সোহাগী পর্ব ৩

0
614

#সোহাগী
#পর্ব:৩
Lutful mehijabin (লেখা)

— ওয়াট ননসেন্স! দিন দিন বেয়াদব হচ্ছো? শিক্ষকদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা ভুলে গিয়েছো?

জুবায়ের কথার প্রেক্ষিতে হাউমাউ করে কেঁদে দিল প্রিয়া। কান্নারত অবস্থা বলতে লাগলো,

— মাস্টার মশাই ওরা আমাকে জেন্ত মে’রে ফেলবে। আমাকে বাঁচান। আপনি তো জানেন না ওরা,,,

বাক্যটা আর শেষ করতে পারলো না প্রিয়া। কারো পায়ের বুট জুতোর খট খট আওয়াজ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়লো। আকস্মিক জুবায়েরের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলে অদ্ভুত কান্ড করে বসলো। হাতের উল্টো পিঠ দ্বারা চোখের জল মুছে চেয়ার ছেড়ে নিচু হয়ে বসে এক পলকের মধ্যে জুবায়েরের পা ছুঁয়ে সালাম করে নিলো। পুনরায় চেয়ারে বসে সজল চোখে মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

— কখনো কোনদিন বেয়াদবি করে থাকলে মাফ করে দিবেন। আজই আমাদের শেষ দেখা। আর কোনদিনই আমাদের দেখা হবে কি সন্দেহ! আমার জন্য আপনার প্রার্থনার দোয়ার চিরকাল উন্মুক্ত রাখবেন এই কামনায় রইলাম।

প্রিয়ার কথাগুলো শুনে জুবায়েরের বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠলো নিমিষেই।‌ অজানা আশঙ্কায় হৃদয় স্পন্দন ছটফট করতে শুধু করলো। জুবায়ের শুকনো ঢোক চেপে প্রিয়ার মুখশ্রীতে দৃষ্টিপাত ফেললো। না, এখন আর ভয় নেই। জুতোর খট খট আওয়াজ হাওয়া মিলে গিয়েছে। অর্থাৎ কেউ এদিকে আসছে না। হয়তো চলে গিয়েছে। তৎক্ষণাৎ প্রিয়ার বা চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু টপ করে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। জুবায়ের লক্ষ্য করলো মেয়েটার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠেছে। অদ্ভুত! ভয় পেয়ে গেল জুবায়ের। নিজকে নিয়ন্ত্রণ রেখে কাঁপা গলায় বললো,

— আমার পা ছুঁলে কেনো? পাগল হয়ে গেছে তুমি? আর আজ শেষ দেখা মানে?

জুবায়েরের কথার প্রেক্ষিতে ফির রহস্যময় মুচকি হাসি উপহার দিলো প্রিয়া। প্রশ্নের উত্তরে, ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে বললো,

— জানেন মাস্টারমশাই সবাই আমাকে রূপবতী বলে। এই সৌন্দর্যের যে আমার কাল তা আজ বুঝি! কিন্তু আফসোস একটাই আমার সৌন্দর্য আপনাকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ! আমি কেনো আপনার যোগ্য হলাম না? আল্লাহ কী আমাকে আর একটু সৌন্দর্য দিতে পারতো না যাতে আপনি মুগ্ধ হতেন!

কথাগুলো শেষ করে কিছুক্ষণ নিরব রইলো প্রিয়া। মাস্টার মশাইয়ের চোখে স্থির দৃষ্টিপাত ফেলতে তার ভীষণ ভয় হচ্ছে! চোখ জোড়া বন্ধ করে,জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে ফির বলে উঠলো,

— আমাকে বিয়ে করা যায় না যায় না মাস্টার মশাই? কথা দিচ্ছি কোনোদিন আপনার কথার অবাধ্য হবো না। আপনাকে ভুলে ও কষ্ট পেতে দিব না। শুধু দিন শেষ আপনার মুখশ্রীতে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাত্রির আঁধার পাড়ি দিবো। আমি যে একটু প্রশান্তিতে বাঁচতে চাই আপনার সঙ্গে। এই বদ্ধ জীবন আমার আর ভালো লাগে না। আমি ম’রে যাবো। আমাকে কী বাঁচাতে পারবেন না মাস্টার মশাই।

