হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ০৪)
#নাহার
·
·
·
জানালা দিয়ে শীতল বাতাস রুমে প্রবেশ করে জানান দিচ্ছে শীত চলে এসেছে। সাদা রঙের পর্দাগুলো সব উড়ছে। উত্তর দিকের জানালা দিয়ে হিম বাতাস রুমে প্রবেশ করছে। বেডের উপর নিরা শুয়ে আছে।
মাথার উলটো দিকের জানালা দিয়ে হুরহুর করে বাতাস এসে নিরার ছোট অবাধ্য চুলগুলোকে বারবার মুখের উপর এনে ফেলছে। তাই একটু শুরশুরি লাগছে নিরার। হালকা শীত শীত লাগায় নিরা উঠে বসেছে। মাথা ঘুরিয়ে জানালার বাহিরে আকাশের দিকে তাকালো। সকাল বেলার নীল আকাশ একদম মন জুড়ানো।
নিরা ফ্রেস হওয়ার জন্য বেড থেকে নামে। ফ্লোরে পা দিয়ে উঠে দাড়াতে গিয়ে আহ্ বলে বসে গেলো বেডে। কালকের ঘটনা মনে পড়তে নিরা কেপে উঠে। তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। বেলকনির রেলিং-এ দুইহাতে ভর দিয়ে হালকা সামনে ঝুকে আকাশ দেখছে নিরা। আজ সকালটাকে কেনো যেনো খুব ভালো লাগছে নিরার। হয়ত শীত আসছে তাই। আর নয়ত আবহাওয়াটাই এমন যে নিরা বারবার প্রকৃতির প্রেমে পড়ছে।
দুইহাতে দুইটা কফির মগ নিয়ে নিরার পাশে উলটো দিকে রেলিং-এ হেলান দিয়ে ঘুরে দাড়ালো কৌশিক। নিরা মাথা ঘুরিয়ে পাশ ফিরে কৌশিক এর দিকে তাকালো। কৌশিক নিরার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। একহাতের একটা কফির মগ নিরার দিকে বাড়িয়ে দিলো। নিরা কফির মগটা নিয়ে এক চুমুক দুই চুমুক এভাবে খেতে লাগলো। কৌশিক এখনো ওভাবে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে এবং আড় চোখে নিরাকে দেখছে। কৌশিক হালকা কেশে নিরাকে জিজ্ঞেস করে,
— কফিটা কেমন হয়েছে?
— খুব ভালো। ভাইয়া তুই বানিয়েছিস?
— হ্যাঁ। রান্না বান্না শিখছি।
কৌশিক এর দিকে তাকিয়ে নিরা হাসলো। বামহাতের পিংকি আঙুলটা দিয়ে ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিলো। চোখ সরিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো। আবার বেলকনি থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে কৌশিককে বললো,
— আফিয়া আপু রাজি?
— হ্যাঁ।
— বিয়ে কবে করছো?
— আফিয়া অনার্স -এর ৩য় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে নিক তারপর দেখা যাবে।
— উহম! উহম! বাহ ভালো। তাহলে বাসায় একটা ভাবি আসবে
কৌশিক নিরা দুইজন একসাথে হাসলো। এমন সময় মেইন ডোরে বেল বাজলো। নিরা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখায় মনোযোগ দিলো। কৌশিক নিরার হাত থেকে খালি মগটা নিয়ে নিচে গেলো।
কৌশিকের গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হয়েছে এক বছর আগে। এখন ভালো বেতনের জব করে। কৌশিক একদম ফর্সা। লম্বায় ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। দেহের গড়ন ভালো। চওড়া বুক। গালে চাপ দাড়ি একটু ঘন। একদম হিরো হিরো লাগে।
নিরাদের পরিবারের সবাই ফর্সা। নিরার ভাই সবগুলোই লম্বা। ফায়াজ, ফাহিম, নাঈম সবাই লম্বা এবং দেহের গড়ন ভালো। আর নিরা, কাশফি এবং ফাতেমা থেকে নিরা একটু শর্ট। কিন্তু সবচেয়ে চেহারা সুন্দর বেশি নিরার। তিন বোনকেই একসাথে দাড়ালে খুব সুন্দর লাগে।
——————————————————————————–
ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন মোহাম্মদ আনোয়ার, আফজাল এবং আহমাদ। তিন ভাইয়ের হাতে তিনটা পত্রিকা। আনোয়ার সাহেব ব্যবসায়ীক বিষয় নিয়ে বেশি পড়েন। আহফজাল খবরের কলাম পড়েন। আহমাদ একটু রসিক টাইপের মানুষ। তিনি এইসব পড়েন না। তিনি বিনোদন এবং খেলাধুলার খবর বেশি পড়েন।
বেল বাজতেই কৌশিক নিচে নেমে আসে। নাঈম দরজা খুলে দেয়। দরজার সামনে ২৬/২৭ বছরের একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে খয়রি কালো রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্ট ইন করা। এক হাতে ঘড়ি অন্য হাতে এপ্রোন ভাজ করা। চুলগুলো স্পাইক করা তাও কপালে ছোট তিন চারটে চুল এসে পড়েছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
নাঈম তাকে ভেতরে আসতে বললো। সে ব্যাক্তি ভেতরে আসলে কৌশিক এর সাথে হ্যান্ডশেক করে। কৌশিক তাকে নিরার বাবার কাছে নিয়ে যায়। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে কিছু ছবি বের করে নিরার বাবাকে দেখিয়ে বলে,
— আঙ্কেল আপনি কালকে নিরাকে যেই অপবাদের জন্য মেরে অজ্ঞান করেছেন সেই অপবাদ ভুয়া।
আনোয়ার এবং আহমাদ পত্রিকা রেখে সামনে মানুষটির দিকে তাকালো। আফজাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
— মানে?
— দেখুন আঙ্কেল এটা হচ্ছে আসল ছবি যেখানে নিরা নেই। আর এই ছবিটা হচ্ছে নকল যেখানে নিরার ছবি বসানো হয়েছে।
— ছবি বসানো হয়েছে মানে?
— মানে কম্পিউটারের মাধ্যমে আরেকজনের ছবিতে ফটোশপ করে অন্য কারো ছবি বসানো যায়। আর কেউ সেটাই করেছে। নিরাকে দোষারোপ করার জন্য।
এরমধ্যে নিরার দাদি এসে বসেছেন আফজাল সাহেবের বরাবর বিপরীত সোফায়। নিরার মা, দুই চাচি নিরার দাদির সাথে বসেছে। ফায়াজ, ফাহিম, নাঈম ও সেখানে উপস্থিত আছে। নিরার দাদি তখন বলে উঠে,
— দেখছোস তোরে আমি কইছিলাম আমার নাতিনের দোষ নাই তবুও তুই আমার কথা হুনলি না। আমার নাতিনডারে কি মাইরডাই না দিছোস।
আফজাল সাহেব এবার বুঝতে পেরেছেন। অনুশোচনা হচ্ছে এখন। নিজের মেয়েকে বাহিরের মানুষের কথায় কি মাইরটাই না দিলো। নিরার বাবা বলেন,
— আমি একটু নিরার সাথে দেখা করে আসি।
কৌশিক বলে,
— চাচু তুমি এখন যেও না৷ নিরা এখন তোমাকে দেখলে ভয় পাবে। তারচেয়ে বরং তুমি আরো পরে যেও।
তাদের ঘরে আসা সেই মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে নিরার বড় চাচি বলে,
— আচ্ছা বাবা তুমি নিরার ঘরে যাও। একটু দেখো কোনো উন্নতি হলো নাকি।
— ঠিকাছে।
সেই মানুষটি উঠে যায়। সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে পেছন ফিরে তাকায় কৌশিক এর দিকে। কৌশিক তার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে। সেই মানুষটা হালকা হেসে পা বাড়ায় নিরার ঘরের দিকে।
নিরা রুমে বসে কান্না করছে আগের সব মনে করে।
— কেনো তুহিন কেনো এতো বাজে একটা কাজ করলে? এতকিছুর পরও তোমাকে আমি চেয়েও ঘৃণা করতে পারছি না।
বেডে হেলান দিয়ে মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসেছে। হাটুতে থুতনি রেখে কাদছে। এমন সময় নিরা তার সামনে দুটো পা দেখলো। মাথা উঠিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো। সেই মানুষটি নিরাকে দাড় করিয়ে একটা ঠাস করে থাপ্পড় মারলো নিরার গালে। নিরা বেডের উপর পড়ে যায়।
গাল হাত দিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিরা বলে,
— রাফিন ভাইয়া। মারলে কেনো?
