হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ৯

0
940

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব৯
#রাউফুন

সকল প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনার পর তারা তিন জন মিলে সব কিছু গুছিয়ে ফেলার কাজে লেগে গেলো। ফ্রীজ, দুটো খাট, একটা কাউচ, ডাইনিং টেবিল, গ্যাসের চুলা। বাজারের মধ্যে, মাছ, মাংস, সকল সবজি, রান্না ঘরে রাখার জন্য রান্নার সকল প্রয়োজনীয় গুডস কেনা হয়েছে। তুলিকা আর মিষ্টির জন্য বেশ অনেক গুলো জামা কেনাকাটা হয়েছে। যদি-ও তুলিকা জামা কেনার সময় বার বার বারণ করেছিলো মাইজিনকে এতো সব ড্রেস তার লাগবে না। দুটো হলেই হবে। কিন্তু মাইজিন তার কথা শুনেই নি।

তারা এক সাথে দুটো খাট, ঘর সাজালো! তুলিকা মাছ মাংস সব কে’টে ফ্রীজে তুলে রাখলো। দুপুরের খাবার তারা বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছে। মাইজিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে তুলিকাকে পরখ করছিলো। মেয়েটা এতো কিছুর পরেও ক্লান্ত হয়নি। মাইজিন তাকে দেখে মুচকি হাসে! এরকম একজন মানুষ তার জীবনে আসবে সে কখনোই ভাবেনি। এমন শান্ত শিষ্ট মেয়ে সে তার কল্পনায় রাখতো। সব কাজ শেষ হলে তুলিকা গোসল করে নতুন একটা থ্রি পিস পরলো৷ মিষ্টিও গোসল করে কালো খয়েরি রঙের একটা জামা পরে নিলো। মিষ্টিকে একদম মিষ্টি পরী লাগছে এতে। তুলিকা বোনকে আদর করে রাতের রান্না চাপালো। মিষ্টিও বোনের কাজে সাহায্য করলো৷

রাতের খাবার খাওয়ার পর মাইজিন তুলিকার রান্নার ভীষণ প্রসংশা করলো। মিষ্টি ঘুমানোর পর মাইজিন তুলিকাকে ডাকলো৷ ডেকে তার হাতে একটা ফোন দিলো প্রথমে। ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যায় তুলিকা।

‘ফোন দিয়ে আমি কি করবো?’

‘কি করবেন মানে? আমি অফিস গেলে আমাকে কল করবেন। আর একটা ফোন যে কতটা প্রয়োজনীয় সেটা জানেন না?’

সত্যিই একটা ফোনের প্রয়োজন আছে। কাল যখন মাইজিন আসতে লেট করছিলো তখন তো তার বেশ চিন্তা হচ্ছিলো। ফোন থাকলে কল করে জেনে নেওয়া যাবে এরপর তার অবস্থান। তুলিকা হেসে ফেলে আনমনে।সে প্রস্থান করতে চাইলে মাইজিন আর একটা পিংক কালারের শাড়ী দিয়ে মুচকি হেসে বলে,

‘এটা আপনার জন্য। আপনি যেদিন আমাকে মেনে নিয়ে আমাকে কাছে চাইবেন সেদিন এই শাড়ীটা পরে আমার সামনে আসবেন। সেদিন আমি বুঝে যাবো আপনি আমাকে ভালোবাসেন। আমাকে গ্রহণ করতে চান সম্পুর্ন রুপে!’

তুলিকা লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বলে, ‘আমি যদি কখনো রাগ করি সে রাগ ভাঙাবেন কীভাবে? আমি তো আপনার ধরা ছোঁয়ার বাইরে!’

তুলিকা জানে না এই প্রশ্ন টা সে কেন করলো। নিতান্তই অবান্তর আর ফালতু একটা প্রশ্ন ছিলো এটা। কিন্তু এমনিতেই মাথায় এসেছে তাই করলো প্রশ্নটা।

‘আপনাকে না ছুঁয়ে, আপনার কাছে না গিয়েও ঠিক আপনার রা’গ, অভিমান ভা’ঙি’য়ে নেবো। সে ক্ষমতা মাইজিন সুলতান রাখে! আপনার মনের অব্যাক্ত কথা বুঝে নেবো আপনার চোখের দিকে তাকিয়েই!’

‘হাউ ইউ অবজার্ভ মাই আইস?’

‘কেন অবজারভ করা নিষেধ?’

‘নাহ তা নয়!যদি আপনার সামনে না থাকি আমি তখন? মানে ধরুন আমি সামনে নেই আপনার। তখন কিভাবে অবজার্ভ করবেন যদি আমি ডিসপ্লে এর ওপাশে অবস্থান করি?

‘ইভেন্ট!’

