#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ১৬)
#নাহার
·
·
·
চোখে মুখে শয়তানি হাসি নিয়ে রাফিনের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিরা। এক হাতে মোমবাতির মতো বাজি নিয়ে অন্য হাতে ম্যাচ বক্স নিয়ে দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর বাজিতে আগুন ধরিয়ে দরজার নিচ দিয়ে দুই আঙুলে টোকা দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলো। দরজার থেকে একটু দূড়ে এসে দাঁড়ায় নিরা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাজি ফুটে। নিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। মিনিট কয়েক পর রাফিন বেরিয়ে আসে রুম থেকে। চোখে মুখে রাগ। নিরা রাফিনকে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে এক দৌড়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়।
রাফিনও দৌড়ে আসে। দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে,
— নিরা দরজা খুলো বলছি। এসব কোন ধরনের ফাইজলামি শুরু করেছো তুমি? নিরা দরজা খুলো।
খুব রেগে বললো। নিরা রুমে এসে সটান হয়ে বেডে শুয়ে পড়লো৷ ঠোটে বিশ্ব জয়ের হাসি।মনে মনে বললো,
— হাহা! আজকে দরজায় বসে কান্নাকাটি করলেও দরজা খুলবো না মিস্টার রাফিন। এতোদিন আপনি ভাব দেখিয়েছেন আজ আমি দেখাবো। হিহি।
নিরা কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। এদিকে কৌশিক আর কাশফি এসে জিজ্ঞেস করে রাফিনকে,
— কি হিয়েছে?
— এতো রাইতে তোর তার ছিড়া বইন আমার রুমে বাজি ফুটাইছে। কেমনডা লাগে?
কাশফি এবং কৌশিক হাসতে হাসতে বললো,
— বাহ বেশ ভালো তো।
— কোন দিক দিয়ে ভালো? কিভাবে ভয় পাইছি জানিস?
— আচ্ছা যা ঘুমা।
কৌশিক কানে কানে রাফিনকে বললো,
— আর এভোয়েড করিস না। দেখতেছিস কি করতেছে আমার বোন তোর প্রেমে দেওয়ানা হয়ে।
দুইজনে হেসে দেয়। রাফিন রুমে এসে মুচকি হেসে শুয়ে পড়ে৷
সকালে নিরা নাস্তা খাওয়ার আগে কয়ক দফা বকা খেয়েছে রাফিনের কাছ থেকে। নিরা রাগে ফুসছে। রাফিন নিরাকে বকে নিরার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিরা প্রতিশোধ নিতে রাফিনের পিঠে জোরে খামছি দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।
——————————————————————————–
সন্ধ্যায় নিরা, ফাতেমা, ফাহিম, ফায়াজ এবং নাঈম পাঁচ জন মিলে একটা গেইম খেলছে। গেইমটা হলো নিচ তলা থেকে তিন তলায় সিড়ি বেয়ে কে কার আগে উপরে উঠতে পারে।
প্রথমে ফাতেমা এবং ফাহিম এর টার্ন ছিলো। তাদের গেইম -এ প্রথম হয় ফাহিম। এদিকে ফাতেমা মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাঈম কাউন্ট করছে৷ এবার নিরা এবং ফায়াজের টার্ন। তারা একবার উঠে নেমে আসে। পরের বারে ফায়াজ আগে উঠে যাচ্ছিলো তাই নিরা ফায়াজকে টান দিয়ে দুই সিড়ি নিচে নিয়ে আসে এবং নিরা আগে আগে উঠে আসে। তিন তলায় উঠার আর তিন সিড়ি বাকি ছিলো। নিরা তিন নাম্বার সিড়িতে বাম পা দিয়ে দুই নাম্বার সিড়িতে ডান পা দিয়ে উঠতে গিয়ে ডান পা দুই নাম্বার সিড়ির মাঝ বরাবর লেগে ধপাস করে সিড়িতেই পড়ে যায়।
শীতকালে হালকাভাবে শরীরের কোথাও বারি লাগলে প্রচন্ড ব্যাথা হয়৷ আর নিরা তো সিড়িতে পরে হাতের কনুই, হাটু, পায়ের আঙুল ছিলে ফেলেছে। ব্যাথায় কুকিয়ে যায়। চুলে খোপা খুলে বারবার হাতের নিচে পড়ে চুলে টান পড়ছে। নিরা পেছনে ফিরে ফায়াজকে বলে সাহায্য করতে কিন্তু ফায়াজ তাড়াতাড়ি দৌড়ে নিচে চলে যায়। ব্যাথায় নিরার চোখে পানি চলে আসে। রাগে ফায়াজকে বকতে থাকে,
— ফায়াজের বাচ্চা তুই আমাকে এভাবে এখানে ফেলে চলে গেলি কেন? তোরে আমি পরে পাবো না? দেখিস কি করি। চুল টেনে ছিড়ে ফেলবো। নাকে মরিচ ঢুকিয়ে দেবো। হাতে মেহেদি লাগিয়ে পেটে ঢিসুম ঢিসুম দিবো। দেখিস তুই। আহ্! আম্মু।
