#অরণ্যবহ্নি
||২য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
গ্রামবাসীর রোষানলে পড়ে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে সামায়ার কবুল বলতে হয় আবেগকে। গোটা গাঁয়ের মানুষদের মাঝে তাদের নিয়ে ছি ছি পড়ে গেলেও সামায়া এ বিয়েতে নাখুশ নয়, তবে আবেগের মুখশ্রী ক্রুব্ধ। তবে কি মানুষটি এবারও মেনে নিবে না তাকে?
আজ সকাল বেলা মিহিরুন্নিসা বানুর অনুরোধ উপেক্ষা না করতে পেরে আবেগের সঙ্গে জঙ্গলের ভাঙা মন্দিরে আসে সামায়া। মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও জড়তায় কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। তবে কতোক্ষণ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে রমণী? গাড়ি থামতেই প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে দেয়।
“এভাবে বিয়ে করার মানেটা কী আবেগ ভাই? আপনি কী জানতেন এসব? আমার জীবনটা নিয়ে এভাবে খেলার মানে আছে?”
“তোকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই মায়াবালিকা।”
“আমার নাম সামায়া শেখ, মায়াবালিকা নয়। আমি বর্তমানে আপনার স্ত্রী, আপনি বাধ্যই তাই জবাবদিহিতা করতে।”
আবেগ ফিঁকে হাসে। গাড়ির বাহিরে নজর রেখে উত্তর দেয়,
“কাগজ-কলমের স্ত্রী, ধর্মীয়ভাবে আমাদের বিয়ে হয়নি। তাই অযথা অধিকার জমাইস না, মায়াও বাড়াইস, তিনটে মাস পরই তালাক।”
রাগ হয় সামায়ার, প্রচণ্ড পরিমাণ রাগ পুরুষটির খামখেয়ালিপনায়। তার জীবন নিয়ে এভাবে নাটকীয়তা করার অধিকার কে দিয়েছে এই মানুষটিকে। সিট থেকে উঠে পুরুষটির উপর চড়ে কলার চেপে ধরে সে।
ঠিক এই অবস্থারেই তাদের দেখে ফেলে কাঠুরে রমিজ মোল্লা। চিৎকার করে গোটা গ্রামের লোক জড়ো করে ফেলে। ঘটনার আকস্মিকতায় সামায়া হচকচিয়ে গেলেও, আবেগের ভাব-ভঙ্গিমা বুঝার উপায় নেই।
দু’জনকে জোরপূর্বক গাড়ি হতে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চেয়ারম্যানের দরবারে। চেয়ারম্যান নজির উদ্দীন মুখে গম্ভীরতা রাখলেও, শয়তানি হাসির রেশ তাঁর মাঝে। মাতব্বর পরিবারকে তার বড়ো নাতীকে দিয়ে অপমান করার চমৎকার একখান সুযোগ পেয়েছেন বলে কথা।
রমিজ মোল্লার হতে সব শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে কেশে উঠে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। পান চাবাতে চাবাতে অশ্লীল ভঙ্গিমাতে শুধান,
“সবই তো শুনলাম, তবে কী যে বলমু বুঝি না! মাতব্বরের নাতীই যদি এমন করে তাইলে গেরামের আর ছেলে-মেয়ে কী শিখবো! আজকালকার ছেলে-মেয়ের এতো যৌবনের কুড়কুড়ানি যে যেইখানে সেইখানে শুরু কইরা দেয়। এই মেয়ে, তুমি সামনে আসো।”
সামায়া একদফা আবেগের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে সামনে আগায়। দরদর ঘামছে তার শ্যামা কায়া, সে জ্ঞাত কতো ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া হয় গ্রাম-গঞ্জে এমন অপরাধের জন্য।
“দেখুন, আপনারা যা ভাবছেন আমাদের মধ্যে তেমন কিছু হয়নি। আপনারা ভুল বুঝছেন।”
“হ, কচু বুঝছি আমরা। সকল ছেলে-মেয়ে ধরা পড়লে এই কথাই বলে। কথা না বাড়াইয়া বাপের নাম বলো।”
“হানিফ রহমান।”
নামটা শুনতেই ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নজির উদ্দীনের। এই মানুষটির জন্যই তাঁর বহু ক্ষতি হয়েছিল।
“ওহ! ঐ মুদি দোকানীর মেয়ে তুই, যে এক রাতেই পরিবার নিয়া পালাইসিল! বুঝতে পারছি ফইন্নি টাকার জন্য শুইতে আসছিলি?”
ঘৃণায় রি রি করে উঠে যুবতী দেহ। আবেগ হুংকার দিয়ে উঠে,
“চুপ! একদম চুপ! অনেক অতিরিক্ত কথা বলছেন আপনি!”
