সেই আদুরে দিন পর্বঃ০৭

0
1209

#সেই_আদুরে_দিন
#পর্বঃ০৭
#Arshi_Ayat

কমলাপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে।ঘড়িতে এখন চারটা বেজে বাইশ মিনিট।মাত্রই স্টেশনের সামনে সি এন জি থামলো।শুদ্ধতা আর রৌদ্রুপ সি এন জি থেকে নেমে দাড়ালো।রৌদ্রুপ ভাড়া দিতে চাইলে চালক জোরে জোরে মাথা নেড়ে তটস্থ গলায় বলল,’লাগবো না।’
এটা বলেই এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে সি এন জি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।যেনো এই যাত্রায় রক্ষা পেলেই তার শান্তি টাকা পয়সা কিছুই লাগবে না তার।

সি এন জি চালকা চলে যেতেই শুদ্ধতা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,’আপনার জন্য লোকটা টাকা না নিয়েই চলে গেলো।’

শুদ্ধতার কথা শুনে রৌদ্রুপ শ্যেনদৃষ্টিতে একবার ওর দিকে চাইলো তারপর বলল,’আহা!দরদ উথলে পড়ছে সি এন জি ওয়ালার জন্য।আমি কি ওকে টাকা না নিতে বলছি?ওরে তো টাকা দিলামই না নিলে আমার কি দোষ?’

শুদ্ধতা কিছু বলল না।শুধু ঠোঁট বাঁকাল।
এখন মাত্র সাড়ে চারটা।ট্রেন আসবে সাতটায়।আরো দেড়ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।রৌদ্রুপ একা হলে প্লাটফর্মেই কাটিয়ে দিতে পারতো কিন্তু শুদ্ধতাকে নিয়ে পারা যাবে না।কখন কার চোখে ধরা পড়ে যায় তার ঠিক নেই তখন তো পালাতে হবে।এমনিতে এতটুকু দৌড়েই শুদ্ধতার অবস্থা বেহাল।তাই শুদ্ধতাকে নিয়ে স্টেশনের তিনতলায় গিয়ে হোটেল নিকুঞ্জ থেকে একটা রুম বুক করলো।ওদের সার্ভিস চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা।

রুমে এসেই শুদ্ধতা ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।শরীরটা যেনো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে।ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে।পা দু’টো ব্যাথা করছে।কখনো এতো দৌড়ায়নি ও।স্বাভাবিক ভাবেই বেশি দৌড়ানোর ফলে এখন ব্যাথা করবেই।বিছানায় শুতেই শুদ্ধতা ঘুমিয়ে গেছে।রৌদ্রুপ ওর মাথাটা ঠিক করে বালিশে ওপর রেখে নিজেও ওর পাশে কিছুটা হেলান দিয়ে বসলো।ঘুমে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আছে।তবুও একপ্রকার জোর করেই চোখ দু’টোকে আটকে রেখেছে কারণ এইমুহুর্তে ঘুমানোটা নিরাপদ না।এখনও ঢাকার ভেতরেই অবস্থান করছে ওরা কখন কি হয়ে যায় বলা মুশকিল।সবরকম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।সেইজন্য ঘুম কাটাতে প্রয়োজন।কিন্তু এভাবে বসে থাকলে ঘুম যাওয়ার বদলে আর আসবে।বসে থাকা ছাড়াও আর কি করা যায়!শুদ্ধতা তো সেই কখন ঘুমিয়েছে।রৌদ্রুপ একবার ঘুমন্ত শুদ্ধতার দিকে চাইলো।কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে!আস্তে আস্তে শুদ্ধতার মাথাটা বালিশ থেকে উঠিয়ে নিজের বুকে রাখলো।আলগোছে কপালে একটা চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।এতচিন্তার মাঝেও শুদ্ধতাকে নিজের বুকে পেয়ে রৌদ্রুপের ভালো লাগছে।ও কখনো চিন্তাও করে নি ওর এমন অনিশ্চিত একটা জীবনে শুদ্ধতাও জড়িয়ে যাবে।ভেবেছিলো দূর থেকে ভালোবাসবে।ওর সুখী হওয়া দেখবে কিন্তু বোধহয় সুখটা দুজনের একসাথেই ছিলো।

