হলদে_প্রজাপতি পর্ব-৪৩

0
270

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

তেতাল্লিশ

( আগের অধ্যায়গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

বাবাকে যখন দেখলাম তখন বাবা আচ্ছন্ন । ঘোরের মধ্যে রয়েছে । একেবারে কাছাকাছি নার্সিংহোমে স্টাফরা যেতে দিচ্ছে না পেশেন্টের রিলেটিভদের । আমি একবার করে বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম , একবার করে বেডের পাশে রাখা মনিটরটার দিকে , অবুঝ ভাবে । মনিটরে যে লেখা , সংখ্যা আর গ্রাফগুলো ফুটে উঠছিল , সেগুলো সবই যেন কোন এক অবোধ্য ভাষায় লেখা । দেখেও দেখছিনা , পড়লেও মাথা কিছু নিচ্ছে না। বাবার চোখ কখনো বন্ধ, কখনো আবার একটু খুলছে। মুখ নাক যান্ত্রিক মেঘে অস্পষ্ট। সরু, মোটা , নল এদিক ওদিক করে চলে গেছে । কোন কিছুরই যেন কোন অর্থ বুঝতে পারছিনা আমি । দৃশ্যটা একটা অবোধ্য ছবির মত লাগছে । এমন কেন হচ্ছে ? ঠিক এই রকম অনুভূতি তো জীবনে কখনো হয়নি । বাবারই তো বছর পাঁচেক আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছিল । তখনও আইসিইউতে দেখেছি । কই এমন লাগেনি’ । আজ ভেতরটা কোন অজানা ঝড়ের আশঙ্কায় যেন থমকে গেছে । এই আপাত সচল দুনিয়াটার কোন অর্থই আর মাথায় ঢুকছেনা । কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছি ওইভাবে ঠায় চোখ মেলে । পায়ের তলা দিয়ে বয়ে গেছে সময়ের স্রোত । তারপর এক সময় টলটল পা’য় ওয়ার্কিং আর এম ও’র কাছে গিয়ে বাবার কন্ডিশন জানতে চাইলাম ।
ডাক্তার বললেন , স্যার আসবেন রাউন্ডে ঘন্টাখানেক পর। তখন আপনি ডিটেইলস ওনার কাছেই জেনে নেবেন ম্যাডাম । ডাক্তার অজিতেশ মন্ডল ওনাকে মেইনলি অ্যাটেন্ড করছেন ।

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেল । আমি আর মা বেরিয়ে এলাম । মা আমাকে আসতে দেখে প্রথমেই একবার রেস্টলেস হয়ে উঠেছিল । ভীষণরকম কান্নাকাটি করছিল। এখন স্টেবল হয়েছে। মাকে নিয়ে গিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসলাম । ঘন্টাখানেক ওয়েট করে ডাক্তার অজিতেশ মন্ডলের সাথে কথা বলে এখান থেকে চলে যেতে হবে । কারণ , এখন আর হসপিটালে থেকে লাভ নেই । বাবার সাথে তো আর দেখা হবে না এখন । আবার বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে আসতে হবে। ছোট মাসি আর মেসোমশাই এসেছে । ওরাই মায়ের সাথে ছিল । মেসোমশাই গিয়ে আমাদের জন্য গরম গরম কফি এনে দিল। আমি আর মা দুজনেই কফির কাপ হাতে নিয়ে বসে বসে ঠান্ডা করছি দেখে ছোট মাসি প্রায় জোর করে আমাদের মুখের সামনে তুলে ধরল। খেলাম । তবে মনে হল যেন চিরতার জল নামছে গলা বেয়ে । এখান দিয়ে এই করিডোর পেরিয়ে বাবাকে য’বে আবার সুস্থ করে নিয়ে যেতে পারবো, তার আগে পর্যন্ত গোটা দুনিয়াটা বিষ লাগছে। লাগবে আমি জানি ।