রাফিন নিরাকে দাড় করিয়ে ওর দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বললো,
— তুমি এতো বেহায়া কেন বলবে আমাকে? এতোকিছুর পরও এখনো ওর জন্য কাদছো। লজ্জা করে না তোমার? সে তোমাকে পুরো এলাকায় চরিত্রহীন বানিয়েছে তারপরও তার প্রতি মায়া আসে কই থেকে তোমার? আমি এখন থেকে এখানেই আছি। আর যদি তোমাকে কোনো পাগলামি করতে দেখি থাপড়িয়ে তোমার দাত সব ফেলে দিবো।
— হু
রাফিন কৌশিক এর মামাতো ভাই। তাই নিরাও তাকে ভাই বলে ডাকে। রাফিন নিরা আর তুহিনের ব্যপারে সব জানে। রাফিন একজন ডাক্তার। কাল রাতে রাফিনই এসেছিলো নিরাকে দেখতে। রাফিন নিরালে উদ্দেশ্য করে বলে,
— কিছু খেয়েছো?
–হু
— কি খেয়েছো?
— কফি
— কফি খেলে পেট ভরে?( ধমক দিয়ে)
— না। কৌশিক ভাইয়া কফিই এনে দিয়েছে তাই
— ওয়েট।
রাফিন পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন করে কাকে যেনো। তারপর আবার কল কেটে মোবাইল পকেটে রেখে দেয়। হাতের এপ্রোন সোফার একপাশে রাখে। নিরা বরাবরই রাফিনকে একটু ভয় পায়। তাই রাফিনের মুখের উপর কথা বলার সাহস নিরার নেই। এখনো একই জায়গায় গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে নিরা। এভাবে নিরাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রাফিন বলে,
— আমি তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো পানিশমেন্ট দি নি। বসো। ( হালকা ধমক দিয়ে)
এরমধ্যেই কৌশিক আসে হাতে নাস্তার প্লেট। রাফিন কৌশিকের দিকে এগিয়ে যায়। নাস্তার প্লেট নিয়ে সোফার সামনের টেবিলে রাখে। কৌশিককে বলে,
— সকাল বেলা খালি পেটে কেউ কফি খাওয়ায় আবাল একটা।
— আরে চাচু তখন যে রেগে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো তাই নাস্তার প্লেট নিতে পারিনি। কফির মগটাও এনেছি ফাতেমাকে দিবো সেই নামে। তোর আসার অপেক্ষা করছিলাম।
— আচ্ছা ওকে।
কৌশিক চলে যায়। রাফিন নাস্তার প্লেট নিয়ে নিরার সামনে বেডে বসে। নিরা নিজে খেতে চাইলে রাফিন ওকে থামিয়ে দেয়। নিজেই খাইয়ে দেয় নিরাকে। নিরা নিচের দিকে তাকিয়ে খেয়েই যাচ্ছে। আর রাফিন নিরার দিকে তাকিয়ে আছে মুগ্ধ নয়নে।
নিরাকে প্রথম দেখেছিলো কৌশিকের নানু বাড়িতে। মানে রাফিনদের বাড়িতে এসেছিলো নিরা বেড়াতে। সেদিন নিরা কালো রঙের একটা জামা পরেছিলো। তখন রাফিন মাত্র ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছে। রাফিন এতোদিন কিছু বলেনি কারণ নিরা তুহিনকে ভালোবাসত তাই। এখন এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পর রাফিন নিরার জীবনে হিরো হিসেবেই এট্রি নিয়েছে।
খাওয়ার পর নিরাকে ওষুধ খাইয়ে দেয় রাফিন। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দেয়। যাওয়ার সময় বলে,
— আমি এসে যদি শুনি ছাদে গিয়ে তুহিনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছো আমার থেকে খারাপ কিছু হবে না। মনে থাকবে?
