ঘাড়ে কারো কোমল স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো স্পন্দন। এই ভোর সকালে তার রুমে আসার সাহস কারো নেই। তাহলে কে তাকে স্পর্শ করলো? ভাবতে ভাবতে মাথাটা ঘুরালো সে। একটা ছায়া দেখতে পেলো। ছায়াটা একজন নারীর। ফ্যান এবং এসির বাতাসে মেয়েটির ওড়না এবং চুল উড়ছে। মেয়েটি হয়তো লুকানোর চেষ্টা করছে কিন্তু স্পন্দনের চোখে লুকিয়ে থাকাটা দায়। বিছানা থেকে উঠে চুপচাপ লাইট অন করতেই মেয়েটি ভয়ে পর্দার আড়ালে লোকানোর চেষ্টা করলো। স্পন্দন ভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,
–” লোকানোর দরকার নেই। এই সাত সকালে কেন আসছিস সেটা বল।”
কোনো সাড়া শব্দ আসলো না। স্পন্দন এইবার বিরক্ত হয়ে রাগী দৃষ্টি এবং ঝাঁঝালো কণ্ঠে আবারো বলল,
–” শুভ্রতা! সমস্যা কি তোর? একবার ডাকলে কানে যায় না? নাটক করতে ভীষণ ভালো লাগে নাকি আমার হাতের থাপ্পড় তোর ভীষণ ফেভারিট?”
আড়াল থেকে বের হয়ে আসলো শুভ্রতা। বিভিন্ন রঙ মিশ্রিত ওড়না। লাল হলুদ বল, ছোট ছোট গাছের পাতা, জর্জেট কিংবা কাতান হবে ওড়নাটা। সেই ওড়নায় হাত পেঁচিয়ে আস্তে করে বলল,
–” তুমি জানলে কিভাবে আমি আসছি?”
–” তোর বুঝতে হবে না। এখন বল কেন আসছিস?”
শুভ্রতা মুখটা মলিন করে বলল,
–” আমার দিকে তাকাও, একদম পা থেকে মাথা পর্যন্ত। দেখো তো কিছু বুঝতে পারো কিনা?”
রেগে গেলো স্পন্দন। সাত সকালে এইটা কি ধরনের অসভ্যতা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল স্পন্দন,
–” তোকে দেখার কি আছে? বিশ বছর ধরেই তো দেখেই আসছি। পিচ্চি কাল থেকে তো আমার কোলে থেকেই তো বড় হয়েছিস। এখন পিঠে পাখা গজিয়েছে? পরী হয়ে গেছিস? ডানাকাটা পরী নাকি হুরপরী নাকি অপ্সরী? বল? কি দেখবো তোকে?”
শুভ্রতা মুখ কালো করে প্লাজুটা একটু উপরে তুলে কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
–” এই নুপুর দেখতে বলছিলাম। তুমি যে কিনে দিয়েছিলে। তাইতো সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখাতে আসছি। ভাবছিলাম তুমি খুশি হবে।”
স্পন্দন শুভ্রতার পায়ের দিকে তাকালো ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলল,
–” হুম দেখেছি। ভালো মানিয়েছে। তো সকালে দেখানোর কি দরকার ছিল একটু পরেই তো দেখানো যেত। এইটা মূল্যবান কিছু নয় যে চলে যাবে। আরো কিছু বলার না থাকলে বের হ রুম থেকে আমি ঘুমাবো।”
শুভ্রতা মাথা নিচু করে ধীর কণ্ঠে বলল,
–” রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। এখনও বৃষ্টি। ভিজবে স্পন্দন ভাইয়া? আমার খুব ইচ্ছা করছে সকালের বৃষ্টিতে তোমাকে নিয়ে বৃষ্টি বিলাস করতে।”
–” পাগল হয়ে গেছিস তুই? এই সাত সকালে বৃষ্টিতে ভিজলে মানুষ পাগল বলবে তাছাড়া জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি, কাশি বিনা দাওয়াতে চলে আসবে। এইসব আজেবাজে ইচ্ছা বাদ দিয়ে ঘুমা নয়তো একা ভিজতে থাক। আমার এত শখ নাই।”
শুভ্রতা মন খারাপ নিয়ে স্পন্দনের রুম থেকে বের হয়ে পড়ল। তার বড্ড কান্না পাচ্ছে। একটু ভালো করে বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত। তার ইচ্ছার কি কোনো দাম নেই । সেদিন রাত তিনটায় তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে কোলে নিয়ে বৃষ্টিতে বৃষ্টি বিলাস করছিল স্পন্দন সেদিন তো সে স্পন্দনকে কিচ্ছু বলেনি। তাহলে আজ কেন স্পন্দন তার সাথে রাগারাগি করলো। শুভ্রতা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, আজকের পর থেকে সে স্পন্দনের কোনো কথাই শুনবে না। তার কোনো ইচ্ছা সেও রাখবে না। তাহলে বুঝবে স্পন্দন কষ্ট কাকে বলে।
একা একা ছাদে চলে গেলো শুভ্রতা। চোখ বন্ধ করে আকাশের পানে মুখ রাখলো। বৃষ্টির পানি তার মুখে এসে পড়ছে। ঠোঁটের কোণায় জমছে বৃষ্টির পানি আর তা গড়িয়ে নিচে পড়ছে।
* বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর পায়ে দিবো সোনার নুপুর।*
গানটা শুভ্রতার কানে আসতেই দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে রইলো। স্পন্দন দাঁড়িয়ে আছে। স্পন্দনকে দেখে রাগে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এক প্রকার রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে পা থেকে নুপুর জোড়া খুলে ছুঁড়ে মারলো স্পন্দনের উপর। স্পন্দন ভাবেনি শুভ্রতা এমন একটি কাজ করবে। তবে মনে মনে খুশি হয়েছে সে। কারণ রাগ উঠলে তা দমিয়ে না রেখে ঝেড়ে ফেলতে হয় তাহলে মন থাকে ফ্রেশ।
–” আমার প্রতি রাগ হয়েছে তোর?”
