#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
পনেরো
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনের মধ্যে কত কি যে রঙিন আলপনা বুনে চলেছিলাম, তার ঠিক ঠিকানা নেই । সদ্য টিনেজ পেরিয়ে যৌবনে আসা , স্কুল ছেড়ে কলেজে পড়া , রঙিন প্রজাপতির পাখনা-মেলা-মন তখন আমার । আনমনে যখনই থাকতাম , তখনই সেই সোনুদার কথাই ভাবতাম । এমনকি, কাজের মধ্যেও যখন থাকতাম , কলেজে ক্লাস করতাম, বাড়িতে পড়াশোনা করতাম, তখনও সেই একটা হাসি-হাসি মুখ আমাকে তাড়া করে বেড়াতো । লম্বা ঘণ্টাখানেকের লেকচার দিয়ে চলেছেন জেনেটিক্সের স্যার , জেনেটিক্সের মাথামুন্ডু কিছুই কি তখন আমার মাথায় ঢোকে? চোখের সামনে ভাসে সেই হাসি-হাসি মুখটা । সেই দুষ্টুমি ভরা তাকানো -! বিভিন্ন সময়ে বলা বিভিন্ন কথা, আমার দেওয়া উত্তর, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, কোনটা কেমন হলে ভালো হতো। ওই সময় ওইরকম বলে ফেলেছিলাম! ইসস্! এমনটা বললে না জানি কি ভালো হতো ! এই ভাবনাই আমাকে তখন মশগুল করে রাখত সব সময়। আশেপাশে যেন কার উপস্থিতি অনুভব করতে পারতাম আমি। ও সবসময় আমার সঙ্গেই আছে যেন । আমি সর্বক্ষণ একটা স্টেজে দাঁড়িয়ে রয়েছি, আমার জীবনের চিত্রনাট্যের অভিনয় চলছে সেখানে। আমি নায়িকা, সোনু দা নায়ক। সর্বক্ষণ । সারাদিন-রাত চলছে সেই নাটিকা ।
সেই সব আজগুবি কিছুই ভাবছিলাম। ঠিক তখন যে সোনুদা আমার কল্পনায় কোন অবতারের রূপে ধরা দিয়েছিল, সেটা আজ আর মনে নেই। হঠাৎ করে মনে হল কেউ যেন আমার ঠিক পেছনে একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে । পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম – সোনু দা ! সোনুদা এখন এই ভর সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাংলোয় ছাদের ওপর কখন এলো?
কেন এলো?
সত্যিই কি এলো ?
আমি যে তার কথাই ভাবছিলাম । এরকমটাও সম্ভব হয় বুঝি? ভাবতে ভাবতে বুঝি এতখানি নিবিরভাবে ভাবা যায়, যে সেই মানুষটা সেই আহ্বান উপেক্ষা না করতে পেরে সশরীরে চলে আসে? কয়েক সেকেন্ড যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না। তারপর বিশ্বাস করতেই হল।
দেখলাম, সেই মিটিমিটি হাসিটা যে শুধু ওর চোখে মুখে লেগে আছে, তাই নয় , সেই হাসিটা মেখেই ও আমায় জিজ্ঞাসা করল,
— কি, তরু ম্যাডাম কি করছে এখানে এখন সন্ধ্যাবেলা ছাদে, একা একা? কি ব্যাপার ? বইগুলো কান্নাকাটি করবে তো!
কেমন যেন একটা শিহরণ খেলে গেল শরীর জুড়ে অকারণে। না , একেবারে অকারণে নয় । ও কথা বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম ও যে সত্যিই এসেছে! তার ওপরে আমাকে সেদিন ও প্রথম ‘তরু’ বলে ডাকল । তরু বলে আমায় বাবা ডাকে। আমায় ওই নামে মা ডাকে , এখানে বান্টি ডাকে, কলেজে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অরুনিমা আমায় ওই নামেই ডাকে। যারা আমায় ভালবাসে, আমি যাদেরকে ভালোবাসি, সকলেই আমায় ‘তরু’ বলে ডাকে। সোনুদাও আজ আমায় ওই নামে ডাকলো । তাহলে কি , ও? ও কি আমায়.. ? তার সাথে ‘ম্যাডাম’ বললো। অরুনিমার সঙ্গে আমার এখন কলেজে খুব বন্ধুত্ব হয়েছে । ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ওর অনেক ইন্টিমেসি । ওরা দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত ফিসফিসিয়ে ল্যান্ড ফোনে কথা বলে । দুজনেই বাড়ির কাউকে জানতে দেয় না । পার্কে দেখা করে । ঠোঁটে ঠোঁট ডুবোয়। ওর বয়ফ্রেন্ড নাকি খুব রোমান্টিকভাবে ওর কানের কাছে এসে ওকে ডাকে ‘ম্যাডাম’। সোনুদা আজকে আমায় ম্যাডাম বলল ?
