হৃৎপিণ্ড_২ (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১

0
783

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে সোজা সায়রীর স্কুলে চলে যায় মুসকান৷ সায়রীর স্কুলে সামনে সপ্তাহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে৷ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই মুসকানের। তার মাথা ব্যথা হলো এই অনুষ্ঠানে যেসব মেয়েরা নৃত্য পরিদর্শন করবে তাদের নিয়ে। এর পিছনে কারণ হলো যারা নৃত্য পরিদর্শন করবে তাদের নৃত্য শিক্ষিকাদের মধ্যে যে ক’জন রয়েছে তাদের মধ্যে সে নিজেও একজন। তাই এ বিষয়ে তার প্রচুর মাথা ব্যথা। স্কুলে থাকাকালীন প্রতি সপ্তাহে একদিন করে নৃত্য শিখতো মুসকান৷ ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি তার ভীষণ ঝোঁক। সে ঝোঁক থেকেই আজ সে বিশ্বাস করে “Dance is a great way to relax our mind”।
কলেজে ওঠার পরও নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে একদিন স্কুলে এসেছে সে। নাচের প্রতি প্রগাঢ় টান অনুভব করে বলেই স্কুলের সকল টিচার্স এবং স্টুডেন্টস’দের মধ্যে আলাদা এক সম্পর্ক তৈরী হয় তার৷ এক পর্যায়ে নৃত্য উপদেষ্টা মুসকানের নৃত্য দেখে এমন মুগ্ধ হলো যে একদিন আবদার করে বসলো স্টুডেন্ট হিসেবে নয় বরং টিচার হিসেবে তার সাথে প্রতি সপ্তাহে একদিন স্কুলে সময় দিতে। যেহেতু সায়রী এই স্কুলেরই শিক্ষিকা তাই মুসকান বা তার পরিবারের কারো এ বিষয়ে আপত্তি ছিলো না। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখে মুসকান। সেসব মাধ্যমের একটি মাধ্যম হলো এই ডান্স।
.
স্কুলের দক্ষিণ পাশের কর্ণারের ক্লাসরুমেই নৃত্য পরিচর্যা করছে ছাত্র-ছাত্রীরা। মুসকান প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে তাদের নৃত্য পরিচর্যা দেখছে। এমন সময় সায়রী ক্লাসরুমের সামনে গিয়ে ভিতরের দিকে উঁকি দিলো। খয়েরি রঙের সূতি গাউন পরিহিত মুসকান স্টুডেন্টসদের সম্মুখীন হয়ে বিমর্ষ মনে বসে আছে। খয়েরি রঙের জর্জেট ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া থাকলেও কেশবতী কন্যার বিনানো কেশ ডান কাঁধের সামনে পড়ে কোল অবদি ছুঁয়ে আছে। ডাগর ডাগর আঁখিদ্বয় দ্বারা পলকহীন তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কাঁধ ব্যাগটি কোলের ওপর রেখে দু’হাতের আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে অদ্ভুত এক ভণিতায় বসে আছে মেয়েটি। সদ্য আঠারোতে পা দেওয়া এই তরুণী’কে দেখলে ভারী অবাক লাগে সায়রীর৷ পনেরো বছয় বয়সী এক কিশোরীর আচমকাই পরিণত নারী হয়ে ওঠার গল্পটি সবার কাছে অতি সাধারণ হলেও তার কাছে আশ্চর্য রকমের অসাধারণ লাগে। আচমকাই যেনো বিলীন হয়ে গেলো তাদের সকলের ছোট্ট আদরের মুসুপাখি।মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ছোট্ট এই কিশোরীর সকল চাঞ্চল্যতা যেনো গ্রাস করে নিলো প্রকৃতি। সত্যি প্রকৃতি? নাকি প্রকৃতি’তে বিরাজ করা কোন এক হৃদয়হীন মানবরাজ ? হ্যাঁ মুসকানের ভাষায় মানুষ’টা আজ তার কাছে হৃদয়হীন। ছোট্ট একটি প্রাণ, কোমল এক হৃদয়ে আঘাত কেবল এক হৃদয়হীন দ্বারাই সম্ভব। সে হৃদয়হীন পুরুষ’টি যে খুব শিঘ্রই আসছে। সে খবর কি সামনের এই বিমর্ষমুখীনি জানে?

“মুসু” বলেই ডাকতেই ডান দিকে তাকালো মুসকান। সায়রী’কে দেখে মিষ্টি এক হাসি আঁকলো ওষ্ঠকোণে।সায়রীও মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করলো,

“আসতে পারি ম্যাম?”

