#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ১১)
#নাহার
·
·
·
সন্ধ্যা সাড়ে আটটা,,,
নিরা একবার নিজের রুমের দরজার সামনে যাচ্ছে আবার হেটে রাফিনের রুমের সামনে আসছে। শুধু এদিক সেদিক পায়চারি করছে। অথচ সাহস করে রাফিনের রুমে যেতে পারছে না। গত এক ঘন্টা যাবত নিরা এমন পায়চারি করছে। অনেকক্ষণ ঘুর ঘুর করার পর স্থির হয়ে রাফিনের রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দোয়া দুরদ পড়ে বুকে ফু দিয়ে দরজায় নক করে। ভেতর থেকে আওয়াজ দিয়ে বলে,
— দরজা খোলাই আছে। ভেতরে আসো।
নিরা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। রাফিন বেডে উপুর হয়ে শুয়ে লেপটপে কাজ করছে। নিরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। পরিবেশ এতো নিরব দেখে রাফিন উঠে বসে।নিরার দিকে তাকিয়ে নিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— ভয় না পেয়ে বলো কি বলতে এসেছো।
— আসলে একটা বিষয়ে পারমিশন নিতে এসেছি।
রাফিন কপাল এবং ভ্রু কুচকে নিরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। রাফিনের এমন নজর দেখে নিরা ভয়ে কি বলবে ভুলেই গেছে। রাফিন স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,
— পারমিশন? তাও আমার থেকে? বাসায় কেউ পারমিশন দিচ্ছে না?
— সেটা নয়। আসলে আপনি পারমিশন দিলেই সবাই রাজি হবে। আমি কিছু বললেই সবাই বলে যাও যাও রাফিনের কাছে গিয়ে পারমিশন নিয়ে আসো। তাই আজকে ওদের কাছে না গিয়ে এখানেই এলাম।
— ওহ আই সি। তো বলো।
নিরা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে,
— একটু পানি খাই?
রাফিন এবার জোরে শব্দ করে হেসে দেয়। হাসি থামিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিরার সামনে এসে দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়ায়। নিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— পানি খাবে সেটার পারমিশন নিতে এসেছো? মাই গড! এতো চেঞ্জ কিভাবে হলে তুমি?
রাফিন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে নিরাকে বলে,
— ডোন্ট টেল মি যে তুমি অন্য কোনো মতলবে এসেছো।
— আসলে একটু পানি খাই আগে?
রাফিন আবার হাসে। নিরাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে নিরাকে দেয়। নিরা ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নেয়। তারপর একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলে,
— আসলে কালকে কলেজে নবীনবরন অনুষ্ঠান আছে। তাই আমিও যেতে চাচ্ছি। যদি আপনি পারমিশন দেন তাই…
নিরা কথাটা বলেই ঢোক গিলে। রাফিন রাগি চোখে তাকিয়ে থাকে নিরার দিকে। নিরা কাপা কাপা কণ্ঠে বলে,
— আচ্ছা থাক। পারমিশন লাগবে না। আমি যাবো না। পড়তে বসছি।
কথাটা বলেই নিরা উঠে দাঁড়ায়। রাফিন নিরাকে অবাক করে দিয়ে আবার হেসে ফেলে। নিরা বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে। রাফিন হাসতে হাসতে বসে পড়ে বেডে। নিরা একবার মেঝের দিকে তাকাচ্ছে একবার রাফিনের দিকে তাকাচ্ছে। আবার লজ্জাও পাচ্ছে। রাফিন হাসি থামিয়ে নিরাকে বলে,
— যাও। পারমিশন দিলাম।
— স স সত্যি?
— হ্যাঁ।
নিরা খুশিতে গদগদ হয়ে যায়। এক দৌড়ে বের হয়ে কাশফির রুমে আসে। কাশফি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো। কাশফি নিরাকে দেখে কল কেটে দেয়। নিরার সামনে এসে বলে,
— কিরে এতো খুশি কেন তুই?
— কালকে নবীনবরণ উৎসব কলেজে তাই তোমার থেকে শাড়ি নিতে এসেছি।
— শাড়ি পড়বি? তাও তুই?