নিরা রেলিং ধরে উঠতে গিয়ে আবার সিড়িতে বসে পড়ে। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে দুইটা পা। মাথা উপরে তুলে দেখে রাফিন দাঁড়িয়ে। চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাত বুকে ভাজ করে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিরার দিকে।
নিরা হিহি করে হেসে উঠতে গিয়ে দুই সিড়ি গড়িয়ে পড়ে যায়৷ রাফিন নিরার সামনে এসে কোলে তুলে রুমে নিয়ে বেডে বসিয়ে দেয়৷ রাগে রাফিনের গা রিঁ রিঁ করছে।
নিরা সিড়িতে পড়ে গিয়েছে সেটার জন্য রাগ নয়৷ উহু! এই রাগ গত ২ মাসের জমানো রাগ। যা আজকে ঢালবে নিরার উপর। এতোদিন সুযোগ খুজেছে কিন্তু পায়নি। আজকে পেয়েছে। নিরা ভয়ে কাচুমাচু করছে৷ এই বুঝি তাকে গিলে ফেলবে রাফিন। নিরা মনে মনে বলছে,
— জান নিয়ে পালা নিরা। এই ডাক্তার সাহেব আজকে তোর সার্জারী করে দিবে।
নিরা দেখলো রাফিন কাবার্ডে কি যেনো খুজছে। নিরা আস্তে করে উঠে চলে যেতে চায়। দুই কদম এগোতেই রাফিনের কণ্ঠ শুনে বুকে ধুকপুক শুরু হয়। রাফিন নিরার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাফিনের ডান হাত পরে নিরার বাম গালে। নিরা গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাফিন নিরাকে বললো,
— তোর সাহস তো কম না আমার মানা করার শর্তেও রুম থেকে বের হস৷ এই তোর এতো সাহস আসে কই থেকে? হুম বল?
রাফিনের মুখে “তুই” শুনে স্তব্ধ নিরা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে৷ রাফিন আবার বললো,
— খুব বড় হয়ে গেছিস? হুম! খুব বড় বড় সিন্ধান্ত নিতে শিখে গেছিস। সিন্ধান্ত নিতে শিখে গেলে আমার কাছে আসার কি দরকার?
রাফিন ধাক্কা দিয়ে নিরাকে বিছানায় বসায়। জোড় করে পা টেনে তুলে সেভলন লাগাতেই নিরা আহ্ করে শব্দ করে। রাফিনের রাগ আরো বেড়ে গেছে। নিরাকে ঝাকিয়ে বললো,
— লাফালাফি করার সময় মনে ছিলো না পড়ে গিয়ে ব্যাথা পাবি। এই তোর মন থাকে কই? এতো উদাসীন কেন তুই? তুই কি আমাকে তোর চাকর ভাবোস? যখন ব্যাথা পাবি আমিই তোকে মলম লাগাবো? হ্যাঁ? চুপ করে আছিস কেনো? কথা বল।
খুব জোরে চিল্লিয়ে বললো। রাফিনের চিৎকারে নিরা কেঁপে উঠে। পাশের রুম থেকে কৌশিক দৌড়ে আসে। রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে আবার রুমে চলে যায়। এই মূহুর্তে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ তাদের সমস্যা নিজেরদেরই ঠিক করে নিতে হবে৷
নিরা মাথা নিচু করে শব্দ ছাড়াই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে। রাফিন নিরার ছিড়ে যাওয়া যায়গাগুলোতে সেভলন লাগিয়ে দেয়। রাফিন নিরার আরেকটু কাছে এসে বসে এক আঙুল দিয়ে থুতনি উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— এইসব লাফালাফি কেন করছিলে?
— খেলছিলাম।
— এটা কোন ধরনের খেলা?
— সরি। আপনাকে আর জ্বালাবো না। আপনি আমার সাথে কথা বলছিলেন না তাই এভাবে আপনাকে বিরক্ত করেছি। আপনি আমার সাথে কথা না বললে ভালো লাগে না তাই এমন করেছি। আর করবো না।
নিরা থেমে থেমে ফুপিয়ে কেঁদে কথা গুলো বললো। শেষের কথা শুনে রাফিন আবার ধমক দিয়ে বলে,
— এই তুই এতো বেশি বুঝিস কেন? থাপড়িয়ে দাত সব ফেলে দিবো। রাবিস।
নিরা এবার শব্দ করে কেঁদে বলে,
— আপনি আমাকে তুই করে বলেছেন?
রাফিনের রাগ এবার ঠান্ডা হয়ে গেলো। নিরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে আর রাফিন বসে বসে নিরার কান্না মাখা চেহারা দেখছে। নিরার নাক লাল হয়ে গেছে। চোখও লাল হয়ে গেছে৷ বাম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে বারবার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। নিরার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া দেখে একটা গানের কিছু লাইন আসলো মাথায়। আজ থাক গানের লাইন গুলো পড়ে শুনাবে নিরাকে। রাফিন শান্ত স্বরে বললো,
— খেয়েছো?
