#সেই_তমসায়_৯
নুসরাত জাহান লিজা
ময়ূখ নিজের ঘরে এসেও সেই ছবিটা বেশ কয়েকবার দেখল। মহিলা শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা টানা, মুখে কিঞ্চিৎ লাজুক হাসি। নতুন বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেমন ভাবভঙ্গি থাকে, এটাও ঠিক তেমন।
ময়ূখ বিষয়টা আগেই বুঝতে পেরেছে, তবুও ছবিটা বারবার দেখার একটা কারণ আছে। ভদ্রমহিলাকে কোথাও দেখেছে বলে মনে হচ্ছে, কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না। মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে একটা উপকার হলো, মাথা ব্যথাটা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। তবে এই উপকার ওর সহ্য হলো না।
অদৃশ্য আ /ক্র/ /ম/ ণ/ কা/ রী/র উদ্দেশ্যে কিছু অশ্রাব্য গালি ছুঁড়ে দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। ওই ব্যাটাকে সামনে পেলে এরকম কয়টা লোকটার নিজের মাথায় বসিয়ে দেবে। তারপর বাকি কথা!
২১.
ঘুম থেকে উঠার পরে আর মাথা ব্যথা তেমন ছিল না, গোসল করে নিতেই বেশ ঝরঝরে লাগল। নাস্তা করে ওষুধ খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। ছবির ব্যাপারে আগেই কাউকে কিছু বলবে না, এতে নিজের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। যা ওর ঘোরতর অপছন্দ।
আজ বেরিয়ে প্রতি মুহূর্তে স/ত//র্ক থেকেছে। এলোমেলে হেঁটেছে, এরপর একটা পায়ে চালিত ভ্যানে উঠে পড়ে চালককে তাড়া দিয়েছে দ্রুত চালানোর জন্য। আশেপাশে আর কোনো বাহন চোখে পড়েনি। তাই অনুসরণকারী থেকে দূরত্ব রক্ষা করা গেছে। এটুকু সে নিশ্চিত হয়েছে সে যেহেতু এতদিন হেঁটে চলাফেরা করেছে তাই ওই লোকের কাছে বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
সূর্য আজ বেশ ভালো মতো হেসেছে। এমন শীতের সকালে এই মিঠে রোদের ছোঁয়া ময়ূখের মনে এসেও লেগেছে। আজ দিনটা ফুরফুরে। আজকের সুন্দর সকালটা ময়ূখের জন্য কতটা সুন্দর হয় সেই প্রত্যাশায় আছে খুব করে।
বাজারে হেঁটে পোঁছাতে লাগে পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিট। সে তেরো মিনিটে এসে পোঁছালো। এরপর এখানকার একটা খাবার হোটেলে ঢুকল। তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। এগারোটা পেরিয়েছে। একটা টেবিলে দু’জন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের পাশে গিয়ে বসল। কয়েক টেবিল সামনে আরও দুই তিনজন স্থানীয় লোক বসেছে।
“মন দিয়ে শোনো হাতে সময় বেশি নেই। যা বলার দ্রুত বলো। তার আগে এটা নাও।”
বলেই ছবি রাখা ফাইলটা এগিয়ে দিল।
“স্যার, আপনি ভালো আছেন?”
“আর ভালো। একটুর জন্য বেঁচেছি। কাল যেকোনো কিছুই হতে পারত। মৌচাকে কেবল একটু হাত ছুঁইয়েছি, তাতেই হুল ফুটারে মরিয়া হয়েছে। শীঘ্রই ঢিল ছুঁড়ব। তখন কী হবে কে জানে? তবে তার আগে আমার ইনফরমেশনগুলোর কী হলো, কতদূর এগুলে?”
“স্যার, যা পেয়েছি তাতে বেশ ভালোই এগিয়েছে বলা যায়।”
“বলো, ফাস্ট।”
“স্যার, সাজিদের ব্যাপারে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আপনি যা বলেছেন তেমনই। তবে মুনিমের ব্যাপারটা যথেষ্ট /গো///ল//মে//লে।
“স্যার শিরিনেরটাও।” দু’জনই পর্যায়ক্রমে মুখ খুলল।
“রেদোয়ান, তুমি আগে বলো। আর একটা কথা, আমাকে এখনো স্যার বলা বাদ দেয়া উচিত। সময় নষ্ট না করে পয়েন্টে আসো।”
“ভাই, আমি প্রথমে শিরিনের হাসপাতালে খোঁজ করলাম। প্রথমে চিনতে পারল না, পরে অন্য একজন কর্মী বলল তার পরিচিত ছিল সে। তার কাছ থেকে শুনলাম সে আরও দুই বছর আগে কাজ ছেড়ে দিয়েছে শিরিন।” ময়ূখের তাড়া খেয়ে সম্বোধন পরিবর্তন করল রেদোয়ান।
“কিন্তু সাজিদ আর সাঈদ তো বলল পুরনো কর্মস্থলেই গেছে।”
“না ভাই। এখন কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দিতে পারল না। পরে ওর সম্পর্কে সব জানতে চাইলাম। ওদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে, অথোরিটির সাথে কথা বললাম। প্রথমে তো ওদের প্রাইভেসির জন্য কিছু বলতে চাইল না। পরে বললাম পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হতে পারে৷ এরপর তারা সেখানে কর্মরত কর্মীদের ফাইল ঘেঁটে শিরিনের সিভি বের করল। সেটার একটা ফটোকপি নিয়ে এসেছি।”
একটা কাগজ ময়ূখের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রেদোয়ান বলল, “বাবার নামটা দেখে খ/ট/কা লেগেছিল। তাই নিয়ে এলাম।”
কাগজের দিকে তাকিয়ে সেটা পড়ে এবার নির্বাক বিস্ময়ে হতবিহ্বল হবার পালা ময়ূখের। শিরিনের বাবার নামের জায়গায় স্পষ্ট জ্বলজ্বল করছে যে নাম তা হলো,
‘এহতেশাম আহমেদ।’
“স্যার, কাহিনী আরও আছে। বলব?”