— হু
রাফিন চলে যায় হসপিটালে। নিরা শুয়ে শুয়ে ভাবছে রাফিন ভাইয়া কি সত্যি তাদের ওখানে থাকবে কিনা।
——————————————————————————–
এক সপ্তাহ পর,
তুহিন কোচিং -এ পড়াচ্ছে। এখন পড়াচ্ছে নিরা যে ব্যাচে পড়ত সেই ব্যাচটা। সব ঠিক আছে কিন্তু তুহিন তারপরও কেনো যেনো উদাস হয়ে আছে। বারবার চোখ যাচ্ছে নিরা যে টেবিলে বসত সেদিকে।
তুহিন না চাইতেও চোখ সেদিকে যাচ্ছে। মনের ভুলেও চোখ যাচ্ছে সেদিকে। ক্লাশ শেষে একেবারে বাসায় চলে আসে তুহিন। কেমন যেনো এক অস্থিরতা কাজ করছে। তূর্য তুহিনের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
— কি হয়েছে?
— জানি না ভাই। কেমন যেনো এক অস্থিরতা কাজ করছে। কিছু একটা নাই বা হারিয়ে ফেলেছি মনে হচ্ছে।
তূর্য হালকা হাসে। তুহিনের পাশ থেকে চিপসের পেকেটটা নিয়ে বলে,
— নিরাকে মিস করছিস তাই এমন লাগছে।
তুহিন চোখ বড়বড় করে তূর্যের দিকে তাকায়। তূর্য আবার হালকা হেসে বলে,
— মনের অজান্তেই তুই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস
— তোর মাথা ঠিক আছে কি বলছিস তুই এসব। এরকম কিছু না। এমনিতেই হচ্ছে এটা। কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।
— যতদিন নিরাকে দেখবি না ততদিন এই অস্থিরতা যাবে না।
তূর্য কিছুক্ষণ চুপ থাকে। আবার বলে,
— হেই তুই যখন ওকে ভালোইবাসিস তাহলে দূরে ঠেলে দেস কেন বারবার। নিজেই জানোস তোর কষ্ট হবে তাও কেনো কাছে আসতে দিস না।
— ভাই তুই সবই জানোস। না জানার ভান করিস না।
তুহিন উঠে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়ায়। তূর্যও জঠে যায়। তুহিনের পাশে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
— সেই আট বছর বয়স থেকে আমরা দুইজন একসাথে। তোর না বলা সব কথা বুঝি আমি। তুই যেটা দেখাস না সেটাও বুঝি আমি। শুন নিরা সত্তিই তোকে ভালোবাসে।
তুহিন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
— হাহ! ভালোবাসা।
— মনের অজান্তেই ভালোবাসিস। দেখিস তুই নিরাকে অন্য কারো সাথে দেখলে তোর বুক ধড়ফড় করবে। কষ্ট হবে খুব। যেটা আগে হয়নি।
— হ্যাঁ এই কষ্টটাই আমি অনুভব করতে চাই না ভাই। এই কষ্টে কষ্টে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে। যা একটু বেচে আছি। নিরাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে সেটাও হারাতে চাই না আমি।
— ভালোবাসাকে নিজের কাছে রাখলে কষ্ট নয় অনেক শক্তি পাওয়া যায়। একবার কাছে টেনে নিলে বুঝতি।
–ভাই প্লিজ চুপ কর। আর শুনতে ইচ্ছা করছে না। নিরা আমাকে ছাড়া ভালো থাকবে। অন্য কারো সাথে ভালোই থাকবে। আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে ওকে আমি জড়াতে চাই না।
তুহিন রেলিং ঘেঁষে সেখানে বসে পড়ে। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। তূর্য পাশে বসে তুহিনকে জড়িয়ে ধরে। তুহিনকে বলে,
— কাদিস না ভাই।
তুহিন ভেজা কণ্ঠে তূর্যকে বলে,
— ভাই আমার জীবনটা এমন কেনো। কেনো এতো বিষাদে ভরপুর। মুক্তি চাই আমি এইসব থেকে।
এভাবেই রাত কাটে তুহিনের বিষাদে। এক বুক যন্ত্রণা আর না পাওয়ার অনেক বেদনা নিয়ে।
·
·
·
চলবে…………………….