#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৫
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
১২.
সাগ্রতকে সাথে নিয়ে রূপক এখন নীলগিরিতে অবস্থান করছে। যেসকল স্পটে হত্যাকান্ডগুলো ঘটেছে সেই সব স্পট ঘুরে ঘুরে দেখেছে তারা। সেখানে কিছুই পায়নি তারা। রূপকের কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে বিষয়গুলো নিছক খুন নয়। খুব ভোরেই পৌঁছেছিল তারা নীলগিরিতে। সেই থেকেই তদন্তের কাজে ব্যস্ত। বেশ অনেকটা বেলা গরিয়েছে এবার নীলগিরি হিল রিসোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হলো দু’জন। আশেপাশে অনেক উপজাতি পরিবারের বসতি। আর যেসকল কিশোরী হত্যাকান্ডের শিকার তারা প্রত্যেকেই সকালে জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল কিন্তু বাড়িতে ফিরে আসেনি আর। তাদের সম্পূর্ণ লাশের হদিসও মেলেনি। সবটা ভাবতে ভাবতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেল রূপক ও সাগ্রত। ভাবনায় খানিকটা ভাটা পরলো অবশ্য। কিন্তু রিসোর্টের মনোরম পরিবেশ আর প্রকৃতির চমৎকার রূপ, ঐশ্বর্য দেখে মুহূর্তের মাঝেই দু’জনের অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেল। মুখ থেকে স্বভাবতই বেরিয়ে গেল রূপকের “সুবহান আল্লাহ”, আর তা শুনে সাগ্রতও পরক্ষণেই বলে উঠল “আল্লাহু আকবর, কী চমৎকার সৃষ্টি!”
দুপুরে দু’জনে গোসল সেরে খেয়ে নিল। তারপর বিছানায় নিজেদের শরীর এলিয়ে দিল। আর কেসটার অগ্রগতি ছিল মুখ্য আলোচ্য বিষয়। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর রূপকের ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে রূপক দেখল হেড কোয়ার্টার থেকে কল এসেছে। দ্রুত কল রিসিভ করল সে।
“জি স্যার বলুন।”
“আর্মি ক্যাম্পে আমাদের কথা হয়েছে। তাদের হাইকমান্ড থেকে অনুমতি এসেছে। তোমরা এখন নিশ্চিতরূপে তদন্ত করতে পারবে। কোনো সাহায্য প্রয়োজন হলে জানাবে। আর্মি ফোর্স যে কোনো মূল্যে পাহাড়ের বিশৃঙ্খলা দূর করে নিরাপত্তা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে চায়। বুঝতে পেরেছ?”
“ইয়েস স্যার।” উৎফুল্ল হয়ে বলল রূপক।
“ওকে টেক কেয়ার। বাই।”
রূপক একটু আশঙ্কা মুক্ত হলো। সাগ্রতকে সবটা জানালো। তারপর দুজনে খানিকটা বিশ্রামের উদ্দেশ্যে বিছানায় শুয়ে পরল। খানিকের মাঝে ক্লান্ত দেহগুলো নিস্তেজ হয়ে গেল। তাদের চোখে ঘুম ভর করল।
১৩.
