#অরণ্যবহ্নি
||৮ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
গলা খাঁকারি দিয়ে পানি পান করেন তিনি। মাথা নত করে বলতে শুরু করেন,
“তখন তোমার বাবা আর আবেগের বাবা হাট্টাগাট্টা তরুণ। আবেগের বাবা মানে তোমার আঙ্কেলের তর্ক হয় একটা ছেলের সাথে বাজারে। ছোটোখাটো তর্কাতর্কি ছিল তাই এতো মাথায় ঘামায়নি কেউ। কিন্তু ঐ ছেলে একদিন ভোরবেলা মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আটকে ধরে।
ছেলেটার সাথে খুব মারামারি হয় তোমার আঙ্কেলের। ঝগড়ার এক পর্যায়ে ছেলেটা তোমার আঙ্কেলকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করতে নিলে ধাক্কা দেয়, ছেলেটা রাস্তার মাঝখানে পড়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ট্রাক এলে পিষে যায় তার দেহ। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয় তোমার বাবা, কারণ তার দোকান ঐ রাস্তাতে ছিল বলে সে তা খুলতে যাচ্ছিল।
তোমার আঙ্কেল ভয়ে ছুটে আসে আমাদের বাড়িতে। আমরা তাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়ে বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করি। ছেলেটা কে ছিল জানো? চেয়ারম্যান নজীর উদ্দীনের মেঝো ভাই। কেস করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় তোমার বাবাকে। কারণ তার দোকান সেখানে ছিল আর ভোরে খোলায়, সবাই নিশ্চিত ছিল সে-ই সাক্ষী। আমার ও তোমার দাদুর কান্নায় মন গলে হানিফের, থানায় বলে সে কিছু দেখেনি। আমার সেদিন দুই ছেলে হয়ে গিয়েছিল।
তবে বদনাম একটা রটেই গিয়েছিল গ্রাম-গঞ্জে। ব্যবসায় লস হচ্ছিল। এদিকে তোমার আঙ্কেল তাও কোনোরকমে একটা ছোটোখাটো কাজ করে আয় করছিল। ব্যবসাও শুরু করেছি, সেখানেই বিয়ে করে আবেগের মা মানে তোমার আন্টিকে। তবে বিয়ের দু’বছর যেতেই ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলে, তখন ব্যবসা বাড়াতে নিজের কোনো এক সদ্য পরিচিত হওয়া বড়োলোক আমেরিকান বন্ধুর সাহায্যে আমেরিকায় যায়। এরপর প্রায় বছর খাণেক সে নিখোঁজ ছিল।
আমাদের সবার দোয়া কবুল করে আল্লাহ, সে ফিরে আসে। তবে আজ মনে হয় না ফিরলেই ভালো হতো। ফিরলেও তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চাল-চলন বেশ বদলে গিয়েছিল। তবে সচ্ছলতা ফিরেছিল আমাদের পরিবারে। দু’হাত দিয়ে টাকা আয় করছিল তোমার আঙ্কেল, বাংলাদেশে আমরাও যেখানে হাত দিচ্ছিলাম তা-ই যেন স্বর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। তারপর আবেগ হয়, ধীরে ধীরে তোমার আঙ্কেল আগের রূপে ফিরে আসে। কিন্তু সে যে ভয়ঙ্কর পাপকার্যে লিপ্ত হয়েছিল তা আর মুছতে পারেনি।”
“পাপকার্য?” অবাক হয় সামায়া।
“হুম, পাপ। তাও যেমন তেমন পাপ নয়, এমন পাপ যা সকলের ঘৃণার্হ্য। শয়তানি শক্তির সাহায্য নিয়েছিল সে।”
লম্বা একটা শ্বাস নেন মিহিরুন্নিসা বানু। আবেগ নির্বিকার ভঙ্গিতে নত দৃষ্টি সমেত বিছানায় বসে। উভয়ের আচারণই সামায়াকে জানান দিচ্ছে, সে যা শুনেছে তা সত্য।
“আমেরিকান বন্ধু যার নাম ডেভিড আসলে আমেরিকান একটি কাল্টের ‘Satan’s’ এর সদস্য, যারা ছিল শয়তান ও শয়তানি শক্তির উপাসনাকারী। তারা অনেকদিন তোমার আঙ্কেলকে নিজেদের আস্তানায় আটকে রাখে। ডেভিড আমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা জানতো, সে ব্রেইনওয়াশ করতে শুরু করে শয়তানি শক্তির সহায়তায়, এই কাল্টে যুক্ত হয়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। তোমার আঙ্কেল অবশেষে ভুল পথেই পা বাড়ায়। অপশক্তির কাছে নিজেকে অর্পণ করে দেয়। কাল্টটির সদস্য ও অপশক্তির সাথে চুক্তি করে, অর্থ ও সফলতার বিনিময়ে নিজের তৃতীয় প্রজন্মকে তথা প্রথম নাতিকে তাদের নিকট ত্যাগ করার। আমি জানি না আমার পেটের সন্তান এতো মতিভ্রষ্ট কী করে হলো! এতো জঘন্য একটা চুক্তি করতে তার বুক একবারও কাঁপলো না!”
