#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৮
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
১৭.
আকাশ ঘন বাদলে ছেয়ে গেছে। বিকেলটা যেন ঘোর অমাবস্যার কালো আঁধারে নিজেকে রাঙিয়েছে। মুহূর্তেই প্রকৃতির রঙ বদলে গেল। থেমে থেমেই দূর থেকে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে। প্রকৃতির মন খারাপের আভাস হয়ত এটাই। পাহাড়ি জনপদে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল। দ্রুত বাড়ি ফেরার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে যেন। পাখিদের দল বেঁধে নীড়ে ফেরার দৃশ্যই বলে দেয় প্রকৃতির অভিমানে ভয় পেয়েছে তারা। একমনে সেই দৃশ্য দেখছে রুথিলা। প্রকৃতির মন খারাপের স্থায়ীত্ব ক্ষণকালীন, মুহূর্তেই সব কষ্ট রূপ নিল বৃষ্টি নামক অশ্রুধারায়। আমরা মানুষ কত অদ্ভুত তাই না! আমাদের মন খারাপ হলে যদি তখনই বৃষ্টি নামে তাকে আমরা প্রকৃতির অশ্রু বলে অবিহিত করি। আবার যদি আমাদের আনন্দের সময়টাতে ঝলমলে সুন্দর আবহাওয়া দেখা যায় তাকে আমরা প্রকৃতির আনন্দ বলেই প্রকাশ করি। বিচিত্র সব চিন্তা-ভাবনা প্রতিনিয়ত সুশীল মনে ঘুরে বেড়ায়। রুথিলা জানালা থেকে দৃষ্টি ফেরাল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিল। নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ঘৃণা করছে তার। নিজের প্রতি একদলা থুতু নিক্ষেপ করল মনে মনে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“কিরে এখনো তৈরি হলি না? বরপক্ষ এল বলে।” রাফিদ রুথিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল।
“এই বাড়াবাড়িটা না করলে কী চলছিল না?” বিষন্নচিত্তে উত্তর করল রুথিলা।
“কথা কম বলার অভ্যাস কর তো। হিরন কিন্তু এত কথা পছন্দ করে না।”
“আমি কী পছন্দ করি না সেই খবর রেখেছ কখনো?” জবাবে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিল রুথিলা।
“রাফিদ নিজের স্বার্থ ছাড়া কোনো কিছুর খবর রাখে না।”
“রাজনীতি করতে তুমি কিসের জন্য? জনসেবার উদ্দেশ্যে নাকি নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে। জনগণের রক্ষক না হয়ে তাদের ভক্ষক হিসেবে নিজেকে বেশ ভালোই গড়েছ। আর একটা কথাই জিজ্ঞাসা করব। বলবে প্লিজ? তুমি শেষমেশ অস্ত্র ব্যবসার সাথেই কেন জড়ালে? ঘুষ খেতে, দুর্নীতি করতে কিংবা চুরি করতে, তাও নিজের মনকে বোঝাতে কষ্ট কম হতো। আমার আদর্শ, আমার ভাইজান সে কী না একজন সিরিয়াল কিলার, অস্ত্র ব্যবসায়ী, নারী লোভী, রেপিস্ট। ছিহ্! ঘেন্না করে তোমার মুখাবয়ব দেখলে। জঘন্য লাগে।” রুথিলা একনাগাড়ে সবটা বলল।
“চুপচাপ বেনারসি পড়ে তৈরি হয়ে নে। আর প্যাঁচাল পারিস না।” রাফিদ বিকৃত মুখাভঙ্গি করে বলল।
“ভাইয়া আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করব না। বিশ্বাস কর শেষ নিশ্বাস অবধি তোমার জন্য অভিশম্পাত বেরোবে আমার মুখ থেকে। কসম করে বলছি।”
রাফিদ কোনো প্রত্যুত্তর করল না কেবল আহত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো, মুখে কিঞ্চিৎ হাসিও ঝোলালো। রুথিলা আবার বলে উঠল,
“তোমার প্রতি আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। যাই করেছি তার জন্য তবুও মাফ করে দিও। ছোটবেলায় অনেক কষ্ট দিয়েছি। অনেক আবদার করেছি, তোমার সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও। তার জন্য আমি দুঃখিত। ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ।” অশ্রুকণা রুথিলার চোখে টলমল করছে। অতি কষ্টে তা সংবরণ করে রেখেছে সে।
রাফিদ হকচকিত হয়ে তাকালো রুথিলার দিকে। তার বুকের ভেতরটা কষ্টে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। নিজের বোনের মুখে এসব কথা শোনার পূর্বেই যদি তার মরণ হতো সেই কামনাই অন্তর থেকে বেরোলো অতি আকুলতার সাথে। রুথিলার চোখে চোখ মেলানোর সাহস হলো না তার, হনহনিয়ে রুথিলার সামনে থেকে সরে গেল সে।
রুথিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আর তখনি নুরা মারমা প্রবেশ করল সেই কক্ষে। রুথিলা তাকে দেখে বলে উঠল,
“জা’নোয়া’রটাকে বুঝালাম, কিছুই শুনল না। আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই। তোমাকে যা করতে বলেছিলাম করেছ?”
