সুতোয় বাঁধা সংসার পর্ব-১২

0
838

#সুতোয় বাঁধা সংসার
writer::প্রিয়া
১২
যোহরের নামাজের পর জানাযা সম্পন্ন হলো।স্বপ্না আর তরী শেষ দেখা সামনে গিয়ে দেখতে পারেনি।আড়াল থেকে যতোটুকু দেখার দেখেছিলো।
লাশ মাটি দিয়ে এসে রিদ্ধ খুব কান্না করছে।রিহান দাদার কাছে যাওয়ার বায়না ধরছে।
ছেলেমেয়ের এই অবস্থা দেখে স্বপ্না নিজেকে কন্ট্রোল করে।মায়েদের সব কষ্ট সহ্য করে নেয়ার ধৈর্য্য থাকে।সবাইকে স্বান্তনা দিয়ে দুপুরের জন্য রান্না করলো।রিহান কে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।
তরী আর রিদ্ধ জল পর্যন্ত খেতে চাইছে না।অনেক বুঝিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে খেতে বসলো।খাবার মুখে তুলতে পারছেনা কেউ।
রিদ্ধ এক লোকমা খেয়ে উঠে গেলো।তরী খাবার গিলতে পারছেনা তবুও মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছুটা খেয়ে নিলো।

রাতে জরুরি বৈঠক বসেছে সালমানের বাসায় মধ্যমনি ওদের মা। দুই মেয়ে, সালমান আর রুমা উনাকে নিয়ে বসেছে।
-আজ থেকে মা আমার কাছে থাকবে। প্রস্তাব সালমানের দুই বোন সালমানের কথায় স্বায় দিলো।
রুমা- মা আপনি এখানে থাকেন, আমার ছেলের সাথে খেলা করবেন, দেখবেন ভালো লাগবে।

উনি তসবিহ পড়ছেন, কারো কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না।আবার সালমান বললো।
-ভাবছি..বাবার দোকান বিক্রি করে দিবো।আমার তো সময় নেই দোকান সামলানোর।
-দোকানের দ্বায়িত্ব কি তোকে দেয়া হয়ছে?
-মা কে সামলাবে দোকান।
-রিদ্ধ সামলাবে।
-মানে ওর স্কুল রেখে দোকান সামলাবে।

রুমা-বুঝলে সালমান স্বপ্নার বড্ড লোভ, সব নিজের দখলে রাখলে চায়।
সালমানের দুই বোনের মন্তব্য তাই।স্বপ্না বড্ড লোভী।

সুমিতা বলে উঠলো, আমার বাপ-মা কে বশ করে সবকিছু দখলে রেখেছিলো।ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে সবার মাথায় উঠে বসেছে।
মিতা ও সুমিতার সাথে একমত।তখনি ওদের মা বলে উঠলেন
-আচ্ছা সবার এতো রাগ কেনো স্বপ্নার উপর। আমরা ওকে সম্পত্তি দিয়ে দিয়েছি তাই।
-মা সম্পত্তি আমাদের পাওনা আমরা আর ভাই ভাগ করে পাবো।ভাইয়ার অংশ থেকে রিদ্ধ,রিহান,তরী পাবে।

কথাটা শুনে রুমার বেশ রাগ হলো।
-আপনি কি বলছেন আপু।অর্ধেক সম্পত্তি আপনারা পেয়ে যাবেন আর সালমান চার সন্তানদের ভাগ করে দিবে অর্ধেক সম্পত্তি সেটা কি করে হয়।
-আমাদের বাবার সম্পত্তির উপর আমাদের অধিকার আছে।
-ভাইয়ের সম্পত্তির উপর নেই।তাই বলছি বাবার সম্পত্তি গ্রামের কিছু জায়গা জমি যা স্বপ্নাকে তোমাদের বাবা দান করেছেন।পারলে ওগুলো দখল করো সালমানের সম্পত্তির দিকে চোখ দিওনা।

ওদের কথা শুনে সালমানের মা মিটমিট করে হেসে চলে গেলেন।এই মূহুর্তে কারো সাথে তর্ক করার মতো অবস্থায় তিনি নেই।তবুও বাবার মৃত্যুর সাথে সাথেই সবাই সম্পত্তি নিয়ে পরেছে।
তিনি চলে যেতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো।সালমান তখন বললো-তোমাদের বরদের টাকার কমতি নেই তবুও কেনো তোমরা লোভ করছো।
-আমরা লোভী এটা তুই বলতে পারলি।
এই নষ্টা মেয়ের পাল্লায় পরে তুই বদলে গেছিস।