“দিদা তুমি কী বলছো এসব? এসব কী করে সম্ভব হয়! আমার মনে হয় তোমার কোনো ভুল হচ্ছে।”
“কোনো ভুল হচ্ছে না। তোমার আঙ্কেল নিজে এসব তার সুইসাইড নোটে লিখে গেছে। আমরা তো জানতামও না এসব। আমার পরিবারটা শেষ করে দিল ছেলেটা!”
“সুইসাইড নোট? সুইসাড? বাবা তো বলেছিল আঙ্কেল হার্ট এ্যাটাক করেছিল।” একের পর এক ধাক্কা সামলে নিতে পারছে না তরুণী। ধপ করে সোফায় বসে পড়ে সে।
“মিথ্যে বলেছিল হানিফ আমার কথা মতো। কোনো সুসংবাদ তো ছিল না, ছিল লজ্জাজনক বিষয়। সবাইকে মিথ্যে বলি, তোকেও তাই জানাতে বলি। তোর মনে আছে আবেগ তোদের বাসা থেকে না বলে চলে গিয়েছিল এক রাতেই? সেদিন রাতেই সুইসাইড করে আবেগের বাবা। আর সেই রাতেই প্রথম ঐ দানবীয় শক্তির আভাস পায় আবেগ।
হ্যাঁ, তোমার ঐ রাত্রিতে দেখা সম্পূর্ণ দৃশ্য সত্য। রাত হলে আবেগ একজন দানবে পরিণত হয়ে, ঐ শয়তানি শক্তি তার উপর আধিপত্য জমায়। তখন আবেগের হুশ থাকে না কোনো, নিয়ন্ত্রণ থাকে না নিজের উপর। পশুতুল্য এক দানবে পরিণত হয়। ঐদিন রাতে হানিফ দেখতে পায় সে হুট করেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
হানিফও তার পিছন পিছন বের হয়। রাত প্রায় একটা হওয়ায় গলা বাড়িয়ে ডাক দেয়নি, যাতে কারো ঘুম ভাঙে। সেদিনই প্রথম এক নির্দোষ রাস্তার পাগল শিকার হয়েছিল আবেগের পৈশাচিকতার। হত্যা করার কিছুক্ষণ পরই জ্ঞান হারায় আবেগ। হানিফ তখন ভয়ে তটস্থ আবেগকে এ দশায় দেখে, আমাকে কল করে তাড়াতাড়ি। আমার লোকেরা ও হানিফ মিলে কোনো রকম লাশটা বনে ফেলে আসে, দেখলে যেন মনে হয় কোনো জন্তুর কাজ।
আবেগকে তাড়াতাড়ি কানাডা পাঠিয়ে দেই আমি ভোরের ফ্লাইটেই। আর হানিফও ভয়ে তোমাদের নিয়ে পরদিন সকালেই আরশিনগর ছাড়ে তোমার ভাইদের কাজ আর তোমার কলেজের বাহানায়। আবেগকে প্লেইনে উঠিয়ে দিতেই আবেগের মায়ের কল পাই। জানতে পারি আমার একমাত্র ছেলে সুইসাইড করেছে। আর সুইসাইড নোটে যা লিখে গেছে তা শুনতেই কপালে হাত আমার।
কাল্টের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, আবেগের বাবা মৃত্যুর কিছুদিন আগে তার সাথে কোনো এক ভাবে যোগাযোগ করে তারা। এই চুক্তি কোনোভাবেই পূরণ করবে না বলে জানালে তারা রেগে যায়। তারপর ক্ষণে ক্ষণে এই দানবীয় শক্তি নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় তোমার আঙ্কেলের কাছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ছেলেটা আর সহ্য করতে পারে না সুইসাইড করে… তার বংশধর হিসাবে এই অপশক্তি পিছু নেয় আবেগের। যেই অবধি তারা আবেগের সন্তানকে না পাচ্ছে, সেই অবধি চলতে থাকবে আবেগের সাথে এমন হওয়া।”
