সেই আদুরে দিন পর্বঃ১৪

0
1158

#সেই_আদুরে_দিন
#পর্বঃ১৪
#Arshi_Ayat

‘এখন বলো তোমার কি সিদ্ধান্ত?কি চাও আমার কাছে মুক্তি নাকি ভালোবাসা?’

শুদ্ধতা এক নজর রৌদ্রুপের দিকে তাকিয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখালো।শীতল কন্ঠে বলল,’জানেন রৌদ্রুপ আমার মা আমার জন্মের সময় মারা গেছেন।ছবি ছাড়া কখনোই সামনাসামনি তাকে দেখি নি।আমার পৃথিবীতে আমার বাবাই আমার সব।আমি শুনেছি আমার মা নাকি কলগার্ল ছিলেন।একদিন ট্রেনে বাবার সাথে পরিচয় হবার পর মা বাবাকে বলেছিলো একটা কাজের সন্ধান দিতে মা আর এইকাজ করতে চাচ্ছিলো না।বাবা মা কে আশ্বাস দিয়েছিলো কাজ খুঁজে দিবে বলে।তখন বাবা সদ্য পাশ করা বেকার ছেলে।নিজেরই চাকরী নেই অন্যকে আবার কি চাকরী দেবে তবে মায়ের করুণ মুখ আর কাতর কন্ঠ শুনে বাবার মায়া লেগেছিলো।তার কিছুদিন পর বাবা একটা চাকরী পেয়ে গেছিলেন।তিনি চাকরী করতে শুরুও করলেন কিন্তু আম্মুর কথা তার আর মনে নেই।এদিকে আব্বুর অফিসের ধোয়ামোছার কাজের জন্য কয়েকজন মহিলা লাগবে তাই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো অফিসের মালিক।তো বিজ্ঞাপন দেখে আম্মু আসছিলো কাজ নিতে।আম্মুকে কাজও দেওয়া হলো।তখনও আব্বু আম্মু জানতোও না আবার দেখা হবে তাদের।তো পরেরদিন আম্মু সবাইকে চা দিয়ে আব্বুর কেবিনেও গেলো চা দিতে।ওইদিন আবার দেখা হলো তাদের।আব্বু আম্মু দুজনই অবাক হয়ে গিয়েছিলো।কয়েকটা ফর্মাল কথা হয়েছিলো সেদিন শুধু।এরমধ্যেই আম্মুর কাজ ভালো বলে অফিসের কয়েকজন স্টাফ আম্মুকে তাদের বাসায় কাজ করার জন্য বলেছিলো আম্মুও রাজি হলো।অফিসে তো আর সবসময় থাকা লাগে না শুধু সকাল সকাল এসে ধোয়ামোছা করে সবাইকে চা কফি দিলেই কাজ শেষ তারপর আবার বিকেলে সবাই যাবার আগে একবার ধোয়ামোছা করতে হয়।তাই মাঝের সময়টুকু আম্মু কয়েকটা বাসায় কাজ করতো।এভাবে ভালোই চলছিলো আম্মুর জীবন।আম্মু ওই ঘৃণিত জীবনটা ছেড়ে দিয়েছিলো।তখন এতো কাজ করতে কষ্ট হলেও আম্মু ভালো ছিলো।কিন্তু একদিন আব্বু অফিস থেকে ফেরার সময় দেখলো রাস্তার মধ্যে কতোগুলো বখাটে ছেলেপেলে আম্মুকে বিরক্ত করছে ওরা আম্মুর খদ্দের ছিলো।আবারও টেনে নিয়ে যেতে চাইতো অন্ধকার দুনিয়ায়।আসলে কেউ ভালো হতে আমরা যারা সভ্য সমাজে বাস করি তারা ওই মানুষটাকে ভালো হতে দেই না নানা অপমান,কুৎসা রটিয়ে আবারও খারাপ হতে বাধ্য করি।কিন্তু আমাদের উচিত একটা মানুষকে ভালো হতে উৎসাহিত করা।যাইহোক তারপর আব্বু ওদের সাথে কথা কাটাকাটি করে আম্মুকে নিয়ে গিয়েছিলো।এভাবে পরপর কয়েকদিনই বিষয়টা খেয়াল করার পর আব্বু নিজেই অফিস শেষ করে আম্মুর সাথে বাসায় ফিরতেন।আম্মুর বাসার একটু পরই আব্বুর বাসা।আম্মু টিনের একটা রুমে থাকতো আর আব্বু একটা মেসে।প্রতিদিন একসাথে যেতে যেতে ওদের মধ্যে অনেকটাই কথা হতো।অনেক ফ্রীও হয়ে গিয়েছিলো ওরা দুজন।তারপর দীর্ঘ এগারোমাস পর আব্বুর মনে হলো আব্বু আম্মুকে ভালোবাসে আর আব্বুর মনে হয় আম্মুও আব্বুকে ভালোবাসে তাই একদিন আব্বু বলেই দিলো তবে আম্মুর কাছ থেকে আশানুরূপ কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না আব্বু ভেবেছিলো আম্মু বোধহয় ওভাবে ভাবে না আব্বুকে।কিন্তু আব্বু তবুও আবার আম্মুকে প্রপোজ করেছিলো আম্মু তখন না করে দিয়েছিলো।না করার পিছনে সমাজ নির্মিত কয়েকটা কারণও দেখিয়েছিলো আম্মু।আব্বু কারণগুলো অগ্রাহ্য করে শুধু বলেছিলো “ভালোবাসো?”।আম্মু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলো।ব্যাস সমাজ,পরিবার বিরোধী হয়ে আব্বু আম্মুকে বিয়ে করেছিলো।ওই মুহুর্তটা কতোটা সুখের একটা মেয়ের কাছে সেটা বোধহয় আম্মুই বলতে পারবে কিন্তু বিয়ের পরই আব্বু আম্মুকে অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়।আমার দাদু আব্বুকে ত্যাজ্য করেছিলো।অফিসের কলিগরাও আব্বুকে নানারকম খোঁচা মারতো।আব্বুর কষ্ট হলেও আম্মুকে বলতো কারণ আম্মু এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছিলো।বিয়ের পর আম্মু আর কাজ করে নি।আব্বুই করতে দেয় নি।এরপর একদিন দুজনেই জানতে পারলো তাদের ছোট্ট একটু বাবু সোনামণি আসছে!’

