হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ০৩)
#নাহার
·
·
·
মেঝেতে উবু হয়ে পড়ে আছে নিরা। উঠতে পারছে না এমন নয়। নিরা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। কেউ ভয়ে নিরার রুমে ঢুকার সাহস পাচ্ছে না। আফজাল সাহেবের কড়া নির্দেশ এই রুমে এবং রুমের আশেপাশে যেনো কাউকে না দেখি তাহলে আমার থেকে খারাপ কিছু হবে না।
নিরার বাবা মা দুজনই অত্যন্ত রাগী৷ তবে মিসেস শায়েলা থেকে আফজাল সাহেবের রাগ অত্যন্ত বেশিই। বাড়িতে বড় ভাই এবং ছোট ভাই এমনকি পুরো পরিবারের সবাই আফজাল সাহেবকে ভয় পায়। তাই উনার কথা অমান্য করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
কৌশিক আর না পেরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। রাস্তায় হাটছে আর আশেপাশে তুহিনকে খুজছে। আজকে তুহিনকে সামনে পেলে মেরেই ফেলবে। কৌশিক এর রাগ যেনো সপ্তম আসমানে চলে গেছে। হাটতে হাটতে একটা টঙ দোকানের সামনে এসে বসে পরে কৌশিক। রাগটা যেনো কোনোভাবেই কমছে না। একের পর এক চা খেয়েই যাচ্ছে।
কৌশিক এই পর্যন্ত দশ কাপ চা খেয়েছে। লাস্ট বারের চা খেতে গিয়ে জিহবা পুরে ফেলেছে। জিহবা পুরায় লাফিয়ে উঠেছে সে। টাকা মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটছে কৌশিক। হাটছে আর মিটিমিটি হাসছে কারণ এই জিহবা পুরার দৃশ্য যদি নিরা দেখতো তাহলে হেসে কুটিকুটি হয়ে যেতো। আর আজকে শুধু ওই তুহিনের জন্য নিরার এই অবস্থা। সব মনে পড়তে মুহূর্তেই কৌশিক আবার রেগে গেছে।
বাড়ি থেকে কিছু দূরে কৌশিক তুহিনকে দেখতে পায়। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছে। কৌশিক দ্রুত পায়ে হেটে আসে তুহিনের কাছে। তুহিনের সাথে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিক এসেই তুহিনের কলার ধরে নাক বরাবর দুই তিনটা ঘুসি মারে। তৎক্ষনাৎ তুহিনের নাক ফেটে রক্ত পরতে থাকে।
এইদিকে নিরার ছোট ভাই নাঈম কৌশিকের খোজে বের হয় ঘর থেকে। কিছুদূরে এসেই দেখে কৌশিক তুহিনকে মারছে। তূর্য থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। নাঈম দৌড়ে এসে পেছন থেকে কৌশিক এর পেট শক্ত করে জড়িয়ে ধরে টেনে পেছনে নিয়ে যায়। তূর্য তুহিনের সামনে এসে দাঁড়ায়।
তূর্যের পেছনে তুহিন হাটু গেড়ে বসে নাক চেপে ধরেছে। তূর্য কৌশিককে জিজ্ঞেস করে,
— কৌশিক ভাই কি হয়েছে আপনি এভাবে তুহিনকে মারলেন কেন?
— ওকে আমি মেরেই ফেলবো। সাহস কিভাবে হয় তোর এভাবে আমার বোনের সাথে মাইন্ড গেম খেলার?
তূর্য বুঝতে পারে কোন ব্যাপারে কথা বলছে। তুহিন এখনো একই অবস্থায় বসে আছে। নাঈম কৌশিককে ছাড়ছে না কারণ এখন কৌশিককে ছাড়লে একটা তুমুল কান্ড বাধিয়ে বসবে। কৌশিক আবার বলতে শুরু করে,
— জানোয়ার আমার বোন তোকে ভালোবেসেছে আর তুই আমার বোনের সাথে এমন করলি। তোকে ভালোবেসে কি এমন দোষ করে ফেলেছে ও যার কারণে এমন করলি? বিয়ে করতে না চাইলে আমাদের বলতি তোর বাপকে বলতি সেটা না করে এতোটা ফালতু গেম খেললি কোন সাহসে?
