হলদে_প্রজাপতি পর্ব-৪২

0
250

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

বিয়াল্লিশ

( আগের অধ্যায়গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

ভুল হয়ে গেল একটা । ছোট-বড়-মাঝারি কেমন ভুল তা বলতে পারব না । আসলে সমস্ত কিছুই বিচারের ভার সময়ের ওপর ছেড়ে দিতে হয় । আপেক্ষিকতাবাদের উপর নির্মিত আমাদের জীবনের সবকিছুর শেষ বিচার্য নায়ক হয়ে দাঁড়ায় সময় । তবুও বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এটুকু বলাই যায়, ভুল একটা হয়েছে। ইন্দ্রাশিষ বাবুর কোন বক্তব্যই না শুনে প্রথমেই অতগুলো কথা তাঁকে বলা মোটেও উচিত হয়নি । মানুষের কাল্পনিক চরিত্রের উপর, বা কাল্পনিক ভুলের উপর কিছু কিছু সময় আমরা আক্রমণ করে ফেলি । আমার ভুলটা তেমনই এক কল্পনাপ্রসূত আক্রমণের ভুল । কিন্তু ভুল যা হওয়ার হয়ে গেছে । এখন ভাবতে হবে, এই ভুল শোধরানোর কোন উপায় কি রয়েছে ? অভিমান করার জন্য সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় যাওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে । সেই গভীরতায় কি আমরা পৌঁছেছিলাম , যে তিনি আমার ওপর অভিমান করেই চলে গেলেন ? নাকি, তিনি মুখের ওপর বলতে পারছিলেন না , কিন্তু এই ভবিষ্যৎ পরিণতি তাঁর ঠিক পছন্দের ছিল না ? তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন , এই সূত্র ধরে প্রত্যাখ্যানের পথ মসৃণ হল বলে ? আমার কি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া উচিত? ভুল যখন করেছি, তখন উচিত বৈকি। তবে কিনা ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথেই প্রত্যাশার নতুন এক সীমারেখা তৈরি হয়ে যায় । তিনি যদি সত্যিই অসমর্থ হয়ে থাকেন সে প্রত্যাশা পূরণে, তাহলে কি প্রত্যাশার ভার মানুষটার মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র তাঁকে বিব্রত করা হবে ? আর, আমার ? আমারই বা কি রইল পড়ে ? আমি চেয়েছিলাম , সত্যিই যে চেয়েছিলাম ! আবারো ভিক্ষাভান্ড নিয়ে বেরিয়ে শূন্য হাতে ফেরা বই তো নয় । তাহলে কি করা উচিত ?

