হৃৎপিণ্ড_২ (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৭

0
436

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_ ৭
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
যে নারী সময়ে অসময়ে বারংবার একজন পুরুষের হৃৎপিণ্ডে মৃদু কম্পন ধরাতে ব্যস্ত থাকে সে নারী কি করে পারে সেই পুরুষটিকে প্রত্যাখ্যান করতে? প্রত্যাখ্যান করার আগে পুরুষটির হৃৎপিণ্ড নামক মাংসপিণ্ডটিকে দেহচ্যুত কেন করলো না? আপনমনে প্রশ্নগুলো করছে ইমন৷ এদিকে মুসকান বার বার আড়চোখে ইমনকে দেখছে আর ফোঁসছে। তার ধারণা ইমন তাকে ইগনোর করছে। এই যে সে শাড়ি পরে এতো সুন্দর করে সেজেছে। এসবের একটুও খেয়াল করেনি ইমন। অথচ এসবের পুরোটা খেয়াল করেই নিজের দৃষ্টিজোড়া কে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে ইমন। একবারের জন্যও যদি নিজের মন এবং চোখকে উৎসাহ দিয়ে ফেলে তাহলে পাশে থাকা ছোট্ট এই রমণীকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।

দশমিনিট পথের পাঁচ মিনিট অতিক্রম করেছে মাত্র। মুসকানের ভিতর উত্তেজনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তার অন্তরটা পুড়ে যাচ্ছে কেমন। হৃৎস্পন্দন ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। একপর্যায়ে নিজেকে দমিয়ে রাখার তীব্র চেষ্টায় মেতে ওঠলো। এক হাত দিয়ে অপর হাত মোচড়াতে শুরু করলো ক্রমাগত। একদিকে নিঃশ্বাসের ক্রমাগত ফোঁস ফোঁস অপরদিকে চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ। ইমন চৌধুরীর আর বুঝতে বাকি নেই তার হৃদয় হরণ কারিনীর অস্থিরতার কারণ এবং অস্থিরতার মাত্রা ঠিক কতোখানি গভীর। তাই মাঝরাস্তায় আচমকাই গাড়ির ব্রেক কষলো। আতঙ্কিত হয়ে কেঁপে ওঠলো মুসকান। ইমনের দিকে ভীতিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ইমনের শান্ত এবং শীতল দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো তার দৃষ্টিজোড়া। বক্ষঃস্পন্দন হয়ে গেলো এলোমেলো। দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই নত করে এলোমেলো শ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করতে থাকলো। ইমন তখনো স্থির, স্থির তার মাদকীয় চাহনীও। সে যে আঁটকে গেছে মুসকানের কৃষ্ণবর্ণী দৃষ্টিজোড়ায়, আঁটকে গেছে গাঢ় গোলাপি ওষ্ঠজোড়ার নিম্নস্থলে সন্তর্পণে ইশারাকৃত কৃষ্ণবর্ণ তিলকটাতে। আজ যেনো ইমনের চারপাশ কৃষ্ণবর্ণে মুখরিত হয়ে ওঠেছে। ঘড়ি ধরে প্রায় এক মিনিট নীরবতা পালন করে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো ইমন। মুসকানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের পিচ ঢালা রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এক ঢোক গিলে শুষ্ক গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” আমার এই একত্রিশ বছরের জীবনে একত্রিশেরও অধিক মেয়ের প্রপোজাল পেয়েছি। একসেপ্ট নয় বারংবার প্রত্যাখ্যান পেয়েছে তারা আমার থেকে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি না চাইতেই তাদের কতোখানি যন্ত্রণা দিয়েছি আমি। ”

অন্তস্তলে তীব্র কম্পন অনুভব করলো মুসকান। নত রাখা নির্মল দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই ক্রোধে পরিণত হলো। তিনটা বছর তাকে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা দিয়ে তাকে বোঝার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করলো না। অথচ তার দ্বারা প্রত্যাখ্যান হওয়া নারীদের বুঝে নিজেকে মহান পুরুষ প্রমাণ করতে চাইছে! তার এই মহান হওয়াটা কোনদিন সফল হতে দেবে না মুসকান। আর যাই হোক ইমন চৌধুরী মহান হতে পারেনা। ইমন চৌধুরী স্বার্থপর, হৃদয়হীন বই আর কিছু হতেই পারেনা৷ মুসকানের ক্রোধে জর্জরিত দৃষ্টিজোড়া দেখে ইমনের শীতল দৃষ্টিজোড়া দৃঢ় হতে থাকলো। দু’জনের নিঃশ্বাসের গতি যেনো ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সেই সাথে হচ্ছে একে অপরের নিঃশ্বাসে, নিঃশ্বাসে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকে স্থগিত করে মুসকান বললো,

