#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®
চোদ্দো
( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)
উপমারা চলে যাওয়ার পর ফিরে এসে আবার লনে পাতা চেয়ারে বসে পড়লাম। হুস্ করে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দুরে কোনো গ্রাম্য বসতি অঞ্চল থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। আমি পুজো করি না। সন্ধ্যা দিই না । মা আমাকে বকাবকি করে সেজন্য । ছোটবেলায় জোর করে অভ্যাস করানোর চেষ্টা করেছিল । কিন্তু, মনের তাগিদ কখনো সেভাবে অনুভব করিনি । তাই ঠাকুর দেবতার সামনে নিয়ম করে গিয়ে দাঁড়ানো , প্রদীপ জ্বালানো, শাঁখ বাজানো, এসব আসে না আমার । আমি কি তবে নাস্তিক ? বোধহয় না । ঠাকুরের সামনে আমি গিয়ে বসি মাঝে মধ্যে। মনখারাপ হলে বসে থাকি। মনের কথা বলি সব মনে মনে । তবে মনখারাপ হলে আমি শুধু ঠাকুরের কাছেই যাই না, প্রকৃতির কাছে বেশি যাই। মন খুব অশান্ত হলে আমাকে পাহাড় টানে তার অসীম সৌন্দর্যের মাঝে । মাঝের এই এতগুলো বছরে কখনো নর্থবেঙ্গলে না এলেও আমি কুমায়ুন হিমালয় গেছি , গাড়োয়াল হিমালয় গেছি , নাগাল্যান্ডের সবুজ ঘেরা পাহাড়ে ট্রেক করেছি। দূরে, ওই দূরে ভেসে ওঠা তুষারশৃঙ্গ একা একা বসে যখন দেখেছি, অনুভব করেছি, দুচোখ ভরে উঠেছে জলে । আমার মনের সমস্ত ব্যথা আমি হিমালয়ের কাছে উজাড় করে দিয়েছি। সব কিছু বলেছি । আমার কাছে ঈশ্বরও যা, প্রকৃতিও তাই । দুজনের গঠন ভিন্ন, অস্তিত্ব এক। আমার বাংলোতেও ঠাকুর আছেন । মা যশোদার কোলে চড়ে দুষ্টু গোপাল – অনিন্দ্যসুন্দর একখানি মূর্তি । মায়াপুরে গিয়ে একবার কিনে এনেছিলাম । পিতলের মূর্তি। নিয়ে এসেছি সেটা আমি আসার সময়। ঠাকুরঘর রয়েছে একটা ছোট্ট মতো। ছাদে ওঠার সিঁড়ির বাঁ পাশে । সেখানে পিঁড়ির ওপরে বসে আছেন আমার গোপাল ঠাকুর। তবে, আমি সন্ধ্যা না দিলেও, টগর প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা উঠে একটা করে প্রদীপ জ্বেলে আসে সেখানে। না কোনো আড়ম্বর নেই ঠাকুরঘরে। ঠাকুরের আধিক্য নেই । ফলমূল, সিঁদুর, বেলপাতা নেই । সিংহাসন , কাঁসর , ঘন্টা , কিছুই নেই। তবে সন্ধ্যাবেলা প্রতিদিন একবার করে যখন ছাদে উঠি আমি, ঘরের মধ্যে ক্ষীণ নীলচে আলোর আভায় আমার গোপাল ঠাকুরকে এক বার করে দেখে নিই। তিনি ভাল আছেন কিনা । এই আমার ঠাকুর পুজো ।
উপমা-ইন্দ্রাশিষ বাবু-চা বাগান-টগর-আমি-ঝিঁঝিঁর ডাক-ফুলের গন্ধ-ঠান্ডা হাওয়া .. মিলে মিশে যাচ্ছে সবকিছু আমার মনের আঙিনায় । কিছু শুনছি, কিছু ভাবছি, কিছু দেখছি । আমার আমি সবটুকুর সাথে দ্রবীভূত হয়ে মিলেমিশে যাচ্ছে । কতক্ষণ ওভাবে ওখানে বসে থাকলাম খেয়াল নেই । টগর বেশ কয়েকবার ইতিমধ্যে ডেকেছে আমায় – মেম ঘরে চলে আসুন । আর কতক্ষণ বসে থাকবেন ওখানে ?