সন্ধ্যা হতে গুটি গুটি পায়ে বাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম । বাবা আর মা এই ঘরেই শোয়। তবে সন্ধ্যাবেলার দিকটা এখন আমরা বাপ-বেটিতে ছাদে বসে গল্প করেই কাটাই । দুটো বেতের চেয়ার থাকে সঙ্গী । আর দূর কোনখান থেকে ভেসে আসা হালকা ছাতিম ফুলের গন্ধ ! এই ছাতিম ফুলের গন্ধে বড় হরিদ্বারের গঙ্গার ঘাটের কথা মনে পড়ে যায় । শরৎকালে পুজোর আগে সময়টায় বছর চারেক আগে গেছিলাম হরিদ্দার । গঙ্গার ঘাট বরাবর থোকা থোকা ছাতিম ফুল ফুটে রয়েছে । সেকি মন মাতানো গন্ধ ! রাতের দিকে যখন পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের ভিড় থিতু হয়ে আসে , তখন এই ছাতিম ফুলের গন্ধ মেখে মাতাল হাওয়ায় গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়ানো – সে এক অনন্য অনুভূতি !
তবে আজকে বাবা ছাদে ওঠেনি । আমি একাই ছিলাম । দুটো পাক দিয়েও এলাম । বুঝলাম , বাবা আজকে ছাদে উঠবে না । তারপরে গুটিগুটি পায়ে নেমে এলাম বাবার ঘরে । দেখি ঘরটা অন্ধকার । বাবা চুপচাপ শুয়ে রয়েছে খাটের ওপর । এই সন্ধ্যার সময় ঘরে কোন লাইট জ্বলছে না । একেবারে অন্ধকার ঘরে বসে থাকা ,বা শুয়ে থাকার তো কোনো প্রশ্নই নেই । বাবার মতে ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলার সময়টা দিনের মধ্যে সবচেয়ে মহার্ঘ । এই দুটোর সময় শুয়ে কাটিয়ে দিলে দিনের বাকি সময়ের সব সক্রিয়তাই মাটি হয়ে যায়। আমি আমার জ্ঞানতঃ, শরীর অসুস্থ ছাড়া বাবাকে কখনো এই দুই সময় শুয়ে থাকতে দেখিওনি ।
আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে সুইচ বোর্ডের কাজ শেষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম , বাবা ঘর অন্ধকার করে রেখেছো কেন ? লাইট জ্বালাবো?
বাবা কোন উত্তর দিল না । টিউব ছাড়া একটা ছোট লাইট ছিলো ঘরে । সেটা জ্বালালাম । দেখলাম, বাবা বিছানার উপর টানটান হয়ে শুয়ে রয়েছে । চোখের কাছে ভাঁজ করে রাখা বাঁ হাতটা। বাবার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
বললাম, শরীর ঠিক আছে তো বাবা ? শুয়ে রয়েছ যে এখন?
বাবা হাতটা সরালো চোখের ওপর থেকে। বলল, না, ঠিক আছে –
— তাহলে শুয়ে রয়েছ যে ?
— এমনি । বল্ , কিছু বলবি ?
বাবার গলার মধ্যে অদ্ভুত একটা নির্লিপ্ততা। এইটা আমায় ভাবায় সবচেয়ে বেশি। বাবা তবে ক্ষুব্ধ হয়েছে আমার ওপর যথেষ্ট ।
বিছানায় গিয়ে বসলাম । বললাম , ছাদে যাবে না ?
— না । বল্ , কিছু বলবি কি ?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম । তারপর বললাম , তুমি জানতে চাও বাবা, আমার সঙ্গে ইন্দ্রাশিষ বাবুর ঠিক কি কথাবার্তা হয়েছে?
