অরণ্যবহ্নি পর্ব-৩

0
834

#অরণ্যবহ্নি
||৩য় পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
একজন অচেতন অর্ধ নগ্ন নারী শায়িত শয্যায়। আবেগ হিংস্র দৃষ্টিতে দুই হাতে নারীটির বাহু আঁকড়ে দানবীয় শক্তির সহিত টান দেয় দুই বাহু, কয়েক মুহূর্তেই হাত দুটি আলাদা হয়ে দেহ থেকে ছিটকে রক্তের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। আবেগ গর্জন করে উঠে, তার মুখশ্রী অস্বাভাবিক ভাবে মুচড়াতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার দু’ঠোঁটের ফাঁক চিড়ে বের হয় এক ভয়ঙ্কর মুখ।

এতোটা ভয়ঙ্কর কিছু নিজের জীবনে তো দূরে থাকুক, কল্পনায়ও কখনও আঁকেনি সামায়া। কালচে জ্বলন্ত এক মুখ, তাতে যেন ভাসছে আগ্নেয়গিরি, যেন কয়লাতে জ্বলছে আগুন। কপালে একটি মাত্র চোখ যাতে নেই কোনো মণি, ঠোঁট নেই, নেই নাক, না আছে কোনো কান। একটু বাদেই ঐ ভয়ংকর জন্তুটি মুখ খোলে, প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা বেলুনাকার জিহ্বা এগিয়ে যায় শায়িতা নারীটির দিকে। জিহ্বাটি হয়তো রক্ত শোষণক্ষম, কারণ রক্তশূণ্য হয়ে পড়তে শুরু করে নারীটির দেহ।

আর সহ্য করতে পারে না সামায়া। চিৎকার করে উঠে। সাথে সাথে আবেগ সহ ঐ বীভৎস মুখটি তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে হলো তার কাঁধের চামড়া ভেদ করে সূচালো কিছু ঢুকছে, চোখের সম্মুখে আঁধার নেমে আসলো সঙ্গে সঙ্গেই।

___

“কী গো দিদিমণি! আর কতো ঘুমাইবেন! উঠেন এখন, কতো বেলা হইলো!”

শকুন্তলা দেবীর জোর গলায় ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে সামায়ার। পিটপিট করে চোখ খুলতেই মাথা ভার অনুভব হয়, ধীরে ধীরে মনে পড়ে যায় গত রাত্রির ভয়ঙ্করতম দৃশ্য।

“আম্মু!” চিৎকার করে উঠে সে ভয়ে। তার চেঁচানোতে মিহিরুন্নিসা বানু ও আবেগ উভয়ই দৌড়ে তার কামরায় আসে।

“কী হয়েছে মায়াবালিকা? চেঁচাচ্ছিস ক্যানো?”

যুবক তার দিকে এগিয়ে এলে ভীতচিত্তে পিছিয়ে যায় সে। জড়সড় হয়ে নত চোখে শুধায়,

“প্লিজ আপনি আমার কাছে আসবেন না। আমাকে মারবেন না প্লিজ।”

মিহিরুন্নিসা বানু আবেগকে ইশারায় থামতে জানিয়ে তার অতি প্রিয় আমানতের কাছে যেয়ে বসে। আবেগ নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।

দিদা আলতো হাতে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে রে বুড়িমা? এমন করছিস ক্যানো? বাজে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিস না কি?”