-সালমান তোমার বোন আমাকে অপমান করছেন।উনাকে কাল সকালে এই বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে বলো।

দুই বোন আর রুমা মিলে ঝগড়া করেই যাচ্ছে।নামাজ শেষ করে আসলেন ওদের মা।
-তোদের ঝগড়া শেষ হয়নি এখনো?
-মা ভাইয়া রাস্তার মেয়ে তুলে আনছে।
রুমা-তুমি বয়সে বড়ো না হলে এখুনি মুখ ছিঁড়ে দিতাম।
-অসভ্য মেয়ে।
-সালমান তোর বউকে শান্ত হয়ে বসতে বল।আমি কিছু কথা বলবো।

সবাই যার যার জায়গায় বসলো।
-আমি জানিনা তোদের বাবার মতো হতভাগ্য বাবা আর কেউ ছিলো কি না?
মানুষটা মারা যাওয়ার সাথে সাথে তোরা সম্পত্তি নিয়ে পরেছিস।আজই তো কবরে রেখে আসলি। কোথায় বাবার জন্য শোক পালন করবি দোয়া করবি, নামাজ পড়বি,কুরআন তেলাওয়াত করবি তা না বস্তির লোকদের মতো ঝগড়া করে যাচ্ছিস।এদিক থেকে স্বপ্না একমাত্র সন্তান।বিশ্বাস না করলে গিয়ে দেখ নামাজে কাঁদছে নয়তো কুরআন তেলাওয়াত করছে।এজন্য তোদের বাবা আর আমি স্বপ্নাকে এতো ভালোবাসি।
তোদের সম্পত্তি চাই তো দিবো চিন্তা করিস না।আমি কিংবা তোর বাবা কাউকে নিরাশ করবো না।মৃত মানুষটাকে ছেড়ে দে এবার থাম তোরা।আমি কাল সকালেই ও বাসায় চলে যাবো।যাওয়ার পর তোমরা দুই বোনকে যা দেয়ার দিয়ে দিবো।

সবাই চুপ করেই রইলো,কিন্তু রুমা চুপ থাকলো না।
-দেখুন মা,আমি বলে দিচ্ছি সালমানের ভাগের অংশ থেকে কিছুই দিবো না।এমনিতে আপনি চল-চাতুরী করে ১৫লক্ষ টাকা মেরে দিয়েছেন।
-সালমান তোর বউকে মুখ সামলাতে বল।নয়তো আমার চাইতে কেউ খারাপ হবে না।
-মা ১৫লক্ষ টাকা আমার কষ্টের টাকা।রুমা কথা বলবে না তো কি করে।
-ওহ তারমানে তুই ও চাস এই টাকা তোকে দিয়ে দেই?
-সব না দাও অল্প তো দিবে।
-এক টাকা ও দিবো না।কেনো দেবো না জানিস?
-কেনো?
-যাতে ভবিষ্যতে এই টাকা তোর উপকারে আসে।যাতে রিদ্ধ আর রিহান বলতে পারে এই টাকা ওদের বাবার ছিলো।
-কিসব বলছো তুমি?
-এখন না বাবা পরে বুঝবি।

কেউ আর কিছু বললো না।সবাই যার যার রুমে চলে গেলো।
সকাল হতেই সালমানের মা সবাইকে ঘুমে রেখেই বেড়িয়ে গেলেন।স্বপ্না কুরআন তেলাওয়াত করছিলো কলিংবেল বাজতে উঠে গেলো।
দরজা খুলে মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে।
-ও মা আমি বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম না।এমন কেনো হলো মা, আমি বাবাকে শেষ বার কেনো দেখতে পারলাম না?
-সব কপাল রে মা। আয় ভিতরে আয়।
-মা আপনি এতো সকাল চলে আসলেন, কেউ কিছু বলে নি?
-সবাই ঘুমাচ্ছে।ওই বাড়িতে আমার ঘুম আসে না।আমি আমাদের রুমে যাই তুই একটু চা করে নিয়ে আয়।

স্বপ্না চা বানাতে গেলো।দু কাপ চা করে নিয়ে আসে।
স্বামীর চাদর জড়িয়ে আছেন তিনি। দীর্ঘ ৫০বছরের সংসার জীবন।সুখ দুঃখ সবকিছু ভাগাভাগি করে ছিলেন।আজ সেই মানুষটা একা রেখে চলে গেলেন।এই মূহুর্তটা কি যে যন্ত্রণার সেটা কেবলি ওপর পাশের মানুষটা বুঝতে পারে।