— হ্যাঁ।
কাশফি ব্যাঙ করে বলে,
— কেউ কি শুনছো নিরা শাড়ি পড়বে। আমাদের নিরা শাড়ি পড়বে। তারপর উষ্ঠা খেয়ে ধপাস করে পড়ে সবাইকে বিনোদন দিবে।
নিরা রেগে যায়। কাশফির হাতে চিমটি দেয়। কাশফি নিরাকে বলে,
— ওমাগো। তোর গোস্ত খাওয়ার ইচ্ছা হইলে চাচিরে বল আমারে চিমটি দেস কে?
— হুহ ভালো হইছে চিমটি দিছি। বেশি কথা বললে গালেও চিমটি দিবো। তারপর তোমার বফ ভাববে তোমার আরেক আশিক কামড় দিছে। হেহে! এরপর ব্রেকাপ। আমি কিন্তু রগট ধর্মের প্রবর্তক মনে রেখো।
নিরা শয়তানি হাসি দেয়। কাশফি একটু যেনো দমে গেছে। আলমারি খুলে বললো,
— যেডা মন চায় ওইডা পর গা।
কাশফি দরজা পর্যন্ত এসে আবার নিরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিরাকে প্রশ্ন করে,
— রাফিন ভাইরে বলছিস?
— হু বলছি।( মুখ ভেঙিয়ে)
নিরা কনফিউজড কি রঙের শাড়ি পড়বে। তাই কাশফিকে নিচতলা থেকে টেনে নিয়ে আসে রুমে। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করে,
— এই আপু বলো না আমাকে কোন কালার শাড়িতে মানাবে?
কাশফি একবার শাড়িগুলোর দিকে তাকাচ্ছে।একবার নিরার দিকে তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ ভেবে বললো,
— তোরে সব কালারেই মানাবে। তাই এখন আমি কনফিউজড তোরে কোনটা সাজেস্ট করবো।
দুইজনেই একে অপরের উলটো দিকে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। হঠাৎ কাশফি লাফ দিয়ে উঠে বলে,
— আইডিয়া।
নিরা চমকে উঠে ভয়ে। বুকে ফু দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ফেলে। তারপর কাশফির দিকে তাকিয়ে বলে,
— কি আইডিয়া?
— শুন তুই রাফিন ভাইয়ার কাছে যা। উনারে গিয়ে জিগা কি রঙের শাড়ি পড়লে তোরে ভাল্লাগবে।
— সত্যি রাফিন ভাইয়ার কাছে যাইতাম।
— হো যা।
— আচ্ছা।
নিরা রাফিনের রুমে এসে আবার নক করে। রাফিন দরজা খুলে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে লুচুলুচু ফেইস করে বলে,
— কি হলো প্রিয়তমা আমাকে ছাড়া বিশ মিনিটও থাকতে পারলে না? এতো টান আমার প্রতি?
নিরা রাফিনের কথায় কাশতে শুরু করলো। রাফিন এক গাল হেসে নিরাকে ভেতরে নিয়ে পানি খাওয়ায়। নিরা পানি খেয়ে রাফিনের দিকে তাকায়। রাফিনও জিজ্ঞাসু চোখে নিরার দিকে তাকায়। নিরা বলে,
— আচ্ছা আমি কি কালার শাড়ি পড়লে মানাবে?
রাফিন চোখ মেরে নিরাকে বলে,
— আহ! এতো দেখতে পারো আমায় তাই আমার পছন্দ করা রঙের শাড়ি পড়বে। নট বেড।
নিরা কিছু বললো না। লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো। রাফিন হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমাকে কে বলেছে আমার কাছে এসে এসব জিজ্ঞেস করতে?
— কাশফি আপু।
— বোকা মেয়ে তুমি। এতোটা বোকা জানতাম না।
— হুহ!
