#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
দুই
(আগের অধ্যায়ের লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
দার্জিলিং মেল ছুটে চলেছে । আজ 28 শে মার্চ। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। ট্রেনের দুলুনিতে এমনিতেও আমার ঘুম আসে না, তার ওপরে আজ এতগুলো বছর ধরে যে জায়গাটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হওয়া সত্ত্বেও জোর করে একবারও আসিনি, জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম, সেই জায়গায় নিজের চাকরির প্রয়োজনে আসতে হল। সেই উত্তেজনা তো আছেই। প্রাইভেটে যাদের চাকরি করতে হয় , তারাই জানে সে চাকরির কোন সুখ নেই, শান্তি নেই । সেরকম ভাল জায়গায় চাকরি করতে পারলে, এমএনসি বা বড় কোনো কোম্পানিই হোক, মোটা অংকের স্যালারি মেলে, কিন্তু জীবনে শান্তির বড় অভাব হয়ে যায় । প্রফেশনাল লাইফের টেনশন জীবনের আধখানার বেশি জুড়ে বসে থাকে । কি করলে ওপরমহলের একটু নেক নজরে পড়া যায় বা ইনক্রিমেন্ট হয়, অ্যাটলিস্ট সেটুকু না হলেও , অন্তত চাকরিটা ধরে রাখার জন্যও কম কসরত করতে হয়না । সরকারি চাকরিতেও যে টেনশন নেই , সে কথা একেবারেই নয় । তবে অন্তত খুব গর্হিত কিছু করে না ফেললে , চাকরি চলে যাবে, এই টেনশন পোহাতে হয় না। এটাই একটা অনেক বড় শান্তি । আর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পার্টিকুলার কিছু প্রফেশন বাদ দিলে, বাদ বাকি সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রাইভেটে চাকরি করলে ওয়র্কলোড অনেক বেশি নিতে হয়। কর্মজীবনের শুরুতে দীর্ঘদিন কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । তারপরে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কয়েক বছর কাজ করতে করতে, একটা টি এস্টেট কোম্পানিতে গত বছরই একই কাজ নিয়ে জয়েন করেছিলাম। সেখান থেকে হঠাৎ করে শিকে ছিঁড়ল । হঠাৎ করেই এই নর্থ বেঙ্গলে টি এস্টেট ম্যানেজারের পোস্টে চাকরিটা পেয়ে গেলাম। হোক ছোট একটা টি এস্টেট, তবুও ম্যানেজারের স্যালারি হিসেবে যা দেবে বলেছে, অনেকটাই বেটার স্কিম । প্রাইভেট চাকরি করতে করতে আজ এতগুলো বছর ধরে মানসিক ক্লান্তি যথেষ্ট জমা হয়েছে। স্বভাবতই মন একটু বেটার্মেন্ট চায়। খুবই দোটানার মধ্যে পড়েছিলাম চাকরিটা হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়ার পর। বেশিরভাগ টি এস্টেট এর চাকরির ক্ষেত্রে রিকোয়ারমেন্টে লিখে দেওয়াই থাকে, মেল ক্যান্ডিডেট চাই । ম্যানেজার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতাও চাওয়া হয় । সেসব কিছুই ছিল না । তবুও পেয়ে গেলাম চাকরিটা । আসলে আমাকে ম্যানেজারের পোস্ট হিসেবে বেশ কম স্যালারি অফার করা হয়েছিল । আমি সেটাতে রাজি হয়েছি। এটা ছোট একটা টি এস্টেট বলেই হয়তো ওরা আমাকে চাকরিটা অফার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।
আজকে এতগুলো বছর ধরে যে জায়গাটাকে জীবন থেকে যতদূর সম্ভব স্মরণে, মননে , দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেছি, সেখানে আজ আবার নিজের চাকরির প্রয়োজনে, সেই একই পরিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়া উচিত হবে কিনা, এ নিয়ে মানসিক টানাপোড়েন যথেষ্ট চলেছে । কিন্তু তার পরে ভেবে দেখলাম, শুধুমাত্র নিজের একটা আবেগজনিত দুর্বলতাকে এত বছর ধরে প্রশ্রয় দিয়ে এসে , শেষকালে এতটা ম্যাচিওরড বয়সে এসেও আজকে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা উচিত হবে না। একটা সম্মানজনক চাকরি তো বটে । মন শক্ত করে চাকরিতে জয়েন করব ঠিক করলাম । এবার আমার সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক বা ভুল, সেটা সেখানে গিয়ে পড়ে তারপর বুঝতে পারবো। রিমোট জায়গা। নতুন চাকরি কতটা কি স্যুট করবে , সেটা যে কোন নতুন চাকরিতে জয়েন করার আগে বোঝা যায় না। ভেতরে ঢোকার পরই একমাত্র যেকোনো সিস্টেমের আ্যকচুয়াল ড্রব্যাক-গুলো বোঝা যায়। দেখা যাক কি হয়।