সালমান,ওর দুই বোন, মাকে না পেয়ে বুঝে গেলো তিনি ওই বাসায় চলে গেছেন।সুমিতা, মিতা দুজনেই নিজেদের বাসায় চলে গেলো।

দুইটা দিন কেটে গেলো তরী কলেজ থেকে ফেরার পথে একটা ছেলে ওর রিকশা আটকালো।
-আপু দুই দিন থেকে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।
-কে আপনি?
-আমাকে চিনবেন না।তবে আমি আপনাকে চিনি একজন ভাইয়া আপনার ছবি দেখিয়েছেন। আর আমার দোকান ওই পাড়ে এদিকে আপনি প্রতিদিন আসেন তাই আমি ছবি দেখেই আপনাকে চিনে পেলি।
-কে ছেলেটা?
-ছেলেটা বিদেশি, আপনাকে একটা গিফট দিয়া গেছে।জানেন পরশুদিন ছেলেটা রোদের মধ্যে পুরোদিন দাঁড়িয়ে ছিলো।
-উল্লাস।
-হ্যাঁ নাম তো উল্লাস বললো।
-কি গিফট?
-এই ব্যাগ নিন।

তরী প্যাকেটটা নিয়ে আসলো।বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে প্যাকেট খুললো।
একটা চিঠি, একটা শাড়ি, বেলি ফুলের গাঁজরা আর এক ডজন কাঁচের চুড়ি।
সবকিছু রেখে চিঠি খুলে বসলো।
প্রিয় মিষ্টি,
তোমার ফোন অফ, ভেবে নিয়েছি তুমি আসবে না বলে ফোন অফ করে রেখেছো।মেসেজ দেয়নি যদি ফোন আর অন না করো।রাগ করো না অন্যজনকে দিয়ে গিফট পাঠিয়েছি বলে।আসলে আমার কোনো উপায় নেই। নিজের হাতে দেয়ার জন্য এগুলো কিনেছিলাম।তুমি আসো নি বলে চিঠিতে মনের কথা লিখছি।আমি কাল চলে যাবো আর দেখা হবে না।তুমি খুব চমৎকার মানুষ। প্রথম দেখায় যাকে আমি ভালোবেসেছি।তুমি কি কখনোই আমাকে ভালোবাসবে না।
খুব ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, বেলি ফুলের গাজরা খোঁপায় কেমন লাগে দেখবো।দেখা হলো না।তুমি কি আমার জন্য ১বছর অপেক্ষা করবে।কথা দিচ্ছি একবছর পর ফিরে আসবো।
প্লিজ মিষ্টি একটা বছর অপেক্ষা করো।আর শাড়ি, চুড়ি আলমারিতে তুলে রেখো।আমি আসলে পরবে।আমার বিশ্বাস আমার ভালোবাসার প্রতি আস্থা আছে তুমি অপেক্ষা করবে।
ভালো থেকো ভালোবাসা।খুব ভালোবাসি তোমায়।
তোমার পাগল।

**স্বপ্নার শাশুড়ী সবাইকে ডাকলেন।রিদ্ধ,তরী সবাই আসলো।
-স্বপ্না তোকে একটা কথা বললো, ভুল বুঝিস না আমায়।
-কি বলছো মা,আপনাকে ভুল বুঝবো।
-মা আমি চাই না আমার স্বামী কে নিয়ে উনার মেয়েদের মনে তিক্ততার জন্ম হোক।মেয়েরা সারাজীবন বাবাকে গালি দিবে আমি মরলে ও গালি দিবে।তাই মেয়েদের মনে কষ্ট দিতে চাই না।
-মা আমাকে আর কিছু বুঝাতে হবে না।আপনি যা খুশি করুন।সব কিছু দিয়ে দিন আপাদের শুধু আপনি আমাদের সাথে থাকুন।
-আমি গ্রামের অংশ ওদের দিয়ে দিতে চাই।
-নিশ্চয় মা দিয়ে দিন।
-তুই কোন ধাতু দিয়ে তৈরি?
-মা গো আমার যে কিছুর লোভ নেই।শুধুমাত্র শান্তি চাই আমি।
-এপারে তুই শান্তি পাসনি ওপারে তুই শান্তি ঠিক পাবি।

রিদ্ধ দাদুকে জড়িয়ে ধরলো -দাদু আপনি আমাদের সাথে থাকুন।আমরা আপনাকে আর মাকে কখনোই কষ্ট দিবো না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here