তবে কি ?
তবে কি..
মুখ নীচু করে বললাম, না এই একটু-
— একটু কি ? আকাশ দেখছিলে ?
— হ্যাঁ ।
আমার নিজের কোনো উত্তর রেডি ছিলনা । তাই ও যখন একটা কিছু বলেই দিল, তখন সেটাকে সমর্থন জানানোই ভালো ।
— আকাশে কি দেখছিলে শুনি, গ্যালাক্সি? মিল্কিওয়ে?
— না ।
— তবে কি?
— ঐ দুরের মিটিমিটি তারাগুলো দেখতে আমার খুব ভালোলাগে ।
ঠোঁট আর দুটো ভুরু তুলে অ্যাপ্রিসিয়েশনের ভঙ্গি করে ও বলল, ডু ইউ ফিল ইন্টারেস্ট ইন অ্যাস্ট্রোনমি ?
— না এমনি-
— তারা চেনো তুমি ? কন্স্টেলেশনস্?
‘তারা’ পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল। ‘কন্স্টেলেশন’ বস্তুটা কী বুঝতে পারলাম না। ‘কন্স্টিপেশন’ জানি, কিন্তু, কন্স্টেলেশন’ .. ? এত ইংরেজি যে কেন বলে না ? আমাদের মাতৃভাষায় কোন শব্দটার অভাব আছে? তবে তারা শব্দটা তো একেবারে সাদামাটা বাংলা শব্দ ।
তার ওপর ভর করে আমতা আমতা করে বললাম, না তা ঠিক-
ও বলে উঠলো , কি কি চেনো তুমি ? সপ্তর্ষিমণ্ডল ? ক্যাসিওপিয়া ? পার্সিয়াস ? দেখাতে পারবে সব ?
সপ্তর্ষিমণ্ডল তো খুব ভাল করেই চিনি । ক্যাসিওপিয়াটাও জানাশোনাই , ঠিকঠাক আছে । তবে পার্সিয়াস.. ? হঠাৎ করে কমন সেন্স সজাগ হয়ে উঠল ।
সেটা আ্যপ্লাই করে বলে ফেললাম,
— সবগুলো তো সব সময় দেখা যায় না ।
আমার মুখের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে এনে ও বলল, কি দেখাতে পারবে তাই দেখাও । আমি দেখব।
আবার প্রশ্নোত্তর পর্ব । আমি সেখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য প্রসঙ্গ অন্যদিকে সরাতে চাইলাম ।
বললাম , আপনি এখন এখানে, আমাদের বাংলোয়?
— হ্যাঁ , বান্টি কেমন আছে, তাই দেখতে এসেছিলাম । তবে শুধু বান্টিকে দেখে কি আর ফিরে যেতে পারি? তার দিদির সঙ্গে দেখা না করে –
বলেই সে এক অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসলো । বলল , আচ্ছা তুমি আমাকে এখনো এত ভয় পাও কেন বলো তো ? আর তো আমি তেমন প্রশ্ন করি না ? করি কি?
— না মানে ভয় কেন.. ভয় কিসের ?
হাত উল্টে সে মুখের এক ধরনের ভঙ্গিমা করে বলল, সেটাই তো জানিনা । ভয় কিসের ? তুমি জানো ?
বলে আবার মিটিমিটি করে হাসতে লাগল । তারপর ঠিক আমি যেমন ভঙ্গিমায় কার্নিশের ওপর কনুই রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম , তেমন ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে বলল , নাও দেখাও কি দেখছিলে ? কি খুঁজছিলে তুমি আকাশে –
— খুঁজবো কেন ? এমনি দেখছিলাম ।
— উঁহু, কিছু একটা খুঁজছিলে তুমি । কি বলতো ?