“সব কিছু করেছি। আর তোমার ইমেইল পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দিয়েছি। ওরা জাতিসংঘে তোমার পাঠানো মেইলগুলোকে মিথ্যে প্রমাণ করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। এস আই শামীম তার আগেই সব কিছু জানিয়ে ইমেইল পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর চিন্তা কোরো না রূপকেও আমরা নির্দোষ প্রমাণ করব। তুমি একটু রিল্যাক্স থাক। সব কিছু ভালোই হবে।” নুরা মারমা শুদ্ধ বাংলায় প্রতিটি কথা বলে থামল।
“এই আস্তে কথা বলো, শুনে ফেলবে কেউ। আর তুমি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছো কেন যে কেউ শুনলে সন্দেহ করবে তো নাকি?” রুথিলা আতঙ্কিত হয়ে বলল।
“আপাতত সবাই বরযাত্রী আনতে গেছে। আর উমাই’র বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বিপদের আভাস পেলে জানাবে। আমি আসছি এখন। তুমি কী কাজটা সেরে ফেলতে চাও?” প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে ভ্রু নাচালো নুরা।
“রান্নাঘরের আশেপাশে কেউ নেই? আর কতজন আসতে পারে বলে জানো?”
“খুব একটা বড়ো আয়োজনের সাহস পাচ্ছে না ওরা। সর্বোচ্চ নয়জন আসতে পারে। একটা ভয়ের মধ্যে রয়েছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে সেরে তোমাকে নিয়ে মালয়েশিয়ার ফ্লাইট ধরবে। টিকেট কেটে রেখেছে তিনটা। তোমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য এখনো অস্পষ্ট।” নুরা মারমা জবাব সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা চালালো।
“আমি যেন ওদের কুকীর্তি ফাঁস করতে না পারি, এজন্য আমায় বন্দী করতে চাইছে বুঝতেছ না এই সামান্য বিষয়টা?” রুথিলা রেগেই বলল।
“আমি এতদিন ওদের সাথে কাজ করে ওদের পরিকল্পনা ধরতে পারলাম না। আর তুমি এত সহজেই বুঝে ফেললে। বাহ্ ইন্টেলিজেন্ট। আ’ম ইমপ্রেসড।”
“এখন চলো তো! ওরা আসার আগেই কাজ সেরে ফেলতে হবে।”
এরপর রুথিলা আর নুরা দ্রুতপদে রান্নাঘরে ছুটে গেল। নিজেদের কাজ সেরেই আবার কক্ষে ফিরে গেল। রুথিলাকে নুরা মারমা বেনারসি পড়িয়ে চটপট বিয়ের সাজে সাজিয়ে দিল। রুথিলার খুব করে রূপকের কথা স্মরণ হচ্ছিলো, খুব করে। অজানা আতঙ্ক হঠাৎই পেয়ে বসল তাকে। নুরার উদ্দেশ্যে বলল,
“শেষ মুহূর্তে যদি সবটা ওলোট পালট হয়ে যায়?”