‘ইভেন্ট?’

‘হুম চোখ বন্ধ করে কল্পনা করবো না হয়! আপনাকে শুধুই অনুভব করে, কল্পনায় আপনার অভিমান ভা’ঙা’বো।’

মাইজিনের এমন মিষ্ট ভাষায় লজ্জা পেয়ে যায় তুলিকা। মিষ্টি ঘুমিয়ে গেছে আজ। যদি মিষ্টি জেগে থাকা অবস্থায় মাইজিন তাকে ডাকতো তবে ভীষণ লজ্জায় পরতো মেয়েটা।ছোট বোন যদি কিছু ভেবে বসে তখন লজ্জা পাবে না তুলিকা?তাই মাইজিন মিষ্টি ঘুমানোর পরই তুলিকাকে ডাকে৷

‘চলুন বারান্দায় গিয়ে বসি। কিছুক্ষন গল্প করা যাক।’

‘চলুন।’ তারা দুজন টুলসের উপর বসে! আকাশের পানে তাকায় দুজনেই। তুলিকা বলে,

‘আপনার আর আমার তো হুট করেই এভাবে বিয়েটা হয়ে গেলো। আপনার সম্পর্কে তো তেমন কিছু জানি না আর আপনিও আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না।’

‘আমার বাবার নাম আব্দুর রৌফ সুলতান! মায়ের নাম আসমা সিদ্দিকা! আমি মাইজিন সুলতান! এম এস কোম্পানির মালিক। বয়স সাতাশ। বাবা দেশের বাইরেই বেশি সময় থাকেন। গাজীপুরে আমাদের নিজেদের ছয়তলা বাড়ি আছে! এখান থেকে যেতে দুই ঘন্টা লাগবে। পুরো সম্পত্তি বাবা আমার নামে করে দিয়েছেন কারণ আমি তার এক মাত্র সন্তান। আবার ভাববেন না আমি নিজেকে আপনার সামনে অনেক বড় কেউ-ই প্রুফ করতে চাইছি বা নিজেকে নিয়ে অহংকার করছি। আপনি জানতে চাইলেন তাই বললাম। তাছাড়া আপনার সত্যিই আমার ব্যাপারে জানার ছিলো।’

‘আপনার কোনো বদ অভ্যাস নেই? এই যেমন ধরুন সিগারেট, ড্রিংকস! মানে হয় না বড়লোকের ছেলেরা তো ক্লাব, পার্টি, ডিস্কে যায়।’

‘আমি শুধু মাঝে মধ্যে সিগারেট খায়। সেটাও লোক চক্ষু সামনে না। আমার ইচ্ছে ছিলো বউয়ের সামনে ছাড়া কারোর সামনে সিগারেট খাবো না। আর বাড়ির কেউ-ই জানেও না আমার সিগারেট খাওয়ার বিষয়টা!’

তুলিকা মাথা দুলিয়ে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে। সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই বেশ গুছিয়ে দেয় মাইজিন

মাইজিন তুলিকাকে প্রশ্ন করে, ‘আপনার ইন ফিউচার হাসবেন্ডকে নিয়ে কি রকম ফ্যান্টাসি কাজ করতো?’

‘হাসবেন্ড নিয়ে আবার ফ্যান্টাসি হয় নাকি?’

‘কেন হয় না। প্রতিটি মেয়ের বিয়ের আগে তার হাসবেন্ড নিয়ে আলাদা একটা ফ্যান্টাসি থাকে।’

‘আমার তেমন কিছু কখনোই মাথায় আসেনি। আমার মাথায় শুধুই মিষ্টির সুন্দর একটা ফিউচার নিয়ে ভাবনা চিন্তা থাকতো!’

‘আপনি কখনোই প্রে’মে পরেন নি?’

‘উঁহু! আপনি পরেছিলেন?’

‘উম আমি জীবনে অনেক গুলো প্রেম করেছি মিথ্যা বলবো না। আপনাকে আমি ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেও ঠকাতে চাই না৷ আর মিথ্যা আমি যেমন বলি না তেমন সহ্যও করি না। আমি কিন্তু সত্যি কারের প্রেমে কখনোই পরিনি।’

তুলিকা রেলিঙের উপর হাত ভর দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে, ‘আপনি তো দেখছি গভীর জলের মাছ। আচ্ছা আপনি কি তবে আমার প্রে’মে পরেন নি?’

‘এটাও মিথ্যা বলবো না। প্রথম দেখায় কখনো ভালবাসা হয় না। যা হয় তা হলো ভালো লাগা!
আর সেই ভালো লাগা নিয়ে ভাবতে থাকলে সৃষ্টি হয় ভালবাসার। আমি তো এক মুহুর্তের জন্যও আপনার ভাবনা আমার ব্রেইন থেকে বের করতে পারিনি!’