–” একদম কাছে আসবে না খুন করে ফেলবো। জল্লাদ, অসভ্য লোক একটা। সেদিন রাত করে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে বলেছিলে আমি কিছু বলছিলাম তোমাকে? নাহ কিছুই বলেনি। আর আজকে তুমি কি করলে? শালা মীরজাফর। আর একবার আছিস দেখিস তোর পা দুটো ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো।”
শুভ্রতার থেকে দু’ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে আছে স্পন্দন। মুখটা তার গম্ভীর। শুভ্রতা বুঝতে পারছে না এখন তার সাথে কি ঘটবে। স্পন্দন কি তাকে মারবে? মারতেও পারে যে অসভ্য ছেলে। কিন্তু স্পন্দন তা না করে শুভ্রতার দু’হাতে হাত রেখে বলল,
–” সরি। আসলে ঘুম থেকে উঠিয়েছিস তাই রাগ করে বাজে বকে ফেলছে। আচ্ছা খুব কষ্ট পেয়েছিস তুই? শোন, কষ্ট পেতে হবে না। তুই আমার কাছ থেকে কালো শাড়ি গিফট চেয়েছিস না? আজকেই তোকে কিনে দিবো খুশি এইবার?”
গাল ফুলিয়ে বলল শুভ্রতা,
–” নো।”
–” তাহলে কি করতে হবে?”
–” কান ধরে উঠবস করতে হবে।”
–” কিঃ?”
–” কানে ধরো নয়তো নো ক্ষমা হুহ।”
শুভ্রতার মন ভালো রাখার জন্য স্পন্দন কানে ধরে উঠবস করলো। শুভ্রতা খিলখিল করে বাচ্চাদের মত হাসতে লাগলো। স্পন্দন সেই হাসির দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে।
–” হইছে হইছে আর উঠবস করতে হবে না।”
–” উহু। তোর মুখের সেই জাদুকরী হাসি দেখার জন্য বারবার কানে ধরে উঠবস করতে পারি।”
শুভ্রতা ভীষণ লজ্জা পেলো। লজ্জায় মুখটা নীচু করতেই পায়ে স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো। পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো স্পন্দন তার পায়ে নূপুর পরিয়ে দিচ্ছে। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে বলল,
–” এইখানে পা রাখ।”
–” ছিঃ। তুমি আমার বড় তার উপরে ভাইয়া। পাপ হবে আমার।”
–” ভাইয়া বললে গলা চেপে ধরে খুন করে ফেলবো। তাছাড়া আমি বলছি পা রাখতে আমার হাঁটুর উপরে সো তোকে রাখতেই হবে।”
বাধ্য মেয়ের মত শুভ্রতা স্পন্দনের হাঁটুতে পা রাখলো। আদুরের সহিত শুভ্রতার পায়ে নূপুর পরিয়ে দিলো স্পন্দন। আকাশ থেকে ঝড়ছে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে দুজন ভালোবাসার মানুষ একত্রে আছে। একজন ভালোবাসার মানুষের দিকে অবাক চাহনি নিয়ে আরেকজন ভালোবাসার মানুষের পায়ে নূপুর পড়াতে। নুপুর পরিয়ে দিয়ে স্পন্দন উঠে দাঁড়ালো। শুভ্রতার হাত জোড়া তার দু’হাতে মুষ্টি বড্ড করে অদ্ভুদ চাহনিতে তাকিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
–” ভালোবাসবো যেভাবে শাসনও করবো সেভাবে। মারতে ইচ্ছা করলে মারবো আদর করতে ইচ্ছে করলে করবো। তুই যেমন আমাকে নিয়ে ভাবিস আমিও ভাবি। তোর চঞ্চল মুহূর্তও আমাকে ভীষনভাবে টানে, তোর শান্ত মুহূর্তও আমাকে অস্থির করে তোলে, তোর রাগী ভাবটা আমাকে ভয় পাওয়াতে সক্ষম করে, তোর কান্না মাখা মুখটি আমার মনকে অশান্ত করে তোলে, তোর আবদার আমাকে এক ধরনের শক্তি জাগাতে সাহায্য করে, তোর আবদার রক্ষা করার জন্য বিচলিত হতে ভীষণ ভালো লাগে। তোর খোলা চুলের নেশায় বারবার আবদ্ধ হতে ইচ্ছা করে। এক কথায় তোর মাঝেও আবদ্ধ থাকতে চাই আমি। তোর সীমান্ত ছাড়া অন্য কোথাও যেতে চাই না। তোর মাঝেই আমার অস্তিত্ব ।”
শুভ্রতা হতবাক হয়ে গেলো। মৃদু হেসে বলল,
–” আমার মাঝেই তোমাকে থাকতে হবে। যদি কোনোদিন অন্য কোনো সীমান্তের কথা ভাবো তাহলে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। জানো না শুভ্রতার যেমন স্পন্দনকে চাই ঠিক তেমন ভাবেই স্পন্দনের শুভ্রতা হয়ে আমি থাকতে চাই।
সমাপ্ত,
#স্পন্দনের_শুভ্রতা_৩
#অনুগল্প
#ফারজানা_আফরোজ
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেইক করা হয়নি।
আফরোজ ফারজানা