সামায়া ভয়ে ভয়ে এক পলক আতঙ্কদায়ক পুরুষটির দিকে দৃষ্টি ফেলে, পুনরায় সেই ভয়ানক দৃশ্য মনে পড়ে যায় তার যখন পুরুষটির মুখগহ্বর চিড়ে বেরিয়ে আসছিল সেই দানব। অতিরিক্ত ভয়ে দিদাকে ঝাপটে ধরে সে, মৃদু কণ্ঠে খুলে বলে তার গতকাল রাতে দেখা দৃশ্য।

দিদা মুচকি হাসে। খাণিক রহস্য করে বলে,
“এতো রাত জাগতে নেই বুড়িমা। রাত যতো গভীর হয়, অন্ধকার জগৎ ততো খোলাখুলি বেড়িয়ে আসে। আর ওসব কিছু না। গতকাল একটু ভয়ে নিয়ে হয়তো ঘুমিয়েছিলে, তাই বাজে স্বপ্ন দেখেছো। তুমিই বলো এসব কী আদৌ সম্ভব? এ যুগের মেয়ে হয়ে এমনটা নিশ্চয়ই তোমার ভাবনা নয়”

রমণীর নিকট এই বৃদ্ধার কথাগুলো কেমন যেন ধাঁধাময় লাগছে। তবুও একটা কথা তো যথাযথই, সে যা দেখেছে তা বাস্তবিকপক্ষে ঠিক যায় না।

“হু” বোধক শব্দ নির্গত হয় তার মুখ হতে। দিদা আদুরে ভঙ্গিতে সামায়ার ললাটে চুমু খান।

“যাও প্রিন্সেস, তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। শকুন্তলা আজ তোমার সব পছন্দের নাস্তা তৈরি করেছে। ঝাল ঝাল পুলি পিঠে, দুধপুলি, লুচি আর গোশতো ভুনা। ফ্রেশ হতে যাও।”

কনফিউজ ভঙ্গিমা সামায়া উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। শকুন্তলা দেবী আরও কিছুক্ষণ পূর্বেই কামরা ত্যাগ করেছেন। এবার আবেগ এবং মিহিরুন্নিসা বানুও একই সঙ্গে কামরার বাহিরে পা বাড়ায়।

“সামু খুব ভয় পেয়েছে দিদা কাল রাত্রিতে।”

“ঐটা শুধুই একটা দুঃস্বপ্ন আবেগ। শুধুই দুঃস্বপ্ন! তুমি যতো দূরে থাকবে সামায়ার থেকে ততোই ভালো। সামায়া আমার কাছে রাখা হানিফের আমানত, তার গায়ে সামান্যতম মলিনতাও আমার নিকট পাহাড় সম।”

কোনো এক অজ্ঞাত কারণ বশত আবেগ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়,
“জী, দিদা। আমি বুঝতে পেরেছি।”

___

কাঠফাটা রোদ্দুর, সামায়া শকুন্তলা দেবীর পালকপুত্র দশ বছরের বাবাইয়ের সাথে মাতব্বর বাড়ির বাহিরে বেড় হয়েছে। যদিও দিদাকে বলে এসেছে ঘুরতে যাবার কথা, তবে বের হয়েছে অন্য উদ্দেশ্যে। ঐ কাঠের এক কামরার ঘরটির সন্ধানে।

মাতব্বর বাড়িটি আরশিনগরের বিলের অপরপাশে বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃর্ণ। ঢাকা শহরে গাজীপুরের দিকের রিসোর্টগুলো যে আকারের হয় এই বাড়িটিও প্রায় ততোটুকু জমি জুড়ে। আবেগের দাদা তথা বখতিয়ার সাখাওয়াত গাছ-গাছালির অনেক সৌখিন ছিল, বাড়িটার গোটা আশপাশ তাই বানিয়েছেন জঙ্গলের মতোন।

রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখায় পথ চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তবে অবশেষে সঠিক পথেই হাঁটতে শুরু করে সে।

বাবাই বাঁধা দিয়ে বলে উঠে,
“না, না, দিদি। ঐদিকে যাওয়া যাইবো না। মেমসাহেবের মানা আছে। মাও বলসে ঐদিকে বিশাল বড়ো এক দানব থাকে।”

এবার সন্দেহ যেন আরও প্রখর হয় সামায়ার, সাথে ভয়ও লাগতে শুরু করে। আর তবুও মুখশ্রীতে চিন্তার রেশ মাত্র আনতে দেয় না।

