সূচনায় সমাপ্তি ৩

0
199

#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০৩
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

৭.

নির্ঘুম একটি রাত পার করে শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়েই কটেজ ছাড়ছে রূপক। কাল সারা রাত নামমাত্র বিছানায় শুয়ে ছিল সে। ঘুম তাকে ধরা দেয়নি বরং অতীতে হারানো দিনগুলোর স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর অতিবাহিত হলেও প্রেয়সীর সাথে কাটানো দিনগুলো আজও স্মৃতিতে অমলিন। সময়ের সাথে আপনজনেরা মলিন হয়ে যায় কিন্তু স্মৃতি সে তো অমলিন রয়ে যায়। পিবিআই এর পক্ষ থেকে বান্দরবানে রূপককে শিফট করার অন্যতম কারণ হচ্ছে বিগত মাস তিনেক ধরে চলা সিরিজ হত্যাকান্ড। আজকে থেকে ডিউটিতে যোগদান করবে রূপক। তবে তার পূর্বে বান্দরবান সদর থানায় যেতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ ও কেসটার অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। তাই লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে রিসিপশনে আসতেই এস আই শামীম ও কনস্টেবল সাগ্রতের সাথে অকস্মাৎ সাক্ষাৎ হয় রূপকের। প্রথম দেখাতেই তাদের চিনে ফেলে রূপক। অবশ্য শামীম ও সাগ্রতের চিনতেও বিলম্ব হয়নি। রূপককে দেখা মাত্রই সাগ্রত বলে উঠল,

“আরে রূপক স্যার যে! কেমন আছেন আপনি? আপনার সাথে এমন হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।”

“আমি ভালো আছি। আপনারা এখানে যে?” কিঞ্চিৎ গম্ভীরতা বজায় রেখে রূপক বলল।

“স্যার আমি আর শামীম স্যার একটু দরকারেই এসেছিলাম।”

“শামীম সাহেব আপনাদের থানাতেই যাচ্ছি, তা চলুন একসাথে যাওয়া যাক।” রূপক বলে উঠল।

“অবশ্যই স্যার চলুন তবে।” শামীম আন্তরিক ভাবে উত্তর দিল।

তারপর চেক আউট শেষে তিনজন একসাথে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এমনটা নয় যে এবারেই রূপকের সাথে শামীম ও সাগ্রতের প্রথম সাক্ষাৎ। ইতোপূর্বে তারা একসাথে অন্য একটি কেসে কাজ করেছেন ও তাতে সফল হয়েছেন। এবার কাজের সূত্রে দ্বিতীয় বারের জন্য মিলিত হলো তারা। তাই নিজেদের মাঝে পরিচয় পর্বের দীর্ঘ আলাপচারিতার হাত থেকে নির্ঘাত মুক্তি মিলল। নতুবা তাদের কাছে এসব যেন কিছু উটকো ঝামেলার নামমাত্র।

গন্তব্যের লম্বা পথ পেরোনোর সময় যে যার মতো কাজে ব্যস্ত ছিল। কেউ কারোর সাথে কথা বলে কাল ক্ষেপণ করেনি। রূপক তার নোটপ্যাডে টুকটাক অফিসিয়াল মেইল চেক করছিল। সাগ্রত নিজের করা হিসেবগুলো মিলিয়ে নিচ্ছিল। আর শামীম চোখ বন্ধ করে ঘটনাগুলোকে পর পর ভেবে দেখছিল, যে কার সাথে কার যোগসূত্র রয়েছে। সবাই একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মস্তিষ্কের নিকট সংকেত পাঠাচ্ছে, যেন সঠিক বার্তাটি মস্তিষ্ক তাদের প্রেরণ করে। তবে সব কিছুর রহস্য কী এত অল্পতে সমাধান হয়? তাহলে তো পৃথিবীতে সমস্যার উদ্ভব হওয়ার অবকাশই থাকত না।

৮.

গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত কোথাও নিজের অবস্থান নিশ্চিত করল রুথিলা। সময়টা ঠিক বেলা না নিশি তা ঠাওর করাও মুশকিল ভীষণ। কেননা চারপাশে শুধুই ঘোর অন্ধকার। এ যেন আবদ্ধ এক মৃত্যু কূপ। যেখানে প্রবেশ করলে মরণ নিশ্চিত। এমনটাই মনে হতে লাগল রুথিলার। হঠাৎই নিজের হুঁশ হারানোর পূর্ব মুহূর্ত স্মরণ হলো তার। ভাবতেই প্রচণ্ড রাগ হলো তার। ঘাড়ে চিনচিনে ব্যাথাও অনুভূত হচ্ছে। এখনো ভালোভাবে আঁখি যুগল মেলতে পারছে না সে। যেন চোখের ওপর ভারী কিছু রেখে দেয়া হয়েছে। নিজের হাত নাড়ানোর চেষ্টা করতেই বুঝতে পারল তার হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। আর নিজের প্যান্টের পকেটের কথা স্মরণ হতেই পা সামান্য নাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু তা খালি অনুভূত হলো। মুহূর্তেই ঘোর অমাবস্যার আঁধার দেখতে পেল রুথিলা। পা’জোড়া যে খুব নাড়াতে পারছে ঠিক তাও না। তবুও নিজের পকেটে কোনো কিছু থাকলে যে অনুভূতি হয় তার স্বাদ পাচ্ছে না রুথিলা। আর তাতেই সে নিশ্চিত নিজের মহা মূল্যবান, কষ্টার্জিত জিনিসটি সে হারিয়ে ফেলেছে। চিৎকার করার চেষ্টা করতেই তার অনুভব হলো মুখটাও কাপড়ে বেঁধে রাখা। চাইলেও মুখ থেকে চিৎকার বেরোনো সম্ভব না। কিন্তু হঠাৎ কে এমন আক্রমণ করতে পারে রুথিলার ওপর! কিছুতেই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের বোধগম্য হচ্ছে না বিষয়টি। আর এরকম বদ্ধ স্থানে হাত, পা আর মুখ বেঁধে রাখারই বা কি কারণ হতে পারে? সবটাই ধোঁয়াশা আর রহস্যে ঘেরা। রুথিলা অস্ফুট স্বরে বলবার চেষ্টা করল,

“কেন করছো এমন?”