ভাবনা চিন্তায় সারারাত ঘুমোইনি। লোয়ার বার্থ রিজার্ভেশন ছিল । ট্রেনে মোটামুটি ভিড় কম । সমস্ত সিটগুলো রিজার্ভড হয়নি । আমার কম্পার্টমেন্টেই বেশকিছু সিট ফাঁকা রয়েছে । যেমন আমার ওপরের মিডিল সিটটাই ফাঁকা ছিল । জাস্ট কয়েকটা দিন আগেই গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বেশ বড় রকমের একটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল । হয়তো সেজন্যই হবে, কিছুদিনের জন্য মানুষজন একটু এভয়েড করছে নর্থ বেঙ্গল সাইডটা । ভোর পাঁচটা থেকে উঠে বসে আছি অক্লান্ত চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে । আজকে প্রায় দেড় যুগ পর এই রাস্তায় আবার আমি আসছি । ভাবা যায় ! আশেপাশের দৃশ্য ট্রেন ছোটার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে লাগলো। আল ঘেরা ধানক্ষেত সাথে পদ্ম আর শালুক পুকুর, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল আনারসের ক্ষেত, বিবিধ সবজি, সাথে হলুদ। একটা সময় আনারসের ক্ষেত বাড়তে লাগল, প্রায় যতটাই চোখ যায় ততটা জুড়ে। তারপর একটা সময় শুরু হলো উত্তরবঙ্গের চিরাচরিত চা বাগান । যতদূর চোখ যায় সেই দিগন্ত ছোঁয়া আকাশে গিয়ে মিশেছে । শুধু চা বাগান । আজকে এতগুলো বছর পর সেই দৃশ্য দেখে প্রথমে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম । তারপর কিরকম যেন একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। সৌন্দর্যের দর্শনেও কখনো কখনো ভীতি জন্মায় । যদি তা অতীতকে খুঁড়ে বার করে, নবনির্মাণ করে আবার চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চলে যায়। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমাকে আমার অতীতের সামনাসামনি দাঁড়াতে হবে । আবারও, আজ এতগুলো বছর পর । সেই ধাক্কায় আমি নুয়ে পড়বো না তো?
এক সময় ট্রেনের চলার গতি শ্লথ হতে হতে একটা সময় স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল । স্থির হয়ে বসে রইলাম । সমস্ত যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি করে স্টেশনে নামার ধুম পড়ে গেল। আমার পা দুটো অসম্ভব ভারী হয়ে এসেছে । মনেই হচ্ছে না উঠতে পারব । আজকে আবার এতগুলো বছর পর সেই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামছি! ভাবা যায়! একটা সময় সম্পূর্ণ কম্পার্টমেন্ট যাত্রীশূন্য হয়ে গেল। আমি তবুও স্থবিরের মত বসে আছি । কিন্তু না , আর বসে থাকা চলে না । যেখানে যা লাগেজ ছিল, সব টেনেটুনে বার করে এগিয়ে চললাম ট্রেনের দরজার দিকে। নেমে পড়লাম । স্টেশনটা কত পরিবর্তন হয়ে গেছে । লিফট হয়েছে, এস্কেলেটর, কতকিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে। ধীর পায়ে ওভারব্রিজ হয়ে বেরিয়ে এলাম স্টেশন থেকে। ওরা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ট্রেন স্টেশনে ঢোকার পর ড্রাইভার আমাকে বেশ কয়েক বার ফোন করেছে। আমি ধরিনি । এখন ঘুরিয়ে ফোন করলাম ।
দোহারা গঠনের বেশ ভারিক্কি চেহারার একজন লোক কিছুক্ষণ পর আমাকে খুঁজে পেতে সামনে এসে দাঁড়ালো ।
— দিদিমণি আমি-
— আচ্ছা, তুমিই জগন্নাথ ?