“এই ছেলে তুমি চুপ থাকো, একে তো চুরি তার উপর বড়ো বড়ো কথা চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে।”
“দেখসো তো তোমরা? এই ছেলে-মেয়ের মাঝে সামান্যতম লজ্জা নাই নিজের অন্যায় নিয়া। এদের তো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। বাঁধো এদের ঐ বটগাছের সাথে, এদের পোড়ায়াই আজ অন্যায়ের খালাস হইবো, যাতে আর কোনো ছেলে-মেয়ে এমন পাপাচার করার সুযোগ না পায়।”
“হ্যাঁ! হ্যাঁ!” চিৎকার করে সমর্থন জানায় উপস্থিত সকলে। সামায়া ও আবেগ টেনে নিয়ে বাধতে শুরু করে। ভয়ে রমণী গা অসাড় হয়ে আসছে।
হুট করে কিছু একটা মাথায় আসতেই চেঁচিয়ে বলে উঠে সে,
“থামুন, থামুন আপনারা। আমরা বিবাহিত। বিবাহিত!”
বজ্রপাত হয় যেন এ বাণী। নিস্তব্ধ গোটা পরিবেশ। তবে চেয়ারম্যান সাহেব আপন মনেই নিশ্চিত যে এই কন্যা মিথ্যে বলছে।
“তোমরা যে মিথ্যে বলতাসো, তা আমার জানা। তোমরা থামকা ক্যানো? বাঁধো এদের।”
“কিন্তু চেয়ারম্যান সাব এরাও সত্যও বলতে পারে, তাই না? দুই জন নির্দোষ মানুষ মারমু!”
একজন নিজের মতবাদ জানাতে অনেকেই সম্মতি দান করেন। নজির উদ্দীন ঘাবড়ে যান, এতো বড়ো সুযোগ হাতছাড়া করতে কিছুতেই তিনি রাজি না।
“দেখো, মানতাসি আমি তোমাদের কথা। কিন্তু এরা সত্য না মিথ্যা বলে তা বুঝমু কেমনে?”
“একটা কাজ করলেই তো হয়, এদের বিয়া করায় দেই আমি। তাহলে বাঁশরি যেমনেই বাজুক, সুর একটাই থাকবো। কী বলেন সকলে?”
ইমাম সাহবের প্রস্তাবে প্রায় প্রত্যেকেই রাজি হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয় চেয়ারম্যান সাহেবকেও। কিন্তু বেঁকে বসে আবেগ।
“না, কোনো বিয়ে হবে না। কীসের বিয়ে? আমাদের একবার বিয়ে হয়েছে। আর লোক দেখাদেখি বিয়ের প্রয়োজন নেই।” অতিরিক্ত অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তার ছোঁয়া তার কণ্ঠে।
এবার যেন আরও একবার সুযোগ পেয়ে বসে চেয়ারম্যান নজির উদ্দীন।
“দেখসো তোমরা? আমি বলসিলাম না মিথ্যে বলতেসে। নাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়? সবার আগে এই মেয়ের গলা কাটো।”
বলতে বলতেই নজির উদ্দীনের জ্যেষ্ঠ পুত্র রনি দা চেপে ধরে সামায়ার গলায়। মৃদু কেটে ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা বেয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে উঠে রমণী। তাৎক্ষণাৎ আবেগের আকস্মাৎ লাথিতে উলটে মাটিতে পড়ে যায় রনি।
“তোর সাহস কী করে হয় আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলার বাস্টার্ড! জানে মেরে ফেলবো একদম। কে বিয়ে করাবে করাক, আমার মায়াবালিকার গায়ে যদি একটা আঁচড়ও পড়ে না রক্তের নদী বয়ে যাবে এ এলাকায়।”
অতঃপর গ্রামের মানুষের উপস্থিতি তিন কবুল বলে বিবাহ হয় আবেগ ও সামায়ার। যুবতী তার ‘আবেগ ভাই’ এর কানের সম্মুখে বিড়বিড়ায়,
“দেখলেন তো আবেগ ভাই, এবার সবদিক দিয়েই স্ত্রী হলাম। অধিকার দেখাতো পারবোই!”