“আরে পিচ্চু, তোর মা আর দিদা তো এমনি এমনি বলসে তোকে ভয় দেখাইতে। আর দিদি আছি না? ভয় পাস না।”

বাবাইয়ের ছোট্ট হাত খানা শক্ত করে ধরে ঐ মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে সে। কয়েক মুহূর্ত বাদেই স্থানটিতে পৌঁছে যায়। জুঁই ফুলের ঘ্রাণে নিশ্চিত হয় সে, কারণ গতকাল রাতেও ঐ ঘরের সামনে একই রকম ঘ্রাণ পেয়েছিল সে। তবে স্থানটি পেলেও কাঠের ঘরের কোনো হদিস নেই। বরং গুটি কয়েক ভাঙা কাঠ পড়ে আছে শুধু।

সবকিছুই কেমন যেন ঘোলাটে লাগতে শুরু করেছে এবার তার নিকট। স্বপ্ন অথচ স্থানটি সত্য এবং স্থানটি আছে অথচ ঘরটি নেই। কী অদ্ভুতুড়ে সবকিছু! আবার এই কাঠের টুকরোগুলোই বা এখানে কী করে? মনে তো হয় না এখানে কেউ আসে।

“কী রে! এখানে কী করিস তুই মায়াবালিকা?”

অনেকটা কাছে এসে অতি পরিচিত কেউ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠে। এতোটা কাছে সে যে, লোকটির রমণীর নিঃশ্বাস ঘাড়ে এসে ঠেকছে।

কেঁপে উঠে এক হাত দূরত্বে চলে যায় সামায়া। আবেগকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে সে বারবার, গতকাল রাত্রির ঐ বিষয়টির পর কিছুতেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না এই যুবকটিকে। শুকনো ঢোক গিলে সে।

“আপনি! আপনি এখানে কী করছেন? আর বাবাই কোথায়?”

“ও আমাকে দেখে চলে গিয়েছে। আর এটা আমার বাসা। আমি যেখানে খুশি সেখানে যেতেই পারি। তোকে জবাব দিতে বাধ্য নই। কিন্তু তুই কি আমাকে ভয় পাচ্ছিস? এই না গতকাল বললি তুই আমার স্ত্রী। অধিকার দেখাবি। আর এখন এই অবস্থা! ভীতুর ডিম যত্তসব!”

হা হা করে হেসে উঠে আবেগ। সামায়ার রাগ উঠে যায়। ভয় যেন ঘুচেছে মানুষটির বাঁকা কথায়।

ঝটপট কাছে চলে আসে সামায়া প্রিয় পুরুষটির। আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে উঠে,

“দেখেন আবেগ ভাই, আমি একদমই ভীতুর ডিম না। তাই ভুলেও এসব আজগুবি নামে ডাকবেন না। আর আমি আপনার আইনত, ধর্মীয়, সামাজিক স্বীকৃতি প্রাপ্ত বউ। আপনি বাধ্য আমাকে জবাব দিতে।”

“ভালোবাসার অপর নাম না কি আলো হয়, তবে তোর আর আমার মাঝের ভালোবাসার আরেক নাম আঁধার। এই আঁধারে ডুবিস না। ছটফট করবি একটু মৃত্যু পেতে।”

“তবুও আমার আপনাকেই চাই। আমি না হয় যে আঁধার আপনাকে ছটফট করায় অরণ্যবহ্নি হয় ধ্বংস করে দিব সে আঁধার।”

“ধুর! এসব খামখেয়ালিপনা করিস না তো। আমি মানি না এসব বিয়ে-টিয়ে। ভালো হবে তুইও তেমন ভাব।”

“ঠিক আছে। অবশ্য ভালোই হয়েছে বিয়েটা হয়ে। এতোকাল বাবা, ভাইয়দের অধীনে থেকে ছাব্বিশ বছরে জীবনে একবার প্রেমের স্বাদও নেওয়া হয়নি। এই তিনমাস চুটিয়ে প্রেম করবো।”