— হ্যাঁ দিদিমণি।
মাথার ওপর একটা ক্যাপ ছিল তার । সেটাকে বাঁ হাতে করে মাথার ওপর তুলে, ডান হাতে করে কপালে জমা ঘাম মুছে নিলো । দেখলাম তার দৈহিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষ হলো কাতলা মাছের মতো একটা মাথা আর তার অর্ধেকখানা জুড়ে কপাল । মাথার গঠনে বেশ বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগর ভাব আছে ।
— চলুন দিদিমণি।
সে লাগেজগুলো নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো ।
আমি বললাম, তুমি কি ওই চা বাগানের মালিকের হয়েই গাড়ি চালাও?
— চালাই দিদিমণি । এখনকার ম্যানেজার বাবুর হয়ে এখন চালাই । আপনি এলেন কিনা? এবার আপনার হয়ে চালাবো ।
এইটা বাজিয়ে দেখার জন্যই আমি প্রশ্নটা করেছিলাম । তাহলে এই জগন্নাথই আমার এখানকার ড্রাইভার । তাহলে গাড়িটাও নিশ্চয়ই এটাই হবে? দেখলাম সেটা একটা মারুতি ডিজায়ার । বেশ পুরনো মডেল। আমাকে একটা গাড়ি প্রোভাইড করা হবে সেটা জানি। সেটা কি এই গাড়িটাই কিনা বুঝতে পারলাম না । হলে অসুবিধা নেই । আমি ড্রাইভ করতে পারব । প্রাইভেটে চাকরি করতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখে নিতে হয়েছে নিজের প্রয়োজনে । সব সময় গাড়ির জন্য ওয়েট করলে এসেন্সিয়াল কাজ পেন্ডিং রয়ে যেতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেই ড্রাইভ করে বেরিয়ে যেতে হতো। তাই শেখা আর কি ।
জগন্নাথ সমস্ত লাগেজগুলো পিছনের ডিকিতে তুলে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বলল , আসুন দিদিমণি।
আমি ঢুকে বসলাম । গাড়ি স্টার্ট দিল । কিছুক্ষণ পর শহরের ঘিঞ্জি ব্যাপারটা পাতলা হতে হতে গাড়ি এগিয়ে চলল ফাঁকা রাস্তার দিকে। আমি জানি কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হবে দিগন্তবিস্তৃত সেই চা বাগান । কেমন যেন গা শিরশিরে অনুভূতি হতে লাগল । ভয় করতে লাগলো খুব । জোর করেই জগন্নাথের সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলাম ।
বললাম , তোমার বাড়ি কোথায় ?
— এখানেই বাড়ি দিদিমণি –
আমি মাঝ পথে বাধা দিয়ে বললাম, আমাকে এভাবে দিদিমণি দিদিমণি কোরো না । আমি দিদিমণি নই । হয়ে উঠতে পারিনি । ইচ্ছে ছিল দিদিমণি হওয়ার । ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর। কিন্তু হয়নি । আমাকে শুধু দিদি বলে ডেকো।
ঘাড় হেলিয়ে জগন্নাথ বলল , আচ্ছা ।
— বলো, কোথায় থাকো তুমি ?
— আপনি যেখানে যাচ্ছেন আমি সেখানেই থাকি । বাগরাকোটই পড়ছে।
— আচ্ছা , বাগড়াকোটের কোথায় ?
— আপনার যে টি এস্টেট আছে, সেখান থেকে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা । জায়গার নাম বললে তো এখন আপনি বুঝবেন না দিদি ।
ঘাড়টা অল্প পিছনে ঘুরিয়ে হেসে বলল , তবে এখন তো থাকবেন। থাকতে থাকতে সব জায়গা জেনে যাবেন। তখন বুঝে যাবেন আমি কোথায় থাকি।
— তুমি বলোই-
কিন্তু কথাটা আমি শেষ করতে পারলাম না। এখনই কি বলতে কি বেরিয়ে যাবে মুখ ফসকে । এখনই কাউকে বলতে যাওয়ার কোন দরকার আছে কি , আমি এখানে এককালে থাকতাম ? তখন যে টি এস্টেট-টা একসাথে ছিল, অনেকটা জায়গা জুড়ে, সেটাই এখন মূল মালিক যিনি তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন । তিনজন সেই সম্পত্তি কিনেছে । তার মধ্যে একটা টি এস্টেটেই আজকে আমি ম্যানেজার হয়ে যাচ্ছি ।
— তোমার বাড়িতে কে কে আছে ?