— এখন কেনো তুমি করে বলছেন? তুই করে বলেন। আপনার তো শান্তি লাগে আমাকে তুই করে বললে আর সবসময় ধমক দিলে৷
— রাফিন শান্ত চাহনিতে নিরাকে দেখছে। মনে মনে ভাবছে,
— মেয়েটা অভিমানও করতে পারে। বাহ ভালো তো। নাকটা টেনে দিতে ইচ্ছা করছে। নাহ থাক এখন নাক টেনে দিলে একটু বেশি হয়ে যাবে।
রাফিন নিরার সামনে এসে বসে। নিরার হাত টেনে ধরে বলে,
— উঠো খেতে চলো। শুধু আছাড় খেয়ে তো পেট ভরবে না। ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে নাও।
নিরা রাফিনকে ভেঙচি দিয়ে নিজে নিজে উঠে দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে হেটে নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মনে মনে বলে,
— ডাক্তার সাহেব আজকে আপনি আমাকে এভাবে বকলেন। ছাড়ছিনা আপনাকে। এটারও প্রতিশোধ নিবো। দেখে নিয়েন হুহ।
পরের দিন সকালে নিরা রাফিনের জন্য জুস নিয়ে এসেছে। রুমে এসে দেখলো রাফিন রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে আওয়াজ আসছে। নিরা মনে মনে বললো,
— তার মানে ডাক্তার সাহেব গোসল করছেন। হুম ভালো।
বেডের উপর দেখলো শার্ট রাখা। শার্ট দেখে নিরা বললো,
— সাদা শার্ট। আহ্! ডাক্তার সাহেব আপনি কি জানেন আপনাকে সাদা শার্টে কতটা সুন্দর লাগে?
নিরা জুসের গ্লাসটা নিয়ে নাচের তালে তালে শার্ট দেখছে আর মনে মনে ভাবছে সে রাফিনের সাথে নাচ করছে৷। নিরা একটু ঘুরতেই জুসের গ্লাস থেকে জুস গিয়ে পড়ে রাফিনের শার্টের উপর। নিরা ভয়ে এদিক সেদিক পায়চারি করছে। শার্টটা হাতে নিয়ে বললো,
— আজকে ডাক্তার সাহেব আমাকে কি করবে আল্লাহ মালুম। আম্মু কেন যে আমার সাথেই এমন হয়? দেখো আমি কি করেছি?
নিরা ভয়ে শার্টটা খাটের নিচে লুকিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসতে নিলেই তখন রাফিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়। নিরাকে এতো তাড়াতাড়ি চলে যেতে দেখে রাফিন পেছন থেকে ডাক দেয়,
— নিরা।
নিরা ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে। মুখে মিথ্যে হাসি নিয়ে বলে,
— আসলে আপনার জন্য জুস নিয়ে এসেছিলাম।
রাফিন সন্দেহের চোখে নিরার দিকে তাকায়। নিরা আবার বলে,
— আরে আমি না। আম্মু পাঠিয়েছে। আমার কোনো ইচ্ছা নেই আপনার রুমে আসার।
— আমার শার্ট কই?
— মমানে?
— তুমি আবার তোতলাচ্ছো কেন? কি করেছো?
— ককই কককিছু না।
— নিরা। ( ধমক দিয়ে)
নিরা ভয়ে কেঁপে উঠে। রাফিন বুঝে গেছে কিছু তো একটা করেছে এই মেয়ে। যার জন্য ভয় পাচ্ছে৷ রাফিন এদিক সেদিক খোজাখুজি করে দেখলো ওর শার্ট নেই। গ্লাসে জুসও নেই। রাফিন বললো,
— জুস এনেছিলে। এখন কই?
— আসলে আমি খেয়ে ফেলেছি।
— কেনো?
— গলা শুকিয়ে গেছিলো তাই।
— কি লুকাচ্ছো তুমি?
— ককই ককিছু না।
রাফিন বেডের নিচে দেখলো ওর শার্ট ওখানে পড়ে আছে। শার্টটা হাতে নিয়ে দেখলো জুসের দাগ। রাফিন রেগে নিরার সামনে আসে। নিরা চলে যেতে নিলে হাত চেপে ধরে বলে,
— শার্টে জুস কেন ফেলেছো?
— আমি ফেলিনি সত্যি।
— তুমি ছাড়া রুমে আর কেউ আসে নি। তো কে ফেলেছে?
— আমিই। না মানে…
রাফিন শার্টটা নিরার হাতে দিয়ে বলে,
— তুমি দাগ ফেলেছো এখন তুমি ধুয়ে দিবে।
নিরা অবাক হয়ে বললো,
— কি আমি?
— হ্যাঁ তুমি। অবাক হওয়ার কি আছে?
— আমি ধুতে পারবো না।
রাফিন রেগে গর্জে উঠে বললো,
— কি বললে?
— হ্যাঁ পারবো পারবো।
— গুড গার্ল। এটা ধুয়ে আমাকে দিবে কালকে।
— হুম।
নিরা চলে আসে। রাফিন হেসে বলে,
— বেচারি নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গেলো।
·
·
·
চলবে…………………..