#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
সাতাশ
( আগের অধ্যায়গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
ডিসেম্বর মাস শুরু হয়েছে । এখানে ডিসেম্বর মাস মানে যথেষ্ট শীত। এর মধ্যে একদিন ছুটির দিন দেখে আমি আর টগর দুজনে মিলে শিলিগুড়ি গিয়ে কিছু শীতের পোশাক, ব্ল্যাঙ্কেট ইত্যাদি কিনে এনেছি । শীতকালটা চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য ভালো। তাদের অন্তত রোদে পুড়ে কাজ করতে হয় না। শীতের রোদ তো গায় ভালো লাগে। শীতের রোদ যেন একটু বেশিই সোনালী । চা পাতার ওপর দিগন্তবিস্তৃত সোনালী ফোঁটাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন উড়ে যায় দূরে কোথাও । দূরের কোনো অদেখা পাহাড়, জঙ্গলে, মন ঘুরে বেড়াতে চায়। দূরের কোন দেশ, অজানা কোন রাজ্য। ঠিক যেন স্বপ্নের মত মনে হয় । তারপরেই মনে পড়ে যায়, আমার জন্মভূমি , আমার বঙ্গদেশ কৃপণ কোথায় ? সে তো উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র, উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে জঙ্গল, সবকিছুই দিয়েছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে তো সবসময়ই কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি।
ছুটির দিনে স্নান করে উঠে চুল খুলে রোদের দিকে পিঠ করে লনে বসে থাকতে খুব ভালো লাগে । এখনো যদিও খুব বেশিক্ষণ বসা যায় না, আর কটা দিন পরে দুপুরবেলাটা লনে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেবো ভাবছি। ছুটির দিনের সোনালী দুপুর। হারানদা আবার কয়েকটা শীতের মরসুমী ফুল লাগিয়েছে। লনের সামনের দিকটাতে দুপাশে সার দিয়ে বেশ কিছু ক্যালেন্ডুলা আর গাঁদা। এখনো পর্যন্ত যে খুব বেশি সংখ্যায় ফুল ফুটছে তা নয়, তবে যে কটা ফোটে আলো হয়ে থাকে। গেটের ছাউনির ওপর দিয়ে লতানে গার্লিক ভাইন তুলেছে একটা। সেটা এই সময়ে ফুলে ভর্তি হয়ে বেগুনি হয়ে থাকে। পাতা দেখাই যায় না ।
আজকাল আবার আমাদের আরেকজন সাথী জুটেছে- টগরের খুড়তুতো বোন কমলা। তার স্বামী গতবছর চা বাগানে কাজ করার সময় সাপের কামড়ে মারা যায় । মেয়েটা আমারই সমবয়সী। দুটো মেয়ে আছে । দুজনেই সাবালিকা । একজনের বয়স আঠারো, আরেকজনের কুড়ি। দু জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। একা একা দিনকাল ভালো কাটছিল না কমলার। শ্বশুর বাড়ির লোকজনও মানসিক, শারীরিক, অত্যাচার করছিল