— আমার বউ, ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা। সব মিলিয়ে ছ জন । আমাকে বাদ দিলে । আমাকে ধরে নিলে আবার সাত হয় ।
— বাব্বাহ্, ফুল ফ্যামিলি। কটা ছেলে মেয়ে তোমার ?
— এক ছেলে, দুই মেয়ে..
টুকটাক করে নিজের বাড়ির , ছেলে মেয়েদের অনেক গল্প করতে লাগলো জগন্নাথ। বুঝলাম ছেলেটা গল্প করতে ভালোবাসে। আমার থেকে বোধহয় কম বয়সীই হবে । কত বড় সংসার । কত তার গল্প । পরিধিটুকু কম হলে গল্প করার পরিসরও কমে যায়। আমার যেমন কারো সাথে গল্প করতে হলে খুঁজতে হয় কি তার বিষয়বস্তু হবে।
বেশ কিছুটা পেরিয়ে এসেছি । এখন চারিদিকে শাল সেগুনের সাথে আরো অনেক গাছের ভিড় । আরম্ভ হয়ে গেছে সেবক রোড । মহানন্দা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি । বেঙ্গল সাফারির গেটটা দেখলাম । কি অদ্ভুত না? আগাপাছতলা ভ্রমন প্রিয় একজন বাঙালি, অথচ নর্থবেঙ্গলে আজ দেড় যুগ ধরে আসা হয়নি । এক আমি ছাড়া এরকম কিম্ভূত জীব পশ্চিমবঙ্গে আরেকটিও পাওয়া যাবে না বোধহয়। রাস্তাও এখন কত ভালো হয়ে গেছে । হু হু করে ছুটছে গাড়ি । এন এইচ সেভেন্টিন । দেখতে দেখতে চলে এলাম করোনেশন ব্রিজ এর কাছে । ব্রিজ পেরিয়ে ডাইনে বেঁকে গাড়ি চলল । এবার রাস্তা প্রথমের দিকে একটু খারাপ, তারপর আবার সুন্দর রাস্তা ।
জগন্নাথ বেশ কিছুক্ষণ মুখ বন্ধ রেখে একনাগাড়ে গাড়ি চালিয়ে, তারপর মুখটা অল্প পিছন দিকে হেলিয়ে বলল, দিদি একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
— হ্যাঁ বল ।
— আপনি এখানে.. মানে এখানে তো চারদিকে খালি চা বাগান আর চা বাগান । চারিদিক ফাঁকা । খাঁ খাঁ করছে । মাঝে শুধু ছোট ছোট কিছু গাঁ, স্কুল-কলেজও কত্ত কম । জনমনুষ্যিও কম। ডাক্তার বদ্যি, হাসপাতাল , সবই অনেক কম । দূরে দূরে । আপনি তো কলকাতায় থাকেন দিদি। সেরকমই বলেছেন আমাদের ম্যানেজার বাবু । তা , আপনি কলকাতা ছেড়ে হঠাৎ-
— তোমাদের এখনকার ম্যানেজার বাবু কোথায় থাকতেন ?
— উনিও কলকাতায় থাকতেন।
— আমি যদিও ঠিক কলকাতায় থাকি না । যাক গে, ছাড়ো, কলকাতাই হলো না হয়। কিন্তু তোমাদের এখনকার ম্যানেজার বাবুও তো বলছ কলকাতাতেই থাকতেন ? তাহলে ?
— না মানে..ইয়ে .. আপনি মেয়েছেলে কিনা..
কানে খট্ করে কথাটা এসে বাজলো । কি স্পর্ধা লোকটার ! আমাকে মেয়েছেলে বলছে? তার পরেই বুঝতে পারলাম, এটা ওর স্পর্ধা নয় । এটা ওর অভ্যাস। ও জানেই না যে কথাটা শুনতে কত খারাপ লাগে। মহিলা বা স্ত্রীলোক বোঝাতে ওরা ওমনি খুব ক্যাজুয়ালি ‘মেয়েছেলে’ বলে থাকে । যা’তে অভ্যস্ত তা তো আর কানে বাজে না ।
আমি আস্তে করে কেটে কেটে বললাম, শোনো জগন্নাথ ! কোন মহিলাকে মেয়েছেলে বলবে না । শুনতে খুব খারাপ লাগে ।
জগন্নাথ অভ্যাসবশে কথাটা ফস করে মুখ থেকে বার করে ফেলেছিল । হয়তো নিজেও জানতোও না কি বলছে । এখন আমার কথাটা শুনে এক ইঞ্চি পরিমাণ জিভ বার করে বলল, দিদি , আমি মানে.. ইয়ে মানে.. মানে..আমি
— বুঝেছি , আমি বুঝেছি । তুমি ওভাবে বলতে চাও নি । আর ওভাবে কখনো বোলোও না । হ্যাঁ, বলো এবার । কি বলছিলে?
