সোহাগী পর্ব ১১

0
443

#সোহাগী
#পর্ব :১১
Lutful Mehijabin (লেখা)

রফিক জুবায়েরের কথার প্রত্যুত্তরে কান্নারত কন্ঠে বললো,

— না মাস্টার মশাই সোহা রাজি না। আইজ সকালে ওগো বাড়িতে গেছিলাম। ওর মাই আমাগো খেদায় দিছে। ও আমাগো দেইখা কাইন্দা দিয়া ঘরে ঢুইকা গেছে।
তৎক্ষণাৎ জুবায়ের উত্তেজিত হয়ে বললো,

–কার সাথে বিয়ে? কোন বাড়িতে?

জুবায়েরের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে রফিক মলিন গলায় বললো,

— ভুঁইয়া বাড়ির ওইযে কয়েক দিন আগে যে বেডার বউ মইরা গেলো ওই বেডার সাথে। আপনি বিয়েটা আটকান মাস্টারমশাই।

কথাটা শুনে মুহূর্তেই চুপসে গেলো জুবায়ের। খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়লো সে। বর্তমানে তার নিকট সবকিছু পরিষ্কার! তারমানে প্রিয়ার ফুপাতো ভাই আমিরুলের সাথে সোহাগীর বিয়ে হতে চলছে। যে লোকটা কীনা বিবাহিত এবং এক সন্তানের বাবা। শেষে মেয়েটা কে বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছে ওর পরিবার! জুবায়ের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করলো। মানুষ কতোটা নিম্ন মন মানসিকতার হলে এতো স্বল্প বয়সী মেয়ে কে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তায় আনে তাও আবার দ্বিগুণ বয়সী পুরুষের সাথে? পরপর দুটো শুকনো ঢোক চেপে জুবায়ের ম্লান হয়ে বলে উঠলো,

— এখন তোরা যা। দেখি আমি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।

রফিক জুবায়েরের কথা শুনে মাথা নিচু করে কয়েক কদম পিছনে গেলো। যাওয়ার পূর্বে জুবায়েরের কে সালাম দিয়ে বিষন্ন হৃদয় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

ছেলে দুটো চলে যেতেই জুবায়ের হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসলো। চেয়ারের পিছনটাতে মাথা ঠেকিয়ে, চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। দুশ্চিন্তায় তার মাথা ভারী হয়ে এসেছে। সে এখন কী করবে? সোহাগীর বিয়ে কীভাবে ভেঙে ফেলবে। তার ভীষণ অস্থির করছে। ভুঁইয়া বাড়ির লোকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া মানে বোকামি বৈকি অন্য কিছু না!

নিজের মাথা চেপে ধরলো জুবায়ের। চোখ বন্ধ অবস্থায় বিরবির করে বলে উঠলো,

— আমাকে ক্ষমা করে দিস সোহাগী। আমি যে নিরুপায়। নিজ স্বার্থে আমি পিছপা হলাম। তোর বিয়ে ভাঙার সামর্থ্য থেকেও যে নেই রে। কিন্তু আর যাই হোক বিয়ে পর যেন তোকে পড়তে দেয় সে ব্যবস্থা করে দিবো। ক্ষমা করিস তোর মাস্টারমশাই কে।

কথাগুলো বলে বুকের বা পাশে হাত রাখলো জুবায়ের। ইদানিং প্রিয়ার সান্নিধ্যে পাবার আশায় তার বুকটা প্রতিনিয়ত ছটফট করে। শেষের পরিনতি ভেবে চিন চিন ব্যথা হয় তার বুকের মাঝে। সে কী প্রিয়াকে পবিত্র বন্ধনে আঁকড়ে নিতে পারবে না! আজিজ ভুঁইয়া রাজি হবে তো। নাকি নাকজ করে দিয়ে তাকে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দেবেন। খুব ভয় হয় জুবায়েরের। তাই তো সে আজ প্রমাণ করে দিলো মানুষ স্বার্থপরথ। নিজ স্বার্থে নিজের বিবেক বিসর্জন দেওয়া মোটেও অসম্ভব নয় তাদের পক্ষে। পৃথিবীর বুকে এমন কোন মানুষ নেই যে কী না স্বার্থপর! একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগে। স্বার্থের কাছে হেরে যায় দৃঢ় বন্ধুত্ব,স্নেহ, মায়া মহব্বত, আবেগ, ভালোবাসা ! এ যেন এক চিরন্তন সত্য বানী।