কিছুক্ষন পর ডক্টর অজিতেশ মন্ডল এলেন । রাউন্ডে গেলেন । সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর, আমি আর মেসোমশাই দুজনে মিলে গেলাম ওনার সাথে কথা বলতে। গুরুগম্ভীর , লম্বা , সাহেবের মত চেহারা । রাউন্ড সেরে ফাস্ট বেরিয়ে যাচ্ছিলেন । বাবার নাম করে কন্ডিশন জানতে চাইতে, হাতের ফাইল ওপেন করে দু তিনটে পেজে ফাস্ট চোখ বুলিয়ে নিলেন। বেশি কথা বললেন না। যেটুকু যা বললেন, বাবার মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন মারাত্মক কিছু সিভিআর নয় । কিছুদিন ইনটেন্স মেডিকেল অবজারভেশনে থেকে সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা । বাকি ঈশ্বরের ইচ্ছা ।
ঈশ্বরের ইচ্ছা !
ঈশ্বরকে চোখে দেখা যায় না । অনুভব করা যায় না পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে । তাই তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা বোঝার কোন উপায় নেই। তবু মা দিনের অর্ধেক সময় ঠাকুর ঘরে পড়ে রইল। আমি মনে-মনে স্মরণ করতে লাগলাম আমার কেষ্টঠাকুরকে ।
বললাম , ঠাকুর তুমি শুধু বাবাকে সুস্থ করে পাঠিয়ে দাও । যে লাউঞ্জটা দিয়ে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আই সি ইউ এর উদ্দেশ্যে, সেই লাউঞ্জ আর করিডোর পেরিয়ে বাবাকে যেন সুস্থ করে নিয়ে আসতে পারি।

এই করে কয়েকটা দিন কাটল। দিন-রাত, ঘুম-জাগরন, সব মিলেমিশে একাকার । শুধু ভিজিটিং আওয়ারস এর টাইমটা মাথায় থাকে। পৃথিবীর বাকি সবটা যেন ঝাপসা । এইভাবে কয়েকটা দিন কাটার পর বাবাকে জেনারেল বেডে দিল। বাবা টুকটাক করে কথা বলতে আরম্ভ করল আমাদের সঙ্গে।

পুজো আসছে সামনে । দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে। আজ মহালয়া। দেবীপক্ষের সূচনায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চণ্ডীপাঠ আর আজন্মলালিত এক সমুদ্র আবেগ নিয়ে আকাশবাণীর নিবেদন শুনতে শুনতে চোখের জলে বালিশ ভিজে এল।
মা’কে বারবার বললাম, মা আর কেন ? ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ । আমাদের ঘরেও সেই আলোর বেণু বেজে উঠুক । এবার বাবাকে তুমি সুস্থ করে ঘরে ফিরিয়ে দাও । বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পূজোটা কাটাই। মন কষাকষির জন্য কিছুটা রাগ করেই বাবা ওখান থেকে চলে এসেছিল । আমাকে পুজোর পোশাক দেয়নি এখনো । পুজোয় বাবার দেওয়া জামা-শাড়ি, যাইহোক, পরে এক আকাশ প্রাপ্তি নিয়ে তোমার ত্রিনয়নের দিকে চোখ মেলে তাকাবো । মাগো ! বাবাকে তুমি ঘরে ফিরিয়ে দাও –