ওর কথাটা আমার কানে ঢুকলেও, মাথা পর্যন্ত পৌঁছায়নি । আমি ওখানেই বসে ছিলাম । এক মাস পার করে ফেললাম এখানে । এই চা বাগানে । ঠিক এক মাস আর দিন কয়েক আগে যখন এসেছিলাম, তখনো শুক্লপক্ষ ছিল । আজকেও শুক্লপক্ষ । কোন তিথি আমার জানা নেই। তবে আর দিন দুই তিনের মধ্যেই পূর্ণিমা হবে। চাঁদের আকার এবং আকৃতি তাই বলছে। লনে বসে বসে যতদূর চোখ যায় চাঁদের আলোয় মায়াবী চা বাগানে চোখ রেখে বসে রইলাম । এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা পেয়ে বসল আমায় । যেন বহু যুগ ধরে চলে আসা অনন্ত কোন সময় এই ভাবেই থমকে রয়েছে । যেন জগৎ সৃষ্টির আদি থেকে সবকিছু ঠিক এমনটাই ছিল । ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত চিন্তা আমার মাথায় চেপে বসলো । এই মায়াবী চাঁদের আলোয় ওই চা বাগানের বুক চিরে যে সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে, সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুরে ঐ বহুদূরে দিগন্তরেখার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কেমন হয় ? কেমন যেন নিশির ডাকের মতো আমাকে সেই রূপোলী ‘চাঁদের বাগান’ হাতছানি দিতে লাগলো। আনমনে লন পেরিয়ে কয়েক পা চলে এসেছি ।
হঠাৎ করে পেছন থেকে টগরের উত্তেজিত গলা ভেসে এলো, মেম কোতা যান ?
আমি থমকে দাঁড়ালাম । বললাম, এই একটু আশেপাশে ঘুরবো।
— এখন এই সাঁজের আঁধারে ?
— হ্যাঁ ।
— কি বলছেন মেম ! একেনে এই জংলার মধ্যে সাঁজের বেলা আপনি ঘুরে বেড়াবেন?
— জঙ্গল কোথায় ?
— মেম আপনি জানেন না , একেনে সব সাঁজের বেলা নানারকম পোকামাকড়, নতা, এসব বেরোয় কিনা ।
— লতা ?
— হ্যাঁ মেম , নতা । কখন এই এ্যাত্তো বড় ফণা তুলবে নিঃসারে, জানতেও পারবেন না ।
সে হাত তুলে সাপের ফণার ভঙ্গি করে দেখালো।
— সাপ ? সাপের কথা বলছো?
টগর ছুটে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো । জিভের প্রায় অর্ধেকটা বাইরে বার করে দাঁতে করে কেটে বলল , সাঁজের বেলা তেনাদের ওই নামে কবেন না, মেম ! নতা বলুন গো , নতা !
হেসে বললাম, আচ্ছা তাই না হয় হল । তা, তোমার লতারা হঠাৎ করে সবাই সন্ধ্যাবেলায় বেরিয়ে পড়বেন কেন শুনি ? সারাদিন তো কাটে আমার এই মাঠে-ঘাটেই। তখন কই বেরোন না তো ?
টগর খুব ভয়ে ভয়ে চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে আমার কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, মেম আর তেনারাও তো আচেন । এভাবে একন ঘুরে বেড়াবেন না মেম। এই সাঁজের বেলায় তেনারা কিন্তু-
— তেনারা কি আমার ঘাড়ে চেপে বসবেন? তা বসুন। তোমার ঘাড়ে তো আর চাপতে আসছেন না ।
ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে সসস্ করে শব্দ করে সে বললো , কি সব বলছেন মেম? চুপ করুন । তেনারা শুনতে পাবেন যে!