মাঝরাতে হঠাৎই এস আই শামীমের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বিছানায় দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলেন তার স্ত্রী গভীর ঘুমে নিমগ্ন। শামীম উঠে বসলেন, আর শরীর থেকে কম্বল সরিয়ে ফেললেন। বেড সাইডের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর ল্যাপটপটা এগিয়ে নিলেন নিজের কোলের ওপর। কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর গুগলে সার্চ করলেন “রুথিলা তাবাস্সুম” নামটি লিখে। যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করা যায় সেই চিন্তা থেকে।
সেকেন্ড কয়েকের মাথায় সাতটা ফলাফল ভেসে উঠলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে। প্রতিটিই হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ। আর একটি হচ্ছে “স্বাধীকার” নামক মানবাধিকার সংগঠনের ওয়েবসাইট। শামীম সবগুলো সংবাদ একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লেন আর “স্বাধীকার” এর ওয়েবসাইট খুব ভালো করে দেখলেন। সংবাদগুলো গত তিনমাসের বিভিন্ন সময়ের। বিভিন্ন পত্রিকায় রুথিলার দেয়া সাক্ষাৎকারের খন্ডচিত্র। দেশের মানবাধিকার হুমকির পথে এই শীর্ষক আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে তার বক্তব্যে। আর গত সপ্তাহে তার কার্যক্রম ছিল উল্লেখযোগ্য, অর্থাৎ নিখোঁজ হওয়ার পূর্বের সপ্তাহে রুথিলা বেশ সোচ্চার ছিল। ওয়েবসাইট থেকে “স্বাধীকার” এর কর্মীদের নামগুলো টুকে নিলেন শামীম। অতি আশ্চর্য হলেন শামীম এই ভেবে যে নুরা মারমাও একজন মানবাধিকার কর্মী এবং রুথিলার সহকর্মীদের একজন। অথচ নুরা মারমা সেই প্রসঙ্গ উল্লেখই করলেন না। শামীম বেশ বুঝতে পারলেন ঘটনাটিকে আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও এটা বেশ জটিল। স্বামীর নড়াচড়ার আভাস পেয়ে মিসেস শামীমের তন্দ্রাচ্ছন্নতা কেটে গেল। তিনি চোখ মেলে দেখলেন শামীম বিছানা ছেড়ে স্টাডি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর সেখানে নিজের ল্যাপটপ আর কাগজ, কলম নিয়ে বসলেন। মিসেস শামীম উঠে বসলেন ও স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“এত রাতে আবার এসব নিয়ে বসলে কেন!”
“ঘুম ভেঙে গেল, তাই ভাবলাম কিছু কাজ এগিয়ে রাখি।” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন শামীম।
“আর শরীরের যত্ন নিবে কখন, সুস্থ থাকতে হবে তো নাকি?”
“তুমি আছো না! আমার যত্ন নিতে তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই পেলাম না।”
“যখন আমি থাকব না তখন?”
তড়িৎ ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি ফেরালেন শামীম। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন তার স্ত্রীর দিকে। কিন্তু তিনি কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলেন না। তাই স্টাডি টেবিল ছেড়ে উঠে আসলেন এবং চকিতে মিসেস শামীমের ওষ্ঠযুগলের ওপর আক্রমণ করে বসলেন। দীর্ঘদিন পর স্বামীর সান্নিধ্য পেয়ে শুষ্ক হৃদয়ে যেন বর্ষণের আভাস পেলেন তিনি। খুশিতে চোখের কোণ বেয়ে তপ্ত কয়েক ফোঁটা অশ্রু নির্গত হলো ও তা শামীমের কপোলে পতিত হলো। শামীম তার প্রিয়তমার চিবুক ধরে মুখখানা উঁচু করে ধরলেন এবং নরম কণ্ঠে বললেন,
“আর কখনো যেন এসব কথা না শুনি। একি প্রেমা তুমি কাঁদছো কেন?”
“ঠিক কতদিন পরে তুমি আমায় একটু সময় দিলে? শেষ কবে এত কাছে এসেছিলে?” অশ্রুসিক্ত নয়নে আকুল কণ্ঠে বললেন প্রেমা।
শামীমের হৃদয়ের মধ্যিখানে চিনচিনে ব্যথায় যেন ছেয়ে গেল আর মুহূর্তেই তা সংক্রামক রোগের ন্যায় সারা অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। সে প্রেমার চোখে চোখ মেলাতে সংকোচ বোধ করছিল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বামী বলে মনে হলো শামীমের। কথা বলার সমস্ত ভাষাও যেন অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গিয়েছে। না চাইতেও নিরবতা পালন করলো একজোড়া কপোত-কপোতি। ব্যস্ততার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া প্রেমানুভূতি হঠাৎই যেন জেগে উঠেছে আর অপরাধ বোধ যেন শামীমকে সেই সুযোগে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। খানিকটা সময় নিয়ে কম্পিত স্বরে শামীম বললো,
“আমায় ক্ষমা করবে প্রিয়তমা?”