যাতে সে বাড়ি ছাড়া হয় । এসমস্ত শুনে টগরই আমার কাছে পারমিশন নিয়ে ওকে কয়েকটা মাসের জন্য এখানে এনে রাখতে চেয়েছিল । আমার আর কিসের অসুবিধা? টগরের হাতে হাতে একটু হেল্পও হবে, আবার একটা অসহায় মেয়ে দুবেলা-দুমুঠো খাবে বৈ তো নয়। সেটুকু দিতে তো আর আমার ভাঁড়ার শূন্য হয়ে যাবে না। কাজেই সে এসে আছে । মেয়েটা যখন এসেছিল বেশ মনমরা ছিল। এখন অবশ্য আমাদের সঙ্গে হাসি, গল্পে মেতে থাকে। কমলা কিছুটা ওর খুড়তুতো দিদি টগরের মতই দেখতে। হাবেভাবেও মিল আছে। শরীরের বাঁধুনি খুব । কালো চিকন ত্বক। দুটো চোখে ভাষা আছে। নাকটা চ্যপ্টা, চুলের গোছ ভালো। তবে টগরের থেকে কিছুটা লম্বা। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে সে বাধ্য হয়ে নিরামিষ খেত। কিন্তু মেয়েটা মাছ-মাংস খেতে খুব ভালোবাসে। আমার কাছে এসে কটা দিন মনের মত করে খেতে পেয়ে ও খুব আনন্দে আছে। রসনা তৃপ্তি মনকে ভালো করার একটা অন্যতম উপায়।
ডিসেম্বরের প্রথম উইকেন্ডে আমরা একটা কাছাকাছি চড়ুইভাতি কাম ওয়ান নাইট স্টে ট্যুর প্ল্যান করে ফেললাম । চাপড়ামারি ফরেস্ট বাংলো বুক করা হলো। সাউথ বেঙ্গল থেকে এনজেপি হয়ে আসতে গেলে এটা বেশ অনেকটাই রাস্তা, দু আড়াই ঘন্টা লেগে যাবে । কিন্তু আমরা তো কাছাকাছিই রয়েছি । এখান থেকে যেতে মূল রাস্তায় অর্থাৎ এনএইচ সেভেন্টিনে উঠে পড়ার পর মোটামুটি ওই মিনিট চল্লিশেক লাগে।
ডিসেম্বরের প্রথম রবিবার। আজকের দিনটাই বুক করে রাখা রয়েছে । অবশ্য বুকিং রিলেটেড এভরিথিং বা ট্যুর প্ল্যানিং ইন্দ্রাশিষ বাবুই সবটা করেছেন। আমি তাঁকেই করতে বলেছিলাম। ডিসেম্বরের ফার্স্ট উইকেন্ডে ট্যুর প্ল্যান করার একটা কারণ হলো, এখনো নর্থ বেঙ্গলে টুরিস্ট এর ঢল নামার সময়টা আসেনি। ডিসেম্বরের কুড়ি বাইশ তারিখের পর থেকে মোটামুটি প্রকৃতি-পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে সত্যি করে ভালোবেসে যে সমস্ত পর্যটকরা আসতে চান , দুই পক্ষেরই সমস্ত ধরনের শান্তিভঙ্গ । আর দ্বিতীয়তঃ, এই সময়টা পূর্ণিমার আগের দিন পড়ছে । ডুয়ার্সের জঙ্গল, চাঁদের রূপালী আলো, নির্মেঘ আকাশ থাকলে আর মনের দরজা জানলাগুলো সব খোলা রাখতে পারলে, মনে হবে স্বর্গের কাছাকাছি চলে এসেছি। সশরীরে স্বর্গে শুধু যুধিষ্ঠির যেতে পেরেছিলেন । আমার কাছে তো প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ মেখে হারিয়ে যাওয়াই সশরীরে স্বর্গে যাওয়া, আবার কি !
