাম হয়ে গেছে । আমি আজকে ফার্স্ট আওয়ারেই আপনাকে সেন্ড করে দেব ওটা ।
— গুড । দেখতে দেখতে এক মাস হয়ে গেল , ভাবা যায় ! এই সেদিন এলাম । কোথা দিয়ে যে একটা মাস কেটে গেল বুঝতেই পারিনি ।
— কাজের মধ্যে রয়েছেন ম্যাডাম । তা ছাড়া বাকি সময় এইসব চা গাছের বাগানে চোখ বোলাতে বোলাতেই কেটে যায় । কি বলেন ? কি ভালো জায়গা ।
— তা বটে । ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে বসে বসে কাজ সামলানোর থেকে সবুজের প্রকৃতির মাঝে বসে সামলানো অনেক সহজ । আচ্ছা শিশির, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি ।
— বলুন ম্যাডাম ।
— তুমি কি আগের ম্যানেজারের সময়ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলে?
— না ম্যাডাম । আমার এই টি এস্টেট এর কাজ এই প্রথম। আগে অন্য টি এস্টেটে কাজ করেছি। আমার এই আপনি জয়েন করার দুদিন আগে জয়েনিং। তারপরে আমি বিশেষ একটা প্রয়োজনে বাড়ি গেছিলাম একটা সপ্তাহের জন্য।
— ও তাহলে তো তুমি বলতে পারবে না ।
— কিসের কথা বলছেন ম্যাডাম ?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ভাবলাম , কথাটা কি শিশিরকে বলা উচিত হবে?
শিশির আবার বলল, বলুন ম্যাডাম। কি বলছেন।
আমি আনমনে বেতের টুলটার ওপর ভাঁজ করে রাখা আজকের নিউজ পেপারটা তুলে নিয়ে চোখ বুলোতে বুলোতে বললাম, তোমার এখানে ঘরে একা সব কাজকর্ম সামলাতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?
— না না , অসুবিধা কিসের? আমি তো এর আগেও এরকম কাজ করেছি ।
কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে বললাম, ফ্যামিলি ম্যান তো নাকি ? বউ আছে?
ঘাড় কাত করে শিশির বলল, তা আছে ম্যাডাম ।
— বাঃ, ছেলে মেয়ে?
— একটি মেয়ে, চার বছরের।
— সেইতো , এখানে তো তাদের নিয়ে আসা তোমার পক্ষে অসুবিধাজনক । এখন তো সব বাচ্চারা হাঁটতে শিখেই স্কুলে ভর্তি হয়ে যায় ।
একটু হেসে শিশির বলল, তাইনা বটে। না ওদেরকে এখানে নিয়ে আসার অসুবিধে।
— তোমার বাড়ি কোথায়?
— শিলিগুড়িতে ।
টগর চা নিয়ে হাজির হল । টেবিলের ওপর চায়ের কাপ ডিশ নামিয়ে রেখে বলল, দেকে নিন বাবু, মোটা দুধ দিই করিচি।
সে আড়চোখে তাকালো শিশিরের দিকে।
আমি বললাম, হ্যাঁ খেয়ে দেখো । টগরের হাতের চা খেলে কিন্তু প্রতিদিন সকালে তোমাকে এদিকে চলে আসতে হবে।
বলে হাসলাম ।
শিশির চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলল, তাই নাকি? দেখি তবে-
ও চায়ের কাপে চুমুক দিল । আমি খবরের পাতায় চোখ রাখলাম। কিছুক্ষণ পর কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে শেষমেষ মনে যে প্রশ্নটা ছিল সেটা করেই ফেললাম । বললাম,
— আচ্ছা, এই সমস্ত লেবাররা চা-বাগানের, এদের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলে ফ্রী হওয়ার চেষ্টা করে দেখেছি । কিন্তু এরা আমার সাথে কিছুতেই ফ্রি মনে কথা বলতে চায় না । বোধহয় মহিলা ম্যানেজার বলে আজব কোন একটা প্রাণী ভাবে । অথচ আগের ম্যানেজার চলে যাওয়ায় যে এরা খুশি হয়েছে সেটা বুঝতে পারি।
শিশির আমার কথার মাঝখানেই বলে উঠলো , ম্যাডাম এদের সঙ্গে বেশি মেশামেশি করতে যাবেন না । প্রভু-ভৃত্যের মধ্যে একটা ডিসটেন্স থাকাই ভালো । আপনার কাজ তো এদের কাজ করিয়ে নেওয়া ।
— তোমার এই পয়েন্টটা আমি মানতে পারলাম না শিশির । আর প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক কিসের ? সত্যি কথা বলতে কি, আমিই বলো, কিংবা চা বাগানের শ্রমিকরা , সকলেই সেই বাগানের মালিকের এমপ্লয়ী । তাই তো ? ঠিক কিনা ? কিছু ভুল বললাম কি ?