“তিনটা বছর একটা মেয়েকে মৃত্যু সমান যন্ত্রণা দিয়ে আজ তুমি একত্রিশের অধিক মেয়ের যন্ত্রণার কথা ভাবছো? হাউ ফানি! ”

” বেশীই বড়ো হয়ে গেছিস তুই। প্রয়োজনের অধিক কিছুই ভালো নয় এক্সেস ইজ দ্যা ভেরী বেড। ”

” বড়ো ছিলাম না বলেই তো কিছু মানুষ সহজেই আঘাত করতে পেরেছে। বড়োর এতো কদর সত্যিই তখন বুঝতে পারিনি। এই পৃথিবীর মানুষ গুলোর কাছে, এই সমাজের কাছে অনুভূতির কোন মূল্য হয় না। যে জিনিসটাকে অধিক মূল্য দেওয়া প্রয়োজন তারা সে জিনিসটাকেই সবচেয়ে তুচ্ছ করে দেখে। ”

নির্লিপ্ত ভণিতায় মুসকানের যন্ত্রণাময় বাক্য গুলো শুনে অধৈর্য হয়ে পড়লো ইমন৷ অকস্মাৎ ভাবে মুসকানের দিকে ঝুঁকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” অনুভূতির মূল্য যদি নাই দিতাম আজ আমি এখানে তোর পাশে থাকতাম না। কোন এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে ওখানেই স্যাটেল হয়ে যেতাম! ”

আচমকাই এতো কাছে আসাতে মুসকানের হাত, পা কাঁপতে শুরু করলো। গলা শুখিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা। বুকের ভিতর হৃদস্পন্দনের ঢিপ ঢিপ শব্দ এবার ধড়াস ধড়াসে পরিণত হয়েছে। ইমনের দৃঢ় দৃষ্টিজোড়ায় নিজের দৃষ্টি রাখার সাহস হয়ে ওঠলোনা আর। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে থাকলো আর বললো,

” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে নানাভাই। ”

” হোক দেরি। কিসের কাজ তোর কি কাজ করিস কে বলেছে তোকে নৃত্যের মাস্টারনি হতে? আমি বলেছি কোন সাহসে তুই সারাদিন একা একা রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াস, কোন সাহসে তুই আজ এভাবে সেজেগুজে বেড়িয়েছিস উত্তর দে! ”

চিৎকার করে কথাগুলো বলতেই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকলো মুসকান। মুসকানের এহেন অবস্থা দেখে আবারো স্থির হয়ে গেলো ইমন। অস্ফুটে স্বরে ‘ওহ শীট’ বলেই এক হাতে মুসকানের কান সহ চোয়াল চেপে ধরলো। আরেকটু এগিয়ে মুসকানের কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক স্পর্শ করলো। চোখজোড়া বদ্ধ করে দু’হাতে শাড়ি খামচে ধরলো মুসকান। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করতেই ইমন শান্ত গলায় বললো,

” আমার মুগ্ধময়ী’কে এভাবে সবাই দেখুক তা আমি চাইনা। আজকের পর এভাবে কখনো বের হবি না মনে থাকবে? ”

উত্তর পেলো না ইমন৷ পাওয়ার কথাওনা। একদিকে এমন ধমক অপরদিকে এমন মোহনীয় স্পর্শের পাশাপাশি মোহনীয় বাক্য। মুসকানকে কুপোকাত করার জন্য এর বেশী কিছুর প্রয়োজন নেই ইমনের। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মুসকানের। ইমন ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে দু’হাতের বুড়ো আঙুলে অশ্রুজোড়া মুছে দিতে দিতে বললো,

” যে অপরাধ তুই করেছিস তার তুলনায় এই রিয়্যাক্টটা জাষ্ট সিম্পল। তাই কেঁদে ভাসিয়ে আমাকে শাস্তি দেওয়ার প্ল্যানটা না করলেই কি নয়? ”