সেই মুহূর্তেই এই মজলিসে নিজের লোকজন নিয়ে উপস্থিত হন মিহিরুন্নিসা বানু। তিনি নিজের লোকের কল পেয়েই রওনা হয়েছেন।
বিবাহের কথা জানতে পেরে রাগের সাথে চিন্তায় ফেটে পড়েন তিনি। একদফা ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে নজির উদ্দীনের দিকে তাকিয়ে নিজের পৌত্র ও পৌত্রবধূকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসেন।
___
বর্তমানে নিজের দিদার সম্মুখে গুরুগম্ভীর রূপ ধরে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে আবেগ। মিহিরুন্নিসা বেগম চাপা গর্জন করে বললেন,
“তোমার কী মতিভ্রষ্ট হয়েছে আবেগ! তুমি কী করে পারলে সবকিছু জেনে এই বিয়ে করতে! আমি তোমার নিকট এরূপ আচারণ আশা করিনি।”
“আমাকে ক্ষমা করবেন দাদীজান। আমার নিজের জীবনের পরোয়া নেই। তবে যেভাবেই হোক সামু আমার স্ত্রী, তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হতে আমি মুখ ফিরাতে পারবো না। তার জীবনের উপর কথা এসেছিল, তাই আমি পারিনি…”
“মুখে মুখে তর্ক কোরো না আবেগ। অপেক্ষা করতে পারতে তুমি, আমি তো আসছিলামই। যাকগে যা হওয়ার হয়েছে, কিন্তু সামুর থেকে দূরে থাকবে তুমি।”
“এজ ইউ সে দিদা। আর কোনো ভুল হবে না।”
চলে যেতে পিছনে ঘুরে যুবক। ফুঁপিয়ে কেঁদে দেন মিহিরুন্নিসা বানু, উঠে এসে মমতার স্পর্শে জড়িয়ে নেন প্রিয় নাতীকে।
“আমি জানি তোর কষ্ট হয় দাদু। আমিও কী করবো, যা করছি তোর জন্যই তো করছি।”
আলতো হেসে দিদাকে জড়িয়ে ধরে আবেগ। বড্ড বেশি ভালোবাসে এই বৃদ্ধাকে সে।
“আমি জানি দিদা। তুমি মন খারাপ কোরো না, সব আমার কপালের দোষ।”
“তোর কোনো দোষ নেই। দোষ যে করেছে সে তো মরে গেছে, তোকে ফাঁসিয়ে গেছে।”
___
কামরায় বসে একা একা মিটমিটিয়ে হাসছে সামায়া। অপেক্ষা করছে আবেগের, ইচ্ছে মতো শায়েস্তা করার ইচ্ছে তার।
কামরার দ্বার খোলাই ছিল। অনুমতি ব্যতীতই ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ করেন শকুন্তলা দেবী। কোনো কথা ছাড়াই সামায়ার সদ্য আলমারিতে গোছানো কাপড়-চোপড় বের করে ব্যাগে ভরতে শুরু করে। অবাক রমণী, রাগও হয়।
“কী করছেন আপনি এসব, আন্টি? জামা-কাপড় ব্যাগে ভরছেন ক্যানো?”
“আমি আদেশ করেছি তাই বুড়িমা।” কামরায় প্রবেশ করতে করতে উচ্চারণ করেন মিহিরুন্নিসা বেগম।
“কিন্তু ক্যানো দিদা? গতকাল না আমাকে এ রুম দেওয়া হলো?”
“এই রুমটা তোমার জন্য না। আমি রাজকন্যা বুড়িমার জন্য আমি বিশাল বড়ো সুন্দর একটা ঘর প্রস্তুত করে রেখেছি। সব তোমার পছন্দ মতো সাজানো। এখন শুধু তোমার যাওয়ার পালা।”
রমণী বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারে যে তাকে আবেগের সাথে থাকা হতে রোধ করতেই দিদা এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও চুপ থাকে সে। নীরবতার সহিত বের হয়ে যায় শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে।
তবে মনে মনে শপথ গ্রহণ করে,
“আমার শপথ, এই সকল ঘটনার মূল না বের করা অবধি, রহস্য উদঘাটন করা অবধি স্বস্তির শ্বাস ফেলছি না। আর আবেগ ভাই, এতো উপেক্ষা করছেন না আমায়, আপনাকে যদি না পুড়িয়ে মারছি যন্ত্রণায় আমি সামায়া শেখ নয়।”
সামায়ার অপ্রকাশিত অসন্তুষ্টি বুঝতে ত্রুটি হয় না দিদার। তিনি গোপণে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তাঁর নিকট কিছুই করার নেই।
___
গভীর রাত্রি, এতোটাই নিস্তব্ধ গোটা বাড়ি যে ঘড়ির টিকটক শব্দটিও জোরালো মনে হচ্ছে। সামায়ার চোখে নিদ্রা ধরা দিচ্ছে না। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে চাঁদের আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে সম্মুখের দৃশ্য।
হুট করেই সে খেয়াল করে আবেগ হারিকেন হাতে কোথাও এগিয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সে এতো রাত্রিতে! প্রশ্নটা মাথায় আসতেই সে নিজেও বাড়ি থেকে বের হয়। লুকিয়ে পিছু নেয় আবেগের।
কয়েক মিনিট হাঁটার পর ছোটো একটি কাঠের ঘরে প্রবেশ করে যুবক। সামায়া কৌতূহল নিয়ে বারান্দার ফাঁকে চোখ রাখে, যা দেখতে পায় তাতে রুহু কেঁপে উঠে তার।
চলবে…
৩|
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=340572541404172&id=100063542867943