— তোমার বান্ধুবিদের ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো তারা কি রঙের শাড়ি পড়ছে। তারপর সবাই একই কালারের শাড়ি পড়বে।
— ওহ ঠিক বলেছেন। এটা তো আমি ভাবিই নি।
— ভাবো নি কারণ ভেবে নিলে আমার কাছে আসার সুযোগ পেতে না তাই।
নিরা উঠে চোরের মতো দৌড় দিয়েছে। রাফিন এদিকে হেসে কুটিকুটি।
— নিরা তোমাকে ভয় লাগাতে আর লজ্জায় ফেলতে বেশ মজাই লাগে।
নিরা রুমে এসে বান্ধুবিদের ফোন দিয়ে জানতে পারে তারা সবাই ছাই রঙের শাড়ি পড়ছে। নিরা কাশফির রুমে ছুটে এসে ছাই রঙের শাড়ি বের করে নেয়। সবকিছু গুছিয়ে নেয়। ছাই রঙের শাড়ির সাথে কালো হিজাব পড়বে। সব ঠিকঠাক শুধু ব্লাউজ নিয়ে ঝামেলা। তাই নিরা ব্লাউজ নিয়ে যায় ছোট চাচির কাছে। সেখানে গিয়ে বলে,
— চাচি এই ব্লাউজটা আমার গায়ের মাপে করে দাও।
— কই যাবি?
— কালকে নবীনবরণ উৎসব আর বান্ধুবিরে সবাই ছাই রঙের শাড়ি পড়ছে।
— ওহ আচ্ছা ঠিকাছে। আজকে রাতেই পেয়ে যাবি।
— ওকে।
নিরা রুমে এসে পড়তে বসে যায়।
——————————————————————————–
সকাল সাড়ে নয়টা,,,
কাশফির মাথা উলোট পালোট লাগছে নিরাকে শাড়ি পড়াতে গিয়ে। কাশফি শাড়ি পড়াতে পারছে না। নিরা বারবার লাফ দিয়ে উঠে শাড়ি কোমড়ে খুচতে গেলেই। কাশফি রেগে বলে,
— সমস্যা কি তোর? এমনে লাফাস কে?
— আমার কি দোষ? আমার কাতুকুতু লাগে।
— হো আর কিছু? বিয়ার পর জামাই যখন টাচ করবে তখনও এমনে লাফাইস।
— তুমি এখন বিয়ের কথা এখানে আনলে কেন?
— সত্যি কথাই বলছি। এখন যদি আর একবার লাফ দেস। আমি চলে যাবো। বলে দিলাম।
— আচ্ছা সরি।
নিরাকে শাড়িটা পড়িয়ে দিলো। নিরা এবার হালকা সেজে নিয়েছে। তারপর হিজাব পড়লো। ব্লাউজ ফুল হাতা তাই হাতে কোনো চূড়ি পড়েনি। শুধু আঙুলে দুইটা রিং পড়েছে। নিরা রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলো। রাফিন ডাইনিং এ বসে চা খাচ্ছিলো। নিরাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসলো। একবার নিজের দিকে তাকালো আবার নিরার দিকে তাকালো। নিরা রাফিনের দিকে তাকাতেই রাফিন ভ্রু উঁচিয়ে লুচু হাসি দিলো।নিরা ব্যাপারটা খেয়াল করলো। তারপর বুঝলো রাফিনও আজকে ছাই রঙের শার্ট পড়েছে। নিরা কিছু বলেনি। চুপচাপ বসে মাথা নিচু করে খেয়ে নিয়েছে। দুইজন একসাথে বেরিয়ে গেলো। রাফিন নিরাকে বললো,
— চলো তোমাকে দিয়ে আসি।
— না।
— না কেনো?
নিরা ভয়ে ভয়ে বললো,
— আসলে আমার একটা বান্ধুবি আসবে। আমরা একসাথে যাবো।
— আচ্ছা তাই। আজকে আমার থেকে পালানোর চেষ্টা। হুম?
— না তেমন কিছু না।
রাফিন হাসে। নিরার দিকে এগিয়ে যায়। নিরা মাথা নিচু করে ফেলে আর ভয়ও পাচ্ছে এই বুঝি রাফিন ওকে ঠাটিয়ে চড় দিবে। নিরাকে অবাক করে দিয়ে রাফিন ওর মুখটা উপরে তুলে নেকাব বেধে দেয়।
— তোমাকে বলেছি না নেকাব বাধবে। আর অপরিচিত কারো সামনে খুলবে না। ওকে?