সশব্দে হেসে ফেললাম । বললাম, ঠিক আছে । কেউ আমার ঘাড়ে চাপবে না। তুমি যাও । নিজের কাজ করো গিয়ে। আমি কাছাকাছি কিছুটা ঘুরে আসি।
মিয়োনো গলায় সে বলল , আপনি মুট্টে কোন কতা শুনেন না। দাঁড়ান, ওই যদুকে বলি আপনার সাথে যাক ।
‘না’ বলতে গিয়েও বললাম না । ভাবলাম , ভালোই তো বলেছে টগর । একজন যদি সাথে থাকে , থাকুক না। অসুবিধা কোথায়?
বললাম , ঠিক আছে । আমি দাঁড়াচ্ছি। তুমি আসতে বল।
সম্পূর্ণ এক মিনিট হওয়ার আগেই যদু চলে এলো। তার ডান হাতে একটা বেশ শক্তপোক্ত বাঁশের লাঠি , লম্বা গোছের । আর বাঁহাতে বড় একটা ব্যাটারি-টর্চ । আমার কাছে এসেই ফটাস্ করে টর্চটা অন করতেই চারিদিকে সেই কৃত্রিম আলো ছড়িয়ে পড়ল। প্রাকৃতিক যে দৃশ্যপট আমাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তার মাদকতা এক নিমেষেই হাওয়া !
আমি বললাম, টর্চটা অফ করে দাও , যদু । এখন কোন দরকার নেই । বেশি অন্ধকার দেখলে তখন জ্বালিয়ো । আমি বলে দেবো । তা ছাড়া চাঁদের আলো তো রয়েছে ।
যদু , ‘আজ্ঞে দিদিমনি’ বলে টর্চটা অফ করে দিলো ।
এগিয়ে চললাম । সরু যে রাস্তাটা চা বাগানকে দু’ভাগে ভাগ করেছে , সেই রাস্তাটা বেয়ে এগিয়ে চললাম । শুধু আমাদের দুজনের পায়ের খসখস্ শব্দ, যদুর মাঝে মাঝে লাঠি ঠোকার আওয়াজ , তার সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক – এছাড়া এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। বেশ কিছুটা দূরের চা পাতার রুপোলী ফোঁটাগুলোর ওপরে ইতস্তত কয়েকটা ছোট ছোট আলোর বিন্দু ঘুরে বেড়াচ্ছে । আরো কিছুটা এগোতে দেখলাম, কয়েকটা নয়, বেশ অনেকগুলো । ছোট ছোট সবুজ বিন্দুগুলো জ্বলছে, নিভছে, জ্বলছে, নিভছে। বুঝলাম জোনাকিরা বাসা বেঁধেছে বাতাসে । যেন ওই দূরের আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো ‘সবুজ সবুজ’ বিন্দুতে খানিক উড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের সামনে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম । তারপর, জোনাক-রঙা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে গেলাম । আরো কিছুটা দূরে এগিয়ে যেতে সেখানে বেশ অন্ধকার। দু’তিনটে শেড-ট্রির ছায়া এসে পড়েছে ।
এতক্ষণ নিঃশব্দে আমার আগে আগে চললেও যদু এবার কথা বলল, দিদিমনি টর্চটা জ্বালাবো?
— কেন? ভয় করছে নাকি তোমার ?
— না মানে এইসব চা গাছের মধ্যে অনেক কিছু ঢুকে থাকে, জানেন তো?
— কিসের কথা বলছো , সাপ?
অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম যদু একটু শিউরে উঠলো । তারপর বললো , শুধু কি তাই দিদিমণি ? এমনকি এই সন্ধ্যার পরে চা বাগানের মধ্যে জঙ্গল থেকে কত জন্তু-জানোয়ার, চিতা পর্যন্ত এসে পড়ে । এভাবে এখান দিয়ে ভর সন্ধ্যেবেলা না ঘোরাই ভালো।
আমি হাসলাম । বুঝলাম, ওর প্রাকৃত কিছুর থেকে অতিপ্রাকৃত কিছুর উপস্থিতির কথা কল্পনা করে ভয় করছে বেশি ।
বললাম, জ্বালো, জ্বালো-
আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই টর্চটা জ্বলে উঠলো । ঠিক যেন একটা ড্রাগন আগুনের মতো হাঁ করে সমস্ত সৌন্দর্য এক নিমেষে গিলে খেয়ে নিল।
এক মিনিট পর আমি বললাম, যদু, এবার অফ করে দাও লাইফটা । কোথাও কিছু নেই, দেখে নিলে তো?