প্রিয়ার বলা প্রতিটি বাক্য জুবায়েরের বুকের ভেতর ঝড় তুলতে সক্ষম হলো। কি বলছে এই মেয়েটা? নিশ্চিত পাগল হয়ে গিয়েছে! জুবায়ের আত্মগ্লানিতে ফেটে পড়লো। মনে মনে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ হিসেবে ঘোষণা করলো! তার মতো কালো, পা হীনা মানুষের জন্য কোনো মেয়ের চোখ থেকে জল পড়েছে। মেয়েটা তাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনছে! তাও যাকে সে ভয়ঙ্কর ভাবে ভালোবাসে! গ্রামের প্রত্যক অবিবাহিত যুবক যেই রূপসী কে ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখে। যাকে একপলক দেখে প্রতিটি নর-নারী মুগ্ধ হতে বাধ্য! সেই প্রিয়া আজ তাকে আকৃষ্ট করতে নিজের অপরুপ সৌন্দর্য কে নগন্য করলো? জুবায়েরের নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আর এখানে থাকতে পারবে না সে। দ্রুত তাকে বিদায় নিতে হবে। নয়তোবা এই কিশোরী মেয়ের পাগলামী তাকে যুবক থেকে কিশোরে পরিনত করে তুলবে। জুবায়ের লাঠি ভর করে উঠে দাঁড়ালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

— পাগলামী বন্ধ করো প্রিয়া। তুমি এখনো অনেক ছোট। নিজের ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়নি তোমার। এই বয়সে সবাই আবেগ প্রবণ থাকে। বুঝেছ প্রিয়া কৈশোর কাল মানুষের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাল‌। কিশোর কিশোরীরা এই বয়সে নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। হঠাৎ বসন্তের আগমনে উন্মাদ হয়ে পরে। কিশোরীরা পুরুষের প্রতি অকারণে আকৃষ্ট হয়। কিশোররা ও ব্যাতিক্রম নয়! যাকে দেখে তার প্রতিই মুগ্ধ হয়। কিন্তু এই মুগ্ধতা সাধারণ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। সেই মুগ্ধতার খাতিরে যারা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসে। তারা অবশ্যই সময়ের তালে তালে একসময় আফসোস করবেই। ঠিক তুমিই একদিন আফসোস করবে, কেন আমার মতো ব্যক্তির জন্য নিজের মূল্যবান চোখের জল ফেললে? বড় হতে হবে তোমাকে। আমার স্বপ্ন তুমি একজন বড় ডক্টর হও। যাকে নিয়ে আমি বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে পারি। সবাইকে যেন বলতে পারি, হ্যাঁ আমার প্রিয় ছাত্রী একজন ডক্টর।

কথাগুলো শেষ করে হাঁপাতে লাগলো জুবায়ের। ইতোমধ্যে তার শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছে! আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারবে না সে। জুবায়ের তৎক্ষণাৎ প্রিয়ার চোখ মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ব্যর্থ হলো সে! মেয়েটা নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে নিজেকে ধাতস্থ রাখার শক্তি পাচ্ছে না। জুবায়ের লাঠি ভর করে এক পা বাড়ালো ঘর থেকে প্রস্থান করার উদ্দেশ্যে। পরক্ষণে পিছু ঘুরে প্রিয়ার খানিক নিকটে এগিয়ে এলো।

— আজ আর পড়াতে পারব না। ছোট মানুষ ভুল করেছ তাই সংশোধন করার সুযোগ দিলাম তোমায়। কান্না কাটি বাদ দিয়ে কোমর বেঁধে পড়ালেখা শুরু করো। আজ রিমা আসে নি সেই সুযোগে নিলে তো! কিন্তু রিমা কেন পড়তে এলো না? আর তুমি ই বা কেন নতুন বউ সেজে রয়েছ?