নাঈম ছাড় আমাকে আজকে এই জানোয়ারকে আমি মেরেই ফেলবো।
নাঈম কৌশিককে ঠান্ডা করার জন্য বলে,
— ভাই প্লিজ থাম। এমনিতেই আপুর অবস্থা ভালো না। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। এখন তুই যদি এমন করিস তাহলে বাবা এবার আরো রেগে যাবে। যার ফল আপুর উপরেই যাবে। প্লিজ থাম আপুর কথা মাথায় আন প্লিজ ভাই প্লিজ।
কৌশিক এবার থেমে গেছে। তূর্য তুহিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কৌশিক ঠান্ডা মাথায় তুহিনকে বলে,
— নিরার ভালোবাসার দাম দেসনি তুই। এটা মনে রাখিস ওর ভালোবাসা একদম পিউর ছিলো যার কারণে তুই হাজারবার ফিরিয়ে দেবার পরও তোর কাছে ছুটে আসতো। হাজার অপমানের পরও তোর কাছে আবার আসতো অপমানিত হতে। ওয়েট কর বাজে দিন তোরও আসবে। নিরার ভালোবাসা তুইও বুঝতে পারবি।হ্যাঁ, আর নিরাকে কখনো তোর কাছে আসতে দিবো না। ভালো থাকিস।
কথাটা বলেই কৌশিক আর নাঈম দুইজন ঘরে চলে আসে। তূর্য তুহিনকে হসপিটাল নিয়ে যায়।
——————————————————————————–
রাত ১২:৩০,,,,
ফায়াজ এবং ফাহিম চুপিচুপি নিরার রুমের দরজার সামনে আসে। আশেপাশে ভালো করে দেখে কেউ আছে নাকি। যেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যাবে তখনি একটা ছায়া দরজায় পরে। দুইজনই কেপে উঠে ভয়ে। ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে দেখে ফাতেমা দাঁড়িয়ে।
–ফায়াজ ফাহিম এবং ফাতেমা হচ্ছে নিরার ছোট চাচা এবং চাচির ছেলে মেয়ে। ফাতেমা বড় ফায়াজ এবং ফাহিম ছোট। আবার ফায়াজ এবং ফাহিম দুইজনই টুইন। ফাতেমা এগিয়ে আসে তাদের দিকে। ফায়াজ ফিসফিস করে বলে,
— এভাবে ভূতের মতো আমাদের ভয় না লাগালেই পারতে।
— তোরা এখানে কি করছিস?
ফাহিম ফাতেমার চুল টান দিয়ে বলে,
— নিরা আপুর কাছে যাইতেছি দেহোস না? চোখ নাই তোর? ও থাকবো কেমনে হারাদিন তো মোবাইলের ভিত্রে ডুইবা থাহোস। শাকচুন্নি একটা।
ফাতেমা রেগে যায় ফাহিমের কথায়। ফাহিমের চুলের মুঠি ধরে টান দেয়। দুইটা সেখানে চুল টানাটানি শুরু করেছে। ফাহিম বরাবরই খুব বেশি দুষ্ট। বান্দরামির মধ্যে এক নম্বর। আর সবসময় ফাতেমাকে ব্যঙ করে কথা বলে রাগানো ফাহিমের স্বভাব। এদের দুইজনের কিলাকিলি দেখে ফায়াজ রেগে যায় আর রেগে ফিসফিস করে বলে,
— কি শুরু করেছো তোমরা দুইজন। এখানে আমরা নিরা আপুকে দেখতে আসছি আর তোমরা মারামারি শুরু করছো। আপু তুমিও ফাহিমমার লগে লাগতে যাও কেন?