সে অনিচ্ছা সত্বেও লাইটটা অফ করল বটে, তবে বলল , আশেপাশে নেই বটে দিদিমণি। তবে হুট করে আসতে কতক্ষণ ? এখানে এইসব চা-বাগানে এমনকি পাশের জঙ্গল থেকে হাতির পাল পর্যন্ত চলে আসে ।
আমি বললাম , তা আসে বটে । ওই চা গাছের নিচের দিকে একরকমের ঘাস খায় ওরা- ‘বনসুম’।
নিদারুণ বিস্মিত গলায় ও বলল , আপনি জানেন ?
— হ্যাঁ জানব না কেন ? চা-গাছ নিয়েই তো আমার কারবার।
— তবু এভাবে সন্ধ্যেবেলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন দিদিমণি, অন্ধকারের মধ্যে ?
আমি ওর কথার কোন উত্তর দিলাম না । এই ক্ষণিক পাওয়া সুন্দর আমেজটা কথা বলে বলে ভঙ্গ করতে আমার ইচ্ছে করছিলো না । কল্পনায় দেখলাম ওই দূরে হঠাৎ করে চা বাগানের ফাঁকে হালকা রূপালী আলোয় দৃশ্যমান হয়ে উঠলো একটি সবল মাংসাশী প্রাণীর বলিষ্ঠ পিঠ !
কি হবে?
কি হয় এমন হলে?
কি করব আমি তখন?
খুব যে কিছু সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারবো না , সেটা আমাকে জাস্ট কয়েকটা দিন আগেই উপমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে । সত্যি কথা বলতে কি , একটু গা ছমছম্ করল । এই গা ছমছমে অনুভূতিটা না হলে সৌন্দর্য আস্বাদনের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না । সেটাও ঠিক ।
যদু বলল, মাকড়া বাড়ি চা বাগানে এই তো দুদিন আগে একটা বড় দাঁতাল হাতী তার দল নিয়ে ঢুকে পড়েছিল । সে একদম কেলেংকারী কান্ড দিদিমণি !
— হ্যাঁ জানি ।
যদু আর কিছু বললো না। তবে ভাবল নিশ্চয়ই- সবই যদি জানেন, তবে আর এখানে এভাবে অন্ধকারে কি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন?
কি যে আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছি তা যে আমি কাউকে বোঝাতে পারিনা। প্রকৃতিকে জড়িয়ে থাকা যে রোমান্টিসিজম , তার স্বাদ এত মধুর, এত সুতীক্ষ্ণ , যে আকর্ষণ অমান্য করা যায় না। আস্বাদনের পরে শূন্য হাতে, পূর্ণ হৃদয়ে ফিরতে হয় ।
ফিরে এলাম মিনিট পনেরো কুড়ি পরে । বাংলোয় ফিরে এসো টগরকে এক কাপ র’চা দিতে বলে নিজের ঘরে এসে কিছুটা গড়িয়ে নিচ্ছিলাম। আবার কাল সকাল থেকে ছোটাছুটি পুরো সপ্তাহটা। রবিবার সন্ধ্যের পর থেকে অদ্ভুত একটা শ্রান্তি মনটাকে ঘিরে ধরে । মোবাইলটা হাতে নিতে দেখলাম জিমেইলে নতুন ইনবক্স এর নোটিফিকেশন এসেছে । জিমেইল একাউন্ট ওপেন করলাম। মান্থলি প্রগ্রেসের যে রিপোর্টটা পাঠিয়েছিলাম, তার রিপ্লাই এসেছে । দেখলাম বেশ কড়া ভাষা । আমি জয়েন করার পর থেকে নাকি প্রোডাকশন একটু কমতে পারে- একমাসের রিপোর্ট সেইরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে । কিন্তু , সেটা কিভাবে সম্ভব ? মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ঠিক বুঝতে পারলাম না এরকম রিপ্লাই কেন ওনারা আমাকে পাঠালেন । সত্যি কি প্রোডাকশন কমতে পারে? আর সেরকমটা হলে আমার ইনক্রিমেন্ট তো সম্ভবই নয় । চাকরিটাই থাকবে কিনা সন্দেহ । প্রাইভেটে চাকরি তো , সবসময় বুকে দুরুদুরু ভাবটা নিয়েই ঘুরতে হয় । আমি নতুন কাজে জয়েন করে অনেকটা উৎসাহ নিয়ে কাজ করেছি এবং সেই সন্তুষ্টি নিয়েই রিপোর্টটা পাঠিয়েছিলাম। ভাবতে পারিনি এরকম নেগেটিভ রিপ্লাই আসতে পারে। মাথাটা ইন্যাক্টিভ হয়ে এলো । ভালো লাগলো না নিজের বদ্ধ ঘরটায় ।