দৃষ্টিজোড়া মেলে ধরলো মুসকান দু’চোখের কাজল লেপ্টে যাওয়ার অবস্থা তৎক্ষনাৎ ইমন সরে গিয়ে বললো,

” এতো কষ্ট করে সেজেছিস এসব করার জন্য? চুপ চুপ একদম চুপ ডোন্ট ক্রাই। ”

মুসকান নাক টানতে শুরু করলো। ইমনের থেকে চোখ ফিরিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ এবং নাক মুছে ঘুরে বসলো৷ ইমন নিজের মাথা হেলিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো,

” কিছু বলার আগেই কান্নাকাটি করলে তো মশকিল। বড়ো আর কই হলি মুসু? ”

ইমনের দিকে না ফিরেই ভেজা কন্ঠে মুসকান বললো,

” আমার ভালো লাগছেনা তোমার সঙ্গে থাকতে প্লিজ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসো নয়তো আমি বেরিয়ে যাবো”

” বাহ দারুণ থ্রেট। ”

কিছু বললো না মুসকান। ইমন ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটিয়েই বললো,

” পারফিউমের চেয়ে তোর চুলের ঘ্রাণটাই বেশী ফিল করছি। ”

বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো সেই সাথে লজ্জায় নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে ফেললো মুসকান। ইমন সেসবে নজর না দিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

” তুই কাল যা বলেছিস আর আজ যা করেছিস আমার কি হবে মুসু? আমি উদ্ধত আচরণ করতে চাইছিনা সমঝোতা চাইছি। ”

” আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে কিনা।”

” যদি বলি না? ”

” আমার দু’টো পা রয়েছে। ”

কথাটি বলেই গাড়ির ডোর খোলার জন্য উদ্যত হলো মুসকান৷ ইমন তৎপর হয়ে মুসকানের বাহু টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। কঠিন স্বরে বললো,

” আমার অনুমতি ব্যতিত এক পা’ও নড়বি না। ”

” আহ লাগছে আমার। ”

কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো মুসকান। ইমন আশ্চর্য হয়ে বললো,

” তোর জন্য এখন তুলো দিয়ে হাত বানিয়ে আনতে হবে! ”

বলেই হাত নরম করে দিয়ে মুসকানের অতি নিকটে এলো। তারপর লম্বা এক শ্বাস টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,

” বলিউডের রজনি কান্ত রোবট মুভিটা কেন বানিয়েছে জানিস? কারণ তিনি দেখাতে চেয়েছেন মেয়েরা শুধু পুরুষদের নয় মেশিনের মাথাও নষ্ট করতে পারে। ”

বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো করে তাকালো মুসকান। চোখ পিটপিট করে বললো,

” বাজে কথা। ”

ইমন হাসলো মুসকানের থেকে সরে গিয়ে বললো,

” উত্তম কথা। শোন আমাকে যে একত্রিশের ঊর্ধ্বে মেয়েরা প্রেম এবং বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচ জন আমাকে সুইসাইড করার থ্রেটও দিয়েছে। দু’জন সরাসরি ব্লেট এবং পয়জন নিয়েও ভয় দেখিয়েছে। তবুও আমি তাদের গ্রহণ করার কথা চিন্তাও করিনি। যারা আমাকে পাওয়ার জন্য সুইসাইড করতে চেয়েছে তাদের কথা যেমন আমি ভাবিনি তেমন যে আমাকে পেলে সুইসাইড করবে বলেছে তার কথাও আমি ভাববো না ? ”

” তার কথা কোন কালেই ভাবোনি।”

“সঠিক সময় বুঝতে পারবেন ম্যাডাম ভেবেছি কি ভাবিনি৷ ”

“মানে? ”

” মানেটা রজনি কান্তের সিনেমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। মাথা নষ্ট! ”

আঁতকে ওঠে ঘুরে বসলো মুসকান। নিঃশ্বাসে তার তীব্র অস্থিরতা। ঈষৎ হেসে চোখ বুঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো ইমন৷
.
স্কুলের সামনে গাড়ি ব্রেক করলো ইমন। মুসকানের দিকে গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

” বিকেলের দিকে নিতে আসবো। ”