— আমি লাগি কই এই বান্দর ফাহিমমাই তো আমার লগে লাগে দেখোস নাই তুই।
— উফ! চুপ করো তোমরা দুইজন। এখন ভেতরে যাই দেখি।
— ওকে।
ফায়াজ আসতে করে দরজা খুলে ভেতরে আসে। তিনজন রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বেডের পাশের ডাই লাইট মেঝে লেম্পটা জালায় শুধু। নিরাকে দেখে তিনজনই চমকে উঠে। এখনো মেঝেতে উবু হয়ে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি তিনজন নিরার কাছে যায়। ফাতেমা মাথার কাছে ফায়াজ এবং ফাহিম পায়ের কাছে গিয়ে নিরাকে ধরে বেডে শুইয়ে দেয়।
এরমধ্যেই কারো পায়ের আওয়াজ আসে তাদের কানে। এদিকে নিরার রুমের দিকেই আসছে। তিনজনই খুব ভয় পেয়ে যায়। পায়ের আওয়াজ যত স্পষ্ট হচ্ছে তাদের তিনজনের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি ততই বেড়ে যাচ্ছে। অবশেষে পায়ের আওয়াজ এসে থামে নিরার রুমের ভেতরে। ভাই বোন তিনটাই এতোটা ভয় পায় যে একজন আরেকজনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রুমের ভেতরে মানুষ টাকে আসতে দেখে তিনজন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ফাহিম বলে,
— বড়মা তুমি। জানো কি ভয় পেয়েছি আমরা তিনজন। ভাবলাম মেঝো চাচু বুঝি এই এলো।
নিরার রুমে নিরার বড়মা মিসেস তানজুম মানে বড় চাচি এসেছে। উনি তিনজনের উদ্দেশ্য বলে,
— তোরা এখানে কি করছিস?
ফায়াজ বলে,
— বড়মা আপুকে দেখতে এলাম। দেখো এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
মিসেস তানজুম নিরার মাথার পাশে বসেন। নিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
— হ্যাঁ তাইতো দেখছি। কৌশিককে বলেছি ডাক্তার নিয়ে আসতে।
দশ মিনিট পর কৌশিক এলো নিরার রুমে সাথে ডাক্তার ছিলো। ডাক্তার নিরার পাশে বসেন এবং ভালো করে দেখে বলেন,
— পেসেন্টকে এভাবে মেরেছে কে?
মিসেস তানজুম বলেন,
— জ্বী আসলে নিরার বাবাই মেরেছে এভাবে
— কেনো?
— অনেক কারণ আছে। তুমি একটু ভালো করে দেখো এবং জ্ঞান ফিরার ব্যবস্থা করো।
— জ্ঞান হারিয়েছে কখন?
— সকাল সাড়ে দশটায়
— সকাল সাড়ে দশটায় জ্ঞান হারিয়েছে আর আপনারা এতোক্ষণে ডাকছেন আমাকে?
কৌশিক বললো,
— আসলে অনেক সমস্যা ছিলো বাসায় তাই।
ডাক্তার ভালোভাবে নিরাকে দেখেন এবং ব্যাগ থেকে একটা শিশি এবং ইনজেকশন বের করে নিরার হাতে পুস করেন। আর কিছু ওষুধ লিখে দেন। ডাক্তার উঠে দাড়ান এবং বলেন,
— কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে চিন্তা করবেন না।
কৌশিক ডাক্তারকে নিয়ে বের হন। ডাক্তার যেতে যেতে কৌশিককে জিজ্ঞেস করে ঘটনা কি হয়েছে। কৌশিক বলতে শুরু করে সব।
———————————————————————————-
সকাল সাড়ে নয়টা। তুহিন এবং তার বাবা চিল্লাচিল্লি করে চলে গেলে নিরা নিচে নেমে তার মাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। নিরার মা কিছু না বলেই কষে থাপ্পড় মারে নিরাকে। নিরার মা নিরার দুই কাধ ঝাকিয়ে বলেন,
— তুই মেয়েটা আমাদের সব সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিলি। তোকে কোচিং এ পাঠাতাম পড়ালেখার জন্য আর তুই.. ছি!ছি!ছি!