বাবা চুপ করে রইলো। কিছু বলল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম বাবা কোন কথা বলছে না , তখন উসখুস করতে লাগলাম।
উঠে চলে যাব ঘর থেকে ভাবছি, এমন সময় বাবা হঠাৎ করে বলল, অনেকদিন তো আছি এখানে। পুজো আসছে । এবারে তোর মাকে নিয়ে ফিরে যেতে হবে। টিকিট কাটার ব্যবস্থা কর্ । দ্যাখ্ কোন ট্রেনে পাস্। যত তাড়াতাড়ি কাটতে পারিস , ততই ভাল। কাল হলে কালই।
চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনলাম । বললাম না কিছু। বুঝলাম এখন এই ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলে লাভ হবেনা। থেকে যেতে বললেও বাবা শুনবে না। ভেবেছিলাম পরে বুঝিয়ে বলব । নিশ্চয়ই বুঝবে । তবে বাবা আমাকে আর সময় দিলোনা বোঝানোর। দুদিন পরেই ফিরে গেল কলকাতা ।

আজকে অক্টোবর মাসের তিন তারিখ । সামনের সপ্তাহেই মহালায়া । পুজোর মুখে মুখে সবমিলিয়েই মনটা ভারি ভারাক্রান্ত। একা একা কাটছে দিন । আবার সেই আগের মত । সঙ্গী শুধু টগর । মাঝে মাঝে ফোনে ইন্দ্রাশিষ বাবুর নামটা বার করে ডায়াল করতে গিয়েও করতে পারিনা । একটা টাচের ব্যাপার। ফোন কল হয়ে যাবে । কিন্তু, সেইটা আর করা হয়ে ওঠে না। পাতাও আসেনি কতদিন । তাও প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হয়ে গেল । মেয়েটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছিল। মায়া জড়ানো অভ্যাস । এই অভ্যাস থেকে বেরোতে এখন অনেক বেগ পেতে হবে । বেরোনো কি প্রয়োজন ? সত্যিই প্রয়োজন ? একটা ফোন কল করে ওনাকে ডাকলে, বা যদি আমি একবার গাড়ি ড্রাইভ করে চলেই যাই পাতাদের বাড়ি ? পাতাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে আসি? ওতো আমার কাছেই থাকত দুপুরবেলাটা । পাতার ওপর রাগ হচ্ছে । অভিমান হচ্ছে । ওর সাথে সম্পর্কটা নিশ্চয়ই আমার সেই গভীরতায় পৌঁছেছিল ! ওর ওপর অভিমান আমি অবশ্যই করতে পারি । কিন্তু মানুষ সময়ে সময়ে কি বোকাই না হয়ে যায়। পাতার ওপর রাগ কিসের ? কিসের অভিমান ? ওর কি আর সত্যিই ইচ্ছে করেনি আমার কাছে আসতে ? ওকে আসতে দেওয়া হয়নি তাই আসেনি। সত্যিই তো, বাবা য’বে থেকে প্রপোজালটা এনেছে , তবে থেকেই ইন্দ্রাশিষ বাবু নিজের মেয়েকে আর আমার কাছে পাঠান নি। এর থেকেও তো আমার বোঝা উচিত ছিল । ইস্ , মেয়ে যেন ওঁর সম্পত্তি ! অধিকারবোধ শুধু শাসনের বেলায় ফলালে হয় ? ভালবাসার সময়ও তো ফলাতে হয় । মেয়েটার কি ছিরি করে রেখেছিল । ক্ষেপীর মত ঘুরে বেড়াতো বনেবাদাড়ে । কোথাও কোনো যত্নের ছোঁয়া নেই । যাক গে যাক । লোকের মেয়ে , তারা যা ভালো বোঝো করুক –

