সেই তমসায় পর্ব ৬

0
305

#সেই_তমসায়_৬
নুসরাত জাহান লিজা

কিছুদূর হেঁটে সামনে যেতে অ”নু”স”র”ণ”কা’রীর উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো ময়ূখের কাছে। ওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করাই তার কাজ আপাতত। তাই এটা নিয়ে মাথা না ঘামানোই যৌক্তিক, তবে গা ছেড়ে দেয়া যাবে না। সদা স*ত*র্ক* থাকতে হবে।

সে প্রাসদোপম বাড়িটায় ফিরে এলো। গেটের কাছে মৃদুলার সাথে দেখা হয়ে গেল। আজ মেয়েটার অভিব্যক্তি কিছুটা অন্যরকম। আগেকার রু*ক্ষ *মূ*র্তি এখন অনুপস্থিত। সৌজন্যসূচক একটা মৃদু হাসিও ফুটল মুখে। কিন্তু কোনো কথা হলো না। তেমনই একটা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে ভেতরে চলে এলো। সন্ধ্যা গড়িয়েছে। মেয়েটা কি কারো জন্য অপেক্ষা করছে? কার জন্য?

অনেকেই বাড়ির বাইরে এখন। সে নিজের ঘরে এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো। খানিক বাদে দেখল মৃদুলা আর সাজিদ হেসে হেসে কথা বলতে বলতে বাগানের দিকে এসে দাঁড়ালো। এরপর খুব গম্ভীর মুখভঙ্গিতে কোনো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে বিদায় নিল। এরপর সাজিদ গেল বাগানের উল্টো দিকের ঘরের দিকে আর মৃদুলা আরও কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করে ফিরে আসছিল। এবার ময়ূখ জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিল।

এমনিতে আগ্রহটা কেবল সাজিদের দিক থেকে, মৃদুলাকে বরং মুনিমের জন্য উতলা হতে দেখেছে। আজ মনে হলো দেখার বাইরের আরও কিছু দেখতে হবে, জানতে হবে।

১৪.
রাতে খেয়ে ছাদে এসেছিল ময়ূখ। এই পরিবার কেমন যেন ছন্নছাড়া বলে মনে হয়! এদের পরিবার থাকতেও কেমন বন্য। আর সে, কখনো কখনো মনে হয় একটা পরিবার, একটুখানি পিছুটান থাকলে ম*ন্দ* হতো না! ওর মতো পো*ড়*খা*ও*য়া মানুষের মনেও কখনো সখনো বিষাদ খেলে যায়! থাকলে হে*লা*য় হা*রা*য় আর না থাকলে কী আহাজারি! বিচিত্র মানব স*ম্প্র*দা*য়!

ওর নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরের একঘর আগে রায়হানের ঘর। সেটা পেরিয়ে নিজের ঘরে আসতে হয়। ছাদ থেকে নেমে ফেরার পথে সেই ঘরে কিছু উত্তপ্ত অথচ ফিসফিস কথা শুনে সেদিকে আরেকটু এগিয়ে কান পাতল ময়ূখ।

“ভেবেছিলাম টাকাটা হাতে পেলেই তোমার ক*ঞ্জু*স ভাইয়ের টাকাটা ফিরিয়ে দেব। কিন্তু সেটা পেলাম না। এদিকে ব্যাটা সারাক্ষণ তাগাদা দিচ্ছে।”

“এতগুলো টাকার ব্যাপার। কতদিন হয়ে গেছে। তাগাদা দেবে না?”

“আরে আমি তো বলেছি টাকা পেলেই দিয়ে দেব। এভাবে সব চু**রি হবে কে জানত। এখন জমিজমার প্রসেসিং হয়ে গেলেই সেটা বিক্রি করে দিতে চাইছি। কিন্তু ওর এখনই লাগবে।”

“তুমি তোমার নিজের বো*কা*মি*র জন্য ব্যবসায় ল*স খেয়েছ। তোমার বাবা তো তোমাকে আশি লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেটা তো গেছেই, আমার ভাইয়ের কাছ থেকে ত্রিশ লাখ নিয়েছ সেটাও গেছে। জু**য়া দেখলে মাথায় ঘিলু কই যায়?”