মাথা ঘুরাচ্ছে সামায়ার। কতোক্ষণ চুলে হাত বুলাচ্ছে, তো কখনও কপালে হাত দিচ্ছে দিকভ্রান্তের মতোন। এও কী সম্ভব! আবেগ পাশে বসে থাকা নারীটির মনের অবস্থা বুঝতে পারলেও সান্ত্বনা দেওয়ার শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না। তার ধারণা অনুযায়ী নিশ্চয়ই নারীটির পরবর্তী প্রশ্ন হবে, সব জেনে শুনে তাকে বিয়ে করে তার জীবন নষ্ট করলো ক্যানো? এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না। সে তো চায়নি তার জীবন নষ্ট করতে, দিদা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে অনেকটা বাধ্য হয়েই বিয়েটা করেছিল।
বৃদ্ধা এবার নাতবৌয়ের পাশে বসে। ডান হাতটা নিজের দুই হাতের মাঝে নেয়। বিনীতভাবে আবেদন করে,
“আর তুই প্লিজ তোর বাবাকে ভুল বুঝিস না। তোর বাবা সব জেনে-শুনে তোকে এই অগ্নিকুণ্ডতে ধাক্কা দিয়েছে এই কথাটা মাথাতেও আনিস না। তোর যখন আড়াই কী তিন বছর, তখন তোর খুব অসুখ। এক লাখ টাকা বিল এসেছিল ঢাকার এক হাসপাতালে, সম্পূর্ণ টাকা আমি দিয়েছিলাম সেই মুহূর্ত। আমার হানিফটা নিতে চায়নি, কিন্তু নিজের ছেলে আর নাতনির এমন দুর্দশায় কি আমি নাকোচ শুনবো! তাও এই ছেলে যে কি না আমার সাত রাজার ধন রক্ষা করেছিল।
তোর বাবা হাসপাতালেই আমার হাত দু’টো চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেছিল, ‘আমি ওয়াদা করছি এই মেয়ে আজ থেকে আপনার আমানত আমার কাছে, আপনি যা বলবেন তা-ই ওর ভবিষ্যৎ’। এবার আমি সেই ওয়াদাই এই বার টেনেছিলাম, তোর উপর দাবী তুলেছিলাম। তোর বাবা এক কথার মানুষ, আমাকে না করতে পারেনি। আমিও ওয়াদা করেছিলাম তোকে হেফাজতে রাখার। আমার উপর রাগ হতেই পারে, তবে আমার একমাত্র জীবিত আপনজন আবেগ। তাকে মরে যেতে কী করে দেখতে পারি নিজের চোখের সামনে?”
কোনো জবাব আসে না তাঁর কথার বিপরীত, স্তব্ধতা কাটেনি তখনও। মিহিরুন্নিসা বানুও আর ঘাটেন না, উঠে চলে যান আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে।
চলবে…
প্রথমত গল্পটা আর দুই পর্বেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে। খুব বড়ো কোনো সমস্যায় নেই। বাট আমি খুবই মেসড আপ মেন্টালি। আই ফিল লাইক টু গেট ডিজাপেয়ার ফ্রম দিজ ওয়ার্ল্ড্ ফর সাম ডেজ, ফিল লাইক টু ডাই, বাট আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতেও চাই না। আমি খুব করে চাই আমার জার্নিটা সম্পূর্ণ করতে। ভাগে আসা প্রতিটি চরিত্র উপভোগ করতে। লাইক নানী হতে, মেয়ের বিয়ে দেখতে, নাতনির বিয়ে দেখতে, বার্ধক্য উপভোগ করতে, সফলতা উপভোগ করতে। আমি চাইলেও লিখতে পারি না। কারণ গল্প নিয়ে ভাবতে বসলে আমি যা ভাবতে চাই না সেই চিন্তাই বারবার আমার মাথায় আসে। সারা দিন কোনো ফানি ভিডিও বা সং শুনে মাইন্ড ডাইভার্ট করি। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই আগের মতো রেগুলার হয়ে যাবো, একটু অপেক্ষা, আর অনেকটা ক্ষমা, আর বেশ খাণিকটা দোয়া চাইছি আপনাদের নিকট। আর কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবেন না এই বিষয়, অনেকটাই ব্যক্তিগত এবং তেমন বিশেষ কিছু না।
পর্বসংখ্যা- ১০০০+