মা আমার কথা শুনলেন। কখনো কখনো মা’কে রক্তমাংসের মানবী বলে বোধহয়। মনে হয় যেন, হাত বাড়ালেই মায়ের মন ছোঁয়া যায় । এই কেমন নিজের মনের সবটুকু চাওয়া দিয়ে মায়ের মনকে ছুঁয়ে দিলাম ! সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের করিডরটা দিয়ে গর্বিত পদক্ষেপে আমার সুপার হিরো বাবাকে নিয়ে চলে এলাম বাড়ি ।
আজ তৃতীয়া । দুদিন পরেই ষষ্ঠী । মায়ের বোধন । বাবা ঘরে ফিরে এসে একটু ধাতস্থ হয়ে নিয়ে পরের দিন অল্প কাঁপা কাঁপা হাতে আমাকে চারটে হাজার টাকা বার করে দিল ।
বলল, পুজোর আগে তো তোদের উপর দিয়ে বেশ ঝামেলা বয়ে গেল । অনেক দেরি হয়ে গেল মা । তোর আর তোর মায়ের জন্য দুটো শাড়ি কিনে আনিস আজকে ।
দুচোখ ভরে জল এলো । বাবার হাতে করে তুলে দেওয়া পুজোর এই উপহারটুকু না পেলে পুজো কি কাটে ? সে যে থমকে যাবে । টাকাটা দুহাত ভরে নিয়ে চোখের জল হাতের পিঠে মুছে ফেলে প্রায় ছুট্টে বেরিয়ে গেলাম বাজারে। বাবার দেওয়া পুজোর উপহার কিনতে যাওয়ার সময় আমি আজও সেই তেরো চোদ্দো বছরের কিশোরী তরু । এই একটা ক্ষেত্রে বয়স আমার আজও থমকে রয়েছে। মায়ের জন্য একটা হাজার বুটির মেরুন পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়ি আর নিজের জন্য কচি কলাপাতা রঙের একটা তাঁতের শাড়ি কিনলাম। এইতো গেল বাবার দেওয়া উপহার। আমি বুঝি বাবা-মাকে দেব না? মায়ের জন্য একটা সফট পিওর সিল্ক আর বাবার জন্য খাদির পাঞ্জাবি কিনলাম । দেশের বাড়ি থেকে আমাদের জন্য পুজোর পোশাক আসে , জ্যাঠাইমা পাঠায় । এবার বাবার অসুস্থতার কারণে ওদেরও পাঠাতে দেরি হলো । ছোট মাসিও প্রতি পুজোতেই পোশাক দিয়ে থাকে । পঞ্চমীর দিন এসে হাজির হলো । আমিও প্রতিবার নিজেকে নিজে কিছু না কিছু উপহার দিই। দামি কিছুই দিই । এবার আর দিইনি যদিও । তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাবার হাতে তুলে দেওয়া টাকা কটা দিয়ে কেনা ড্রেসটা যেন অন্যমাত্রার । পোশাকের মূল্য কি প্রিন্টেড প্রাইস এ নির্ধারিত হয়? তার মূল্য নির্ধারক হল মনের আবেগ ।

অষ্টমীর দিন রাত ন’টা নাগাদ পাড়ার প্যান্ডেলে বাবার দেওয়া শাড়িটা পরে বাবার হাত ধরে টুকটুক করে গিয়ে বসলাম । কর্পোরেট পুজোর যুগে পাড়ার ঘরোয়া ব্যান্ডেলে মহাষ্টমীর রাতে এই সময়ে বিশেষ ভিড়ভাট্টা নেই । ঢাকের বাদ্যি এখন বন্ধ । ঢাক বেজে উঠবে আবার সন্ধি পুজোর সময় । বাবা প্যান্ডেলের চেয়ারে বসে তন্ময় হয়ে অনেকক্ষণ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।
একসময় ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা যেন স্বগতোক্তির মতো বলল , কি জানি ! এই হয়তো শেষ বার ।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল । বাবার হাতটা চেপে ধরে বললাম , এসব কি কথা বলছো বাবা ! চুপ করো !
বাবা কেমন যেন স্নেহ মাখানো উদাস ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমার মাথার ওপর ডান হাতটা রাখল । চোখ বন্ধ করে রইল প্রায় এক মিনিট ।
তারপর চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল , মায়ের কাছে বসে মনের সব কথা খুলে বল্ । কিছুক্ষণ পর সন্ধিপুজো আরম্ভ হবে । এ বড় মহার্ঘ্য সময় । মা’কে মনের সব কথা জানাতে হয় ।
আমি জানালাম । দু’হাত জোড় করে ব্যাকুল হয়ে মায়ের কাছে প্রার্থনা করলাম , মা এই যে বাবাকে পাশে নিয়ে বসে রয়েছি মহাষ্টমীর রাতে এখন , এইসব মুহূর্ত যেন আমার জীবনে বারে বারে ফিরে আসে। এইগুলো যেন অনন্ত হয় । এগুলো তুমি আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না , মা ।
মা অবলীলায় ত্রিশূল হাতে অসুর বধ করছেন । আমার দিকে চেয়ে রইলেন । মুখে স্মিত হাসি ।