সায়রী’কে দেখে ছাত্র-ছাত্রী’রা তাকে সালাম দিয়ে আবারো নাচে মনোযোগ দিলো। সায়রী সালাম ফিরিয়ে মুসকানের দিকে হাসি হাসি মুখে চেয়ে রইলো। বসা থেকে অত্যন্ত নমনীয় ভঙ্গিতে ওঠে দাঁড়ালো মুসকান। মুখশ্রী’তে কিঞ্চিৎ অভিমান ফুটিয়ে তুলে দরজা অবদি এগিয়ে গিয়ে বললো,

“তুমি এমন কেন? স্কুল তোমার স্টুডেন্টস তোমার বোনটাও তোমারি। তাহলে ক্লাসে ঢুকতে অনুমতি কেন চাইছো? ”

ভিতরে ঢুকে মুসকানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সায়রী। বললো,

“আহারে পাগলী’টা অভিমান করছে! অভিমান করতে হবে না এইতো ঢুকে গেছি। ক্লাস করাচ্ছিস অনুমতি না নিয়ে হুটহাট ঢুকে পড়া মন্দ দেখায়। হাজার হোক এ’স্কুলের শিক্ষিকা আমি তোর আমার সম্পর্ক যাইহোক স্টুডেন্টসদের সামনে এটুকু ম্যানার্স দেখাতেই হয়’রে। ”

“তুমি আবার আমায় পাগলী বলছো আপু।”

মুখশ্রী’তে দৃঢ়তা বজায় রেখে প্রশ্ন করলো মুসকান৷ সায়রী জিব কেটে বললো,

“সরি সরি বনু। তা আবির স্যার’কে দেখছিনা যে কোথায় ওনি? ”

“স্যারের মা অসুস্থ তাই আসতে পারেনি। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে আমায়। ”

“ভালোই হয়েছে স্যারের তোকে পেয়ে তাইনা। হুটহাট যে কোন সমস্যায় তোর ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। প্রতি সপ্তাহে একটা দিন আসতে হয় তবুও ওনার শুধু সমস্যা আর সমস্যা। বেলী ম্যাডামের বিয়ে হওয়ার পর কাজটা ছেড়ে দিলো আর তোর ওপর সব চাপ আসলো তাইনা?”

মুসকান ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললো আজ এ পর্যন্তই। আজ সোমবার সামনে সপ্তাহের শনিবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাই শুক্রবার বিকেল চারটায় এক ঘন্টা নৃত্য পরিচর্যা করতে হবে বলেই স্টুডেন্টসদের থেকে বিদায় নিয়ে সায়রীকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জন। সামনের মোড় থেকেই রিকশা নেবে। সায়রী আবির স্যার’কে কিছু গালি দিচ্ছে। কারণ সে প্রায় সব সময়ই মুসকানের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিজে গা বাঁচিয়ে চলে। সায়রী’কে থামাতে মুসকান বললো,

“ছাড়োনা আপু ওনার মা অসুস্থ। এটা জানার পর মানবিকতা দেখিয়েই এই অল্পস্বল্প দায়িত্ব আমি পালন করি। ভালোই লাগে আমার। ”

“হুম বুঝলাম তা ইরা আন্টি যে গত কয়েকমাস ধরে এতো অসুস্থ তার প্রতি একটু মানবিকতা কি দেখাতে পারিস না? ”

“তারা বড়োলোক মানুষ অসুস্থ হলে হাজারটা কাজের লোক থাকে তাদের সেবা যত্ন করার। তাছাড়া তাদের আত্মীয় স্বজনের অভাব নাকি? শুধু শুধু আগবাড়িয়ে আমি কেন যাব? ”

“আগবাড়িয়ে না মুসু ইরা আন্টি তোর সাথে অসংখ্যবার দেখা করতে চেয়েছে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আরো বেশী দেখা করতে চায়। তুই একটাবার অন্তত যেতে পারতিস? ”

নিশ্চুপ হয়ে গেলো মুসকান। সামনে রিকশা পেতেই চুপচাপ রিকশায় ওঠে বসলো। সায়রী তার পাশে বসে রিকশাওয়ালাকে হুডি তুলে দিতে বলে মুসকানের দিকে তাকালো। বললো,

” আর মাত্র চারটা দিন মুসু ইমন ফিরছে। তোর সব অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে এবার অন্তত একটা বার দেখা করে আয় ইরা আন্টির সাথে। ”

তাচ্ছিল্য সহকারে হাসলো মুসকান। রিকশা চলছে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাস্তার ধারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। এক ঢোক গিলে অদ্ভুত স্বরে বলে ওঠলো,