ভ্রুজোড়া কুঁচকে মুসকান বললো,

“সায়রী আপুর সঙ্গে চলে যেতে পারবো। ”

” আমার বাড়ি যেতে হবে তিনবছরে নিজের মধ্যে এতোটা পরিবর্তন আনবি বুঝিনি। যে পরিবর্তনটায় আমার মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করতেও তোর বাঁধবে না। ”

আশ্চর্য হয়ে ইমনের দিকে তাকালো মুসকান বললো,

” আমি কখন বেয়াদবি করলাম! ”

” পুরো তিনটা বছরই বেয়াদবি করেছিস। আর গতকাল আমার মায়ের পাশে সায়রীর চেয়ে তোকে বেশী প্রয়োজন ছিলো। ”

” আমি কারো প্রয়োজন মেটাতে পারবো না৷ “,

হতভম্ব হয়ে গেলো ইমন। থমকানো সুরে বললো,

” মুসকান!”

” না মানে বিকেলে বন্ধু’দের সাথে সময় কাটাবো।”

বলেই মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় ডোর খুলে নেমে পড়লো। ইমনের মাথাটা পুরো ঝিম মেরে গেছে মুসকানের বলা শেষ বাক্যটি শুনে৷ ভেবেছিলো চলে যাবে কিন্তু লক্ষ্য করলো মুসকানের পায়ের গোড়ালি থেকে অনেকটা উঁচুতে শাড়ি ওঠে গেছে। নিম্নস্থানে কালো পেটিকোটের বেশীরভাগই দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো পুরো পিঠ ছেয়ে আছে একদিকে চুল অপরদিকে আঁচল সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে মুসকান৷ এদিকে রাস্তা পার হতেও পারছেনা৷ ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়েই গাড়ি থেকে নামলো ইমন৷ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে মুসকানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে কিছুটা ঝুঁকে শাড়ি টেনে পেটিকোট ঢেকে দিলো। চমকে ওঠলো মুসকান বললো,

” কি হচ্ছে কি? ”

ইমন ক্ষুব্ধ হয়ে মুসকানের দিকে তাকাতেই মুসকান এক ঢোক গিলে আশেপাশে নজর বুলালো। ইমন চোখ,মুখ কুঁচকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল টেনে মুসকানের ডানপাশের কাঁধে ওঠিয়ে বললো,

” এভাবেই থাকবি নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা। ”

মুসকান চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তার বলিষ্ঠ হাত দ্বারা মুসকানের ছোট্ট কোমল হাতটি মুঠোবন্দি করে নিয়ে রাস্তা পার হলো৷ মনে মনে প্রচন্ড খুশি হয়ে ইমনের পিছন পিছন আগাতে থাকলো মুসকান।
.
মুসকানকে গেট অবদি পৌঁছে দিয়েই গাড়িতে এসে বসেছে ইমন৷ দীর্ঘ একটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর পকেট থেকে ফোন বের করে মুরাদের নাম্বার ডায়াল করলো।

” হ্যাঁ ইমন বল মুসুকে পৌঁছে দিয়েছিস? ও বুঝতে পারেনিতো আমি আর দিহান প্ল্যান করেই ওকে পৌঁছে দেইনি আজ? ”

” কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য ফোন দেইনি কৈফিয়ত নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি। ”

” তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন কি নিয়ে আবার চটে গেলি দোস্ত? ”

” রিমিকে এখনি সাজগোজ করে রেডি হতে বল সায়রীর স্কুলে ওকেও নিয়ে আসবো। ”

” কিহ মাথা খারাপ রিমিকে স্কুলে পাঠাবো তাও আবার সাজগোজ করে! বাড়িতেই সাজতে দেইনা আবার নাকি অনুষ্ঠানে হুহ। ”

” তার মানে বোনের প্রতি যতোটা দরদ দেখাস ভেতরে ভেতরে আসলে ততোটাও নেই? ”

” মানে! ”

” ইয়েস তোর বোন কোন সাহসে এভাবে বেরিয়েছে আনসার মি ”

প্রথমে মুরাদ কিছু বুঝতে পারলো না তারপর ইমনের থেকে সব শুনে বললো,

” মুসকান এভাবে কখনোই বের হয় না ইমন। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি বুঝতে পারছিনা ও তো বাসার ভিতেরও সাজগোজ করে না আজ শাড়ি পরে এভাবে বেরিয়েছে অদ্ভুত! ”

