হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ১১

0
956

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১১
#রাউফুন

‘মাইজিন ভাইয়া মোচা চিংড়ি জাষ্ট ওয়াও!’

‘ওরেম্মারে মিষ্টি তুই ইংরেজি বলছিস?’

‘সেকি বুবুজান তোমার কি আমাকে খুব গাধা স্টুডেন্ট মনে হয়? ভাইয়ার চমৎকার রান্নার জন্য আমার কাছে যদি এর চেয়েও ভালো কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার থাকতো আমি দিতাম। এতো সুস্বাদু খাবার আমি আগে খায়নি!’

‘ হ্যাঁ তাই তো। এতো বছর যখন আমি রান্না করেছি তখন তো চেটেপুটে খেতি। রান্না কি ভালো হতো না?’

‘দেখেছো মিষ্টি তোমার বুবুজান আমাকে হিংসে করছে!’

‘উম মোটেও আমি আপনাকে হিংসে করছি না।’ বললো তুলিকা।

‘মাইজিন ভাইয়া ইউ আর গ্রেট!’

‘মাই প্লেজার ডার্লিং!’

স্বশব্দে হেসে উঠলো তুলিকা আর মিষ্টি।

‘মাইজিন কাল থেকে যেনো আপনাকে রান্না ঘরের আশেপাশেও না দেখি।’

‘কেন দেখলে কি হবে? আপনি জানেন, আমাদের ফ্যাক্টরিতে অর্ধেকই মহিলা কর্মচারী, মহিলা এমপ্লয়িই। তারা ভোরে উঠে সকালের ব্রেকফাস্ট করে স্বামী সন্তানের জন্য রান্না করে, তারপর নিজে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অফিস আসে। তাও ভোর সাতটাই। তারা আবার রাতে ফিরে গিয়ে রাতের রান্না করে স্বামী সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেই। তারা তো আমাদের মতো বসদের চেয়েও বেশি কষ্ট করে। তারা যদি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে পারে আমরা পুরুষরা কেন পারবো না। যেসব পুরুষরা তাদের সঙ্গীনিদের হাতে হাতে কাজে সাহায্য করতে কার্পণ্য করে তারা আসলে কাপুরষ। সব পুরুষ যেমন কঠোর না আবার সব মহিলাও কিন্তু কোমল না। অনেক সময় মেয়েরাও পুরুষের মতো কঠোরতা বজায় রেখে চলতে পারে। তারাও নিজের মনে এমন ধারণা পোঁষন করতে পারে, ❝নারী তোমার কাঁদতে নেই। কাঁন্না তোমাকে মানায় না! তুমি ভেতর থেকে যতটা কোমল বাইরে তার থেকেও বেশি কঠোরতা বজায় রাখার ক্ষমতা তোমার আছে।❞ অনেক নারী এমন আছে যে নিজের কোমলপ্রাণ কে সবার সম্মুখে না এনে মুখে কঠিন ভাব বজায় রাখে। জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় সময়েও সে অবিচল, কঠোর, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা না হারিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। নারী কোন সময় কোন রুপি হয় সেটা বুঝার জন্য যে মন টা দরকার তা শতাধিক পুরুষের নেই। থাকার কথাও না। এমনো নারী আছে যাকে বুঝার দুঃসাহস কারোরই থাকে না। আর যে পুরুষ নিজের বউকে বুঝতে পারে না সে নিতান্তই অধমের কাতারে পরে৷ আমি সেই অধমের কাতারে পরতে চাই না। আমি আপনাকে সব সময় সাহায্য করবো আপনার কাজে।’

‘আমায় এবার ক্ষ্যামা দিন মাইজিন মশাই। আপনার সঙ্গে কথায় পারবো না আমি। যে কথায় বলবো আপনি তার বিরুদ্ধে লম্বা একটা আর্গুমেন্ট দাঁড় করিয়ে দিবেন।’

আবারও মিষ্টি আর মাইজিন হো হো করে হেসে উঠলো।

‘হয়েছে অনেক হেসেছিস। দাঁতে পোকা পরবে মানুষকে বুঃ (Boo)করে হাসলে।’

‘আমি একটুও বুঃ করছি না বুবুজান।’

খাওয়া দাওয়া শেষ করে মিষ্টি পাশের রুমে পড়তে বসে। আজকে আসার সময় মাইজিন তার বই এনেছে। বই পেয়ে মিষ্টি ভীষণ আনন্দিত!