“আরে, নাজমুলও টাকা পায় লাখ দুইয়েক।”

“তোমার মেয়ে বড় হচ্ছে। ঋণ শোধ দিতে গিয়ে সম্পত্তি চলে গেলে ভবিষ্যৎ কী? তোমার এসব নিয়ে চিন্তা নেই? বাড়ির কেউ জানলে মুখ দেখাতে পারবে?”

কারো পায়ের মৃদু আওয়াজ আসতেই ময়ূখ সটকে পড়ল। রায়হান ঋণে জ*র্জ*রি*ত, জু* *য়া*য় আ*স*ক্ত। বাবার টাকার উপরে তাই লো**ভ রয়েছে প্রবল। সে জানত এহসান সাহেব না গেলে কিছুই হাতে আসবে না। তার জন্য কিছু করা কী সম্ভব! যদিও টাকা লো**পা**টের সাথে তার লেনাদেনা নেই বোঝাই যাচ্ছে।

নোটবুক আর কলম বের করে কিছু জরুরি টাস্ক লিখে রাখল। আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে, এবার বিশ্রাম নেয়া যাক!

১৫.
ময়ূখ পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় এলোমেলো হাঁটল অনেকক্ষণ। একটা নিগুঢ় উদ্দেশ্যে আছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে উদ্দেশ্য চরিতার্থ হলো।

এই গ্রামের কিছু ঘর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আলাদা করে কোনো পাঁচিল বা দেয়াল দেয়া নেই চারপাশে। অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের বাস এদিকে। বাড়ির সামনের দিকের উঠোনটাই রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটা জায়গায় চার-পাঁচজন লোক মিলে কাঠ কা*ট*ছিল। খুব কাছাকাছি আরেকটা জায়গায় ধান শুকাতে দেয়া হয়েছে। গরম ভাপ উঠছে, মনে হয় সদ্য সেদ্ধ করা। সেখানেও একজন পুরুষ আর একজন নারী কাজ করছে। পাশে কয়েকটা শিশু ধুলোয় হুটোপুটি করে খেলছে। মুরগির ডাক ভেসে আসছে সেদিক থেকে।

ময়ূখ সেদিকে যেতেই একটা লোক কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করল, “আপনে কই আসছেন? আগে দেখি নাই।”

“আমি এহতেশাম সাহেবের বাড়িতে এসেছি। তার ছোট ছেলে সাঈদের বন্ধু।”

“ও। তা ঘুরতে আসছেন?” এবারে লোকটার গলায় সমীহ দেখা গেল।

“হ্যাঁ, তাই বলা যায়। সাঈদের মুখ থেকে ওর বাবার অনেক প্রশংসা শুনতাম। তার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু..” মুখে দুঃখ দুঃখ আবহ ফুটিয়ে তুলে ময়ুখ বলল কথাটা।

“হ্যাঁ। উনি মানুষ আছিলেন একখান। কী চালচলন! জমিদারি আছিল তো এককালে। নবাবী চালে চলাফিরা করত।”

পাশ থেকে অন্য একজন বলল, “কিন্তু লাভ কী! একটা পোলাও মানুষ হইল না। অ* *ক**র্মা হইসে। বাপ দাদার নাম ডুবাইবো।”

“কেন, কী হইসে?” ময়ূখ এবার টুপ করে প্রশ্ন ছুঁ*ড়ে দিল। তবে লোকটা চু*প*সে গেছে।

“কিছু না। হ্যারা তো কিছু করে না। বাপের ট্যাকা পয়সা আছে, উড়াইতাসে।” অন্য একজন মুখ খুলল এবার।

“আপনের বন্ধু, কিন্তু আমার সত্য কইতে ড*রাই না। বুঝলেন!”

“সত্য বলাই তো ভালো। আপনাদের দেখেই বোঝা যায়, আপনারা সততা নিয়ে চলেন৷ আমার উনার সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ছিল। কেমন মানুষ ছিলেন এহতেশাম চাচা, বলেন তো?”