এই পর্যন্ত বলেই শুদ্ধতা মৃদু হাসলো।তারপর আবারো বলতে শুরু করলো,’গর্ভাবস্থায় আব্বু অনেক খেয়াল রেখেছিলো আম্মুর।তো একদিন অফিসের কাজে আব্বু ঢাকার বাইরে যায়।আম্মু ডেলিভারি আরো একসপ্তাহ পরে।আব্বু যাওয়ার আম্মুর সাথে ওনার দুঃসম্পর্কের এক ভাবীর কাছে রেখে যায়।তারপর আব্বু আসার একদিন আগে আম্মুর লেবার পেইন ওঠে।আম্মুকে হসপিটালে নেওয়া হয়।এরপর ডেলিবারির সময় আমি বাচলেও আম্মু বাঁচে নি।তখনও আব্বু জানে না তার ভালোবাসার মানুষটা আর নেই।আব্বু যখন জানতে পারলে সবকাজ রেখেই রওনা দিলো।এসে আম্মুকে মাটি দিলো এরপর আমাকে কোলে নিয়ে বুকে মিশিয়ে কান্না করলো।তখন আমি আর আব্বু দুজনে একসাথে কান্না করছিলাম।আব্বু কাঁদছিল প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্টে আর আমি স্বভাবসুলভ কারণে।তারপর আব্বু আর বিয়ে করেন নি।আমাকে নিয়েই ছিলেন।বড়ো হতে হতে লোকমুখে মায়ের নামে এতোকিছু শুনেছি যে ওগুলো মনে করলেও ঘৃণায় জীবনটা বিষিয়ে আসে।এমনকি আমার জন্ম পরিচয় নিয়েও অনেকের সন্দেহ আছে!’

শুদ্ধতা থামলো।রৌদ্রুপ বুঝতে পারলো ও কাঁদছে।কাঁধ থেকে মাথাটা তুলে নিয়ে ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।সামান্য সময় পর নিজেকে সামলে শুদ্ধতা বলল,’আজ এগুলো বলার একটাই কারণ তা হলো আমি আপনাকে ভরসা করি।ভালোবাসি কি না জানি না!তবে আপনি না থাকলে আমিও থাকবো না।আমি মুক্তি চাই না আপনার থেকে,আপনাকে চাই।’

মোহময় এক অনুভূতিতে ভাসছে রৌদ্রুপ।ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি।কপালে আলতো একটা চুমু খেয়ে বলল,’তুমি না চাইলেও আমি তোমারই প্রিয়।’

সব দুঃখ গ্লানি শেষ!রৌদ্রুপ শুদ্ধতার চোখের পানি মুছে দিলো তবুও যেনো ওর মুখ মেঘভার হয়ে আছে।তাই ওকে হাসানোর জন্য আচমকাই কাতুকুতু দেওয়া আরম্ভ করলো।
হাসির দমকে শুদ্ধতার চোখে পানি চলে আসার মতো অবস্থা।রৌদ্রুপ ইচ্ছে করে আরো কাতুকুতু দিচ্ছে।শুদ্ধতাও ওকে কাতুকুতু দিচ্ছে তবে বেশি দিতে পারছে না কারণ ও হেসেই কুল পাচ্ছে না আবার কাতুকুতু দিবে কি!হাসতে হাসতেই শুদ্ধতা কোনোমতে বলল,’প্লিজ এবার থামুন।মরে যাচ্ছি তো!’