তুলিকা গুটিগুটি পায়ে মাইজিনের রুমের দিকে আসে৷ দরজায় দাঁড়িয়ে দোনামোনা করে রুমে আসবে কি না। মাইজিন বুঝতে পেরে ল্যাপটপে চোখ রেখে শুধাই,

‘কি হ’য়েছে কি? নিজের স্বামীর রুমে আসতে এতো সংকোচ কিসের মিসেস সুলতানের।’

‘নাহ আসলে ভাবলাম আপনি কাজ করছেন আমি রুমে গেলে যদি ডিস্টার্বড ফীল করেন। আমি বরং এখন যায় আপনি কাজ শেষ করুন।’

‘নাহ! আমার কাছে সব কিছুর আগে আমার বউয়ের প্রায়োরিটি বেশি। সব কাজ বন্ধ। আপনি ভেতরে আসুন। আর কখনোই আমার রুমে আসার আগে অনুমতির অপেক্ষা করবেন না। মনে থাকবে?’

‘আচ্ছা মনে থাকবে।’

তুলিকা ভেতরে এলে মাইজিন তাকে বিছানায় বসতে বলে। তুলিকা এক সাইডে বসে। সে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে দেখে মাইজিন বলে,

‘আরে আপনি আবারও আমার সঙ্গে সংকোচ করছেন? আমি কি এতোটাই খারাপ মানুষ যে আমার সঙ্গে একটু নিঃসংকোচে দুটো কথাও বলা যায় না?’

‘না না কি সব বলছেন আপনি। আসলে কাল আশফি, নীতি ভাবি, সাইমুম, নীরব ভাইয়ারা আসতে চাইছিলেন। প্রথমবার এখানে আসবে তাই না করতে পারিনি মাইজিন।’

‘আরে আপনি তো খুব কুড়ো বউ দেখছি।’

‘এহ!’

‘ হ্যাঁ কড়োই তো। আমার বাসায় মেহমান আসবে আর আপনি না করবেন? আপনার সাহস তো কম নয়। যদিও আমার বউটার একটু বেশিই খাটনি হবে তাও ব্যাপার না। আপনার বর আছে তো।’

মাইজিন চোখ টিপে হাসলো তুলিকার দিকে তাকিয়ে।

‘এই না না মাইজিন আপনি ওঁদের সামনে একদম রান্না বান্না করতে যাবেন না। ওঁরা কি ভাববে আমাকে? আমি একটা দ’জ্জা’ল বউ। শুধু স্বামীকে খাটাই!’

‘আপনি সত্যিই দ’জ্জা’ল বউ। কত খাটাচ্ছেন আমাকে জানেন! উফফ! ওঁদের শুধু আসতে দিন আমি সব বলে দিবো!’

‘মাইজিইইইন!’

‘আহ কি মধুর ডাক!’ তুলিকা ক্ষীপ্ত হয়ে বালিশ ছুড়ে মা’রে মাইজিনের দিকে। আর মাইজিন হাসতে হাসতে সেটা ক্যাচ করে।

পরদিন মাইজিন সারাদিন অফিস যায়নি৷ দুপুরে আশফিরা এখানে আসলো৷ এসে তারা তুলিকাকে ভীষণ জ্বালাতন করেছে। যত রকমের লেকপুল করা যায় করে নিচ্ছে। মাইজিন খাবার টেবিলে সাজিয়ে বলে,

‘এই যে ভাবিরা এবার আমার বউকে ছাড়ুন। খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। খুব জ্বালাচ্ছেন কিন্তু আমার বউকে।’

‘ওহোহো! বউকে চোখে হারাচ্ছেন ভাইয়া?’

‘এই মাইজিন তুমিও দেখি নীরবের মতো বউ পা’গ’লা হয়েছো। পোঁড়া কপাল আমার। আমার স্বামীই আমাকে চোখে হারায়**!’

‘স্টপ স্টপ ভাবি। আপনি অন্তত পক্ষে আমার কাছে এই গল্প ফাঁদবেন না। সেদিনই বুঝেছি আপনাকে সাইমুম ভাইয়া চোখে হারাই কি না। আমি সারাজীবন মনে রাখবো সেদিনের কথা!’

সবাই সমস্বরে হেসে উঠলো। মিষ্টিকে তুলিকা জোর করে স্কুলে পাঠিয়েছে। তা না হলে সেও হেসে লুটোপুটি খেতো!

‘বাই দ্যা ওয়ে সাইমুম ভাইয়া আর নীরব ভাইয়া আসলেন না কেন?’

‘আর বলবেন না ভাইয়া। তারা তো অফিসে ব্যস্ত।বলেছে রাতে আসবে আমাদের নিতে।’

‘তাহলে আসুন আপনারা খেয়ে নিন।’


খাওয়া দাওয়া শেষ মাইজিন অফিসে একটা জরুরি কাজে গেছে। এদিকে তুলিকা যেনো কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামী সেভাবে তাকে ঘিরে রাখা হয়েছে। তুলিকা ফেসে গেছে এরকম ফেইসে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নীতি আর আশফিকে পরখ করছে।

‘আপনারা কি বলবেন আমাকে এভাবে ঘিরে কেন ধরেছেন যে?’