কিছুটা আমতা আমতা করে জগন্নাথ বলল, আপনি দিদি, এই প্রথম এখেনে ম্যানেজার হয়ে আসলেন । আপনার আগে কখনও কোনো দিদি ..
— আমিই প্রথম মহিলা ম্যানেজার, তাইতো?
— হ্যাঁ ।
— প্রথম তো অনেক কিছুই হয় জগন্নাথ। তুমি প্রথম একদিন বিয়ে করেছিলে, তারপর তুমি প্রথম একদিন বাবা হলে। সবকিছুই তো প্রথম থেকেই শুরু হয় ।
লজ্জা লজ্জা গলায় জগন্নাথ জড়িয়ে মুড়িয়ে কিছু একটা বলল । ঠিক বোঝা গেল না । তারপর বলল , আপনি ভারী ভালো কথা বলেন দিদি-
মংপং, এলেনবারি , ওয়াশাবারি পেরিয়ে গাড়ি চলে এলো লিস নদীর ব্রিজের কাছে। লিস নদী ! কত যে অতীতের স্মৃতি রয়েছে আমার এই নদীর বুকে ! মনের মধ্যে ক্যামেরার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো সঙ্গে সঙ্গে এল কিছু । এক ঝটকায় সেসব মন থেকে বার করে দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । গাড়ি আরো কিছুটা দূরে গিয়ে বাঁদিকে মোড় নিল । কিছুটা যাওয়ার পরে মেঠো রাস্তা । দু’পাশে ধু ধু করছে শুধুই চা বাগান । রাস্তাটা মেঠো রাস্তা। গাড়ি চলার দু চাকার দাগ রয়েছে শুধু দুপাশে, মাঝে ঘাস । এই একই রাস্তা সামনে যতদূর চোখ যায় , দেখা যাচ্ছে । যেন সেই কোন দিক চক্রবালে গিয়ে মিশেছে । গাড়ি সেই রাস্তার উপর দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল । কোথায় যাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারলাম না । বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে মেঠো রাস্তার উপর দিয়ে, কখনও সোজা, কখনো ডানদিক-বাঁদিক করে এসে পৌঁছলাম একটা ছোটখাটো বাংলোর সামনে।
জগন্নাথ গাড়িটাকে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল , আসুন দিদি ।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম । তাকিয়ে দেখলাম সামনের দিকে । একটা কাঁকুড়ে রাস্তা গেট থেকে বাংলোর দরজা পর্যন্ত গেছে। বাংলোটা বেশ ছোটখাটো ছিমছাম । সুন্দর করে সাজানো । সামনে বিভিন্ন ফুলের গাছ । ঘাসের লন । সমস্তটাই মেনটেন করা যে, দেখে বোঝাই যাচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম । বাংলোর সদর দরজা খোলাই ছিল । তাও নক করেই ভেতরে ঢুকলাম। দেখলাম , একটা লম্বা বারান্দা মত আছে। সেখানে বেশ কিছু ব্যাগ প্যাক করে রাখা। বুঝলাম মূল জিনিসপত্রগুলো বিদায়ী ম্যানেজার বাবু আগে হয়তো প্যাকার্স অ্যান্ড মুভার্সদের দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন নিজের নতুন আস্তানায় । বাদবাকি যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো রয়ে গেছিল, সেগুলোকে প্যাক করে রাখা রয়েছে বারান্দায় ।
আমি একবার গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকলাম, কেউ আছেন ?