— না কিছু খুঁজিনি ।
— কই তুমি দাঁড়াও তো এখানে, যেভাবে দাঁড়িয়েছিলে । আমার পাশে এসে দাঁড়াও ।
ওর প্রতিটা কথাই কেমন একটু ব্যাঙ্গার্থক , বোঝাতে পারবো না । তবে বুঝতে পারতাম। কিন্তু, অমান্য করার সাধ্য ছিল না আমার। ও যাই বলতো , সেটাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো করতাম । ওর পাশে এসে কার্নিশের ওপর কনুই রেখে দাঁড়ালাম ।
ও বলল, এবার বলতো কি দেখছিলে তুমি ?
বললাম , ওই যে , ওই দূরের মিটিমিটি তারাগুলো আমার দেখতে ভারী ভালোলাগে ।
— কিন্তু আজকে তো আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো । এত চাঁদের আলোয় কি ভালো করে তারা দেখতে পাও ?
আমি বললাম , যা দেখতে পাই , সেটাই খুব ভালোলাগে ।
ও বলল , তাকাও তো আমার দিকে ।
এই একটা কাজ যখন ও করতে বলে, তখন ভারী বিপদে পড়ে যাই। ওর দিকে সরাসরি চোখ তুলে তাকাতে আমার যে কি হয়, আমি ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না । পেটের মধ্যে কেমন যেন গুড়গুড় করে , বুক দুরুদুরু করে । ও আমাকে ওর দিকে তাকাতে বলে কেন ? যদি বা অন্যদিকে তাকিয়ে একটু সহজ স্বাভাবিক থাকতে পারি, ওর দিকে তাকালে আমি একেবারেই ভ্যাবলাকান্ত’টি । তবুও কি আর করা ? এক আকাশ লজ্জা নিয়ে ওর দিকে ফিরে চোখ তুলে তাকালাম ।
ও আমার দিকে দুষ্টুমি ভরা চোখে তাকিয়ে বলল , এখন কি দেখছ ?
আমি যদিবা অনেকটা লজ্জা অতিক্রম করে তাকিয়েছিলাম ওর দিকে , এমন প্রশ্ন শুনে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলাম ।
ও ঝুঁকে পড়ে আমার মুখটা সামনাসামনি দেখার চেষ্টা করে বললো , চোখ সরালে যে? কি হলো ? তাকাতে বললাম না, আমার দিকে ?
আমি ছাদের কার্নিশের ওপর চোখ নামিয়ে আঙ্গুল দিয়ে কারিকুরি করতে করতে বললাম, আপনার দিকে তাকানোর কি আছে ?
— কি আছে সেটা না তাকালে বুঝবে কি করে?
কিছু একটা বলব বলব ভাবলাম । কিন্তু শেষমেশ বলে উঠতে পারলাম না।
— কি হলো, তাকাবে না তো ?
আমি কিছু বললাম না । শুধু একটা ঢোঁক গিললাম।
— কার মধ্যে কি আছে সেটা কি ওমনি দূর থেকে বোঝা যায়? দেখতে হয়, বুঝতে হয়, জানতে হয়।
আমি ওর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম ও কথা বলতে বলতে মিটিমিটি হাসছে ।
বললাম, আপনি তো জানেন নিজের মধ্যে কি রয়েছে । বলে দিন তাহলে সেটা ।
ফিক করে হাসল ও । বলল, সেটা আমি বলতে পারি। কিন্তু, আমার দিকে তাকিয়েই সেটা শুনতে হবে ।
— বা রে ! মানুষ বুঝি চোখ দিয়ে শোনে ? আমার কান খোলা আছে । আপনি বলুন ।
— উঁহু, আমার দিকে না তাকালে আমি বলবো না ।
ছাদের কার্নিশ থেকে কনুই দুটো তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকের উপর দু’হাত ক্রস করে রাখল ও। দাঁড়ানোর এই ভঙ্গিমাটার মধ্যে কি আছে ঠিক জানি না , তবে কেমন যেন মনে হয় মানুষটা একটু দূরে চলে গেল । ভয়ে ভয়ে তাকালাম । ও যদি এখনই ছাদ থেকে নেমে চলে যায়, এই সমস্ত বিরল মুহূর্ত, এমন সব মুহূর্ত , যা আমি সর্বক্ষণ মনে মনে কল্পনা করি- আমি নিজের ঘরে রয়েছি, হঠাৎ করে ও সেখানে চলে এলে কেমন হয় ? এই আমি ছাদে ঘুরছি, যদি এখন ও চলে আসে? কলেজের ক্লাসরুমে বসে রয়েছি , ও ঠিক আমার পাশে বসে থাকলে কি হত ? বা , যদি প্রফেসরের জায়গায় ও দাঁড়িয়ে লেকচারটা দিত , আমি অবাক হয়ে শুনতাম ? আর এই সমস্ত স্বর্ণ-মুহূর্ত এসে পড়লেই, আমি কেমন যেন ভেবড়ে যাই ।
