সূচনায় সমাপ্তি ২

0
165

#সূচনায়_সমাপ্তি
#পর্ব_০২
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা

৪.

গরম ধোঁয়া ওড়া কফির কাপ হাতে কটেজের বারান্দায় বসে আছে রূপক। সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য উপভোগের চমৎকার সঙ্গী হলো কফি। সময় পেরিয়ে সূর্যাস্ত ঠিকই ঘটল, তবে কফির কাপে আধ খাওয়া কফি পড়ে রইল টি-টেবিলে অবহেলায়। নিজের পছন্দের জিনিসগুলোর প্রতিও আজকাল তিক্ততা অনুভব করে রূপক। প্রেয়সী যেন যাবার সময় রূপকের সব সুখ কেড়ে নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে দূর ঠিকানায়। সেখানে চাইলেও হয়ত যাওয়া যায় না কিংবা সময় হয়ে ওঠে না। ট্রাউজারের পকেটে হাতরে একটা কাগজের সন্ধান করতে পারল সে। কোমলতায় পূর্ণ স্পর্শের মাধ্যমে কাগজটি খুলে পড়তে আরম্ভ করল। ঠিক কাগজ বলা চলে না, একটা চিরকুট।

প্রিয়তম,

ভালোবাসা নিও। আজকের এই মুহূর্তের পর হয়ত আর কখনো তোমার কথা স্মরণ করব না। তোমাকে উদ্দেশ্য করে এটাই আমার প্রথম ও শেষ চিরকুট। এই দেখ সূচনাতেই সমাপ্তি টেনে ফেলছি। যাই হোক মূল প্রসঙ্গে যাচ্ছি। আর একটা কথা, এটা কিন্তু গতানুগতিক ধারার প্রেমপত্র না কিংবা পরীক্ষার খাতায় লেখা চিঠি না। তাই অনিয়ম করেই লিখছি আমি আমার মনের ভাব। কখনো ভুল ধরতে যেও না, আমার আকুল অনুরোধ।
আমাদের পথচলা দু’বছরের মতো ছিল। এর চেয়ে দীর্ঘ আর হওয়া সম্ভব নয়। কেননা আমাদের পথ যে ভিন্ন। আমরা দু’জন দু’মেরুর বাসিন্দা। ভুলবশত প্রেমের মায়ায় আটকে আমাদের পথচলার সূচনা ঘটেছিল হয়ত। কোনো পড়ন্ত বিকেলে তোমার চিহ্ন মুছে ফেলতে গিয়েছিলাম, তবে আমি পারিনি আমার দায়িত্ব পালন করতে বরং তোমার মায়ায় জড়িয়ে ছিলাম আষ্টেপৃষ্টে। আমি জেনে বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। তারই শাস্তি স্বরূপ আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় ভাইজানকে হারাতে হয়েছিল। আর তার মৃত্যুর কারণ কিন্তু এই তুমি। ঘটনাটি জানামাত্র তোমার আর আমার পথ আলাদা হয়ে গিয়েছে। তুমি হয়ত সবটা জানো আর জেনেও না জানার অভিনয় করছ মাত্র। তবে আমি করুণা গ্রহণ করতে অপরাগ। তাই সম্পর্কের মায়াজাল ছিন্ন করছি। ডিভোর্স পেপারে সই করেছি। তুমিও করে নিও। আর এসব থেকে মুক্তি দিও। তোমার দেয়া সিমকার্ড, ফোনসহ সব কিছু রেখে যাচ্ছি। আমার খোঁজ করার চেষ্টা করো না কখনো। আমি আর দেখা দিব না তোমায়।

ভালো থেকো রূপ। নিজের যত্ন নিও। আর সুহানাকে বিয়ে করে ফেলো। তোমার সাফল্য কামনা করি।

ইতি

অকৃতজ্ঞ আমি

বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সযত্নে চিরকুটটি পুনরায় ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল রূপক। রোজ দু’বার নিয়ম করে লেখাগুলো না পড়লে তার দম আটকে আসে। “খুব কী দরকার ছিল দেশপ্রেমিক হওয়ার! অন্য কোনো পেশা কী দেশে ছিল না! কেন আমার জীবনে আজ সে নেই? কেন?” রূপক আক্ষেপের সাথে উচ্চারণ করল। খানিক নিরবতা পালন শেষে আবার বললো, “তুমি অকৃতজ্ঞ নও পাখি, তুমি মোটেও অকৃতজ্ঞ নও। তুমি আমার হৃদয়ের রাজরাণী, আমার হৃদয়ের সারথী।”

নিজেকেই নিজে সাহসের বাণী শুনিয়ে সান্ত্বনা খুঁজে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালালো রূপক। বাইরের দুনিয়ায় নিজেকে অনেক হাসি খুশি হিসেবে প্রমাণ করলেও ভিতরের রূপককে কেউ অনুভব করতে পারে না, কেউ না। সে যেন নিজের প্রকৃত সত্ত্বা আর দুর্বলতা গোপনের মহা কৌশলে বলীয়ান।

৫.