সঙ্গে সঙ্গেই একটি মধ্যবয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এলেন । বেঁটেখাটো , আঁটসাঁট চেহারা, চোখ-মুখ কাটা কাটা , মাথায় বেশ পুরু চুল, সেটি পরিপাটি তেল চকচকে করে পিছনে বাঁধা , খোঁপাটি বেশ বড়। আটপৌরে করে শাড়ি পরা । বুঝলাম , হয়তো এইটি আমার পরিচারিকা হতে পারে । আমাকে দেখে প্রথমেই চোখ তুলে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত স্ক্যান করলো।
বললো , মেম, আইচেন ? ইদিকে আসেন । মানিজার বাবু আপনের সাতে কথা কইবেন।
নিঃশব্দে পরিচারিকাকে অনুসরণ করলাম। বারান্দাটা পেরিয়ে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকলো সে। আমিও পিছনে পিছনে গেলাম । সেখানে দেখলাম মধ্যবয়সি বেশ দীর্ঘদেহী নির্মেদ চেহারার মাজা মাজা কম্প্লেকশন এর একজন ভদ্রলোক চেয়ারের ওপরে ডান পা বাঁ পায়ের উপর ক্রশ করে রেখে রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন ।
পরিচারিকা ঘরের ভেতর ঢুকে বললো, মানিজার বাবু, মেম এইচেন-
ম্যানেজার বাবু আমার দিকে একটি অপাঙ্গ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর পরিচারিকাকে চোখের ইশারায় নির্দেশ দিলেন একখানি চেয়ার এগিয়ে দিতে আমার দিকে । পরিচারিকা তাই করল ।
ম্যানেজার বাবু বললেন, বসুন ম্যাডাম ।
বসলাম।
রিল্যাক্সড ভঙ্গিমাটি ছেড়ে খাড়া হয়ে বসলেন ম্যানেজার বাবু । তারপর বললেন , বাড়ির বাকিরা আগেই চলে গেছে । আমি রয়েছি আপনাকে সবটা বুঝিয়ে দেবো বলে। আমার সঙ্গে আপনাকে একবার অফিসে যেতে হবে ম্যাডাম । সেখানে অফিশিয়াল কিছু ফাইলস আপনাকে হ্যান্ডওভার করে , বুঝিয়ে দিয়ে, তারপরে আমি এখান থেকে বেরোবো । এরপরে আপনার যদি কোথাও কোনো অসুবিধা হয়, আপনি অবশ্যই আমাকে ফোন করবেন। আমার ফোন নাম্বার তো রয়েইছে আপনার কাছে । অনেকটা জার্নি করে এসেছেন । আপনি কি এখনই আমার সঙ্গে যাবেন অফিসে ? অফিসটা এই কাছেই । মিনিট দশ পনেরো লাগবে গাড়িতে যেতে । নাকি একটু ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে-?
বুঝলাম ম্যানেজার বাবুটি বেশ কাজের মানুষ। সরাসরি কাজের কথায় চলে যান। কোন ভূমিকা নেই , সূচনা নেই, কুশল জিজ্ঞাসা ইত্যাদি ইত্যাদি নেই । তা ভালো। অহেতুক বেশি বাক্যব্যয় আমার একেবারেই পছন্দের নয়।
— না এখনই চলুন । অফিস থেকে ঘুরে এসে তারপরে-
— হ্যাঁ সেই ভালো । এই বাংলো তো এখন থেকে আপনারই বাড়ি । একেবারে নিজের বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নেবেন । সেটাই বেটার হবে আই থিঙ্ক ।
— হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয় । চলুন।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই জগন্নাথ আমাদের পৌঁছে দিলো অফিসে । অফিস বলতে আর কিছুই নয়, ছোট একটা এক চেম্বারের ঘর । তার সাথে টয়লেট রয়েছে । ঘরটা একটু স্পেসিয়াস, এই যা। তিন-চারটে চেয়ার-টেবিলের সেট রাখা রয়েছে ঘরের মধ্যে একটু দূরে দূরে । তারমধ্যে দুটো টেবিলের ওপর দুটো কম্পিউটার , বাকি দুটো শুধু ফাইলে ভর্তি । বর্তমান ম্যানেজার বাবু একটি টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজে চেয়ারে বসলেন । টেবিলের বিপরীতমুখী একটা চেয়ারে আমাকে বসতে বললেন । আমি বসলাম । উনি একটা ফাইল খুলে কতগুলো কাগজে চোখ বুলিয়ে ফাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন ।
বললেন, দেখুন পেজগুলোর নিচে সিগনেচার করার জায়গা রয়েছে । সিগনেচার করে দিন। আমি ঝটপট দেখে নিচ্ছি আর কোথায় কি কি লাগবে চার্জ হ্যান্ড ওভার করার জন্য।
আমি সিগনেচার করছি । উনি আরো কিছু খুঁজতে খুঁজতে আমাকে হঠাৎ করে বললেন, আপনার নামটা যেন-
— তরুশী ঘোষ ।
ভুরু দুটো কুঁচকে উনি বললেন, আচ্ছা আপনার নামের অর্থ-
অল্প হেসে উত্তর দিলাম , সাহস বা জয়, অন্যভাবে বললে জয় করার সাহস ।
— বেশ আনকমন নাম আপনার ।
— অনেকেই আমার নামের মানে জানতে চায়।
— আচ্ছা, হঠাৎ এরকম একটা রিমোট জায়গায় আপনি একা – ?
