হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১০

0
990

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১০
#রাউফুন

সকালে কিছু পোঁড়ার গন্ধে ঘুম ভাঙে তুলিকার। ঠিক পোঁড়া গন্ধ নয়। কিছু রান্নার গন্ধ মো মো করছে রুম জুড়ে। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। কোনো কিছু রান্না করা হচ্ছে মনে হয়? সে ঝটপট রান্না ঘরে আসে। গিয়ে যা দেখে এতে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে! সে কি স্বপ্ন দেখছে? ভালো ভাবে চোখ কচলে দেখে, না সে ভুল দেখছে না। ঠিক দেখছে। মাইজিন রান্না করছে! বেলা কইটা বাজে? সে কি এতোটাই দেরিতে উঠলো আজ? মাইজিন তুলিকার উপস্থিতি টের পেয়ে কড়াইয়ে তেল দিতে দিতে বলে,

‘ওহ আপনার ঘুম ভেঙে গেছে? মিষ্টিকে ডেকে তুলুন ব্রেকফাস্ট রেডি! আরেকটু কষ্ট করে শুধু অপেক্ষা করুন!’

‘একি করছেন আপনি? আপনি কেন কাজ করছেন? আমি আছি কি জন্য? বেলা কইটা বাজে?’

‘সারে ছয়টা কি সাতটা মতো বাজবে হইতো। নামাজ পড়ে আসার পর আর ঘুম ধরেনি তাই কাজ করতে বসে গেছি। এতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই?’

‘আমাকে ডাকবেন না? এভাবে কেউ মেয়েদের কাজ করে? পেয়াজ মরিচ কে’টেছেন যদি হাত জ্বালা করে! কি যে করেন আপনি!’

‘কাজ, কাজ ই হয় তুলিকা। আপনি এটা নিয়ে ভাববেন না আমার অভ্যাস আছে।’

‘আপনার তো কষ্ট হচ্ছে।’ কাঁন্না করে ফেলে তুলিকা।

মাইজিন পেছনে ঘুরে তাকালো তুলিকার কান্নারত গলায়। রুমাল এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনার চোখের পানি মুছে দিতে গেলে আপনাকে স্পর্শ করা হবে তাই এখন আমি পারলাম না মুছে দিতে। কিন্তু খবরদার আর যেনো কাঁদতে না দেখি। এই সামান্য ব্যাপারে কেউ কাঁদে? রান্না-বান্না করার অভ্যাস আছে আমার। একটুও কষ্ট হচ্ছে না!’

‘মানে আপনি রান্না-বান্না সব পারেন?’

‘ হ্যাঁ, সব রান্নায় তো আমি করি। আমার বাড়িতে কোনো কাজের লোক নেই তেমন না। আমার নিজেরই রান্না করতে ভালো লাগে। আমি বাসায় ভোর ছয়টাই ঘুম থেকে উঠে সকালের রান্না করি। এরপর ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অফিস চলে যায়।সন্ধ্যায় ফিরে রাতের রান্না করি।খেয়ে দেয়ে আবার অফিসের কাজ করি!’

‘আপনি এতো সব কাজ কেন করেন? আপনার মা করেন না এসব কাজ?’

‘মা-হ? হাসালেন! আসুন আসুন খাবার রেডি। মিষ্টিকে ডেকে তুলুন!’

বলেই গ্যাস অফ করে মাইজিন ফ্রেশ হতে যায়।
তুলিকা আবারও ভাবনায় বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাইজিন কি বললো এটা? ওভাবে হাসলো কেন? তার হাসিতে এতো বেদনা কেন দেখতে পেলো সে?হাসিটা জীবন্ত কেন নয়?শুধু নিজের রান্না করতে ভালো লাগে বলেই রান্না করেন বাসায় নাকি অন্য কারণে?

তারা যখন খেতে বসলো তখন খাবার মুখে দিয়ে মিষ্টি অবাক হয়ে যায়। তুলিকা রুটি হাতে নিয়ে নেরেচেরে দেখলো। মাইজিন রেডি হয়ে এসে এক সাথে বসলো। তুলিকা মাইজিনের প্লেটে রুটি দিতে দিতে বললো,

‘এতো গোল গোল আর সুন্দর করে রুটি বেলতে পারেন আপনি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। একটাও রুটি আঁকাবাকা হয়নি।’

‘আপনার স্বামী সব পারে মেডাম। আমি এসব কাজে ভীষণ অভিজ্ঞ বলতে পারেন।’

‘আপনি আমার চেয়েও দারুন করে রুটি বানিয়েছেন। ইভেন অনেক ভালো বেলতে পারেন!’