অফিসে অলসভাবে বসেছিলাম । যদিও কাজের চাপ যথেষ্ট ছিল । উদাস ভাবে মাঝে মাঝে টেবিলের পাশে জমা ফাইলগুলোর দিকে চোখ বুলোচ্ছিলাম। মনিটরটা অন করাই ছিল । পুজোর আগে একটা প্রেজেন্টেশন আছে । তারই পিপিটি পেজগুলো রেডি করার ছিল । কিছুটা হয়েছে । কিছুটা বাকি। মাঝে মাঝে স্ক্রল ডাউন করছিলাম । তবে করছিলাম না কিছু ।
মৃন্ময় এসে নক করলো আমায় । বলল , ম্যাম, আজকে টি ফ্যাক্টরি থেকে যে প্যাকেজড্ টি-গুলো এসেছে , তার মধ্যে একটু গরমিল দেখতে পাচ্ছি আমি । প্রিমিয়াম সিটিসি-টা চল্লিশ প্যাকেট আসার কথা ছিল , পঁয়ত্রিশটা এসেছে দেখছি । আর লুজ ডাস্টটাও ওজনে কম রয়েছে । আমি তো কালকে মোটামুটি একটা এস্টিমেশন নিয়েই এসেছিলাম ওখান থেকে আসার সময় । কিন্তু আজকে যখন ফাইনালি গুদামে এসে পৌঁছলো, দেখছি কিছু কিছু গন্ডগোল রয়েছে।
বিরক্ত মাখা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম , নিজেই কালকে হিসেব করে এসেছ বলছ । আজকে আবার নিজেই বলছো গন্ডগোল রয়েছে। কোথায় কি গন্ডগোল , নিজেই খুঁজে বার করো । আমাকে কি বলতে এসেছো ? আমার কি করার আছে এখানে ?
— না মানে ম্যাম –
— এখন যাও মৃন্ময়। নিজে দেখে এসো-
ঘন্টাখানেক পরে বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে । সারাদিনে প্রায় কিছুই কাজ করি নি । এখন সবে তিনটে বাজে । আরো ঘন্টাখানেক থাকতেই পারতাম , কিন্তু থাকলাম না ।
জগন্নাথ দা’কে বললাম, আজকে অফিসের কাজ মোটামুটি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে । চলো একবার নদীর দিকে । কিছুক্ষণ সেখান থেকে ঘুরে আসি ।
জগন্নাথ দা একবার আমার মুখের দিকে তাকালো। কি বুঝলো কে জানে । বললো না কিছু । গাড়ি স্টার্ট করল । ঘন্টাখানেক চুপটি করে বসে রইলাম নদীর ধারে । অলস গতিতে ঝিরিঝিরি ধারায় বয়ে চলেছে । সরু হয়ে এসেছে যাত্রাপথ। বর্ষাকালে বালিভর্তি অঞ্চল সম্পূর্ণটাই নদীর অধিকারে চলে যায়। আবার তা কমতে কমতে তন্বী দেহে বয়ে চলা এক নদী । নদীর ধারে একটা পাথরের উপর বসে বসে ভাবছি । ভাবছি আমি । ফিরে যাওয়ার সময় দুটো রাস্তা ধরে যাওয়া যায় বাড়িতে । একটা রাস্তা একটু শর্টকাটে পাতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে আর একটা রাস্তা অপেক্ষাকৃত চওড়া , তবে একটু ঘুর হয় । যাওয়ার সময় অবশ্য জগন্নাথ দা’কে বললাম , চওড়া রাস্তা দিয়ে যেতে। কি দরকার ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার? যদি আবার মেয়েটাকে দেখতে পাই? আমি তখন কি করব ? আর ওই বা কি করবে ? আমি তো জানিই না , আমার কি করা উচিত । মন খুলে আগে সে কথা জেনে নিই। তারপর না হয় দেখা যাবে ।
জগন্নাথ কিছুক্ষণ ধরেই উসখুস করছিল । কিছু একটা প্রশ্ন ঘটছে হয়তো ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।একসময় করেই ফেলল।
বলল , পাতা দিদি আর আসে না আপনার বাড়িতে ? শরীর টরির কি খারাপ হয়েছে ?
বললাম , না । তেমন কিছু নয় –
— তবে?
চট করে মাথায় আধা সত্য, আধা মিথ্যা, বাকি মনগড়া, একটা কথা গজিয়ে উঠলো।
বললাম , ওরা হয়ত এখান থেকে চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই বদলি হয়ে । তাই এখন বাড়ি থেকে বের হয় কম ।
— তাই নাকি ? ইস্ , মেয়েটা খুব ভালো থাকতো আপনার কাছে এসে, জানেন তো দিদি ?
জানলা দিয়ে ছুটে আসা হিমেল হাওয়ায় মুখটাকে একটু বাড়িয়ে দিয়ে চাপ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম , হুম !
বাড়ি পৌঁছতে যখন আর মিনিট সাত কি আট বাকি, তখন রাস্তার ধারে একটা শিউলি গাছ পড়ে । গাছটার কাছে এসে পৌঁছতে জগন্নাথ দা’কে বললাম , গাড়িটা একটু দাঁড় করাও তো।
জগন্নাথ দা ব্রেক কষলো । গাড়ি থেকে নেমে গাছটাকে সুন্দরী প্রেমিকার মুগ্ধ প্রেমিকের মতো পর্যবেক্ষণ করলাম । এখনো শিউলি ফুলগুলোর পাপড়ি মেলার সময় হয়নি । রাত যত গভীর হয় , তত বাড়ে ওদের সক্রিয়তা । একেবারে ভোরের মুখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে । পুজোর আগে একদিন পাতার আমাদের ঘরে রাতে থাকার কথা ছিল । আর তারপর, একেবারে ভোরবেলা উঠে আমি, পাতা আর বাবা তিনজনে মিলে এই শিউলী গাছটায় শিউলি ফুল করতে আসতাম– এইরকম একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল বাবা আর তার নাতনি দুজনে মিলে । ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কেন যে মানুষ করে ? এতটুকু কিছুও ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে, হারিয়ে যায় চোখের সামনে। ফুলগুলো মুখ লুকিয়ে রয়েছে বটে , তবে হালকা একটা গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে । কিছুক্ষণ গাছটার দিকে চেয়ে হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাসের মত দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িতে উঠে বসলাম ।