টগর চা এনে দিলো । অশান্ত হৃদয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে ছাদে উঠে এলাম । টগর আসার চেষ্টা করেছিল আমার পেছন পেছন।
কিন্তু, আমি তাকে কড়া গলায় বললাম, একদম এখন ছাদে উঠে আসবে না আমার সঙ্গে ।
সে আমার গলা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল । আর কিছু প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা করলো না । উঠে এলাম ছাদে । একা একা। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না । আমি তো প্রিভিয়াস কয়েকটা মাসের রিপোর্ট চেক করেছি । আমি যে রিপোর্টটা পাঠিয়েছি, তাতে তো সেরকম কিছু ইন্ডিকেশন মালিকপক্ষের পাওয়া উচিত নয় । অন্ততপক্ষে এত তাড়াতাড়ি। জয়েন করার এক মাসের মধ্যেই । অস্থিরভাবে পায়চারী করতে করতে ভাবতে লাগলাম । হঠাৎ করে মাথায় একটা পয়েন্ট ক্লিক করলো । এমন কি হতে পারে , ওনারা আমাকে উল্টো চাপ দিয়ে প্রোডাকশন আরো বাড়ানোর চেষ্টা করছেন? যাতে করে আমি একটু চাপে পড়ে যাই এবং প্রোডাকশন ঊর্ধ্বমুখী করার আপ্রাণ চেষ্টা করি ? হ্যাঁ , হতে পারে । এমনটা হতে পারে। মালিকপক্ষ বেশিরভাগ সময়ই এইরকম জঘন্য স্ট্র্যাটেজি নিয়ে থাকে । যাইবা হোক, যে কারণেই বা হোক , কাজ শুরুর একমাস পরেই এরকম একটা নেগেটিভ রিপোর্ট আমাকে বেশ হতাশাগ্রস্ত করে দিল। কলকাতার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এখানে এত দূরে এসেছি বেটার কিছুর আশাতেই তো । আমাকে এরা আবার ম্যানেজারের পোস্টে রাখবে তো ? চাকরীটা আমার থাকবে তো ? এই সমস্ত চিন্তা বেশ পেয়ে বসলো । মনটা খারাপ হয়ে গেল । ছাদের কার্নিশের ওপর বসে স্থির হয়ে ভাবতে লাগলাম ।
চাঁদের রুপোলি আলো নীলচে হয়ে যেন গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যেতে লাগলো । কি কারণ হতে পারে ? ইমেলের পরে আমার নিজস্ব কাজে কি কি পরিবর্তন আনা দরকার? প্রোডাকশন তো অবশ্যই কিছুটা বাড়াতে হবে । কি করা যায়? কিছুক্ষণ ভাবলাম । একটা স্ট্র্যাটেজি এল মাথায় । মনটা কিছুটা শান্ত হল । কিন্তু, অদ্ভুত এক হতাশার ভারে ডুবে গেল। চাঁদনী রাত .. সেই চা বাগান .. সেই.. সেই সন্ধ্যাবেলার কথা মনে পড়ল । আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগেকার এক রুপোলি চাঁদের রাত। ছাদে আমি ছিলাম, আকাশের চাঁদ ছিল , আর ‘সে’ ছিল। আমার সোনুদা –