তরু, না ! এখন কিছুতেই ওকে ছাদ থেকে চলে যেতে দেওয়া যাবে না। জোর করে নিজের চোখ দুটোকে শাসন করলাম , লজ্জাকে শাসন করলাম। তারপর এক পৃথিবী ভার দুটো চোখের পাতায় উত্তোলন করে আমি জোর করে তাকালাম ওর দিকে ।
বললাম , তাকিয়েছি বলুন এবার ।
ও একটু সরে এলো আমার কাছে । নিচু হয়ে মাথাটাকে ঝুঁকিয়ে সরাসরি আমার চোখের মধ্যে তাকালো ।
বলল, ‘ফিলোসফার্স স্টোন’ জানা আছে , কাকে বলে ?
দ্বন্দ্বে পড়লাম । ফিলোজফার কাকে বলে তা জানি, স্টোন কি তাও জানি । তবে ‘ফিলোসফার্স স্টোন’টা কি পদার্থ কে জানে । আবার প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারার লজ্জা ।
চোখ নামিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম , ও বলল, উঁহু! চোখ নামালে হবে না । বল জানা আছে কিনা ।
মুখে সেই মিটিমিটি হাসি ।
আমি বললাম না কিছু । নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লাম দুদিকে।
ও বলল , এলিক্সির অফ লাইফ ?
অসহায় লাগছিল ! মনে হচ্ছিল যেন ও সম্পূর্ণ অজানা কোন একটা ভাষায় কথা বলছে । আরো জোরে দুদিকে ঘাড় নাড়লাম । যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করলাম ওর প্রশ্নগুলোর বিরুদ্ধে । এমন অনুচিত প্রশ্ন এখনই বন্ধ করা উচিত! উচিত , উচিত !
ও বাঁ হাতটাকে কপালের পাশে নিয়ে গিয়ে তর্জনীটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল, হুম ! কি করে যে বোঝাই তোমায়-
তারপর হঠাৎ করে খুশি খুশি গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ মনে পড়েছে – পরশ পাথর । পরশ পাথর কি নিশ্চয়ই জানো ?
এবার ডানদিকে ঘাড় কাত করে বললাম, হ্যাঁ ।
— বেশ , কি বলতো ? উঁহু , চোখ একদম সরাবে না । আমার দিকে তাকিয়েই বল।
মিনমিনে গলায় বললাম, পরশ পাথর ! ঐতো এমন একটা পাথর , যেটা দিয়ে যে কোনো কিছুকে টাচ করলে সেটা সোনা হয়ে যায় ।
— গুড , তার মানে ম্যাজিকাল কিছু তাইতো?
— হ্যাঁ ।
— এই ম্যাজিক্যাল কিছু যে কারোর মধ্যে রয়েছে কি না , তা কি অমনি অমনি বোঝা যায়? তাকে দেখতে হয়, বুঝতে হয়, জানতে হয় ।
— হুম !
— কী , হুম? কী বুঝলে বলো ।
— না মানে-
— হ্যাঁ বলো-
— মানে , আপনি কি বলতে চাইছেন ? আপনার মধ্যে ম্যাজিকাল কিছু রয়েছে ?
এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম কথাগুলো ।
হাত উল্টে ও বলল, কি জানি থাকতেও পারে । সে কি আর নিজে নিজে বোঝা যায় ? অন্য কেউ বললে এক বুঝতে পারি।
— মানে ?
— মানে , পিসি সরকারের ম্যাজিক দেখে এত এত অডিয়েন্স ম্যাজিকাল কিছু দেখতে পায় বলেই না পিসি সরকার, পিসি সরকার হয়েছেন?