‘ভাইয়া এতো মজার খাওন এর আগে আমি কহনোই খায় নাই। আফনের হাতে জায়াদু আছে।’ বললো মিষ্টি।

‘তাই? তা মিষ্টি তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’

‘ভাইয়া আমি ক্লাস এইটে। বই গুলা তো সব পুঁইড়াই গেছে। কেমনে পড়ুম আমি।’

‘তুমি চিন্তা করো না আমি আরেক সেট বই এনে দেবো। কোন স্কুল বলো আমি নিজে গিয়ে সব বই আনবো।’

মিষ্টি সুন্দর করে হাসে। স্কুলের নাম বলে বললো, ‘মাইজিন ভাইয়া আফনে খুব ভালা। থ্যাংক ইউ!’

তুলিকা এক ধ্যানে মাইজিনকে দেখছিলো। মানুষটার চোখে মুখে আলাদা একটা মাদকতা আছে। তুলিকা তখনকার কথাও ভুলতে পারছে না। মানুষটা রান্না করে তারপর অফিস যেতো আবার এসেও রান্না করতো। কেন? তবে কি উনার মা রান্না করে দিতেন না সকালে উঠে? কেন দিতেন না? এতোটা কষ্ট করেছে মাইজিন? মা হয়ে ছেলের কষ্ট কেন বুঝতে পারেন নি? মাইজিন যতোই বলুক সে অভিজ্ঞ এসব কাজে তাও মনে মনে যে মানুষটার কতটা ব্যথা, কষ্ট লুকিয়ে আছে সেটা খুব ভালো ভাবে বুঝতে পারছে তুলিকা। এসব ভাবনায় যখন মত্ত সে তখনই মিষ্টির কথায় ধ্যান ভাঙে। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

‘এই নাম ধরে ডাকছিস কেন মিষ্টি? শুধু ভাইয়া বলবি। উনি কতটা বড় তোর জানিস? আর শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে কি হয় হ্যাঁ?

‘আহা তুলিকা ওঁকে বকছেন কেন? ওর মুখ থেকে এই ডাক শুনতে ভালো লাগে। আর কথা গুলোও ভীষণ ভালো লাগে আমার।’

‘মাইজিন ওঁকে লাই দিয়েন না। বা’দ’র মেয়ে একটা!’

খিলখিল করে হাসে মিষ্টি। মাইজিন ও হাসে। শুধু হাসে না তুলিকা।

মাইজিন অফিসে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘তুলিকা আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে। কেউ আসলে না দেখে দরজা খুলবেন না।’

‘হুম!’

‘আসছি। আপনি আর মিষ্টি সাবধানে থাকবেন। বেশি মন খারাপ করলে দরজা লক করে ছাদে যাবেন মিষ্টিকে নিয়ে!’

‘আচ্ছা!’

হঠাৎই মাইজিন ফ্লাইং কিস ছুঁড়লো তুলিকার দিকে। চোখ পিট পিটিয়ে তাকিয়ে থাকে সে। মাইজিন মিষ্টি হেসে বলে, ‘আপনাকে ছোঁয়া যাবে না কিন্তু এটা তো করতেই পারি তাই না? আপনাকে না ছুঁয়ে আদর করাটা কেন মিস করবো?’

মাইজিন দরজা খুলে চোখের আড়ালে চলে যায়। আর তুলিকা তখনও অস্বস্তিতে বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষটা এতো ভালো কেন? ঠিক কতটা ভালো হলে মানুষ এমনটা করতে পারে? মাইজিনকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে তুলিকা!