রৌদ্রুপ চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো তবে ঘুমায় নি।হঠাৎ শুদ্ধতা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো।ওকে এভাবে উঠতে দেখে রৌদ্রুপও ওঠে বসলো।বিচলিত হয়ে বলল,’কি হলো শুদ্ধ উঠে পড়লে কেনো?খারাপ লাগছে?’

‘পানি খাবো।’
রৌদ্রুপ বেডসাইড থেকে ঢেকে রাখা পানির গ্লাসটা শুদ্ধতার দিকে বাড়িয়ে দিলো।এক চুমুক দিয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে স্তিমিত গলায় বলল,’কয়টা বাজে?’

‘সাড়ে ছয়টা।’

‘ওহ!’
এটা বলেই শুদ্ধতা আবার শুয়ে পড়লো।কিন্তু রৌদ্রুপের চিন্তা কমলো না।শুদ্ধতার এভাবে ঘুম থেকে ওঠার কারণ কি?রৌদ্রুপ ওর দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলো।এভাবে একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুদ্ধতা বলল,’এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?’

‘কি হয়েছে তোমার?এভাবে ঘুম থেকে উঠে গেলে যে।’

‘একটু অসুস্থ লাগছিলো তাই।’

‘ওহ!এখনো খারাপ লাগছে?’

‘না এখন একটু ভালো।’

‘আচ্ছা চলো আমরা নাস্তা সেরে নেই।ট্রেন তো সাতটায় চলে আসবে।’

‘চলুন।’
শুদ্ধতা আর রৌদ্রুপ হোটেলে রুমের চাবিটা দিয়ে নিচে নেমে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলো।একটা টেবিলে বসার পর রৌদ্রুপ জিগ্যেস করলো,’কি খাবে?’

‘রুটি,ভাজি হলেই হবে।’

রৌদ্রুপ নিজের জন্য আর শুদ্ধতার জন্য রুটি আর ভাজি অর্ডার দিলো।অর্ডার দেওয়ার পর একটু বসতে হলো ওদের কারণ রেস্তোরাঁগুলো সবেই খুলেছে।একটু সময় লাগবে।তবে বেশি সময় লাগে নি।পাঁচ/সাত মিনিটের মধ্যেই দিয়ে গেছে।

নাস্তা করে যখন ওরা বের হলো তখন ছয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট।রৌদ্রুপ শুদ্ধতাকে একটা পানির বোতল কিনে দিয়ে ওয়েটিং রুমে বসতে বলে কোথায় যেনো গেলো।একটু পরেই ফিরে এসে বলল,’চলো।ট্রেনে উঠতে হবে।’

ওরা ট্রেনে ওঠার পরই ট্রেন আসতে আসতে ছেড়ে দিলো।এখনো যাত্রীরা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠলো।শুদ্ধতা আর রৌদ্রুপ ওদের নির্দিষ্ট বগিতে চলে গেলো।সেখানে একজোড়া কাপল বসে ছিলো আগে থেকেই।ওদের বরাবরই সীটে রৌদ্রুপ আর শুদ্ধতা বসলো।শুদ্ধতা জানালার সাইডে বসেছে।ট্রেন এখন দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে।সকাল সাতটার আকাশ গুমোট ভাব ধারণা করেছে।বাতাসে আদ্রতা।শুদ্ধতা ট্রেনের জানালা দিয়প বাইরে তাকিয়ে রইলো ওর খেয়াল নেই পাশে ব্যাক্তিটির দিকে।হঠাৎ কাঁধে ভারী কিছু অনুভব হতেই শুদ্ধতা পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো রৌদ্রুপ ওর কাঁধে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।শুদ্ধতা মাথাটা এক হাতে একটু চেপে ধরে আবারও বাইরে তাকালো।চোখজোড়া মেঘলা আকাশে নিবদ্ধ থাকলেও কানজোড়া সামনের সীটের দু’টো মানুষের কথা শুনতে আগ্রহী।না তাকিয়েও বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা হাসছে আর ছেলেটা কানেকানে কিছু বলছে তাতে মেয়েটার হাসির বেগ আরো বাড়ছে।