রৌদ্রুপ থামলো কিন্তু ও থামতেই শুদ্ধতা ঝাপিয়ে পড়লো ওর ওপর।অতর্কিত হামলায় রৌদ্রুপ নাস্তানাবুদ।শুদ্ধতা ইচ্ছে মতো কাতুকুতু দিচ্ছে আর রৌদ্রুপের সাথে সাথে সেও হাসছে।
———–
খাবার আনার পর আরেক বিভ্রাট দেখা দিলো যেহেতু সিনাতের হাত বাঁধা সেহেতু হয় রিভানকে খাইয়ে দিতে হবে নয় সিনাতের হাত খুলে দিতে হবে।রিভান তো জীবনেও খাইয়ে দিবে না এই আশা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।তাই অগত্যা সিনাতের হাতই খুলে দিলো সে তবে হাত খুলে দিলেই একদম সামনে বসে ওকে নজরে রাখলো।সিনাত মনের সুখে খাওয়া আরম্ভ করলো।তবে ভেতরে ভেতরে অন্য প্ল্যান চলছে।এখান থেকে পালানোর প্ল্যান।খেতে খেতেই ও চোরা চোখে আশেপাশেটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।তারপর রিভানের অগোচরেই মেঝে তে পড়া একটা ব্লেড দেখতে পেয়ে ওটা তুলে নিয়ে হাতে মুট করে রাখলো।এরপর সুযোগ বুঝে খাবারটা ফেলে দিলো।শব্দ হওয়ায় রিভান তাকাতেই সিনাত এমন একটা ভাব ধরলো যেনো সে ইচ্ছে করে ফেলে নি।কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলল,’সরি,একটুও খেতে পারলাম না।পড়ে গেলো।এখন আমার না খেয়েই থাকতে হবে।’
এটা বলেই কাঁদতে আরম্ভ করলো।যদিও চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না তবুও নিচের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পানি বের করে ফেললো।রিভানের প্রচন্ড রাগ হলো।কাছে গিয়ে একটা চড় দিতে নিলেই ফোনটা বেজে উঠলো।তাই আর না মেরে সিনাতের হাতদুটো বেঁধে বাইরের দিকে চলে গেলো।

এই সুযোগ হাত মুট করে রাখা ব্লেডটা দিয়ে আসতে আসতে হাতের রশিটা কাটা শুরু করলো সিনাত।পুরোনো ব্লেড হওয়ায় ধার তেমন নেই তবুও কষ্ট করে কাটতে লাগলো আর আল্লাহ!আল্লাহ! করতে থাকলো যেনো রিভান চলে না আসে।অনেক খাটাখাটুনির পর রশিটা কাটতে পারলো সিনাত।হাত দুটো ছাড়া পেতেই পায়ের বাঁধনটাও খুলে ফেললো।তারপর বিশাল গোডাউনের একদম পিছনের একটা ড্রামের ভেতর চুপ করে বসে রইলো ও।এর মধ্যেই রিভান চলে এলো তবে এখন ওর সাথে আনা আর নিক্স দুজনই আছে।

চেয়ারে পাশে কাটা রশি, ওপরে ব্লেড।কোথাও সিনাতকে না দেখতে পেয়ে নিক্স গম্ভীর স্বরে বলল,’মেয়েটা কোথায় রিভান?’

‘এখানেই ছিলো একটু আগেও।বুঝতেছি না গেলো কোথাও?’রিভান চিন্তিত গলায় বলল।

আনা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’বুঝতে পারছো না এখনো?মেয়েটা পালিয়েছে।চেয়ারের ওপর ব্লেড দেখছো না?’

‘কিন্তু পালালে তো ধরা পড়তো।দরজা দিয়ে বের হলে তো আমি দেখতে পেতাম।’রিভান ভ্রু কুঁচকে বলল।

‘তাহলে কি হাওয়া হয়ে গেলো নাকি?’নিক্স দারুণ রেগে বলল।

‘আমার মনে হয় মেয়েটা গোডাউনেই লুকিয়ে আছে।’আনার কন্ঠে সন্দেহ।

‘তাহলে দাড়িয়ে আছো কেনো।জলদি খোঁজো।’নিক্স হুকুম করতেই ওরা দুজনে খুঁজতে লেগে পরলো।এদিকে ওদের কথা শুনে ভয়েই সিনাতের গলা শুকিয়ে আসছে!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।আলহামদুলিল্লাহ পরীক্ষা ভালো হচ্ছে।আর দুটো বাকি।১৭ তারিখ থেকে গল্প আবারো নিয়মিত পাবেন।ইনশাআল্লাহ!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here