— হুম।
— আমার বান্ধুবি এসে গেছে।
— আচ্ছা যাও। সাবধানে থেকো।
— হুম।
নিরা ওর বান্ধুবি প্রভার সাথে একটু হেসে রিকশা নিয়ে নেয়। রাফিন গাড়িতে বসে কিন্তু গাড়ি স্টার্ট দেয়নি। যতক্ষণ নিরাকে দেখতে পেয়েছে ততক্ষণ বসে ছিলো। রিকশায় উঠার পরও যতক্ষণ নিরার আচলটা দেখা গেছে ততক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। নিরার আচলটা চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যাওয়ার পর রাফিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে চলে যায়। তাদেরকে দূরে থেকে দেখে তুহিন রাগে ফুসছিলো। মনে মনে বললো,
— নিরা আজকে তোমার খবর আছে। তোমাকে বলেছি রাফিন থেকে দূরে থাকতে কিন্তু না তুমি বারবার ওর আরো কাছে চলে যাচ্ছো।
সারাদিন অনেক হৈ হুল্লোড় মজা মাস্তি করে নিরা বাসায় ফিরে আসে। অনেক ক্লান্ত ছিলো। নিরার মা ওয়াশরুমে গরম পানি রেখে গেছেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে হালকা হালকা শীত লাগছে তাই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে বলেছে মিসেস শায়েলা। নিরা শাড়ি পালটে গোসল করে নেয়। একটা প্লাজো এবং নীল রঙের একটা ফ্রকের মতো টপস পড়ে নেয়। নিরার সবসমই ওড়না ছাড়া ঘুরার অভ্যাস। বাসায় কেউ কিছু বলে না তাই ওর এই অভ্যাস বদঅভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
নিরা বেলকনিতে ভেজা চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে শীতের চাদর জড়িয়ে রেখেছে। হালকা মৃদু বাতাসে নিরার সামনের ভেজা চুল বাতাসে উড়ে শুকিয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই আবহাওয়াটা।
নিরা তার সামনে কারো উপস্থিতি টের পায়। তাও মনের ভুল ভেবে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। এখন বুঝতে পারলো এটা মনের ভুল নয়। সত্যি কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিরা চোখ খুলে তাকিয়ে দুই তিন কদম পিছিয়ে যায়।
— তুহিন।
তুহিনের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। রেগে নিরার হাত চেপে ধরে বলে,
— তোকে বলেছিলাম রাফিন থেকে দূরে থাক। তাও তুই ওর আশেপাশেই কেন ঘুরঘুর করিস? এই তুই এখন আর আমাকে ভালোবাসিস না? ভালো না বাসলেও এখন তোকে ভালোবাসতেই হবে। বলে দিলাম আমি। নাইলে অনেক খারাপ হবে।
— তুহিন আমার হাত ছাড়েন।
তুহিন নিরাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। রাগে গজগজ করে কিছুক্ষণ। তারপর নিরার সামনে গয়ে বলে,
— রাতে আমি ছাদে দাড়াবো। আমি ফোন দিলেই চলে আসবি। বুঝেছিস?
— হ্যাঁ।
তুহিন চলে যায়। নিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালকা হাসে। মনে মনে বলে,
— আমার ভালোবাসা এতোদিন পর আবার ফিরে এসেছে নিজ থেকেই।
আমরা যাদের মোহে ডুবে থাকি তারা যতই খারাপ ব্যবহার করুক না কেনো। হুট করেই যদি ফিরে এসে একবার ভালোবাসা প্রকাশ করে তাহলে আমরা আরো তাদের মোহে ডুবে যাই। তখন এটা বিবেচনা করা খুব কঠিন হয় এটা আমাদের ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা। তখন আমাদের বিবেক কাজ করে না। আমরা শুধুই আবেগ দিয়ে চিন্তা করি। আর এটাকে ভালোবাসা ভেবে সেইদিকে আরো গড়িয়ে চলে যাই। নিরার ক্ষেত্রেই তা হয়েছে। সেও তার এই মোহে ডুবে এটাকে ভালোবাসা ভেবে নিয়েছে।
·
·
·
চলবে………………………