“বলার জন্যই তো এসেছো নাকি?” সম্বিৎ ফিরতে কড়া গলায় বলল ময়ূখ। ওর ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে মঈদুল বলল,
“ভাই, টাস্কি খাবেন এক্কেবারে। আমি আর রেদোয়ান তো ভাই আ/ /হা/ /ম্ম/ /ক হয়ে গেসিলাম।”
“মঈদুল, সময় নেই, তুমি বলতে না পারলে…” মঈদুলের স্বভাব সম্পর্কে ময়ূখ অবগত। একবার বলতে শুরু করলে রসিয়ে রসিয়ে বলতে থাকে। তাই এভাবে ঝাঁঝের সাথে বলল, তবুও থামানো গেল কিনা কে জানে!
“বলছি বলছি। আমি গেলাম মুনিমের ঠিকানা দেয়া এলাকায়। গিয়ে শুনলাম মুনিম নাকি ওর মা আর বোনের সাথে থাকত। তবে ওরা ওই এলাকার লোকাল না। বগুড়া থেকে আসছিল। মুনিম নাকি তখন ইস্কুলে পড়ে, আর ওর বোন ছোট। তবে এই জায়গাও নাকি বিক্রি করছে কিছু, বাকিটুকু বিক্রির বন্দোবস্ত করতাসে। দেশের বাইরে চলে যাব বোনরে নিয়ে।”
“দেশের বাইরে? মুনিম তো অন্য একটা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দিয়েছে, সেখানে নাকি কাজ পেয়েছে?
“ওইখানেও গেসিলাম স্যার। সেখানে জয়েন করছে কয়দিন হয়। তবে এত অনিয়মিত যে ওরা না/খো/শ। একটু কৌশল করে বললাম, সে আমার পুরোনো আত্মীয়। আমার কাছে টাকা ধার নিসে। এখন আমার বউয়ের অসুখ খুব। এখন তখন অবস্থা। টাকাটা খুব দরকার। যদি ওর নতুন বাসার ঠিকানাটা দিতেন।”
ময়ূখ নিজেই এবার হেসে ফেলল শব্দ করে। “বিয়ে না করেই বউকে তো প্রায় /মে/ /রে/ / ফেললে?”
রেদোয়ানও হাসতে হাসতে বলল, “ভাই, ওর হবু বউ এবার বিয়েতে না করে দিলেই ষোলোকলা পূর্ণ। ”
“শ/কু/নের দোয়ায় গরু…” রেদোয়ানকে আরও কিছু বলার আগে ময়ূখ আবার তাড়া দিল। মঈদুলও সিরিয়াস হলো।
“মুনিমের ঠিকানা দিতেসিল৷ তখন আমি ফাইলের কাগজটায় দেখলাম ওর বাপের নাম। জানেন কি দেখলাম?”
“এবারও এহতেশাম সাহেবের নাম দেখেছো নাকি?” ঠাট্টাচ্ছলে বলল ময়ূখ।
“একদম ঠিক স্যার। এইটাই দ্যাখসি।”
ময়ূখের বিস্ময় এবার আকাশ ছাড়ালো। হুট করে মনে হলো কিছু এলোমেলো পাজল মিলে গেল। শিরিন আর মুনিম ভাইবোন! দুজনেই এহতেশাম সাহেবের লুকোনো স্ত্রীর সন্তান। এজন্যই এদের জন্য তার অপরিসীম স্নেহ ছিল। সত্যিই কি তাই? তাহলে তাদেরকে তিনি ছেড়েছিলেন কেন?
নিশ্চয়ই তারা উনার ছায়া বঞ্চিত ছিল। অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে জীবনে চলার পথে। এহতেশাম সাহেবের মতো মহীরুহ ব্যক্তিত্ব যাদের মাথায় তাদের এমন জীবনযাপন করতে হতো না নিশ্চয়ই। এরাই কি তাকে নিজেদের /প্র/ /তি/ /শো/ /ধ কিংবা স্বা/ /র্থ/ সি//দ্ধির জন্য ব্ল্যা// /ক /মে/ /ই/ল করছিল! নাকি এর পেছনে অন্য গল্প আছে!
নিমগ্ন বসে থাকতে থাকতে সহসাই নতুন একজন এই হোটেলে প্রবেশ করছে বুঝতে পারল। ময়ূখ এক নজর তাকিয়েই জরুরি গলায় সঙ্গীদের বলল,
“হ্যাট পরে নাও, মাফলার থাকলে মুখ ঢেকে ফেল। টি//ক//টি//কি এসে পড়েছে। দুজন দুই পথে যাবে৷ এখান থেকে বেরিয়ে কেউ কাউকে চেন না। কী করে ফাঁ//কি দিতে হয় তোমরা জানোই। এখনি উঠো না। আমি সংকেত দিলে উঠবে। আমার কথার খেই ধরে উত্তর দেবে। বুঝতে পেরেছ?”
দুজনেই মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল। ততক্ষণে মঈদুল আর রোদোয়ানের চেয়ারের সাথে লাগোয়া উল্টোদিকের চেয়ারে বসল নতুন আগত লোকটা। ময়ূখ মুখ দেখতে পায়নি। টুপি আর মাফলারে ঢাকা মুখ। এখন এতটা ঠান্ডাও নেই, তাই বুঝতে অসুবিধা হয় না কে হতে পারে।
…….
(ক্রমশ)