বিদ্যুতের আঁকাবাঁকা রেখা চিরে দিল কাঠ কয়লার মতো আকাশটাকে, কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল কোথাও। ঘনঘোর দুর্যোগের দিন, ঝড়ো হাওয়ায় গাছগাছালি নুয়ে নুয়প পড়ছে।বৃষ্টি শুরু হতেই শুদ্ধতা জানালার কাচ আটকে দিয়েছিলো।রৌদ্রুপ তখনও ঘুমে।বারবার ওর মাথাটা পড়ে যাচ্ছিলো বলে শুদ্ধতা দুই হাত দিয়ে আগলে রেখেছিলো ওকে।তাতে অবশ্য রৌদ্রুপ ভালো করে ঘুমোতে পেরেছে তবে একটু আগে ধরণী কাঁপানো বাজের শব্দে উঠে গিয়েছিলো।তবুও ঘন্টাদেড়েকের মতো ঘুম হয়েছেই।

এতক্ষণ তুমুল বৃষ্টি গলেও এখন গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছে।শুদ্ধতা সামনের সীটের ওদের থেকে পারমিশন নিয়ে জানালা খুলে দিলো।ঠান্ডা একটা বাতাসের পাশাপাশি হালকা বৃষ্টির ছাটও এসে পড়তে লাগলো শুদ্ধতার মুখে।

সারা রাস্তা কতক্ষণ শুদ্ধতা ঘুমিয়েছে তো কতক্ষণ রৌদ্রুপ ঘুমিয়েছে।ওদের মাঝে তেমন একটা কথাও হয় নি।এমন কাহিনি দেখে সামনের সীটের ওরা বোধহয় ভাবছে এমন বোরিং জামাই বৌ জীবনেও দেখি নি।একটুও কথা নেই শুধু ঘুম আর ঘুম।কিন্তু তারা কি জানে!সারা রাত ওরা ঘুমায় নি তাই রাতের ঘুম এখন ফুরাচ্ছে।

ট্রেন পাহাড়তলী ষ্টেশনে থামলে শুদ্ধতাকে নিয়ে রৌদ্রুপ নেমে পড়লো।এখনো আকাশ থমথমে হয়ে আছে।স্টেশন থেকে সোজা পাহাড়তলী বাজারে চলে এলো ওরা।এখন ১২.২৫ বাজে।বৃষ্টি হওয়ার কারণে বাজারের রাস্তা ঘাট মাখামাখি হয়ে আচে কাঁদায়।রৌদ্রুপ প্যান্ট’টা একটু খাপিয়ে নিলো ওর দেখাদেখি শুদ্ধতাও খাপালো।বাজার থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকের রাস্তাটা ধরলো ওরা।একটু হেঁটে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকলো রৌদ্রুপ ওর পেছনে শুদ্ধতাও আছে।এই সারিতে সব টিনের বাড়ি।রৌদ্রুপ একটা ঘরের সামনে এসে জোরে হাক দিলো।

‘খালা,ও খালা দেখো আমি আসছি।’

ভেতর থেকে একটা মধ্যবয়স্ক মহিলা বেরিয়ে এসে রৌদ্রুপ দেখেই এসে জড়িয়ে ধরলো।রৌদ্রুপও ধরলো।তারপর কোমল কন্ঠে বলল,’ও..বাফ তুইঁয় ক্যান আছো?এতোদিন ন আইয়ো কা?'(তুমি কেমন আছো বাবা?এতোদিন আসো নি কেনো?’)