” অপেক্ষা শব্দ’টি ভীষণ মিষ্টি,ভীষণ সুন্দর। অপেক্ষা শব্দ’টায় মিশে থাকে অজস্র অনুভূতি। আর এই অনুভূতি’টা ভীষণ দামীও। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকার বিনিময়েও এই অনুভূতি’কে জব্দ করা যায় না। আমার এই অনুভূতি এতোটা সস্তা নয় আপু। আমার আত্মমর্যাদা সম্পর্কে হয়তো এখনো তোমরা জ্ঞাত হওনি। আমার ব্যক্তিত্ব এতোটা সস্তা নয় যে ইমন চৌধুরীর জন্য অপেক্ষায় থাকবো!”
______________________

রাত প্রায় দু’টো ছুঁই ছুঁই দশটা থেকে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে মুসকান। তবুও ঘুম তার চোখে ধরা দেয়নি৷ যতো দিন এগোচ্ছে পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনটা বছর যাবৎ একটু একটু করে নিজেকে তৈরী করেছে মুসকান৷ অথচ মাত্র দু’দিনেই তার সমস্ত মনোবল প্রায় ভেঙে চুরমারই হয়ে গেছে। দু’দিন হয়ে এলো হৃদয় নামক স্থানটি বড্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। স্নায়ুবিক অবস্থা প্রচন্ড রকমের খারাপ আছে। বক্ষঃস্থলের ভিতরে হৃৎপিণ্ড নামক যে জিনিসটি রয়েছে সেটিতে পচন ধরেছে তিন বছর আগেই৷ এখন বুঝি পচা আবর্জনার মতোনই হৃৎপিণ্ড টুকু বের করে ডাস্টবিনে ফেলার সময় হয়ে এলো। বড্ড অশান্তি করছে হৃৎপিণ্ড নামক এই আবর্জনা’টা। শোয়া থেকে ওঠে বসলো মুসকান। এক ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে বার কয়েক শ্বাস ছাড়লো। তারপর নিজ বক্ষঃস্থলের বাম পাশে তাকিয়ে ডানহাতটা চেপে ধরলো বক্ষে। আমাদের হৃদ্‌যন্ত্র একটি নির্দিষ্ট ছন্দে স্পন্দিত হয়। এর নাম হার্ট বিট বা হৃৎস্পন্দন। একজন সুস্থ মানুষের মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বার হার্ট বিট হয়। কিন্তু মুসকান ফিল করছে তার হার্ট মিনিটে ১০০ নয় বরং হাজার বার বিট হচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন তার। তার কি হৃদরোগ হলো? হৃদরোগ হয় কি করে ফুলে পচন ধরলে সে ফুল কি সুভাস ছড়ায়? ছড়ান না তো। তবে দুর্গন্ধ ছড়ায়৷ তাহলে যে হৃদয়ে পচন ধরে সে হৃদয়ে আবার রোগ বাসা বাঁধে কি করে? নিশ্চিয়ই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে? কিন্তু সে কেনো পাচ্ছে না সে দুর্গন্ধ। তার ভিতরে সব দুর্গন্ধ গুমোট হয়েই কি এই অশান্তির সৃষ্টি করছে?

বক্ষঃস্থল থেকে হাত সরিয়ে বিছানা থেকে ওঠে সেন্টার টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ভরে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। ফোন কোথায় মনে হতেই বেজে ওঠলো ফোন৷ বুকের ভিতরটা কেমন ছেদ করে ওঠলো। ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসে বালিশের পাশ থেকে ফোন ওঠাতেই থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো হাত৷ এর কারণ একটাই নাম্বারটি বাংলাদেশী নয়। প্রায় ছুঁড়েই বিছানায় ফেললো ফোনটি৷ নিমিষেই চোখদুটো জলে ভরে ওঠলো। শুধু বক্ষঃস্থল নয় সারা অঙ্গেই অদ্ভুত ভাবে কম্পন ধরে গেলো তার। চোখ মুখ খিঁচে বসে দু’হাতে মুখ চেপে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। অভিমানের পাল্লা কতোখানি ভারী হয়েছে তা হয়তো মুসকান নিজেও জানে না৷ তবে জানে সে মানুষ’টি যাকে কেন্দ্র করে এই অভিমান৷ মুসকান হয়তো এটাও জানে না তিনটে বছরে ইমন চৌধুরী’কে ঠিক কত-শত আঘাত সে করেছে। আর মাত্র একটি দিন এবং একটি রাতের অপেক্ষা তারপর ইমন চৌধুরী পইপই করে সব হিসাব বরাবর করবে।

চলবে…
পই পই করে বলছি রিচেক দেইনি। আমার জন্য দোয়া করবেন সকলেই কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্ট পেয়ে গেছি। মহান আল্লাহ তায়ালার নাম করে যেনো ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারি। আর হ্যাঁ ইমন মুসকান নিয়ে অবশ্যই অনুভূতি জানাবেন সবাই। গল্পটি পুরোটাই আমার কল্পনা জগৎকে কেন্দ্র করে লেখা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here