লহমায় প্রিয়া জুবায়েরে চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। পূর্বের ন্যায় রহস্যময় মুচকি দিয়ে উঠলো। ঠোঁটের কোণে ভয়াবহ হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো,

— বেঁচে থাকলে তো পড়তো আসবে!

কেঁপে উঠলো জুবায়ের। কি বলছে মেয়েটা মাথা ঠিক আছে তো! উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

— কি বলছো! মাথা ঠিক আছে ?

— হুম। যা সত্যি তাই বলছি মাস্টারমশাই।

স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে জুবায়ের।‌ মিনিট খানিক চোখ জোড়া বন্ধ করে নিরবতা পালন করলো সে। চোখ খুলতেই লক্ষ্য করলো প্রিয়া হাতে সাদা খাম। তার বুঝতে রইলো না যে খামের ভেতর চিঠিপত্র রয়েছে। জুবায়ের শুকনো ঢোক গিললো। মুহুর্তেই তার কর্ণকুহরে ভেসে উঠলো প্রিয়ার অদ্ভুত কন্ঠস্বর,

— মাস্টার মশাই এটা একটু পড়ে দেখবেন। আমি কিছু বলতে চাইছি না। কাল আমাদের দেখা হবে কিনা তাও অজানা! তবুও শেষ নিঃশ্বাস বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। শেষ বারের মতো আবারো বলছি আমাকে বিয়ে করবেন?

জুবায়ের এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হলো। এক হাতে লাঠি ভর করে অন্য হাত দিয়ে সজোরে থা’প্পড় মেরে বসলো প্রিয়ার শুভ্র, স্বচ্ছ গালে! মেয়েটার এমন ব্যবহার মোটেও প্রত্যাশা করা যাচ্ছে না। যে প্রিয়া কখনোই তার সঙ্গে প্রয়োজন ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করে না। সেই ভদ্র মেয়ের মুখে নিশ্চিত এসব কথা বেমানান! তৎক্ষণাৎ জুবায়ের লাঠি ভর করে দ্রুত চিলেকোঠার ঘর থেকে প্রস্থান করলো। না, এই মেয়ের মুখের দিকে তাকানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিশ্চই মেয়েটার চোখে অশ্রু এসে জমেছে। এখন তাকালে নির্ঘাত তার বুকের ভেতর অদৃশ্য রক্ত ঝরতে শুরু করবে!

জুবায়ের ঘর থেকে বের হতেই চোখের জল মুছে ফেললো প্রিয়া।‌ নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বইয়ের পাতায় মুখ গুজে সেই ভয়াবহ রহস্যময় হাসি দিয়ে উঠলো মুহুর্তেই!
____________________

রাশেদ বাড়ি ফিরেছেন মিনিট পাঁচেক পূর্বে। এসেই ভ্যান বারান্দায় খাড়া বাঁশের সঙ্গে বেঁধে রেখে, কলপাড়ে এলেন। দ্রুত হাত মুখ ধোয়া শেষ করে বার কয়েক আমেনা বেগম কে ডাকলেন।

— আম্মা,,

রাশেদের কন্ঠস্বর পেয়ে দ্রুত সোহানার ঘরের দোর খুলে বেরিয়ে এলেন আমেনা। রাশেদ কে দৃশ্যমান হতেই অদূরে থেকে উচ্চ কন্ঠে বলে উঠেন,

— জী আব্বা। তুমি আইছো। খাড়াও আমি গামছা নিয়া আয়তেছি।

রাশেদ গিয়ে কাঠের চৌকির উপর বসলেন। আমেনা দ্রুত গামছা এনে রাশেদের হাতে দিয়ে দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে ছুটলেন। রাশেদ মুখ মুছে গামছাটা কাঁধের সঙ্গে ঝুলিয়ে নেন।‌