এমন আশঙ্কার কথা শুনে নুরা মারমার হাত থেকে কাঁচের আয়না মেঝেতে পড়ে যায়। তীব্র শীতের মাঝেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হয় আতঙ্কে। হঠাৎ কাঁচের আয়না মেঝেতে পড়ে যে ঝনঝন শব্দের ঝংকার তুলল তাতে রুথিলা চমকে ওঠে। তার মনের আশার আলো যেন উড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে দপ করে নিভে যায়।
১৮.
শামীম নিজের ফোর্স নিয়ে একদম তৈরি। আজকে রাতে তার কর্মজীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিযান। তাকে খুবই সতর্কতার সাথে পরবর্তী পদক্ষেপ ফেলতে হবে। নুরা মারমার সাহায্য ছাড়া এত বড়ো অস্ত্র পাচারকারী চক্রের নাগাল পাওয়া মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। পাশাপাশি বিচক্ষণ রুথিলাও অনেক সাহসীকতার সাথে এত ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ না নিলেও কাজটা হয়ত কখনও সম্ভব হতো না। এসব ভাবনাতেই নিমজ্জিত ছিল শামীম। তখনই তার মোবাইল ভাইব্রেট করে ওঠে। স্ক্রিনে চোখ বোলাতেই প্রেমার নামটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। শামীমের দেহে অজানা আতঙ্ক যেন ভর করে। তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। এই বুঝি প্রিয়ার সাথে শেষ কথোপকথন। কেবল এই একটি চিন্তাই মাথায় বারংবার হানা দিচ্ছে। কম্পনরত হাতের সাহায্যে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল,
“ফিরে আসতে তোমাকে হবেই। মনোবল হারাবে না। সত্যের ধ্বংস নেই। আমি জানি তুমি পারবে। তোমার নেতৃত্বে আরেকটি বিজয় আসবেই ইনশাআল্লাহ্।”
“দোয়া কোরো, তাই যেন হয়।” আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল শামীম।
“হুম।” কান্নারত কণ্ঠ শ্রোতার কর্ণগোচর হলো।
শামীম বুঝতে পারল প্রেমা সাহসের বাণী আর বুলি আওড়ালেও মনে মনে ভীত, সঙ্কিত। তবুও আর কিছু বলে মেয়েটাকে ঘাটতে চাইল না সে। আর মায়া বাড়িয়ে কী লাভ! যা ঘটবার, যা কপালের লিখন তা কী খন্ডানো সম্ভব। আস্তে করে মোবাইল কান থেকে সরিয়ে ফেলল শামীম। তারপর সাথে থাকা সদস্যদের উদ্দেশ্যে শামীম বলল,
“আপনারা কী প্রস্তুত? লাইসেন্সকৃত সকল অস্ত্র গুছিয়ে নিন। কাজে লাগতে পারে। আর কমান্ড না পাওয়া পর্যন্ত কেউ ফায়ার করবেন না। যত বড়োই অপরাধী হোক না কেন, সে ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন। তাই বিচার বহির্ভূত হত্যা আমাদের নীতি বিরোধী। একান্তই নিরুপায় হয়ে গেলেই কেবল ট্রিগারে হাত রাখবেন। মনে থাকবে তো!”
“ইয়েস স্যার।” সমস্বরে বলে উঠলেন সকল পুলিশ সদস্য।
এই মুহূর্তে শামীম, অফিসার রূপকের নেতৃত্বকে খুব বেশিই স্মরণ করছে আর সাথে কনস্টেবল সাগ্রতের সঙ্গ সেটার অনুপস্থিতিও বেশ বুঝতে পারছে। তবে নিজেকে দুর্বল ভাবলে চলবে না, সাহস ধরে রাখতে হবে। শত্রুদের পরাস্ত করে তবেই মিলবে শান্তি, মিলবে মুক্তি। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো বোকামি, যার মাশুল আপনাকে নিজের জীবনের বিনিময়ে দিতে হতে পারে। তাই শক্ত থাকুন, মনোবল বজায় রাখুন, ইনশাআল্লাহ্ মহান রবের পক্ষ হতে সাহায্য আসবেই। শামীম চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল, এসব ভাববার পর নিজেকে তার বেশ হালকা লাগছে, আর অস্বস্তিকর অবস্থারও বেশ উন্নতি পরিলেখ হলো।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~
[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। রিচেক হয়নি, ভুলক্রটি মার্জনীয়। কপি করা নিষেধ।]
[