— মানে আপনি কি বলতে চাইছেন , আপনি পিসি সরকার ?
জোরে হেসে উঠল ও । বলল , পিসি সরকার না হলেও ছোটখাটো ম্যাজিশিয়ান তো হতে পারি ।
অবিশ্বাস ভরা চোখে বললাম , আপনি ম্যাজিক দেখাতে পারেন ?
— ইয়েস , চেষ্টা তো করতে পারি ।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দুলতে লাগলাম । অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে সত্যিই খুঁজতে লাগলাম ওর মধ্যে কি কিছু একটা ম্যাজিকাল রয়েছে? ও কি সত্যিই ম্যাজিশিয়ান ?
ও ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ম্যাজিক দেখতে গেলে চোখ বন্ধ করতে হবে । এইরকম করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে তো ম্যাজিক দেখানো যাবে না ।
আমি বললাম, চোখ বন্ধই করে ফেললে আর ম্যাজিক কোথায় হল? পিসি সরকারের ম্যাজিক বুঝি আমরা চোখ বন্ধ করে দেখি?
— সব ম্যাজিক কি একরকম হয় নাকি ? আমি যে ম্যাজিকটা দেখাবো সেটা চোখ বন্ধ করে দেখতে হবে ।
— চোখ বন্ধ করে ফেললে আর দেখবোটা কি ?
— সেটা চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাবে।
আমি কি করব বুঝতে না পেরে সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম । ও ওর বাঁ হাতটা আমার মুখের কাছে নিয়ে এসে আমার চোখের পাতায় স্পর্শ করল । কেঁপে উঠলাম আমি ! ইস্, কি লজ্জা ! ও বুঝতে পারেনি তো , আমি কেঁপে উঠেছি? ওকে আর কিছুই করতে হলো না , আপনি আপনিই আমার দুটো চোখের পাতা সমস্ত লজ্জার ভার গায়ে মেখে বন্ধ হয়ে পড়লো টুপ্ করে ।
কিছুক্ষণ সবকিছু অন্ধকার । তারপর হঠাৎ করে যেন হাজার-মুখী একটা লাইট জ্বলে উঠলো আমার মনের মধ্যে। নাকি হাতে ? কোথায় কি হলো কে জানে । আমি বুঝতে পারলাম, ও আমার ডানহাতটা নিজের বাঁহাতে তুলে নিয়েছে । তারপরে আমার অবশ হয়ে যাওয়া হাতের আলগা মুঠোটা খুলে ফেলে, ডানহাতের ওর আঙুলগুলো দিয়ে আমার আঙুলগুলো স্পর্শ করেছে । তর্জনী, মধ্যমা , অনামিকা, কনিষ্ঠা , প্রতিটা আঙ্গুলের ডগা ওর আঙ্গুলের স্পর্শ পাচ্ছে। এক এক করে আমার আঙুলগুলো ভিজে যাচ্ছে , গলে যাচ্ছে । আমি দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছি । বিন্দুতে বিন্দুতে মিশে যাচ্ছি সান্ধ্য-হাওয়ার স্রোতে। এ কি অদ্ভুত কান্ড ! শুধু আমার আঙ্গুলের ডগাগুলো ও স্পর্শ করে দিল, তাতেই আমি এভাবে গলে যাচ্ছি ? আস্তে আস্তে ও আমার আঙ্গুলের ডগা ছেড়ে, আঙুলগুলো বরাবর প্রতিটা খাঁজে ওর তর্জনী বুলিয়ে দিতে লাগল। তারপরে দুটো হাতই ওর হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে আমার আঙ্গুলের খাঁজে খাঁজে ওর আঙুলগুলো ডুবিয়ে দিয়ে আমাকে কার্নিশের গায়ে চেপে ধরল । আমার আঙ্গুলের প্রতিটা ভাঁজ তখন ওর আঙ্গুলের প্রতিটা ভাঁজের সাথে মিলেমিশে একাকার । আমার মনের মধ্যে মেঘ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে । আমি ভিজে যাচ্ছি । চমকে উঠছি । কেঁপে কেঁপে উঠছি। চোখ খুলতে ভয় পাচ্ছি । চোখ খুললেই যেন এই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে পড়বো । আর কোনদিন এই স্বপ্ন আমি দেখতে পাবো না ।
কি যেন বলছিল ও?