সকালবেলা উঠে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে চা খেয়ে রেডি হতে যেটুকু সময় লাগলো । আমরা মোটামুটি নটা নাগাদ তল্পিতল্পা গুটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম । একটা স্করপিও বুক করা হয়েছে। জগন্নাথই গাড়ি চালাবে। ওই গাড়ির মালিকের সাথে যোগাযোগ করে গাড়ি ঠিক করেছে। সাথে অবশ্য একটা ছোট ম্যাটাডোর ভ্যান যাবে। তাতেই চড়ুইভাতির বাসন-কোসন আরও যা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব যাবে। আমরা প্রথমে মূর্তি নদীর ধারে একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গা দেখে সেখানে চড়ুইভাতি করব। তারপর সেখান থেকে চলে যাব চাপড়ামারি ফরেস্ট বাংলো । আমার বাংলা থেকেই গাড়ি স্টার্ট দিলাম। সঙ্গে অবশ্য আমার সাঙ্গ-পাঙ্গরা সকলেই যাচ্ছে। সাঙ্গোপাঙ্গ বলতে, টগর, কমলা তো আছেই, তার সাথে যদু আর শিশির। হারানদাকেও যেতে বলেছিলাম । কিন্তু , হারাণদার বাড়িতে কিছু একটা বিশেষ কাজ পড়ে গেছে, আজকে যেতে পারবেনা । আমরা গাড়ি স্টার্ট করে প্রথমে গেলাম ইন্দ্রাশিষ বাবুর বাড়িতে । সেখান থেকে তাঁকে আর পাতাকে তুললাম । ওনার মা বাতের ব্যথার কারণে যেতে পারবেন না । আগেই জানতাম সেকথা। এরপর মেঠো পথ পেরিয়ে মেন রোডে ওঠা। সেখান থেকে দুপাশে চা বাগানকে রেখে হুহু করে এগিয়ে চলল গাড়ি । পথে ওদলাবাড়ি , ডামডিম , এরকম কত ছোট-বড় বিভিন্ন চা বাগান। মালবাজার, চালসা, হয়ে মূর্তি নদী ব্রিজ পড়ল । সেটা পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকলো বাঁদিকে । আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের প্রথম গন্তব্যের দিকে। মূর্তি নদীর ধারে একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে গাড়ি এসে থামল। সেখানে আমাদের সমস্ত সাজসরঞ্জামপাতি নামানো হলো ।
দশটা বেজে গেছে। সাড়ে দশটার দিকে গড়িয়েছে ঘড়ির কাঁটা । ছোট একটা গ্যাস সিলিন্ডার আর ওভেন আনা হয়েছে। তাতেই রান্না হবে। টগর বেগুন কেটে বেসন ফেটিয়ে নিয়ে, কড়াই এর মধ্যে আধ কড়াই তেল ঢালল । বেগুনি ছাঁকা হবে । আমি, কমলা আর ইন্দ্রাশিষ বাবু মিলে পেঁয়াজ কুচি , লঙ্কা কুচি , শসা কুচি সহযোগে ঝাল মুড়ি মেখে ফেললাম। জম্পেশ হয়েছে। ঝালমুড়ির সাথে যে য’টা পারবে গরম গরম ফুলকো বেগুনি । গোল করে সবাই মিলে ঝাল মুড়ির বাটি নিয়ে বসে গল্প করতে করতে চোখ রাখলাম প্রকৃতির দিকে । এখানটা নদীর চর । ছোট-বড় নুড়িতে ভর্তি । সামনে নদী। ওপাশে ঝোপঝাড়ের । জঙ্গল আমাদের পেছনদিকেও তাই । ঝিরঝির করে বয়ে চলেছে মূর্তি নদীর ধারা। নিস্তব্ধ জায়গায় নদীর এই ঝিরিঝিরি বয়ে চলার ছন্দ যে কি অপূর্ব বাদ্যযন্ত্রের মতো শুনতে লাগে, তা শুধুমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারে যাদের মনের বীণার তারগুলো সেই ছন্দ ও লয়ের সাথে নিজেকে বেঁধে ফেলে । তার মাঝে উটকো খানিকগুলো মানুষের আগমনে বেসুরো কিছু গলা সঙ্গ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতির ছন্দ তাতে করে ছন্দহীন হয়ে পড়ছে না । আমাদের মুড়ির বাটি যখন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, তখন বেচারা টগর আমাদের সঙ্গে এসে বসতে পেল । প্রত্যেকের জন্য বেগুনি ভাজা শেষ করে নিজে শেষে ভাজা দুটো বেগুনি আর মুড়ি নিয়ে এসে বসলো।