— ওদের কাছে আপনিই মালিক। আসল মালিককে ওরা চোখেও দেখেনা, জানেও না । ওদের যে কাজ করায়, সে’ই ওদের কাছে মালিক ।
— সে যাই হোক , এই সমস্ত তর্কে না গিয়েই বলছি , আমি ওদের সাথে মেলামেশা করলে ক্ষতি কি ? আমার তো মনে হয় তাতে করে ওদের আমাকে একসেপ্ট করে নিতে সুবিধা হবে ।
— ম্যাডাম আপনি যত ওদের সঙ্গে মিশবেন ততো ওরা বিভিন্ন আর্জি জানাবে আপনাকে । সেগুলো আপনি ফুলফিল করতে পারবেন না স্বাভাবিকভাবেই । প্রথমেই মাইনে বাড়াতে বলবে। কিন্তু মাইনে বাড়ানো তো আর আপনার হাতে নেই ম্যাডাম । সেই জন্যই বলছি, ওদের শুধু টুক করে কম্যান্ডটা দিয়ে দিন । ব্যাস্, মেলামেশা না করাই ভালো ।
এই ব্যাপারে শিশিরের সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না আমি । কথা শুনে মনে হল যেন , ওই আমার ম্যানেজার। একগাদা জ্ঞান দিচ্ছে । আমি একটা এস্টেট এর ম্যানেজার হয়ে এসেছি। চা গাছের সঙ্গে তো আর বন্ধুত্ব করা যায় না । কিন্তু যাদের সঙ্গে করা যায় , তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখলে আমার কাজটা সম্পন্ন হবে কি ? আমার তো মনে হয়, হবে না । কারণ কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে শুধু মেকানিক্যালি কাজ করে গেলে হয়না। সেখানে ইমোশনাল টাচ থাকতে হয়। মানুষের মনের সঙ্গে যোগাযোগ, মনের সেতু, বড় ম্যাজিক করতে পারে। সেই ম্যাজিক কখনো শুধু হাত-পা নেড়ে কাজ করে করা যায় না।
— ঠিক আছে , শিশির।
উঠে পড়লাম আমি, বললাম , এবারে আস্তে আস্তে টুকটাক কিছু কাজ করে নিয়ে অফিসে বেরোনোর জন্য রেডি হতে হবে, বুঝলে ?
— হ্যাঁ ম্যাডাম । আমিও উঠবো ।
— তুমি বরঞ্চ মাঝেমধ্যে এস্টেটের কাজ সেরে সন্ধ্যেবেলা ঘরে আসার পর আমার বাংলোয় এসো। তখন বেশ সময় করে গল্প করা যাবে।
— ঠিক আছে ম্যাডাম।
উঠে পড়ে আড়চোখে একবার আমার বাংলোটার দিকে তাকিয়ে পিছন দিকে ওর ঘরের দিকে হাঁটা দিল।
সেদিন অফিস আওয়ার্স এর মধ্যেই এক মাসের কাজের রিপোর্ট মালিকের হেড অফিসে মেইল করে দিলাম । তারপর অফিসের কাজকর্ম সেরে বেরোলাম বাগানগুলোর কাজ পরিদর্শন করতে । আজকে আর জগন্নাথ আসেনি । তাই আমাকে নিজেকেই গাড়ি ড্রাইভ করতে হচ্ছে । অবশ্য জগন্নাথকে আমি আসতে বারণ করে দিয়েছিলাম । সকালে ও ফোন করে বলেছিল ওর কালকে রাত্রে থেকে বেশ জ্বর এসেছিল। এখন যদিও গায় আর জ্বর নেই । তবে শরীর খুব দুর্বল । আমি যখন নিজে ড্রাইভ করতে পারি, তখন আর শুধু শুধু শরীর খারাপের মধ্যে আবার ওকে টেনে এনে কি হবে ?