‘ব্যাস্ত ছিলাম খালা।এই তো এখন কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এলাম।’

‘ভালা গইরজু।(ভালো করছো।)

মহিলাটা রৌদ্রুপের সাথে কথা বলতে বলতে শুদ্ধতার দিকে তাকিয়ে বলল,’আরে ফরি গেইয়ো?ইবে তোয়ার বও না?'(আরে মেয়েটা কে?এটা তোমার বউ না?’)

‘হ্যাঁ খালা ও আমার বউ শুদ্ধতা।’

মহিলাটা শুদ্ধতার মুখে স্পর্শ করে বলল,’ওমা..তোয়ার বও তো সুন্দর আছে।ক্যান আছো মা?'(তোমার বউ তো সুন্দর আছে।কেমন আছো মা?’)

শুদ্ধতা কিছু বুঝলো না।তাই রৌদ্রুপের দিকে তাকালো।রৌদ্রুপ বলল,’জিগ্যেস করলো কেমন আছো তুমি?’

‘জ্বি,ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?’

‘আইঁ ভালা আছি।(আমি ভালো আছি।)

মহিলাটা শুদ্ধতার হাত ধরে রৌদ্রুপ আর ওকে বলল,’আইয়্যু তয়ারা ভিতুর মিক্কে আইয়েনে বইয়্যু।'(আসো তোমরা ভেতরে এসে বসো।)

ওরা ভেতরে গিয়ে বসতেই একটু ষোল সতেরো বছরের মেয়ে এসে রৌদ্রুপকে বলল,’ক্যান আছন রৌদ্রুপ ভাইয়ে?'(কেমন আছো রৌদ্রুপ ভাই?)

‘এই তো ভালো আছি তুমি?’

‘আই ভালা আছি।ইবে হন?'(আমি ভালো আছি।এটা কে?’)শুদ্ধতার দিকে চেয়ে বলল মেয়েটা।

‘ও তোমার ভাবি।’
রৌদ্রুপের উত্তরটা শুনে মেয়েটা সাথে সাথে মুখ কালো করে ফেললো।পেছন থেকে ওর মা এসে বলল,’শিউলি,ইতারা রে হজির শরবত দে।'(শিউলি,ওদের লেবুর শটবত দে।)

‘আইন্নি।'(আনছি)এটা বলেই শিউলি মেয়েটা চলে গেলো।রৌদ্রুপের খালা এসে ঘরের ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে চলে গেলো।খাটের ওপর আরাম করে বসে রৌদ্রুপ নিজের শার্টের বোতমগুলো খুলতে নিলেই শুদ্ধতা মৃদু গর্জন দিয়ে বলল,’বোতাম খুলছেন কেনো?’

‘আরে গরম লাগছে তাই।’

‘লাগুক আপনি খুলবেন না।’শুদ্ধতা চোখ গরম করে বলল।রৌদ্রুপ খুললো না।
এর মধ্যেই শিউলি লেবুর শরবত এনে রাখলো।রৌদ্রুপের ঘামে ভেজা শার্ট’টা দেখে বলল,’রৌদ্রুপ ভাইয়ে তয়ার শার্ট ইবে খুলি ফেল ঘামি চুপচুইপ্পে অই গেয়ি'(রৌদ্রুপ ভাই শার্ট’টা খুলে ফেলুন আপনি ঘেমে গেছেন।)

শুদ্ধতা শিউলির কথা পুরো না বুঝলেও আংশিক বুঝতে পেরেছে যে সে রৌদ্রুপকে শার্ট খুলতে বলেছে।শুদ্ধতা রৌদ্রুপের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে এর অর্থ তুই ‘একবার শার্ট’টা খোল তোর বুক আমি জ্বলসে দিবো।তারপর বুক দেখাইস।’

রৌদ্রুপ শুদ্ধতার চোখ রগড়ানো দেখে একটা ঢোক গিলে শিউলিকে বলল,’না শিউলি ঠিক আছে।এমনিই শুকিয়ে যবে।’

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।এখানে চিটাগং এর আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here