যেদিন অজিত কাকুর বাংলোয় ডিনার করতে এসে সোনুদা আমার ঘরে গিয়ে আমাকে বলে এসেছিল , পরের দিন থেকে যেন আমি বিকেলবেলায় বান্টির সঙ্গে অবশ্যই বেরোই, তারপর থেকে সে আদেশ লঙ্ঘন করার সাধ্য আমার তখন ছিল না। পরের দিন থেকেই দুরুদুরু বুকে আবার বান্টির সঙ্গে বিকেল বেলা বেরোতে আরম্ভ করলাম। টুকটাক কথা হতো সোনুদার সঙ্গে । বান্টি অনর্গল বকে যেত । আমি দু-একটা কথা বলতাম । তবে , জড়তাটা কিছুটা কেটেছিল । মাসখানেক এভাবে কাটার পর বান্টির হঠাৎ করে খুব শরীর খারাপ হলো । টাইফয়েড জ্বর। ভীষণ বাড়াবাড়ি হয়ে গেল । প্রায় যমে মানুষে টানাটানির অবস্থায় গিয়ে পৌঁছলো । যাইহোক , শেষ পর্যন্ত জ্বর সারলেও ডক্টর বান্টিকে বাড়িতে রেস্টে থাকতে বললেন । মাসখানেক খাওয়া-দাওয়ার ওপরেও প্রচুর রেস্ট্রিকশনস হলো। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। ভামিনী কাকিমার সবকিছুতেই বেশ বাড়াবাড়ি ছিল । বান্টির এই শরীর খারাপ, তার শুশ্রূষা এবং পথ্য , ইত্যাদি সমস্ত কিছুতেই সেই একই রকমের বাড়াবাড়ি আরম্ভ হল । স্কুলের সাথে কথা বলে প্রায় মাস পাঁচ-ছয় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ । সেদ্ধ-পক্ক খায় । আমি একাই গাড়িতে করে কলেজে যেতাম, আসতাম । বিকেলবেলা ঘুরতে বের হতাম । আর এই সময়টাতেই আমার সঙ্গে সোনুদার আলাদাভাবে মেলামেশার সুযোগ ঘটলো । প্রতিদিন বিকেলে প্রায় কোন এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে আমি কলেজ থেকে ফিরেই বাইরে বের হতাম । সোনুদা’ও নির্দিষ্ট সময়ে চলে আসতো। ধীরে ধীরে জড়তা অনেকটাই কেটে গেল আমার । লজ্জা পেতাম খুব । যেন এক পৃথিবী লজ্জা ভর করত আমার চোখের পাতায় সোনুদা’কে দেখলেই । তবে অতোটা ভয় আর পেতাম না । কিছুটা বন্ধুত্ব হল । সহজ হয়ে এলো সম্পর্কটা।
তারপরেই এলো সেই রুপোলী চাঁদের রাত । রাত নয় , সন্ধ্যে। ঠিক আজকেরই মতো । আমি ছাদের কার্নিশে কনুই রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম । কি যে ভাবছিলাম , মনের কোন্ অতলে ডুব দিয়েছিলাম জানিনা । সেই সেদিন .. যেদিন প্রথম ওর আঙুল ছুঁয়েছিল আমার আঙ্গুল –
নাকি অন্যকিছু কে জানে…
ক্রমশ..
©®copyright protected
এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/
দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/
তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/
চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/
পাঁচ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/986002805523117/
ছয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/987404668716264/
সাত-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/989485091841555/
আট-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/991102821679782/
নয়-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/993099491480115/
দশ-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/994279738028757/
এগারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/995634347893296/
বারো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/998832147573516/
তেরো-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/1000733104050087/
ছবি : সংগৃহীত