বাড়ি ফেরার পর একসময় টগর জিজ্ঞাসা করল , দিদি রাইতে কি খাবা? মাছ মুরগা দুইই আছে কিনা ফিরিজে ? কোনখান রান্ধি ?
ওর দিকে তাকিয়ে ব্যাজার মুখে বললাম , সব ছোটখাট ব্যাপারে আমাকে এত প্রশ্ন করে জ্বালিয়ো না তো । নিজের যা ইচ্ছা হয় করো গে । এতদিন তো হলো সংসার সামলাচ্ছে । কোনো ডিসিশনই কি নিজে থেকে নিতে পারো না ?
টগর মাংসই রান্না করেছিল , বেশ কষিয়ে , রগরগে করে। খাওয়ার সময় পাতে মাংস দেখে ঠেলে সরিয়ে দিলাম বাটিটা।
বললাম , ইস্, এই রাত্রিবেলা একেবারে রগরগে করে মাংসের ঝোল রেঁধে রেখেছে । আমি খাব না।
টগর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গেল । তারপর আর কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে বাটিটা তুলে রাখলো ।

………………………………………………………………………….

আমি জানলার খোলা পাল্লার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছি উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে। আমার ঘরের জানলার ঠিক তিন হাত দূরে একটা শিউলি গাছ হয়েছে । সারা দিনরাত সাদা কমলায় ঝামড়ে থাকে । আমি উদাস চোখ মেলে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছি। টুপ টাপ করে ঝরে পড়ছে । ঝরে পড়ছে আলতো মন মাতানো গন্ধ । হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে নীল ডানায় ভর করে একটা নীলকন্ঠ পাখি বসল সাদা ফুলের নুয়ে পড়া গাছটায়। পিছলে যাচ্ছে ওর আকাশ নীল রংয়ের ডানা , যেন রং পিছলে পিছলে পড়ছে –
আমার দিকে কালো মুক্তোর দানার মত দুটো চোখ মেলে ঠোঁট নামিয়ে বার দুয়েক সে ডাকলো —
কাক্ কাক্ খাক্ খাক্ ..
আবার তাকাচ্ছে আমার দিকে। যেন ডাকছে আমায় । আস্তে আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে আমি গেলাম শিউলি গাছের কাছে । পাখিটা বসে আছে । বসেই আছে। উড়ে চলে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করছে না । নীলকন্ঠ পাখি কোনদিন দেখিনি আমি । কোনদিন না । আজকে হঠাৎ করে জানলার একবারে পাশের শিউলি গাছে এত সুন্দর পাখিটা কোত্থেকে এসে বসল কে জানে ? সামনে পুজো , প্রায় চলেই এসেছে। শুনেছি মর্তে মায়ের বিসর্জন হওয়ার পর নীলকন্ঠ পাখিকে উড়িয়ে দেওয়া হয় । সে নাকি নীলকন্ঠ মহাদেবের কাছে মায়ের আগমন বার্তা নিয়ে যায় কৈলাশে । তবে কি , মা আজকে সাধ করে নিজের মর্তে আগমন বার্তা জানান দিতে আমার একেবারে সামনে দূত পাঠিয়ে দিয়েছেন ? আমি হাত বাড়িয়ে নীল রঙে ভিজে যাওয়া ডানাটা স্পর্শ করলাম । পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে আমায় । উড়ে যাচ্ছে না । হঠাৎ করে কোথা থেকে একটা হলুদ রঙের প্রজাপতি উড়ে এলো । এইবার উড়ে গেল পাখিটা । না , তবে উড়ে চলে গেল না । কিছুটা নীল রং চারপাশে ছিটকে দিয়ে এক ঝাপটায় ঠোঁটে করে ধরে ফেললো প্রজাপতিটাকে । তবে খেয়ে নিল না । হলুদ নিথর মৃতদেহটাকে ঠোঁট নেড়ে ফেলে দিল মাটির ওপর । আরও একটা প্রজাপতি উড়ে এলো । পাখিটা আবার উড়ে গেল । আবারো একটা হলদেটে মৃতদেহ টুপ করে খসে পড়লো মাটির ওপর ।
আরও একটা..
আরও একটা..
এইবার ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে । পাখিটা প্রত্যেকটাকে নিমেষ ফেলতে না ফেলতেই ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে ফেলছে । টুপ টুপ করে হলুদ মৃতদেহগুলো খসে পড়ছে মাটির বুকে। তার সাথে একগোছা করে শিউলি ফুল । সাদা, কমলা আর হলুদে ভরে উঠছে আমার শিউলি-গাছতলা । এমন কেন করছে পাখিটা ? আমি হাত বাড়িয়ে ওকে থামাতে গেলাম । হাত পাচ্ছিনা । কিছুতেই পাচ্ছিনা । তখনো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে হলুদ প্রজাপতিগুলো অমোঘ মৃত্যুর টানে। আমার পায়ের পাতা ভরে উঠেছে শিউলি ফুল আর প্রজাপতির মৃতদেহে। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি শুধু গাছতলায় নয় , যতদূর আমার চোখ যায় , শুধু সাদা, কমলা আর হলুদে ভরে উঠেছে । যেন একটা বিস্তীর্ণ পথ তৈরি হয়েছে । সেই পথ মিশে গেছে কোন সুদূর দিগন্তে । আর সেই পথ ধরে অনেক দূরে ছায়ার মত একজন হেঁটে চলেছে । রাজ্যের কুয়াশা জমা হয়েছে সেখানে । তবুও বোঝা যায় । এত দূর থেকেও বোঝা যায় — সাদা রঙের পাজামা-পাঞ্জাবী, উন্নত মাথা, ঋজু মেরুদন্ড , নির্মেদ শরীর , অটল পদক্ষেপ .. বাবা !