“তা ম্যাম, এই মফস্বলে কোথায় পাবেন আপনি সেই বনমানুষ? কারণ শহরে তো আপনি এর মধ্যে যেতে পারছেন না।”

“আজকাল ইন্টারনেটের যুগ, সামনা-সামনি দেখা লাগে? প্রেমই তো করবো, বিয়ে তো আর না। কতো ডেটিং এ্যাপ আছে। চ্যাটিং, অনলাইড ডেট, ভিডিও কল, অডি কল। সকালে রোমান্টিক গল্প-কবিতার আদান-প্রদান হবে, রাতে…”

আর বলতে পারে না তার পূর্বেই আবদ্ধ হয় মানুষটির শক্ত বন্ধনে। তবুও আফসোসের রেশ মাত্র নেই চোখে। বরং চওড়া এক দুষ্টু হাসি।

আবেগ হিসহিসিয়ে বলে,
“তোর লজ্জা করে না আমার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলতে! এতো চরিত্র নিচে নেমেছো, ভালোই তো উন্নতি হয়েছে সাত বছর তিন মাস পনেরো দিনে।”

সামায়া খিলখিল করে হেসে উঠে। মুখ বাড়িয়ে আলতো করে কামড় দেয় পুরুষটির চিবুকে।

“ইশ! নাকটা কেমন লালচে হয়েছে! এত্তো জ্বলে ক্যানো? বউ না মানেন না আবেগ ভাই? কী যেন গানটা ছিল! আমি কারো হলে তোমার ক্যানো জ্বলে বন্ধু! তোমার ক্যানো জ্বলে!”

“পাগল কোথাকার!” বিড়বিড়িয়ে তাকে ছেড়ে হনহন করে চলে যায় আবেগ। রমণীর হৃদয়ে শীতলতা বয়ে গিয়েছে, আজ লোকটাকে খুব করে শায়েস্তা করতে পেরেছে বলে কথা।

___

“আসসালামু আলাইকুম। চাচীমা কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম হানিফ। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তুই কেমন আছিস?”

মিহিরুন্নিসা বানু হাসি মুখে কুশল বিনিময় করে। তবে ফোনের অপরপাশে থাকা হানিফ সাহেব চিন্তিত।

“মেয়েকে নিজ হাতে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে এসে আমি কী করে ঠিক থাকতে পারি চাচীমা? আমার একটা মাত্র মেয়ে চাচীমা, একটু সামলে রেখেন। আপনার ভরসায় দিয়ে এসেছি।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন বৃদ্ধা। তিনি নাখুশ নয়, ছেলেটা মাটির মানুষ, তাঁকে মায়ের মতো সম্মান দেন আর ঋণী বলেই জেনে-শুনে এই বিপদে রেখে গিয়েছেন। নাহলে কখনোই রাজি হতেন না।

“তুই চিন্তা করিস না হানিফ। আমি আবেগ থেকে বুড়িমাকে দূরত্বে রাখি। ওর উপর কোনো আঘাত তো দূরে থাক, দাগও আমি লাগতে দিব না। আমি স্বার্থপরের মতো কাজ করেছি ঠিকই, তবে এতোটাও স্বার্থপর নই যে তোর হতে তোর কন্যাকে ছিনিয়ে নিব।”

“আপনার উপর ভরসা আছে বলেই নিজের জান আপনার হাতে দিয়ে এসেছি চাচীমা।”

সামায়া দিদার কাছে এসেছিল মাথায় তেল দিতে। দরজার বাহির হতে দিদার কথাবার্তা শুনে সে চিন্তিত, কোনো গভীর রহস্য তো আছে। যা সে না জানলেও তার প্রিয় তিনটি মানুষই জ্ঞাত।
৪ও৫|
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=342040057924087&id=100063542867943
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here