____________

ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই এক। চিন্তা গ্রস্থ মুখশ্রীতে আসমা পায়চারি করছেন আজিজ ভুঁইয়ার কক্ষে। বোন এবং ভাগ্নের চিন্তায় বেশ বিরক্ত আজিম। তার যুক্তি অনুযায়ী মা ছেলে মিলে অযথাই চিন্তা করছে। আসমা বারংবার একই বানী বলে যাচ্ছেন।

— ভাইজান কী হবে এখন? আমার ভীষণ ভয় করছে।

মুহূর্তেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আজিজ। গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,

— আহ্! আসমা। চিন্তা করছিস কেন? দেখ তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই হবে না ।

পায়চারি থামিয়ে দিলেন আসমা। তৎক্ষণাৎ আজিজের পায়ের কাছে এসে বসে পড়েন। আজিজের পায়ে স্পর্শ করে বলেন,

— ভাইজান আজ বিয়েটা হোক। আমরা গিয়ে ওই মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসি। আমিরুল গন্জে গেছে। যাওয়ার আগে বলছে কোন চিন্তার বিষয় নাই। ও একাই শহরের হিসাব-নিকাশ করে নিবো। বলছে আসার পরপরই সোহাগীদের বাড়িতে যাইবো। তার আগে যেন আমরা রাশেদ মিয়ার বাড়ি উপস্থিত থাকি। ওই মেয়ে রে ওর মনে ধরছে। ছেলেরে কথা দিছি। আপনে সাফিদে আর ছোট ভাই কে বুঝিয়ে বলেন।

আসমার কথাগুলো শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আজিজ। হঠাৎ বিরক্ত কন্ঠে বলেন,

— এমন কাজ করার আগে তোর ছেলের সাবধান হওয়া উচিত ছিলো। সবসময়ই টাকা বা ক্ষমতা আশ্রয়ে বাঁচা যায় না। তোর ছেলে আর তুই দুইজনই গাধা। দুর্ঘটনা ঘটানোর আগে আমিরুলের ভাবা উচিত ছিলো। যে কাজের জন্য বারবার টাকা খসে মান সম্মান হারানোর ভয় হয় সে কাজ ঘটানোর একদমই অনুচিত। নাতির কথা ভেবে হলেও এ পথ অবলম্বন করতে নাও পারতি তোরা!

আজিজের কথার প্রেক্ষিতে মাথা নিচু করে ফেললেন আসমা। মলিন কন্ঠে বলেন,

— আমি বুঝতে পারি নি ভাইজান। আমিরুল যে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে তা কখনোই ধারণা করতে পারি নি। ক্রোধের বশে উন্মাদ হয়ে গেছিলাম আমি। এই সামান্য কারনে আজ আমার উপর থেকে তোমার ছায়া সরিয়ে নিও না ভাইজান। সাফিদ কে রাজি করাও।

আসমার উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালেন আজিজ। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,

— সামান্য ঘটনা বলছিস তুই? পাগল নাকি! তোদের জন্য আমাকে কতো শত ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছে জানিস? আর পয়সার কথা বাদই দিলাম। তোর ছেলের যে ভবিষ্যতে ও এমন ভয়ানক ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটাবে না এর কোন সন্দেহ নেই! এখনি কেন বিয়ে করতে হবে ওকে?

— ভাইজান আমি কথা দিতেছি ও আর এমন কোন কাজ করবে না যাতে তোমার অসুবিধা হয়। কথা দিলাম। এখন তৈরি হও রাশেদ ফকিরের বাড়ি যাবো। ওই মেয়ে কে আনলে আমাদের যা লাভ হবে না ভাইজান!

বেশ আকুতির সাথে কথাগুলো বললেন আসমা। আজিজ খানিকটা সময় চুপ থাকলেন। একমাত্র ছোট বোন কে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। আসমার কথার অমান্য করার মতো সাহস এ পর্যন্ত তার হয়ে তার। স্বল্প বিরক্ত নিয়ে আসমার কথায় সম্মতি জানালেন আজিজ।

— ঠিক আছে যাহ। তবে আমি যাব না। সাফিদ কে বলছি ও যাবে আমি যেতে পারছি না। তোর ভাবি আর কয়েক জন কে নিয়ে যা। তবে প্রিয়াকে নিবি না কিন্তু। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে টা সেরে ফেলবি। আমি লোক পাঠাচ্ছি ওদের বাড়িতে যেন বিয়ের আয়োজন শুরু করে আধ ঘণ্টার মধ্যে।