একই প্রশ্ন গাড়িতে আসতে আসতে জগন্নাথও করেছিল ।
আমি বললাম , কেন বলুন তো ? আপনিও তো ছিলেন চাকরির জন্য ?
— আমার কথা আলাদা । আপনি একজন মহিলা হয়ে –
অল্প হেসে বললাম, মহিলা কি হিউম্যান ক্যাটাগরির বাইরে ? যা পুরুষ অনায়াসে করছে তা মহিলা করলে আশ্চর্যের কি ?
— না তা নয়। তবে সেফটি’র একটা ব্যাপার থাকে তো । আপনি একা একজন মহিলা এভাবে রিমোট প্লেসে-। এর আগে এখানে কখনো কোন মহিলা ম্যানেজার হয়ে আসেননি ।
আমি জানি যে সে কথা , সেটা আর বললাম না। আমাকে সিলেকশনের সময়ই বলে দেওয়া হয়েছিল, শুধু মহিলা হওয়ার জন্য আমাকে আপাতত স্যালারি কিছুটা আ্যমাউন্ট কম দেওয়া হবে । অর্থাৎ আমার পোস্টে একজন পুরুষ এলে তিনি যা এফিসিয়েন্সি দেখাতে পারতেন , আমি সেটা দেখাতে পারব কিনা সেই ব্যাপারে মালিক পক্ষের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । সেই সন্দেহের নিরসন হলে তবেই আবার ওনারা আমার ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করবেন ।
মুখে বললাম, আমার চেয়েও অনেক অনেক বেশি রিমোট প্লেসে অনেক মহিলারা বিভিন্ন প্রয়োজনে যাচ্ছেন, থাকছেন। আমার কোন অসুবিধা হবেনা ।
টেবিলের ওপরে আমার শরীরের যতখানি দৃশ্যমান হচ্ছিলো , তার ওপর ভালো করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অল্প একটু ঠোঁট টেনে হাসলেন ম্যানেজার বাবু ।
বললেন , অবশ্য আপনার মত মধ্যবয়স্কা মহিলাদের জন্য সেরকম অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
কথাটা খুব শান্তভাবে বলা একটা নিবিড় খোঁচা । আমাদের দেশে যেখানে একজন ঊনআশি বছর বয়সের বৃদ্ধা মহিলাও ধর্ষণের শিকার হন , তিনিও সুরক্ষিত নন, সেখানে ঊনচল্লিশ বছর বয়সে আমি তো কোন ছার। কিন্তু , ওই হাসিটুকুর আড়ালে উনি যেটা বলতে চাইলেন সেটা হলো , সুন্দরী তো আর নন, যুবতীও না । অতএব শিকারি পুরুষদের কৃপাদৃষ্টি লাভের সম্ভবনা কম । নারীর অস্তিত্বটা শুধুমাত্র তার শরীর, রূপ আর যৌবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । কথার ভাবার্থ সেই একই। সমাজের প্রতিফলন । দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ।
বুঝলাম , একজন অবিবাহিত মহিলা ম্যানেজার হয়ে আসায় এখানে অ্যাসোসিয়েটেড যে কজন মানুষজন রয়েছেন , তাদের মধ্যে একটা বেশ শোরগোল পড়ে গেছে । সেই কারণেই মাত্র কিছুটা সময়ের ব্যবধানে আমাকে দু’বার এই একই প্রশ্ন ফেস করতে হলো । চা বাগানে যে সমস্ত কর্মচারীরা রয়েছে , শ্রমিকরা, তারা তাহলে এটা ঠিক কিভাবে নেবে, সেটা নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হলো মনের মধ্যে।
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
ছবি : সংগৃহীত