উঠে বসলাম ঘুম থেকে । হ্যাঁ , একেবারে পূর্ণ চেতনায় উঠে বসে আছি। ফোনটা বাজছে না ? হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে টেনে বার করলাম ফোনটাকে । মা ! মায়ের ফোন ! কটা বাজছে এখন ? ভোর ছটা ? এত ভোরে মা ফোন করছে ? কি ব্যাপার? কি হল? বুকের ভেতরটা কেমন যেন অজানা আশঙ্কায় ভরে উঠলো। ঠান্ডা আঙ্গুলের ডগা ঘষে ফোনটা রিসিভ করলাম ।
— হ্যালো ! মা , কি হয়েছে ?
ওপাশ থেকে মায়ের গলাটা বিভ্রান্ত শোনালো ।
— তুই আজকেই একবার আসতে পারবি ?
— কেন মা? হয়েছেটা কি?
— তোর বাবার .. বাবার খুব শরীর খারাপ। রাত্রিবেলাতেই কেমন যেন করছিল । তখন প্রায় রাত তিনটে হবে । ওই পাশের ফ্লাটের প্রশান্ত, শ্যামল, ওদের সব ডাকলাম । খুব ঘামছিল জানিস ? আর হাত পা’গুলোও কেমন যেন ঠান্ডা । ওরা সবাই মিলে এসে তোর বাবাকে নার্সিংহোমে এডমিট করেছে ।
— কি হয়েছে বাবার ?
আমার অলরেডি গলা কাঁপছে । হাত-পায়ে কোন জোর নেই ।
— ডাক্তার তো বলছে হার্ট অ্যাটাক।
আমি তখন আছড়ে পড়া ঢেউয়ে নিমজ্জিত হয়ে আপ্রাণ বালি আঁকড়ে ধরছি ।
প্রশ্ন করলাম , বাবা এখন আছে কেমন আছে?
— আছে । ভর্তি আছে আই সি ইউ তে । তুই আয় ।

আছে !
বাবা আছে !
কাঁপা কাঁপা হাতে মৃন্ময়ের নাম্বারটা ডায়াল করলাম ।
বললাম , এত ভোরে তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম, প্লিজ কিছু মনে করো না। আমাকে এক্ষুনি একটা ফ্লাইট এর টিকিট কেটে দিতে পারবে? বাগডোগরা টু কলকাতা । একচুয়ালি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় দেখো ভাই । আমার কিছু কাজ আছে। তৈরি হয়ে নিতে হবে । তাই তোমায় রিকুয়েস্ট করছি । একটু যদি ফ্লাইট এর টিকিটটা বুক করে দিতে –
— কোন সমস্যা হয়েছে ম্যাম ? মানে এত আর্জেন্ট বেসিসে টিকিট বুক করতে গেলে ফেয়ার কিন্তু অনেকটাই পড়ে যাবে ।
— ফেয়ার যাই পড়ুক । তুমি বুক করো । কুইক ।

মনে মনে বললাম , বাবা আছে । আছে বাবা ।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/

ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/

সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/

আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/

নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/

দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/

এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/

বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/

তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/

চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/

পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/

ষোল-

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/

আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/

উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/

কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/

একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/

বাইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1019125995544131/

তেইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1021798458610218/

চব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1024967944959936/

পঁচিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1031476470975750/

ছাব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1034632350660162/

সাতাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1038754843581246/

আঠাশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1046967802759950/

উনত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1048831039240293/

ত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1051696202287110/

একত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1053606998762697/

বত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1060747584715305/

তেত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1064517157671681/

চৌত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1073169890139741/

পঁয়ত্রিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1075303099926420/

ছত্রিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1077175089739221&id=248680819255323

সাঁইত্রিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=426810745740602&id=100052350402509

আটত্রিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=431076141980729&id=100052350402509

উনচল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=435617384859938&id=100052350402509

চল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=440158787739131&id=100052350402509

একচল্লিশ-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=444880253933651&id=100052350402509

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here