পরশ পাথর ?
ও ম্যাজিশিয়ান ? ওর কাছে পরশপাথর আছে ? পরশ পাথর দিয়ে ছুঁয়ে দিলে আমি সোনা হয়ে যাব ?
মনের প্রতিটা কোণ তখন আমার তরল হলুদ ধাতুর বর্ণ ধরে গলে গলে পড়ছে । ছাদের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে সেই তরল স্বর্ণাভ করে দিয়েছে প্রতিটা চা গাছের পাতা । আশেপাশের বিশাল চা বাগান হলুদ আলোয় হাসছে। ঝিকমিক করছে । আমার শরীর-মনের তরল সোনা নিজের বর্ণে রাঙিয়ে দিয়েছে সমগ্র পৃথিবীকে । সোনালী তারাগুলোর থেকে সোনালী মিটিমিটি আলোর বিকিরণ হচ্ছে । গোটা পৃথিবীটা এমন করে এক নিমেষে সোনায় বাঁধানো হয়ে গেল কি করে ?
পরশ পাথর !
কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা । হয়তো সময়ের হিসেব করলে দাঁড়াবে দু তিন মিনিট । তবুও আমি জানি দু তিন যুগের কম তা ছিল না ।
হঠাৎ করে , হঠাৎ করেই, চোখ খুলে আমি ওর আঙুলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে সিঁড়ির পথ ধরলাম । সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে দোতলায় নেমে সটান চলে গেলাম আমার ঘরে । দরজায় আগল দিলাম । সেদিন সন্ধ্যাবেলা সেই আগল আর খুললাম না । কি করেছিলাম সেদিন ঘরের মধ্যে নিজেই জানিনা । কোনো খেয়ালই ছিলনা । কখনো মনে হচ্ছিল হয়তো পাতালে ডুবে যাচ্ছি । কখনো মনে হচ্ছিল, মেঘের রাজ্যে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি। কখন যে কি হচ্ছে ! বইয়ের পাতা খুলে বসলে তার রং হলদে হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে সর্বত্র তরল সোনা ! শুধু এটুকু মনে আছে , মাঝে একবার দেওয়াল আলমারিটা খুলে নিজের চুড়িদারগুলোর মধ্যে থেকে বেছে বেছে হলুদ চুড়িদারগুলো বার করে সব ওপরে সাজিয়ে রেখেছিলাম । হলুদ রং বড় প্রিয় হল আমার সেদিন থেকে । পরশ পাথর যে সব কিছুকে হলুদ সোনায় রূপান্তর ঘটায় !
হুঁশ ফিরেছিল যখন বাড়ির একজন কেয়ারটেকার রাজীব কাকা আমার বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আমাকে নক করে বলেছিল , দিদি খাবেন আসুন । সাড়ে নটা বাজে । সবাই টেবিলে ওয়েট করছেন আপনার জন্য ।
ধড়মড়্ করে উঠে বসে ছুটেছিলাম একতলায় ডাইনিং স্পেসে। নটা পঁয়ত্রিশ বাজছে । সকলেই রয়েছে সেখানে। ভামিনী কাকিমার মুখ গম্ভীর, থমথমে। টেবিলে আমার নিজের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারটায় ধপ্ করে বসে পড়ে চামচ আর কাঁটাচামচ হাতে তুলে নিয়েছিলাম । সেইদিন প্রথম ভামিনী কাকিমার লাগু করা একটা নিয়মের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন নিয়ম আর পৃথিবীতে বলবৎ হতে পারে বলে আমার মনে হয় নি । সেই প্রথম ভামিনী কাকিমার করা শ্বাসরুদ্ধকর নিয়মের জাল আমাকে এক পশলা বৃষ্টি এনে দিয়েছিল । কাঁটাচামচ , চামচ ! আমাকে না তো হাতে করে মেখে খেতে হবে, না তো খেয়ে উঠে হাত ধুতে হবে। সারাটা রাত আমি আমার সোনুদার স্পর্শ মেখে ঘুমোতে পারব।
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/
আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/
নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/
দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/
এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/
বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/
তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/
চোদ্দো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1002718000518264/
ছবি : সংগৃহীত