তবে মুখ থেকে স্পষ্ট কোনো কথা বেরোলো না। রুথিলা ভাবতে লাগল,

“আমার কাজগুলোই হয়ত আমার এই পরিণতির কারণ। এই মৃত্যু কূপ থেকে হয়ত আমি আর কোনোদিন বেরোতে পারব না। তবে জানি না জীবনের অন্তিম মুহূর্তে কেন তোমায় মনে পরছে। তুমি কেমন আছো? কোথায় আছো? আমায় কী মনে পড়ে কখনো! জানো তোমায় অনেক মনে পড়ে। আমি আজও ভালোবাসি তোমায়। অনেক ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের নিয়তি যে খুবই নিষ্ঠুর। তাইতো সংসারের সূচনাতেই সমাপ্তি ঘটেছে। আর তুমিও খোঁজ নিয়ে দেখনি আমায়। ইশ আবার যদি পেতাম দেখা!”

কষ্টে রুথিলার হৃদয়জুড়ে তোলপাড় বয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায়, ফেলে আসা দিনগুলোতে করা খুঁনসুটিময় আবেগঘন মুহূর্তেরা নিত্য দোলা দিচ্ছে মনে। সেই স্মৃতিতে গা ভাসিয়ে অশ্রুরা যেন আপন মনে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে রুথিলার নেত্রযুগলে। ডুঁকরে কেঁদে ওঠে রুথিলা। আজকে তার পরিবারকে বড্ড মনে পড়ছে। কতই সুখকর সময় অতিবাহিত করেছে সে নিজের মা-বাবা আর বড়ো ভাইয়ের সাথে। অথচ কালের বিবর্তনে আর সময়ের বেড়জালে তারা আজ অতীতের স্মৃতি মাত্র। আহা জীবন, বড়োই বিচিত্রময়ী তোমার পদক্ষেপ!

৯.

“বস আজকের শিকার কে!” বিদঘুটে মুখাবয়ব ধারণ করে প্রশ্ন করল কেউ।

“আজকে কিছু করার প্রয়োজন নেই। রূপক আহসানের উপর আপাতত নজর রাখ।” প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্যে জবাব দিল কেউ।

“ওই একটা চেংরার ওপর আবার নজর রাখার কী আছে? ও শা’লা ছ্যাঁ’কা খাওয়া মা’ল। প্রত্যেক রাত ওর চোখের জল ফেলতে ফেলতেই কেটে যায়। এক্কেবারে মাই’গ্গা।” কথাগুলো বলেই ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল উক্ত ব্যক্তি।

“তা যা বলেছো। ওর মানসিক সামর্থ্য আর শারীরিক সামর্থ্য দু’টোই একদম শেকড় থেকে উপড়ে গেছে। ওর দ্বারা আর কিছুই সম্ভব হবে না।” বলেই সঙ্গীর হাসির সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগল সে।

“আর ওই মাথামোটা শামীম আর সাগ্রত দু’টোর বা’পেরও তো ক্ষমতা হবে না, আমাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করার। আরেকটা পথের কাঁটা ছিল ওটাকেও বন্দী করেছি। এখন একটু অপেক্ষা করি। তারপর পরবর্তী পদক্ষেপ নেই, কী বলেন বস!”

“তুমি যথার্থই বলেছ হিরন।” বলেই পুনরায় বিদঘুটে হাসি হাসতে শুরু করল ব্যক্তিটি।

সেই হাসির শব্দ শুনে যে কারোরই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতে বাধ্য। ঘরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কীটপতঙ্গেরাও হয়ত ভয়ে কুঁকিয়ে উঠল। কী ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় মেতেছে তারা আর তাদের পরবর্তী শিকারই বা হতে চলেছে কারা! কার জীবনের ধ্বংস করতে তারা মেতে উঠেছে! এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর তারা নিজরাও জানে না। এমনকি তারা এটাও জানে না তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে?

তারপর তারা দু’জনে দু বোতল মদ নিয়ে বসল। আপন মনে মদ পান করতে লাগল তারা। আর মদ্যপ হয়ে নিজেদের মাঝে অ’শ্লী’ল আলাপচারিতা চালাতে লাগল। এদিক থেকে যেন তাদের মাঝে প্রতিযোগিতা। ঠিক কে কতটা অ’শ্লী’লতার পরিচয় দিতে পারে। তাদের মাঝে শুধুই টাকা, মাদক আর নারীর প্রতি নেশা ছাড়া কিছুই নেই। আর এর মাঝেই তারা খুঁজে নিয়েছে নিজেদের সুখ। তাদের কাছে এ জীবনটি যেন স্বর্গসুখের। মানুষের চরিত্রের ঠিক কতটা অধপতন হলে এ ধরনের উশৃঙ্খল জীবনে সেই ব্যক্তি নিজের সুখ খুঁজে পায়!

~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here