‘এই তুই মাইজিন ভাইয়াকে দিয়ে খাটাস? তখন বলতে পারিনি। এসেই দেখলাম ভাইয়া রান্না করছে। আবার খাবার টেবিলে সাজাচ্ছে৷ ব্যাপার খানা কি রে?’ ভ্রু কুচকে বলে আশফি।

‘হায় আল্লাহ্ কপাল আমার। আমি আপনাদের মাইজিন ভাইয়াকে কত্তো বারন করেছি তিনি শুনেন নি। আমিও রান্না করেছি কিন্তু উনি বলেছেন উনি মুরগীর রোষ্ট নাকি খুব ভালো বানান। তাই জোর করে রোষ্ট করেছেন।’

‘তাই তো বলি এতো মজা কেন!’ বললো নীতি।

‘এই শোন তুলি জীবনে মাইজিন ভাইয়ার মতো এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার! তাকে কষ্ট দিস না কখনোই।’

তুলিকা নিশ্চুপ হয়ে শুনলো শুধু আশফির কথা।

‘আচ্ছা সত্যি করে বলতো তোদের মধ্যে কি কিছুই হয়নি?’

‘ইয়েহহ! কি হবে?’

‘ইয়েহহ কি রে? তোদের ফুল সজ্জা হয়নি?’

‘ ইশ কিসের সজ্জা! আমার জামাই তোদের মতো লুচু নাহ! হাহ্!’

‘মানে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যা হয় তা এখনো হয়নি?’ বললো নীতি।

‘অসম্ভব!’

‘আজকে হবে। আমরা হওয়াবো।’

‘নায়া! বিয়ে করে কি সব লাজ লজ্জা ভুলে গেলি নাকি আশু। কি ভাবনা তোর! আর ভাবি আপনার থেকে এরকম আশা করিনি।’

‘এই রাখ তো তোর আশা! প্রথম থেকে শেষ দিন যা যা হয়েছে সব বল দেখি!’

তুলিকা মুখ গোমরা করে বিয়ের আগের কথা এবং এরপরের সব কথায় আশফি আর নীতিকে বললো। আশফি কিছু একটা ভেবে বললো,

‘শোন আজকে আমরা দুই জা এখানে থাকবো। মাইজিন আর সাইমুমকে আউট, মানে ওঁদের এখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আজকে তুই মাইজিন ভাইয়ার দেওয়া শাড়ীটা পরবি।’

‘নোপ! আই কান্ট ডু ইট!’

‘ইয়াহ্ ইউ ক্যান!’

‘নো! নো!’

‘ইয়েস ইয়েস!’আশফির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো নীতি।

‘যে মানুষটা কে তুই দূরে দূরে রাখছিস তার দিক টা কি কখনোই ভেবেছিস তুলি? তার কি বুকে ব্যথা করে না? সেই মানুষটাও তো চাইতে পারে, তার ভালোবাসার মানুষটা সুখ দুঃখে তার পাশে, তার সঙ্গে থাকুক। এমন মানুষের মধ্যেই তো নারী মন ভালোবাসা খোঁজে! হেলায় হেলায় সব হারাস না তুলি। পরে পস্তাবি।’

তখনও নিশ্চুপ তুলিকা। তার ভেতরে একটু আধটু কষ্টের উদ্রেক হলো আশফির কথায়। সত্যিই তো সে মাইজিনের কথা তো কখনোই ভাবেনি। সে কি জেনে বুঝে মাইজিনকে কষ্ট দিচ্ছে? যে মানুষটা তার কথা এতো ভাবে। তার কষ্ট হবে বলে অফিস করে এসেও তার কাজে সাহায্য করে এই মানুষ টা কি তার কাছে কিছু এক্সপেক্ট রাখতে পারে না?

সবাই জম্পেশ খাওয়া দাওয়া করে রাতে জোর করে সাইমুম আর নীরবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো আশফিরা। এরপর আশফি আর নীতি তুলিকা কে শাড়ী পরিয়ে সাজিয়ে দিলো দিলো।মাইজিনের ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।তুলিকা দ্বিধাদ্বন্দ্বে দু-চোখ বন্ধ করে বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দু-হাতে শাড়ীর আঁচল চেপে ধরলো শক্ত করে। মাইজিন দু চোখ ভরে দেখছে তুলিকাকে। তুলিকার চোখ তখনও বন্ধ। মনে মনে যত্তো গা’লি আছে সব দিচ্ছে আশফি আর নীতিকে। মাইজিন এক পা এগিয়ে আসতেই তুলিকা ফট করে চোখ খুলে বলে,

‘আমার কোনো দোষ নেই। আশফি আর নীতি ভাবি জোর করে শাড়ী পরিয়েছে আমাকে।’

‘আমি জানি তো। কিন্তু আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? ওঁরা তো জোর করে পরিয়েছে কিন্তু আপনার এখানে কাঁপাকাঁপির কি আছে?’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here