জলখাবারের পাঠ চুকতে আরম্ভ হল দুপুরের খাবারে তোড়জোড় । মেনু খুব সিম্পল । মুগের ডাল , দেরাদুন রাইস, ঝিরিঝিরি করে আলু ভাজা, বেগুন ভাজা, খাসির মাংসের ঝোল আর চাটনি – এই রান্না হবে। দই আর মিষ্টি সাথে এনেছি। চড়ুইভাতির মেনু সিম্পল হওয়াই ভাল । সবাই মিলে একসাথে জড়ো হয়ে আনন্দ করাটাই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য । খাওয়া-দাওয়াটা অবশ্যই একটা ব্যাপার, তবে গৌণ । ঝটপট করে আমরা আলু , বেগুন , পেঁয়াজ, রসুন, আদা , সব কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলাম । হয়েও গেল তাড়াতাড়ি। পাতা কাছাকাছি ঘুরঘুর করছিল। নদীর ধারে যেখানে স্রোত হালকা সেখানে নীচু হয়ে ঝুঁকে কি সব দেখছিল। জলের পোকা, ছোটখাটো মাছ এসব নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছে । কিছুক্ষণ পরে এসে আমার হাত ধরে টানাটানি করতে আরম্ভ করলো। সমবয়সী কেউ আসেনি তো , একা একা ওর হয়তো একটু বোর লাগছে। কিছুক্ষণ পর উঠে গেলাম ওর সাথে। ও নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে চলে যাচ্ছিল বলে আমরা বারবার বকা দিচ্ছিলাম । তাইতে আমি ওর সাথে থাকলে ওর সুবিধে হয়, কেউ আর দূরে যেতে বারণ করবে না, এই আর কি। পাতার সঙ্গে কিছুটা এগিয়ে গেলাম । বাকি সকলে চোখের আড়ালে, এখন আর কেউ নেই । বাসন-কোসনের ঠকাঠক , ঝনঝন নেই, কথার আওয়াজ নেই, হাসির শব্দ নেই, শুধু আমি , কিশোরী একটা ছটফটে মেয়ে আর বহমান নদীর কলকল। দুধারে মাথা দোলাতে থাকা ঘাস আর গাছের পাতা । পাতা কখনো নদীর জলের মধ্যে কিছুটা নেমে যাচ্ছে , তখন ওর কাছে গিয়ে খেয়াল রাখতে হচ্ছে যাতে বেশি গভীরে না যায় । আবার কখনো নদীতীরে ছুটতে ছুটতে ঘাসের ওপর বসা ফড়িংগুলোকে ধরার চেষ্টা করছে । একটা ধরেও ফেলল। ডানাদুটোকে পেছনের দিকে দুটো আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরে আমাকে দেখাতে নিয়ে এলো । ফড়িংটা খুবই সুন্দর দেখতে । উজ্জ্বল হলুদ আর কালোয় মেশানো। ফড়িংটা অসহায় ভাবে পাগুলো ছুঁড়ছে মুক্তি পাবার আশায় ।
আমি পাতাকে বললাম , পাতা ফড়িংটাকে ছেড়ে দাও ।
— ছেড়েই তো দেব মণি। ওদেরকে আমি ধরে রাখি নাকি ? আমিতো জানি , আমাদের মত সমস্ত আ্যনিমাল , গাছেদেরও কষ্ট হয় । বল মণি ?
আমি অল্প হেসে ওর গালে একটা আঙ্গুল বুলিয়ে দিয়ে বললাম , তবে যে তোমার গাছ-স্টুডেন্টদের মারতে লাঠি করে ?
— এখন আর মারিনা।
— তাই বুঝি ? কি করে বুঝলে তুমি ওদের কষ্ট হয় ?
— বা রে ! আমাদের স্কুলে ইভিএস ক্লাসে পড়ালো যে গাছেরও প্রাণ আছে আমাদের মত ?
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল , বাবা আমায় বারণ করেছে ।
— কি বারণ করেছে ?