আমেনা থালা ভর্তি খাবার সাজিয়ে এনে চৌকির উপর রাখেন। বারান্দায় হ্যারিকেন জ্বলছে। তার খানিকটা আলো গিয়ে কলপাড়ে পড়েছে। আমেনা পানির আনার উদ্দেশ্যে টিনের গ্লাস হাতে করে কলপাড়ে ছুটলেন। মুহুর্তেই রাশেদের কন্ঠস্বর পেয়ে থেমে গেলেন।

— আম্মা।

— খাড়াও আমি কল থাইকা ঠান্ডা পানি নিয়া আহি। ভাত খাওয়ার আগে একটু ঠান্ডা পানি মুখে দিলে তোমার পরান জুরাই যাইবো।

— আম্মা সোহাগী রাতে খেয়েছে?

আমেনা ফাঁকা গ্লাস থালার পাশে রাখলেন।‌ অতঃপর নিম্ন স্বরে বললেন,

— না খাই না। আমাগো খাওয়া শ্যাষ।

আমের কথা শুনে রাশেদ চৌকি থেকে উঠে পড়েন। কিছু একটা ভেবে, আমেনা কে বলেন পানি নিয়ে সোহাগীর ঘরে আসতে। অতঃপর ক্লান্তি মাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহাগীর ঘরে ঢুকে পড়েন তিনি।

সোহাগী চৌকির উপর বসে পড়ছিলো। হঠাৎ দরজা চাপানোর আওয়াজ কানে যেতেই বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুললো। বাবাকে দেখে নিমিষেই তার বুকের ভেতর প্রশান্তি হাওয়া বইলো।

রাশেদ খাবারের থালা হাতে করে বিছানার উপর বসলেন।

— রাতে খাও নি কেন আম্মাজান?

রাশেদের আদুরে মাখা বাক্য শুনে ক্রন্দন নিবারণের প্রয়াস চালালো সোহাগী। অধর জোড়া একবার কামড়ে ধরলো। অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে বলে উঠলো,

— আচ্ছা আব্বা আমাকে বিয়ে দিলে কী তোমার কষ্ট কমে যাবে? আমার খরচ চালাতে তুমি তো অনেক কষ্ট করো। আমি তো শুধু খাই আর কিছু করি না। আব্বা বলো না কি করলে তোমার কষ্ট আমি দূর করতে পারবো?

রাশেদ মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠেন। পরক্ষণে নিজেকে সংযত রেখে ভাতের সঙ্গে আলুর ঝোল মাখতে লাগলেন। এক লোকমা ভাত সোহাগীর মুখের সামনে ধরে বলে উঠেন,

— দূর পাগলী, কি যে বলিস! আমার কষ্ট যদি কমাতে চাস তাহলে মন দিয়ে পড়ালেখা কর। সর্বদা সত্যের পথে অটল থেকে মানুষের মতো মানুষ হ। সবসময়ই মনে রাখবি মা শিক্ষার মতো ধারালো অস্ত্র এ পৃথিবীতে আর দু’টো নেই। একমাত্র শিক্ষাই তোর জীবনের অন্ধকার দূরে ঠেলে আলোর প্রবেশ করাতে সক্ষম। পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারলে একসময় তুই সাবলম্বী হয়ে উঠবি। তোর পথে বাঁধা দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না। তখন তোর নিজের অস্তিত্ব তৈরি হবে। অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না তোকে। জানিস মা এই পৃথিবীতে একটা ভাতের দানা পেটে দিতে কতো পরিশ্রম করতে হয়! ধরনীর বুকে এমন কোন মানুষের জন্ম হয় নি যে তোর মুখে বিনা স্বার্থে অন্ন তুলে দিবে। কেউ নেই যে কিনা তোকে শান্তি তে বাঁচার পথ তৈরি করে দিবে। কিন্তু একমাত্র শিক্ষাই তোকে মুক্তি দিবে, শান্তিতে বাঁচতে দিবে। প্রতিটি মানুষের জীবনে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।

(চলবে)

[রিচেক দেই নি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here