পুজো শেষ হয়ে গেল । ঢাকের বাদ্যি শুনতে শুনতে মা ঝুপ করে জলে ডুব দিলেন। উঠবেন সেই কৈলাস পর্বতে গিয়ে। বাবার অসুস্থতাজনিত কারণে পুজোর আগে থেকে বেশ কিছুদিন এমার্জেন্সি ছুটি নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম । এবারে ফিরে যেতে হয়। প্রতিবার দেশের বাড়িতে যাই লক্ষী পুজো উপলক্ষে । এবার আর যাওয়া হবে না । বাবার শরীরে অত ধকল নেওয়ার মত জুত নেই , সত্যি কথা বলতে কি। খুবই চিন্তা হচ্ছে বাবা-মাকে এখানে একা ফেলে যেতে। এই হচ্ছে বাড়ি থেকে দূরে চাকরি করার অসুবিধা । বাবার যেকোনো সময় মেডিকেল ইমার্জেন্সি প্রয়োজন হতে পারে। এই অবস্থায় ওখানে আমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখারও কোনো উপায় নেই । এখন মনে হচ্ছে হুট করে অতদূরে চাকরির অফারটা একসেপ্ট না করলেই ভালো হতো । বিশেষ করে বাবা-মাকে দেখার জন্য যখন আর কেউ নেই । আপাতত কয়েক সপ্তাহ ছোট মাসি আর মেসোমশাই এসে থাকবে বলেছে । কিন্তু সেটা তো কখনই কোন পার্মানেন্ট সলিউশন হতে পারে না । আমায় কি তাহলে ওই চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আবার কলকাতার দিকে নতুন কোন চাকরি খুঁজতে হবে? দেখা যাক কি হয় । এই মুহূর্তে তো সেটা সম্ভব নয় । এখন আপাতত আমায় ফিরে যেতেই হবে । টিকিট কাটলাম । লক্ষ্মী পূজার পরের দিনই ফিরে যাব। এই বছর ফ্ল্যাট বাড়িতেই মা ছোট করে লক্ষ্মী পুজোর আয়োজন করে ঠাকুরকে পাঁচালী পড়ে শোনাবে ।

বাবা আমাকে লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় নিজের ঘরে ডেকে পাঠাল । বাবা এই সন্ধ্যাবেলার সময়টায় নিজের ঘরে রাখা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ , স্বামী বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনখানা ছবির সামনে কাঠের র্্যাকের ওপর তিনটে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকে । তবে আজকাল বাতি জ্বালালেও বসে থাকতে পারে না । হয়তো মিনিট পাঁচেক বসে রইল । তারপর শুয়ে পড়ে । এই সময়ে এই ঘরটা যেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান বলে মনে হয় আমার। বাঙালির তিন ঠাকুর, সাথে বাবা । চারজনের সান্নিধ্যে মনটা কানায় কানায় ভরে ওঠে ।