— কোন আ্যনিমালকে মারতে নেই । তাদের কষ্ট হয়। বলেছে আমায় বাবা ।
— তাহলে তুমি যে এখনও ফড়িংটাকে ওভাবে ধরে রেখেছো ? আঙ্গুলে করে ওর দু’দিকের ডানা চেপে রেখেছো-, কত কষ্ট হচ্ছে। এরপর যখন ছেড়ে দেবে, তোমার আঙ্গুলের চাপে তো ওর ডানার কিছুটা অংশ ভেঙেও যেতে পারে পাতা -না
— আমি আস্তে করে ধরেছি মণি।
— তোমার এরকম মনে হচ্ছে পাতা । কিন্তু ওদের কাছে ওই ধরাটাই খুব জোরে। ওদের তাতেই ডানা ভেঙে যেতে পারে ।
পাতা সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল দুটোকে আলগা করে ছেড়ে দিলো ফড়িংটাকে ।
কিছুক্ষণ পাতার সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে আবার ফিরে এলাম আমাদের পিকনিক স্পটে । টগর আর কমলা দুজনে কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্না আরম্ভ করে দিয়েছে । যদু ওদের বাসন-কোসন ধুয়ে দেওয়া, এগিয়ে দেওয়া, জল বাড়িয়ে দেওয়া, এই সমস্ত কাজ করছে। শিশির আর ইন্দ্রাশিষ বাবু দুজনে বসে গল্প করছে । আমিও গিয়ে বসলাম।
— কি বুঝছেন? জন্তু-জানোয়ারের দর্শন মিলবে?
প্রশ্নটা করলাম ইন্দ্রাশিষ বাবুকে। যদু আর শিশিরের পিকনিক সেরে বাংলায় ফিরে যাওয়ার কথা । আমরা বাকিরা চাপড়ামারি বনবাংলোয় নাইট স্টে করব ।
তিনি বললেন, কোন কোন জন্তু দর্শনের ইচ্ছা আছে আগে শুনি-
— যেগুলো এখানে দেখা-টেখা যায় । ওই বাইসন , হরিণ, হাতি-
— এইটুকু মাত্র? দেখুন অরণ্য দেবী আপনার উপর প্রসন্ন হন কিনা। হয়তো দেখা মিলতে পারে । তবে এ জঙ্গলে চিতাও আছে জানেন তো ? আর নদী থেকে তো জলটল খেতে – , বুঝতেই পারছেন –
হেসে ফেললাম ।
বললাম, আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছেন , নাকি নিজে ভয় পেয়ে রয়েছেন ?
তিনি হেসে বললেন , এই আকাশ বাতাস প্রকৃতি সব সাক্ষ্য দিতে পারে, সেই আদিকাল থেকে বরাবরই পুরুষ জাতি নারীদের ভয় পেয়ে এসেছে । ভয় দেখানোর কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ।
হেসে ফেললাম ।
একজোড়া পাহাড়ি ময়না একটু দূরে নদীর চরে নুয়ে পড়া একটা অর্জুন গাছের ডালে বসে ডেকে উঠলো ।
টগর আর কমলা খুব হাত চালিয়ে রান্না করছে। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সবকিছু কমপ্লিট করে নামিয়ে ফেলবে। কিছুক্ষণ ওদের দিকে চোখ রেখে বসে রইলাম। দুই বোনের মধ্যে ভারী সদ্ভাব। কি সুন্দর মিলেমিশে রান্নাবাটি করছে। আমরা ছোটবেলায় বন্ধুরা মিলে একসাথে সবাই রান্নাবাটি খেলতাম । চড়ুইভাতি যেন বড়দের সেই রান্নাবাটি খেলাই।
একঝাঁক সাদা বক উড়ে এসে নদীর ওপারে বসলো । শিশির মোবাইলে কয়েকটা স্ন্যাপ তুলে নিল ।