চা বাগানগুলো দেখতে দেখতে, আস্তে আস্তে গাড়ি ড্রাইভ করছিলাম । এই একমাসে ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওদের সম্পর্কে বেশ কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করেছি। এই যে , জীর্ণ রং চটা একটা করে শার্ট আর প্যান্ট কিংবা আটপৌরে করে গাছকোমর করে আঁচল জড়ানো একটা করে ময়লা শাড়ি, মাথায় বেল্টের মত পরে পিঠে একটা ঝুড়ি ধরে রেখেছে , তা নিপুণ হাতে ভরে উঠছে সদ্যতোলা চা পাতায় । এই চিরাচরিত চা বাগানের ছবির পেছনে যে কত রকম গল্প রয়েছে, দুঃখ কষ্টের , তা আমরা যখন বেড়াতে গিয়ে চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করি, তা বুঝতে পারি না । জানার চেষ্টাও করি না । আমরা তো যাই আনন্দ পেতে। তবে আনন্দ কি ওই ময়লা শাড়ি জামার পেছনে আর নেই? আছে। তবে আনন্দের খবর এরা আমাকে সেভাবে দেয় না । দুঃখ কষ্টের খবরই বেশি দেয়। অভাব-অনটনের সংসারের কথাই বেশি বলে। এই কদিনে আমি যেন ওদের একটু কাছাকাছি যেতে পেরেছি। প্রথমদিকের বিদ্রোহ ভাবটা আর নেই । এখনো পর্যন্ত ঠিক মেনে নিতে না পারলেও, এদের আমাকে নিয়ে এখন কৌতুহল বা পিছনে হাসাহাসির বহরটা কমেছে । আমার উপস্থিতিটা এখন এরা এতটা হালকা ভাবে নেয় না । আমাকে আসতে দেখলে যে যার কাজ মনোযোগ দিয়েই করে । এই চা পাতা তোলার দৃশ্য এমন এক চিরন্তন সৌন্দর্য, যা সারাদিন ধরে দেখেও আমার চোখ ক্লান্তি বোধ করে না। এদের মধ্যে খুব অল্প কিছু পাহাড়ি , নেপালি , এছাড়া সমতলের রাজবংশী, নাথ, আদিবাসী, গেন্নাই, তেলি , নমঃশূদ্র , ইত্যাদি বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের মানুষজন বিভিন্ন চা বাগানে কাজ করেন। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। অভাব-অনটনের সংসার। খাটতে পারেন প্রচুর । শরীরে যেন কোনো ক্লান্তি নেই। আর মনগুলিও বড় সতেজ । আমরা অল্প কিছু দুঃখের আঘাতেই ঝড়ে ভেঙে নুয়ে পড়ি । সেখানে এরা কত দুঃখ কষ্ট মাথায় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে হাসতে হাসতে ,গল্প করতে-করতে ,গান করতে করতে কাজ করে। কাজেই এদের আনন্দ ।
সবুজ চা বাগানে চোখ রেখে হঠাৎ করে একটা ইচ্ছা মাথার মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠলো। আজকে তো জগন্নাথ আসেনি । গাড়ির স্টিয়ারিং আমার হাতে। আমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি । শুনেছি অজিত কাকুদের বাংলোটা এখন সম্পূর্ণ খালি পড়ে রয়েছে । কাকু মারা গেছেন আজ প্রায় তিন বছর হলো । কাকিমা জয়ন্তদার সঙ্গে ব্যাঙ্গালোরে থাকেন। বান্টির বিয়ের পরে সে তার হাজবেন্ডের সাথে ইউএসএ চলে গেছে। এখন বাংলোটা একজন কেয়ারটেকারের হাতে। তাই শুনেছিলাম। হঠাৎ করে ইচ্ছেটা আমার মধ্যে ভীষণভাবে পেয়ে বসলো । দেড় যুগ আগে ফেলে আসা সেই সমস্ত স্মৃতিমাখা জায়গাগুলোর এত কাছে থেকেও, এখনো পর্যন্ত একবারও চাক্ষুষ করিনি । সেখানে আমার স্মৃতিরা কেমন ভাবে ঘুমিয়ে রয়েছে দেখে আসা হয়নি । একবার গেলে হয়না ? মোটামুটি আইডিয়া করে আশেপাশে চা বাগানের শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করে ঠিকই মনে হয় চলে যেতে পারবো । সেখানে কতদিন ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে আমার প্রেম । না চেয়ে পাওয়া, না পেয়ে ভুলতে চাওয়া- আমার সেই এক এবং অদ্বিতীয় প্রেম ! জীবনে ভালোবাসা পাওয়া আর ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া- দুটো কি সমার্থক? আমি কি দুটোই এক কালে পেয়েছিলাম? এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজ এতগুলো বছর ধরে খুঁজেছি । আজও খুঁজে চলেছি।
এই এক মাসে মোটামুটি আশেপাশের জায়গা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে । সেই ধারণার ওপর নির্ভর করে গাড়ি চালিয়ে দিলাম।
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
ছবি : সংগৃহীত