” তোরা সব কয়টা ইবলিসের থেকেও খারাপ। নিজের বউ যত্নে ঘরে রেখে দিছিস। দিহান, সায়রীও এসব বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। অথচ মুসকানকে তোরা কেউ সঠিক শিক্ষা টা দিতে পারিস নি। ভালো ভাবে বলছি এমন উন্মুক্ত চলাফেরা ইমন চৌধুরী মেনে নেবে না। তোকে সাবধান করলাম। ”

” তুই মাথা ঠান্ডা কর আজই এভাবে বেরিয়েছে এর আগে কখনো এভাবে বের হয়নি। আমার পরিবার সম্পর্কে তোর ধারণা আছে নিশ্চয়ই। ”

” ধারণা অনেক কিছুই ছিলো সব বদলে গেছে। ”

” কিছুই বদলায়নি সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

“আর কতো সময় দেবো? ”

চিৎকার করে ওঠলো ইমন৷ মুরাদ হকচকিয়ে গেলো। বললো,
” ওকে বুঝিয়ে বলতে পারতিস হুদাই আমারে ধমকাচ্ছিস যাকগে বাসায় ফিরে বুঝিয়ে বলবো। ”

“সে জাতের বোন অন্তত তোর না। ”

” ভাইরে ভাই তোরে কে মাথার দিব্যি দিছিলো আমার বোনের দিকে নজর দিতে? কতোবার না করছি গ্যানজাম করছি কথা শুনস নাই এখন দেখ কেমন লাগে! ”

” আমি যদি চাই তোর বোনের ত্যাড়ামি দু’সেকেণ্ডে বন্ধ করতে পারবো। করবো? ”

” ঐ শালা বাড়াবাড়ি করবি না। ”

” শালা তো তুই আমার, শোন আজ তোর বোনের সব কাণ্ড দেখবো তারপর সে অনুযায়ী এ্যাকশন নেবো। স্কুল শেষে চুপচাপ বাড়ি গিয়ে মুড়ি খাবি বোন নিয়ে নো চিন্তা ওকে? ”

” ইমন শোন মুসু কিন্তু ছোট মানুষ আমাদের মতো বোঝদার ও হয়নি তুই কিন্তু…”

বাকি কথা বলার পূর্বেই ফোন কেটে কুটিল হাসলো ইমন। বিরবির করে বললো,

” সময়টা আর আগের জায়গাতে নেই। এখন ছাড় দেওয়া মানে নিজের অধিকারকেই ছাড় দেওয়া। ”
__________________
অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েই মুসকানের চারপাঁচ জন ফ্রেন্ড স্কুলে এলো। স্টেজের একপাশে সায়রীর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলো মুসকান। পূজা, স্বরণ,
স্বর্ণা,শুভ, আর তূর্যয় এসেছে এরা পাঁচ জনই মুসকানের কাছের বন্ধু। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্লোজ হচ্ছে পূজা। পূজা হাত নেড়ে মুসকানকে ইশারা করতেই মুসকান এক গাল হেসে দু’হাতে শাড়ি সামলে ওদের কাছে চলে এলো। পূজা আর স্বর্ণা জাবটে ধরলো মুসকানকে বললো,

“দোস্ত তোরে হেব্বি লাগতাছে। ”

স্বরণ বললো,

” দেবীর মতো সুন্দরী লাগতাছেরে পুরাই দেবী। ”

শুভ স্বরণের পিঠে চাপর দিয়ে বললো,

“শালা গবেটের বাচ্চা ও তোদের দেবী হইতে যাব কোন দুঃখে তোরা পূজারে দেবী বলগা আমাগো মুসকানরে হুরপরীর মতো লাগতাছে। ”

তূর্যয় বললো,

” আরে শালা রাখ তোর দেবী রাখ তোর হুরপরী আমাগো বান্ধবীরে বান্ধবীর মতো সুন্দর লাগতাছে।”

এ পর্যারে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সকলেই। পূজা আচমকা মনে পড়েছে এই ভণিতায় মুসকানের কাধ জড়িয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

” জানু আজ কিন্তু স্বরণ বিয়ারের ব্যবস্থা করছে। তোর কাজ শেষ হলেই আমরা জমিয়ে আড্ডা দিব আর বিয়ার খাবো উফস ”