আমি বললাম , ক্যামেরা নিয়ে আসোনি ? খুনিয়া, চাপড়ামারি এই অঞ্চলগুলোর জঙ্গলে বিভিন্ন ধরনের পাখি রয়েছে। আর পাখির ছবি তুলতে তো ক্যামেরা মাস্ট। বেস্ট অপশন অবশ্যই ডিএসএলআর উইথ প্রপার লেন্স।
— না ম্যাডাম , অত খরচা করে ক্যামেরার কেনা আর হয়ে ওঠেনি। এই মোবাইলেই যা পারি তুলে রাখি ।
— কই দেখি কেমন উঠলো ? বকগুলো তো বেশ দূরে রয়েছে ।
ও আমার দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল , ওই সাদা সাদা ফুটকির মতো উঠেছে আর কি ।
আমি অল্প হেসে ওর মোবাইল স্ক্রীনে চোখ রাখলাম।
ও বলল , দেখুন আরো রাইট সাইডে রোল করুন । ওই যা পেরেছি, দু’চারটে ছবি তুলেছি আরকি।
আমি আঙ্গুল বুলিয়ে বুলিয়ে ছবি চেঞ্জ করে দেখতে লাগলাম ।
ও মোবাইলের ওপর অল্প ঝুঁকে আমার কাছে একটু সরে এলো।
তারপর বেশ গলা নামিয়ে বলল, এই কমলা মেয়েটি কে ম্যাডাম ? ও বুঝি টগরের কেউ হয় ?
— হ্যাঁ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তো আমার কাছেই রয়েছে। টগরের বোন । ও বিশেষ বাইরে বেরোয় না , তাই বোধহয় দেখোনি-
— ও-
তারপর গলাটা আরেকটু নামিয়ে বলল, এসমস্ত মেয়েছেলেকে হুটহাট করে ঘরে না তোলাই ভাল, বুঝলেন কিনা ম্যাডাম ? কার মনে কি আছে । তারপর এদের সব চরিত্রের-
আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম শিশিরের দিকে ।
মোবাইলটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম, এই ধরনের কথাবার্তা কি একটু এক্তিয়ারের বাইরে হয়ে যাচ্ছে না?
— না মানে আপনার ভালোর জন্যই ম্যাডাম-
এই লোকটার প্রথম থেকেই আমার ভালো চাওয়ার বহরটা খুব বেশি দেখছি । গায়ে পড়ে পড়ে খালি ‘ভালো চাওয়া’র কথা শোনাতে আসে। আমি আর কোন কথা বললাম না । ওই প্রসঙ্গটা আপাতত এখানেই ক্লোজ হোক । কারণ, এটা নিয়ে আমি যদি এখন কোন কথা বলে ফেলি, তাহলে ব্যাপারটা ভালো কিছুর দিকে গড়াবে না । খামোখাই একটা মুড অফ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু ঘটে যেতে পারে । আর সেটা বাঞ্ছনীয় নয় ।
টগর হঠাৎ করে লম্বা খুন্তিটাকে ব্যাটের মত করে ধরে ডান্ডিটাকে কাঁধের ওপর রেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বেশ জোরে বলল, ডাক্তারবাবু একখান গান করেন না । আমরা একেনে সক্কলে জানি আপনে ভারী সুন্দর গান করেন। হ্যাঁ কিনা?
প্রস্তাব শুনে ইন্দ্রাশিষ বাবু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন ।
আমি প্রায় চমকে উঠলাম । বললাম , একি ! আপনি এত বড় কথাটা আজকে চড়ুইভাতির দিনেও বেমালুম লুকিয়ে রেখেছেন? আমি জানিই না ? এত দিন হয়ে গেল আপনার সাথে পরিচয় !
— না না , আহ টগর ! কে বলছে এসব?
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ওর কথা বাদ দিন !