তুলিকা ঘর মুছে, বিছানা সুন্দর করে গুছিয়ে নিলো। দুপুরে মিষ্টি গোসল করে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েছে। তুলিকাও গোসল করে বারান্দায় বসে চুল শুকাচ্ছে। সে ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে মাইজিনকে কল করবে কি করবে না। নিজের মন মস্তিষ্কের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে এক প্রকার। মন বলছে ফোন করে জানতে সে খেয়েছে কি না। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে ফোন দিতে হবে না। যদি কিছু মনে করে মাইজিন! এসব ভাবতে ভাবতেই তার ফোন বেজে উঠে। ফোনে চোখ বুলিয়ে দেখলো এম দিয়ে সেইভ করা নাম্বার টা। নিশ্চয়ই মাইজিন সেইভ করে দিয়েছে তার নাম্বারটা। সে মাইজিনের ফোন পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। মনে যেনো রঙিন প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই পরিচিত কন্ঠঃস্বর কানে এলো।

‘হ্যালো তুলিকা খেয়েছেন?’

‘হুম আপনি খেয়েছেন?’

‘ হ্যাঁ খেয়েছি! কি করছেন?’

‘এইতো বসে আছি। মিষ্টি ঘুমাচ্ছে!’

‘ওহ আচ্ছা। আপনিও ঘুমাতেন।’

‘নাহ ঘুম আসছে না। আমার দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। একা একা লাগছে। আপনি এখানে থাকলে—!’

নিঃশব্দে হাসে মাইজিন। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই বলে, ‘আমি ওখানে থাকলে কি?’

‘কিছু না তো। গল্প করতাম আর কি।’

‘তাই? এখনো তো গল্প করা যাবে!’

‘আপনি তো অফিসে। কাজে ব্যস্ত নিশ্চয়ই?’

‘ উঁহু ব্যস্ত না তো। এই মাইজিন সুলতান তার বউয়ের জন্য জা’ন দিয়ে দিতে পারে। শুধু একবার বলুন আপনি কথা বলতে চান বউ।’

‘বউ!’ ডাকটা শুনে তুলিকার সারা শরীর কেমন শিউরে উঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালো লাগা কাজ করে৷ একই সাথে লজ্জায় ফোন কে’টে দিলো সে। সে আর একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারবে না। লজ্জায় কানের লতি গরম হয়ে গেছে একদম। মাইজিন কান থেকে ফোন নামিয়ে আলতো করে হেসে ফোনেই চু’মু একেঁ দিলো।

অফিস থেকে সন্ধ্যা ছয়টাই বাড়ি ফিরলো মাইজিন৷ অফিস ব্যাগ রেখে, জুতা, মুজা, খুলে জুতার রেকে রাখলো। রান্না ঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছে। মাইজিন রান্না ঘরে গেলো।

‘আপনি এসে গেছেন। ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি কফি দিচ্ছি!’

‘আল্লাহ আমার বউ দেখি অনেক ঘেঁমেছে। আপনার কাজ করতে হবে না। সারাদিন অনেক কাজ করেছেন। এখন আমি কাজ করবো। সরুন সরুন!’

‘এমা আপনি কি বলছেন এসব? আপনি এই মাত্র অফিস থেকে এসেছেন ক্লান্ত লাগছে না? আমাকে কি হার্টলেস মনে হয় আপনার?’

‘সর্বনাশ! আমি কেন আপনাকে হার্টলেস ভাববো? আপনি হলেন কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ! এখন যান রেস্ট করুন। সারাদিন অনেক কাজ করেছেন!’

‘আপনি আমার চেয়েও বেশি কাজ করেছেন। আমি এখন কিছুতেই আপনাকে কাজ করতে দিবো না।’

‘উম বললেই হলো কাজ করতে দেবেন না। মিষ্টি কই ওর আওয়াজ শুনছি না!’

‘আপনার শালিকা এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।’ হেসে বললো তুলিকা!

‘উম উম শালিকা বলবেন না। ওঁ আপনার যেমন আদরের ছোট্ট বোনটি ঠিক আমারও!’

‘আপনি কি দিয়ে তৈরি বলুন তো? আপনি ক্লান্ত হোন না তাই না?’

‘ উঁহু ক্লান্তি আমাকে ছুঁতেই পারে না। আচ্ছা আপনি মোচা চিংড়ি খেয়েছেন এর আগে?’

‘নাহ খাওয়া হয়নি!’

‘ওকে চলুন আজকে আমি রান্না করে খাওয়াবো। আপনি শুধু আমাকে এসিস্ট করুন!’

‘ বুঝতে পেরেছি! আপনি আমার কথা শুনবেন না?’ গাল ফুলিয়ে বলে তুলিকা। আর মাইজিন সুন্দর করে দাঁত বের করে বলে,

‘নাহ!’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here