অনেকদিনের ইচ্ছে মুসকানের সে বিয়ার খাবে। এই নিয়ে স্বরণ,শুভ তূর্যয়কে কম কথা শোনায়নি। কেমন ছেলে ফ্রেন্ড এরা যে বান্ধবীদের সামান্য এই শখই পূরণ করতে পারেনা! অবশেষে যখন বান্ধবীদের শখ পূরণের ব্যবস্থা করলো মুসকান বেশ বাহবা দিতে থাকলো। কিন্তু স্বর্ণা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

” এই আমরা কোথায় খাবো? আর যদি নেশা হয়ে যায় বাসায় ধরা পড়ে যাবোতো। ”

পূজা বললো,

“আমার বাড়ি যাবি একদম রিল্যাক্স মুডে সব করা যাবে। আমার বাড়ি সব ফ্রি। ”

শুভ রসিকতা করে বললো,

” তাই তাহলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে রিল্যাক্স মুডে ডেট করার ব্যবস্থাও করে ফেল। ”

” ছিঃ ফ্রি বলে এতোটা ফ্রি বলিনি। তোরা আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড সে হিসেবে তোদের বাসায় নিয়ে আড্ডা প্লাস ড্রিংক করতেই পারি। বড়দি আর মেজদাও তাদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে। তাই বললাম আর কি।”

ওদের কথার মাঝে মুসকান ফোড়ন কেটে বললো,

” এই থাম তোরা আমার কথা শোন আমি যেভাবেই হোক দাদাভাইকে ম্যানেজ করবো। সন্ধ্যার দিকে তূর্যয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিস তাই হবে। তাহলে আমাদের শখের পার্টি পূজা সেনের বাড়িতেই হচ্ছে। ”

সকলেই হৈহৈ করে ওঠলো। মুসকান আবার চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললো,

” আবার নেশাটেশা হয়ে যাবে না তো? আমি কিন্তু অল্পই খাবো জাষ্ট টেস্ট আর কি। ”

স্বরণ বললো,

” আরে না কিসের নেশা হবে কিচ্ছু হবে না জাষ্ট চিল ম্যান। ”
.
বিকেল চারটার দিকে অনুষ্ঠান শেষ। সে অনুযায়ী চারটা দশমিনিটে আবারও স্কুলের সামনে এসেছে ইমন। আসার পথে মুসকানের জন্য একটি এন্ড্রয়েড ফোনও কিনে নিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে যেতেই সায়রীর সঙ্গে দেখা হলো ইমনের। ইমন সায়রীর পিছন দিকে লক্ষ্য করে বললো,

” মুসকান কোথায়? ”

” মুসকান ওর বান্ধবীর বাসায় গেছে আমাকে বলে গেছে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরবে। চল আমাকে পৌঁছে দে। ”

ভ্রু কুঁচকে হুম বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো ইমন। অথচ মনটা উদ্বেগে আকুল হয়ে রইলো। পরোক্ষণেই ভাবলো তিনটা বছর তো এমনভাবেই কাটিয়েছে মুসকান। আজ হঠাৎ তার চলাফেরায় হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। আস্তেধীরে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের মতো করে গড়ে নিতে হবে। মনকে হাজারটা স্বান্তনা দিলেও ভিতরটা কেমন জ্বালা করছিলো। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে সায়রীকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলো।
.
চারদিকে মাগরিবের আজান ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বহুদিন পর বান্ধবী রিক্তা ফোন করায় রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে ফোনে কথা বলছিলো ইমন। যখন মাগরিবের আজান দিলো তখন রিক্তাকে বিদায় জানিয়ে ফোন করলো মুরাদকে। মুরাদ রিসিভ করতেই ইমন বললো,

” মুসুর জন্য ফোন কিনেছি দুপুরে দেওয়া হয়নি তুই কি বাড়িতে আছিস? ”

” হ্যাঁ বাড়িতেই। ”

” মুসু কি করে ওকে বলবি টাকাটা তুই আমাকে দিয়েছিলি আমি জাষ্ট কিনে দিলাম। ”

“মুসু তো এখনো বাড়ি ফেরেনি ফোনও সাথে নেই ওর বান্ধবীর নাম্বার খুঁজতাছি। ”

” হোয়াট!”

চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমা করে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here