— একদমই বাদ দেবো না । এক তো, আপনি একটা বিশাল বড় অপরাধ করে ফেলেছেন, এই কথাটা এতদিন লুকিয়ে রেখেছেন । আর এটা জানার পরেও আজকে যদি আপনার কাছে একটা গান না শুনে ছেড়ে দি, তাহলে সেটা আমার জন্যও একটা ক্রাইম হবে ।
— কিন্তু তেমনটা নয়-
— কেমনটা আমি সেটা শুনতে চাই!
— কি মুশকিলে আমায় ফেললে বলতো টগর এখন কি আমায় গান গাইতে হবে?
— গাইতেই হবে।
— এটা কি অর্ডার?
— ইয়েস, ইটস আ্যন্ অর্ডার !
— বুঝলাম ।
উনি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে মাথার মধ্যে দিয়ে আঙ্গুল চালালেন । গান বাছলেন নিশ্চয়ই মনে মনে । তারপর একটা সময় গান ধরলেন-
‘ হৃদয় আমার প্রকাশ হল অনন্ত আকাশে-‘
গুরুগম্ভীর রাবীন্দ্রিক তালে মেতে উঠলো প্রকৃতি । গানটা ওনার গলায় কি অসম্ভব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে যেন রবিঠাকুর এই সময়ে ওনার গাওয়ার জন্যই গানটা লিখেছিলেন। ওনার গান গাওয়ার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার উপলব্ধি করতে পারলাম, সেটা হল, গানের সাথে উনি বড় একাত্ম হয়ে গাইছেন। শুধু ওনার গলায় নয়, মনের প্রতিটা বিন্দুতেও তাই সুরের , ভাষার, উপলব্ধির, অনুরণন । আত্মমগ্ন হয়ে ওনার গান শুনলাম । শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আবেশ রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ । কোন কথা বলতে পারলাম না । তবে গান শেষ হতে একবার ওনার দিকে তাকিয়েছিলাম । মুখে কিছু বলিনি । তবে হয়তো ওনার গান কেমন লেগেছে চোখের ভাষায় তা কিছুটা বলতে চেয়েছিলাম । কারণ, এইসব ভালোলাগা কেমন হয় , তা মুখে বলতে যাওয়ার মত মুর্খামি আর কিছুই হয় না । জানিনা উনি কতটা বুঝেছিলেন।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়াটা সেদিন ভীষণ জমল । সাথে করে কলাপাতা নিয়ে আসা হয়েছিল । সেগুলো সাইজ করে কেটে সব মূর্তি নদীর জলে ধুয়ে আমরা সব কলাপাতা পেতে খেতে বসে পড়লাম। সাদা দেরাদুন রাইস, তার সাথে ভাজাভুজি যা ছিল, ছিল ; খাসির মাংসের ঝোলটা অসাধারণ হয়েছিল খেতে। তাছাড়া কলাপাতায় খেতে বসলে এমনিই খাবারের স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে যায় । আমাদের খাওয়া-দাওয়া হতে টগর আর কমলা বসলো । ওদেরকে আমরা বেড়ে দিলাম। খাওয়া-দাওয়া মিটে যেতে সমস্ত বাসন-কোসন ধুয়ে ভ্যানে তোলা হলো । আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি আমাদের চাপড়ামারি বনবাংলোর কাছে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাবে আমার বাংলোয় । আমি, কমলা , টগর আর ওদিকে ইন্দ্রাশিষ বাবু আর পাতা – আমরা আজকের নিশিযাপন করব এই অরণ্য বাসে।
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/
আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/
নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/
দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/
এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/
বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/
তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/
চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/
পনেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1004549847001746/
ষোল-
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1007202950069769&id=248680819255323
সতেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1009015169888547/
আঠারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1011129543010443/
উনিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1013312572792140/
কুড়ি-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1015118655944865/
একুশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1017814589008605/
বাইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1019125995544131/
তেইশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1021798458610218/
চব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1024967944959936/
পঁচিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1031476470975750/
ছাব্বিশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1034632350660162/
ছবি : সংগৃহীত