এবার তাদের উৎসাহ ফিরে এলো।

“হ্যায় তো ভালা মানুষ আছিল। একটু অ* *হ* ং*কা*রী ছিল অবশ্য। তয় ওইরম মানুষের তা এট্টু থাকবই। আমগোরে তো থাকব না। তবে দান করসে দুই হাত ভইরে। কেউ সাহায্য চাইতে গেলে খালি হাতে ফিরায় নাই।”

এমন আরও কিছু স্তুতিবাক্য শুনে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিল ময়ূখ। আজও বাজারের দিকে গেল। এভাবে আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে যেটুকু বুঝল৷ গ্রামের লোকেরা ভদ্রলোককে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। কেউ কেউ আ*ফ*সো*স পর্যন্ত করল।

একটা লোক সম্পর্কে ঘরের এবং পরের মানুষের দুইরকম মত। তবে তার ছেলেদের সম্পর্কে সবাই একমত। এহতেশাম সাহেবের মতো এলাকাবাসীরও ধারণা তারা অ**ক*র্ম*ণ্য। রায়হানের ব্যাপারটায় তো এটুকু পরিষ্কার ওর কাছেও। এই জন্যই হয়তো নিজের সবকিছু সন্তানদের দিতে সংশয় ছিল ভদ্রলোকের।

১৬.
রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে এলো ময়ূখ। সারাদিনের ধ*ক*লে অবসন্ন লাগছে ভীষণ। ঘুমঘুম চোখে ব্যাগের তালা খুলে নোটবুক বের করে হাতে নিল সে। সারাদিনের সঞ্চিত ত*থ্য লিখল। সেটা আবার যথাস্থানে রেখে টেবিলের কাছে এলো। সেখানে ওর একটা ব্যাগ রাখা আছে। তার ঠিক পাশে নীল রঙের একটা ছোট্ট চারকোনা কাগজ পেপারওয়েট দিয়ে চা*পা দেয়া। ময়ূখের স্পষ্ট মনে আছে খেতে যাবার আগে এটা এখানে ছিল না।

সে কাগজটা হাতে নিয়ে উল্টো পাশের লেখা জায়গাটা বের করল। তাতে কেবল একটা শব্দই লেখা,

“সা*ব* *ধা*ন*।”

আর কিচ্ছু লেখা নেই তাতে। *হু** *ম* কী* তে সে দমে না। কাগজটা ভাঁজ করে এই ব্যাগের পকেটেই রেখে দিল। ব্যাগেও যে ত* *ল্লা* *শি চা*লা*নো হয়েছে সেটাও স্পষ্ট। যে কাজটা করেছে, সে নিতান্ত আনাড়ি হাতে করেছে।

খাবার সময় সাজিদ ছিল না সেখানে, মৃদুলা আর মুনিরাও পরে এসেছে। এদের মধ্যে কেউ করেছে নাকি কাউকে দিয়ে করানো হয়েছে!

ভাগ্যিস বড় ব্যাগে তালা দেয়া ছিল। যে এটা করেছে, সে-ই নিশ্চয়ই অ*নু*সর*ণ করার সাথে যুক্ত। একটা কথাই বারবার মনে হলো, একে ধরতে পারলে অর্ধেক ধাঁধা সমাধান হয়ে যাবে!

সে চেষ্টা করছে অজ্ঞাত মানুষটার মনে ভীতি সৃষ্টি করতে। সেটা যত বেশি করা যাবে তত বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তত দ্রুত ধরা দেবে। কিন্তু কথা হলো নিজেকে *টো*প হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে যা কিছু ঘটে যেতে পারে! তাই নিজেকেই সে চিরকুটের কথাটা শোনালো বারকয়েক,

“সা*ব*ধা*ন, ময়ূখ। সা*ব** *ধা*ন।”
……….
(ক্রমশ)
(প্রিয়, পাঠক, মতামত জানিয়ে অনুপ্রাণিত করবেন প্লিজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here