তুলিকার একটু মন খারাপ হয়ে যায় মাইজিনের কথায়। তবে কি বিয়েটা করে কখনো মাইজিন পস্তাবে?

‘কি ভাবছেন? আমি আপনাকে বিয়ে করে কখনো পস্তাবো কি না? কখনোই পস্তাবো না। এটা মাথায় রাখবেন সব সময়!’

মাইজিন হেসে একটি সিগারেট বের করে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরলো। তার ওই সুন্দর ঠোঁটে এই বিষাক্ত জিনিসটা খুবই বেমানান লাগলো। তুলিকা সেটা কে’ড়ে নিয়ে বললো,

‘আপনি আমার সামনে সিগারেট খাচ্ছেন?’

‘আপনি তো আমার নিজের মানুষ খেলে কি হবে? আর বললামই তো বউয়ের সামনে খাবো!’

‘আমি সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।’ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো তুলিকা। মাইজিন কিছু বলবে তখনই তার ফোন টা বিকট শব্দ বেজে উঠলো! তুলিকা বললো,

‘আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে মাইজিন। আপনি কথা বলুন আমি আসছি!’

মাইজিন বুঝতে পারলো তুলিকা তাকে স্পেস দিতে চাইছে তাই ঘুমানোর কথা বলছে। তুলিকা চলে গেলে মাইজিন ফোন রিসিভ করে।

‘মাইজিন এসব কি করছো? দুই দিন থেকে বাসায় আসছো না! আজ একাউন্ট চেইক করে দেখলাম দুই লাখ টাকা সেখান থেকে খরচ হয়েছে। তুমি ছাড়া তো কেউ-ই টাকা উঠাবে না?’

মাইজিন সুক্ষ্মভাবে উত্তর দেয়, ‘আমার টাকা খরচ করার রাইট নিশ্চয়ই আমার আছে? আপনাকে বলে কয়ে খরচ করতে হবে এখন?’

‘শাট আপ মাইজিন।এভাবে কথা বলছো আমার সঙ্গে? তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করছো রীতিমতো!’

‘তর্ক করছি না।শুধু আমার কাজে হস্তক্ষেপ কর‍তে বারণ করছি আপনাকে।’

‘তোমার বাবা আসুক দেশে।তোমার বেয়াদবির কথা এবার আমাকে বলতেই হবে!’

‘এই জীবনে আপনার সঙ্গে কবে বেয়াদবি করেছি বলতে পারবেন? আমি তো এই পর্যন্ত কখনোই বিনা কারণে একটা টাকাও খরচা করিনি। তবে আজ যখন করেছি আপনাকে সেটা নিয়ে কেন কৈফিয়ত
দেবো? আপনি যখন হাজার হাজার টাকা আপনার বাবার বাড়ি, আপনার বোনের বাড়ি, বোনের মেয়েকে হাত ভরে টাকা দিচ্ছেন। আমি কি কখনোই এটা জিজ্ঞেস করি যে, আমার টাকা, আমার সম্পত্তির অংশ কেন অন্য বাড়িতে দেওয়া হয়? কেন এতো টাকা অযথা খরচ হচ্ছে? আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করেছি কখনোই? আপনি কি ভেবেছেন আমি আপনার গতিবিধি সম্বন্ধে ধারণা রাখি না?’

রাগ গজগজ করতে করতে কল কেটে দিলেন শাপলা। তিনি সব সময় মাইজিনকে হাতে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু আজকে যখন একাউন্ট চেইক করে দেখলেন মাথায় বা’জ ভেঙে পরেছে তার। ছেলেটা তার বিরুদ্ধে গিয়ে বেকে না বসে। শেষে সব সম্পত্তি হাত ছাড়া হবে! খুব শীঘ্রই শারমিনের সঙ্গে মাইজিনকে বিয়ে দিতে হবে। না হলে আরও হাতের বাইরে চলে যাবে।

তুলিকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিছুতেই দু চোখে ঘুম আসছে না। মাথার মধ্যে মাইজিনের কথা ঘুরপাক খাচ্ছে সামন তালে। সে উঠে বসলো বিচলিত হয়ে! মাইজিন তার মায়ের নাম আসমা সিদ্দিকা কেন বললো? এটা তো তখন সে ভাবে নি? সে যতটুকু জানে মাইজিনের মা মানে তার শাশুড়ীর নাম শাপলা! হ্যাঁ তার স্পষ্ট মনে আছে মাইজিনের মায়ের নাম শাপলা! তবে আসমা সিদ্দিকা কার নাম?নাকি আসমা সিদ্দিকা মাইজিনের মায়ের ভালো নাম।শাপলা নামটা সবাই জানে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here