আজিজের কথা শুনে আসমার ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মুহূর্তেই সে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

____________

রাশেদের বাড়ির আনাচে কানাচে জুড়ে লোকজন গমগম করছে। স্বল্প কিছু মানুষ কে নিমন্ত্রণ করেছেন সোহানা। হঠাৎ ভুঁইয়া বাড়িতে থেকে বিয়ের সংবাদ পেয়ে চমকে উঠেছিলেন। প্রথমে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হলেও পরক্ষণেই আনন্দিত হয়েছেন তিনি। যাক বাবা বাঁচা গেলো! যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সোহাগী কে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। বলা তো যাই না কখন কি ঘটে যায়। রাশেদ যদি সপ্তাহ খানিক না থেকে কাল বা আজ বিয়ের পূর্বে চলে আসে, তাহলে কী হবে! নিশ্চয়ই বিয়েটা ভেঙে যাবে।

ইতোমধ্যে সোহাগীর প্রতিবেশী কয়েক জন মহিলা বিয়ের খরব পেয়ে ছুটে চলে এসেছে! তবে সোহাগী মাচার ঘরে রয়েছে বিধায় কারো সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। সোহাগী ভুঁইয়া বাড়ির বউ হবে ভেবে কেউ ইর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আবার কেউ গর্বিত হচ্ছে।
______
হঠাৎ বাড়িতে ভেতর মানুষের কোলাহল শুনে সোহাগীর বিষাদগ্রস্ত হৃদয় কুঁ ডাকতে আরম্ভ করেছে! আমের কিংবা সোহানা তার খোঁজ নেয় নি। রাতারাতি অনুভূতিহীন কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছে মেয়েটা। কাল রাতে ভীষণ কেঁদে ছিলো সে। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। কিন্তু কেউ তার যন্ত্রণা বুঝেনি। শক্ত, শীতল মাটির উপর সারারাত গড়াগড়ি খেয়েছে কিন্তু তাকে কেউ শান্তনা পর্যন্ত দিতে আসেনি। রাতারাতি হঠাৎ আমেনা চুপসে গিয়েছেন। সোহানার কথা মতো কাজ করছেন। সোহাগীর নানীর পরিবর্তনে ভীষণ খুন্ন! যার দরুন তার বেদনা হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সকালে আলো ফুটতেই সোহাগীর কান্না শুকিয়ে এসেছিলো। রাতভর জেগে সারা রাত্রি নির্ঘুম পাড় করে দিয়েছে মেয়েটা। সে যেন চোখের পলকে এক প্রাপ্তবয়স্ক নারীতে রুপান্তরিত হয়ে উঠছে! সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। রাশেদের অপেক্ষা তার প্রতীক্ষার প্রহর যেন এক যুগে পরিণত হয়েছে। আব্বা আসছে না কেন? সকাল বেলা উঠেই মাচার ঘরে চলে এসেছিলো সোহাগী। বাবার অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে রাশেদের রিকশার উপর গুটিয়ে শুয়ে ছিলো। ঠিকই তখনই সোহানার চিৎকার চ্যাচামেচির শব্দ! রফিক এবং তামিমের কন্ঠস্বর পেয়ে ঘরের দরজায় ছুটে এসেছিলো সোহাগী। তাদের দেখে আনন্দিত হৃদয়ে ছুটে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু কোন এক আজনা কারণে যেতে পারে নি! লুকিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো খানিকক্ষণ। ইশ, তারা কি আর এক সাথে ঘুরতে পারবে না! বিয়ের পর এক পুরু দেয়াল তৈরি হবে তাদের ভেতর। চাইলেও কথা বলতে পারবে না। হঠাৎ রফিক দৃষ্টি গোচড় হয় মাচার ঘরে দরজায়। রফিকের দৃশ্যমান হয়, সোহাগী শাড়ির আঁচল মুখ চেপে অঝরে কেঁদে চলছে। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর চোখের জল দেখে রফিকের বুক কেঁপে ওঠে! দুজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই কান্নারত অবস্থায় ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে সোহাগী।

(চলবে)

[হঠাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। রেগুলার ক্লাস করতে হচ্ছে প্রতিদিনই। তাই চেষ্টা করেও রেগুলার হতে পারছি না। রিচের দেইনি, দুঃখিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here