আলতো হাতে শামীমকে জড়িয়ে ধরে প্রেমা ডুকরে কেঁদে ওঠে। শামীমও তার স্ত্রীকে পরম মমতায় নিজের বাহুডরে আগলে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে প্রেমার হেঁচকি উঠে যায়। শামীম আনমনে নিঃশব্দে হেসে ফেলে এই ভেবে যে তার পাগলি এখনো ঠিক আগের মতোই অভিমানীনি রয়ে গেল। কাজের ভিড়ে কখন যেন সম্পর্কের রং ফিকে হয়ে গেছে তা বুঝতেও পারল না শামীম। আচ্ছা কাজের কী তাই এত ক্ষমতা যে আপনজনকে পর করে দিতে জানে? এসব ভাবতে ভাবতেই শামীমের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে এল।
১৪.
রুথিলা নিজের সামনে ঘটে যাওয়া নির্মমতা দেখে স্তব্ধ, নির্বাক, হতভম্ভ। নিজের চোখের সামনে এ ধরনের ঘটনা কোনোদিন অবলোকন করতে হবে তা নিজের দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি রুথিলা। আতঙ্কে তার পুরো শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। এই নিয়ে তিনবার বমি করেছে রুথিলা তাও নিজের জামা-কাপড়ের ওপরেই। কিন্তু সেই নিয়ে রুথিলার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই যেন। অনুভূতিরাও যেন মরে গেছে। এখন রুথিলার হাত পায়ের বাঁধনগুলোও খুলে রাখা। তবুও তার পালিয়ে যেতে কিংবা নিজেকে মুক্ত করার কোনো প্রকার সাধ জাগছে না। মানুষ নামক নরপশুদের চেহারাগুলো দৃষ্টিপটে ভেসে উঠছে বারংবার। প্রতিশোধের সুপ্ত স্পৃহা জেগে উঠছে মনের মাঝে। ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠছে তার।
কিছুক্ষণ পূর্বে,
“রিমি তুমি কেন এমন করছো? বলো আমি কী তোমার কোনো ক্ষতি করেছি? আমাকে এভাবে আঘাত করে পাচ্ছ কী!” রুথিলা আকুল স্বরে বলে উঠল।
“কিন্তু আমার করার কিছুই নেই। তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম তবে সেই সাধ্য আমার নেই। উপরন্তু তোমাকে আঘাত না করলে আমার নিস্তার নেই। আমার নিজের হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। বিশ্বাস কর।” রিমি অসহায় কণ্ঠে বলল।
“তুমি আমায় সাহায্য কর প্লিজ, কথা দিচ্ছি তোমাকে সাথে নিয়েই পালাবো। বিপদে ফেলে পালাবো না। আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমাকে দিয়ে জোর করে এসব করানো হচ্ছে। তুমি নিজেও এসব থেকে মুক্তি চাও।”
রুথিলার এই কথাগুলো শুনে রিমির হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হলো। নতুন করে বাঁচার আশা জাগল মনের কোণে। না চাইতেও সে রুথিলার কথায় সম্মতি দিতে চাইল। মন আর মস্তিষ্কের টানাপোড়েনে রুথিলার প্রতি নিজের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এলো রিমি। রুথিলাকে সাহায্য করার ইচ্ছে পোষণ করল। আর সেই অনুযায়ী নিজেদের পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল তারা।
[বিঃদ্রঃ টাইপে আছি তবে হয়ত শেষ করতে পারব না। তাই কেউ #শেষ_বিকেলের_চিঠি গল্পের জন্য অপেক্ষা করবেন না।]
~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~