“নুরা’দি তোমার স্বামী আর ছেলে ঘুমিয়েছে?” ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল রুথিলা।

“হ্যাঁ ঘুমিয়েচে।”

“তাহলে তুমি এসো।” রুথিলা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল।

“আইজকে যাব না রে। শরীরের ভেতরে ভালা লাইগছে না। তুয়ার কাম সেরে এসো।” নুরা মারমা চোখ কচলাতে কচলাতে জবাব দিল।

“ঠিক আছে তুমি থাক, আমি আসছি। আজ রাতে আর ফিরব না। তুমি চিন্তা করবে না কিন্তু। ঘুমিয়ে পড়ো।”

“রাগ কইরো না, আসলেই আইজকা রাত জাগার শক্তি নেই। আবার দু’দিন পর যাব কেনে।” অপরাধীর মতো বলল নুরা।

“নাহ রাগ করিনি। তুমি থাক আসছি।” রুথিলা তড়িৎ জবাব দিল।

তারপর আঁধার পথেই বেরিয়ে পড়লো আর মুহূর্তের মাঝে নিকষ কালোতে মিলিয়ে গেল। যতক্ষণ রুথিলার শরীরের প্রতিকৃতি বোঝা যাচ্ছিল ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল নুরা মারমা। অতঃপর রুথিলা আঁধারে মিলিয়ে যেতেই দরজা আটকে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো সে। রোজ রাতে জেগে থাকা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার তাও শীতের মৌসুমে।

রুথিলা পাহাড়ি ঘন জঙ্গল পেরোনোর সময় কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে পিছু ফিরল। তবে সন্দেহজনক কিছু নজরে এল না তার। মনের ভুল ভেবে সামনে অগ্রসর হলো। পুনরায় কিছু ভাববার প্রয়োজন বোধ করল না। কিছুক্ষণ হাঁটবার পর আবারো রুথিলার কানে পদচারণার শব্দ ভেসে এলো। এবার ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল সে। তাই শব্দের উৎসের খোঁজ পাওয়ার জন্য পিছু ফিরতেই হঠাৎ আক্রমণে হকচকিত হয়ে যায় রুথিলা। কিন্তু যতক্ষণে বিষয়টি ঠাওর করলো সে ততক্ষণে কারো বাহুডরে নিজেকে আবদ্ধ হিসেবে আবিষ্কার করল। ঘটনাটি খুব ধীরগতিতে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে জানান দিল। অজানা আতঙ্কে রুথিলার শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। নিজের হাত ছোড়ার চেষ্টা করতেই সে অনুভব করল তার ঘাড়ে কোনো সুক্ষ্ম, সুঁচালো বস্তুর প্রবেশ। তারপর অনুভূতিরাও বিশ্বাস ঘাতকতা করল রুথিলার সাথে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আগন্তকের ওপর নিজের সমস্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিল রুথিলা।

আগন্তক বিজয়ের হাসি হেসে নিজের সাফল্য উৎযাপন করল। আর রুথিলার উদ্দেশ্যে আফসোসের স্বরে বলল,

“তুমি চল ডালে ডালে আর আমি পাতায় পাতায়।”

৬.

বেশ অনেকটা সময় বাক যুদ্ধ চালিয়ে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিল সাগ্রত আর শামীম। কেস নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই তাদের মাঝে তর্কযুদ্ধ, হাতাহাতি, মারামারি সবটাই ঘটে। এতে কেউই তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কিন্তু তবুও তারা নিজেদের মাঝে ঝামেলাতে জড়াবেই।
“স্যার, ভাবী খুব ভালো বিধায় আপনার সাথে সংসার করছে।” চোখ মুখ কুচকে বলল সাগ্রত।

“আমি মানুষটাই ভালো তাই সবাই আমার সাথে মিলেমিশে থাকে।” গর্ব করে বলল শামীম।

“ইশ কত ভালো তা দেখতেই পাচ্ছি। পুরো শরীর জুড়ে ব্যাথা করতেছে। সামান্য ক’টা ঘুসি খেয়েই যেন শরীরের হাড়গুলো গুঁড়ো হয়ে গেছে।” ধীর কণ্ঠে বলল সাগ্রত।

“কিছু বলছিলে কী সাগ্রত! আমার ঘুম পাচ্ছে। আজকে যা ধকল গেল। পুরো বিকেল তো ঘোরাফেরা করতে করতেই কেটে গেল। আহ্ তোমার হাতগুলো বেশি চলে। এখন পুরো শরীর ব্যাথা করছে।”

“আর আপনি বোধহয় দুধে ধোয়া তুলসি পাতা। আপনার হাত কী আবার কম চলেছে?”

“হয়েছে এবার ঘুমাও। মনে রেখো আমি তোমার সিনিয়র।”

“আপনিও মনে রাখবেন আমি জুনিয়র।”

তর্কে তর্কে তাদের নিশি পালিত হলো। তবে তা ক্ষণকালীন, অল্পকাল অতিবাহিত হতেই দু’জনের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এল। আর দু’জনেই তলিয়ে গেলো ঘুমের জগতে। রাতের নীলাচল যেন প্রকৃতির অপার বিস্ময়! ঝিঁঝি পোকার ডাক, মেঘের আনাগোনা, নিস্তব্ধ নীলিমার গহীন কালো দৃষ্টি সব কিছুই যেন বাড়তি সৌন্দর্যের অভয়ারণ্য। যে জন একবার সেই মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, সে জন বারংবার সেই প্রকৃতির টানে ছুটে যায়। সাগ্রত আর শামীম বিভিন্ন সময়ে এই নীলাচলে এসেছে। কখনো প্রাতিষ্ঠানিক কাজে আর কখনো বা প্রকৃতির টানে। এবারে অবশ্য দুটোর জন্যই আসা হয়েছে।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here