মিসেস শায়েলা বসে পড়েন মাথায় হাত দিয়ে। নিরার বাবা মোবাইল বের করে করে নিরার সামনে ধরে। যেখানে একটা ছবিতে নিরা একটা ছেলের গায়ের উপর শুয়ে আছে। নিরা বললে ভুল হবে অন্য কোনো মেয়ের ছবিতে নিরার চেহারা ফটোশপ করে বসানো হয়েছে। সবাই এটা বুঝতে পারছে শুধু নিরার বাবা মা ছাড়া।
বাড়ির মেয়ের এমন একটা ছবি দেখলে সেই মুহূর্তে কোনো বাবা মার মাথাই ঠিক থাকার কথা না। তেমনটা নিরার বাবা মার ক্ষেত্রেও হয়েছে। এতোক্ষণে পুরো এলাকা জানাজানি হয়ে গেছে। তুহিনের বাবা বলেছে,
— এমন চরিত্রহীন মেয়েকে তার ছেলের বউ বানাবে না।
এলাকায় ছড়িয়ে পরেছে মেয়ে চরিত্রহীন সাথে বিয়েও ভেঙে গেছে। এখনকার সমাজে সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই গুজবে কান দিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলে। সেটাই হয়েছে।
নিরার বাবা মা সন্তানদের খুব ভালোবাসেন। তাদের খুশির জন্য সব করতে রাজি। কিন্তু খারাপ কিছু শুনলে এক চুলও ছাড় দিতে রাজি না। নিরার বাবা নিরার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে যেতে নিলে নিরার দাদি বলে,
— আমার নাতিন ডারে মারিস না আফজাল। ছাইড়া দে আমার নাতিনরে। আমার মন কইতাছে আমার নাতিনের কোনো দোষ নাই।
— মা তুমি কোনো কথা বলবা না৷ কেউ রুমে আসার চেষ্টা করবে না। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
নিরাকে রুমে এনে কোমড়ের বেল্ট দিয়ে খুব মারে মোহাম্মদ আফজাল। নিরার জ্ঞান হারানোর পরও মারতে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি হাপিয়ে গেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন।
এইদিকে নিচে সোফায় বসে মিসেস তানজুম নিরার বড় চাচি, মিসেস রেহানা নিরার ছোট চাচি বসে বসে নিরার দাদিকে বলছেন,
— মা আপনি গিয়ে মেঝো ভাইকে থামান প্লিজ। মেয়েটাকে এভাবে আর কত মারবে?
— আমিতো কইলাম। দেহোস না কেমনে হুঙ্কার দিলো।
কাশফি ছুটে আসে তার মায়ের কাছে। এসে বলে,
— মা প্লিজ কিছু করো।
— কিছু করার নেই। তোর চাচাকে সবাই ভয় পায়। উনার কথার হের পের হলে একটা তুমুল কান্ড বাঁধবে।
কাশফি মনে মনে বলে,
— এই কাজ তুহিন নিজেই করেছে চাচু। কিভাবে যে বলি তোমাদের। আল্লাহ একটা যেনো মিরাকেল ঘটে এবং এটা যেনো প্রমাণ হয়ে যায় নিরা নির্দোষ।
———-
কৌশিকের মুখ থেকে সবকিছু শুনে ডাক্তার কৌশিকের কাছ থেকে সেই ছবি গুলো নেয় এবং কৌশিককে বলে,
— ডোন্ট ওয়ারি কাল সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সব প্রমাণ করে দিবো নিরা নির্দোষ।
— ঠিকাছে। আমি কালকের অপেক্ষায় থাকবো।
— আচ্ছা আসি এখন।
— আচ্ছা।
ডাক্তার মেইন ডোর থেকে বের হয়ে নিজের গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। কৌশিক হালকা হাসে আর বলে,
— নিরা কাল তোর জন্য এক নতুন সকাল অপেক্ষা করছে।
·
·
·
চলবে…………………