আমি গিয়ে বাবার মাথার পাশটাতে বসতে বাবা বলল , এসেছিস ?
— হ্যাঁ বাবা । বলো, কিছু বলবে বলে ডেকেছো ?
— হ্যাঁ ।
বলে বাবা দুটো হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের খাঁজে খাঁজে ঢুকিয়ে হাত দুটো বুকের উপর রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে রইলো ।
তারপর ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সেদিন ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে তোর ঠিক কি কি কথা হয়েছিল বলতো মা আমায় ।
সত্যি কথা বলতে কি, বাবাকে নিয়ে এই মানসিক অশান্তি আর টানাপোড়েনের মধ্যে এ কটা দিন যেন সম্পূর্ণ এক অন্য জগতে পৌঁছে গেছিলাম । তবুও মনের মাঝে ইন্দ্রাশিষ বাবু আর পাতার কথাটা যে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি যে তা নয় । তারা যে রয়েছে আজও , বেশ জাঁকিয়ে বসে রয়েছে মনের মাঝে, তা জানান দিয়ে যায় । বাবা হঠাৎ করে এই প্রসঙ্গ তুলবে বুঝতে পারিনি। প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম ।
তারপরে বললাম , আচ্ছা বেশ । বলছি শোনো –
যা যা কথা হয়েছিল সেদিন তাঁর সঙ্গে আমার, সবটাই বললাম বাবাকে । বাবা চুপচাপ শুনলো। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসলো । ঘরের নরম মোমবাতির আলোয় বাবার মুখটা কেমন যেন অপার্থিব লাগছে । আমার প্রতি স্নেহের ছবিখানা মুখের প্রতিটা খাঁজে যেন প্রকট হয়ে উঠেছে ।
বাবা ধীরে ধীরে বলল , শোন্ মা , ইন্দ্রাশিষ সোনার টুকরো ছেলে , তা আমি বুঝেছি। জীবনে একজন মানুষের সঙ্গে যদি কাটাতে হয় , তাহলে তার সেই গুণটা থাকলেই যথেষ্ট । সেই মানুষটার মনটা যেন খাঁটি হয় । একেবারে সোনার মত । ইন্দ্রাশিষ তাই । আমি বুঝেছিলাম বলেই আজকে তোর বিয়ের জন্য এতোখানি লেট হয়ে যাওয়া সত্বেও আমি ভীষণভাবে চেয়েছিলাম তুই এই বিয়েটা কর । সুখে না থাক, শান্তিতে থাক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাবা বলল , আমি আর বেশিদিন নেই মা । তোর মা না হয় তোর সঙ্গে কিছুদিন থাকবে । কিন্তু সারাটা জীবন, জীবনের অনেকগুলো বছর সামনে পড়ে থাকবে । একজন মনের মানুষ না থাকলে, একজন বন্ধু না থাকলে, ওভাবে কি জীবন কাটানো যায়? আমার একটা ভুল হয়েছে। মারাত্মক বড় ভুল। হয়তো তোর মতামতের তোয়াক্কা না করেই বিয়েটা আগেই দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা পারি নি। সবাই কি সব কিছু পারে ? বাবা হিসেবে আমি সেটা পেরে উঠিনি । তোর অমতে গিয়ে তোর বিয়ে দেওয়া । পারলে এবার ফিরে গিয়ে ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে সামনাসামনি বসে কথা বলিস । সেদিন হুট করে কি বলতে কি বলেছিস। ও’ই বা কি বলেছে, কি বুঝেছে ! গন্ডগোল হয়ে গেছে পুরো ব্যাপারটা । ঠান্ডা মাথায় দুজনে মিলে বসলে ঠিক সলিউশন বেরিয়ে আসবে। আমি জানি মা, তুই ইন্দ্রাশিষ আর পাতাকে নিয়ে ভালো থাকবি । আমি সেদিন থাকি আর না থাকি , আমার আশীর্বাদ থাকবে তোদের সঙ্গে । ভালো থাকতে তুই বাধ্য । ঠাকুর এইটুকু কথা আমার ঠিকই শুনবেন ।
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার তরু মা লাল বেনারসি পরে, কপালে ছোট ছোট চন্দনের কলকা এঁকে সোনার গয়না গা’য় সেজেগুজে, রজনীগন্ধার বড় একটা মালা গলায় ঝুলিয়ে, সিংহাসনের ওপর রানীর মত বসে রয়েছে । তার রাজপুত্তুর আসছে তাকে নিয়ে যাবে বলে । রাজপুত্তুর রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল । তারা হাত ধরাধরি করে গালভর্তি হেসে এগিয়ে গেল নতুন জীবনের পথে । আমি দুহাত ভরে অনেক আশীর্বাদ করলাম । এ স্বপ্ন কবে থেকে দেখেছি মা –
বাবার গলাটা কেঁপে গেল। বলল , তুই একটা সুন্দর জীবন সাথী পাবি । রাজপুত্র তো সেই হয় , যার একটা ভালো মন থাকে । অনেক টাকা পয়সা , সোনা দানা , গয়না গাটি , এসব নিয়ে কি হবে? শেষমেষ তো চাই দিনের শেষে একটু হাসি মুখ । একটু ভালোবাসা । তোর জন্য রাজপুত্র সিলেকশনে আমার ভুল হয়নি মা। তুমি নিশ্চিন্ত থাকিস । ফিরে গিয়ে ইন্দ্রাশিষের সঙ্গে কথা বল । তোরা দুজনে ভালো থাকবি। আমি বলছি ।

বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছিল । বুঝতে পারছিলাম, বাবা আমার বিয়ে দেওয়া নিয়ে আমার অমতে গিয়ে কখনো নিজের জোর না খাটালেও, কতখানি আবেগ , কতখানি স্বপ্ন, ওই একটা বুকের মধ্যে আজ এত বছর ধরে চেপে রেখেছে ! স্বপ্ন বুনেছে। আজও বুনে চলেছে। হয়তো এইবারে এসে কিছুটা অসহায় পড়েছে।
বললাম , দেখছি বাবা কিরকম কি পরিস্থিতি দাঁড়ায় । আগে ফিরে যাই । তোমাকে আর মাকে এখানে একা রেখে যেতে খুব চিন্তা হচ্ছে।

লক্ষ্মী পুজো হয়ে গেছে কালকে। আজকে আমার ফিরে যাওয়ার কথা । সকালবেলায়, তা বেশ ভোরের দিকেই হবে , মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম ।
দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলাম , কি হয়েছে মা?
মা কেমন যেন উদভ্রান্তের মত তাকিয়ে বলল , তোর বাবা চোখ খুলছে না। সাড়া দিচ্ছে না।
— কি বলছ !
হুড়মুড় করে ছুটে গেলাম বাবার ঘরে ।
বাবা ঘুমোচ্ছে।
হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে তো –
চোখ দুটো গভীর প্রশান্তিতে বন্ধ । হাত দুটো আঙুলের খাঁজে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ওইভাবেই বুকের ওপর রাখা । কি হয়েছে ? ঘুমোবে না? এত সকালে উঠবে কেন বাবা? শরীরটা খারাপ না?
— বাবা !
বাবার মাথার উপর হাত রেখে ডাকলাম , বাবা !
বাবা সাড়া দিল না। কপালটা ঠান্ডা । মনে হল যেন দেহে কোন উত্তাপ নেই ।
উত্তেজিত হয়ে ডাকলাম, বাবা , ওঠো !
বাবা চোখ মেলে চাইল না । পাগলের মত ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম , বাবা – , বাবা শুনছো ?
বাবা সাড়া দিল না ।
দিল না।
কিছুতেই দিল না।
অনেকক্ষণ পর ছুটোছুটি দৌড়োদৌড়ি করে ডাক্তারের কাছ থেকে যখন ডেথ ডিক্লেয়ার্ড কাগজটা হাতে পেলাম , তখন অবুঝ চোখে নির্মম লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম–
মা শুধু দেবীপক্ষটুকুর জন্যই বাবাকে ঘরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দেবীপক্ষ শেষ হল । মা’ আমার বাবা’কে সাথে করে নিয়ে কোথায় গেলেন কে জানে ! ওইখানে ওই কৈলাসের পারে ?

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/

কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/

একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/

বাইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1019125995544131/

তেইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1021798458610218/

চব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1024967944959936/

পঁচিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1031476470975750/

ছাব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1034632350660162/

সাতাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1038754843581246/

আঠাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1046967802759950/

উনত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1048831039240293/

ত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1051696202287110/

একত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1053606998762697/

বত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1060747584715305/

তেত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1064517157671681/

চৌত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1073169890139741/

পঁয়ত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1075303099926420/

ছত্রিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1077175089739221&id=248680819255323

সাঁইত্রিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=426810745740602&id=100052350402509

আটত্রিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=431076141980729&id=100052350402509

উনচল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=435617384859938&id=100052350402509

চল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=440158787739131&id=100052350402509

একচল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=444880253933651&id=100052350402509

বিয়াল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=448896420198701&id=100052350402509

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here