১.
“আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। সত্যিই বলছি। এক বিন্দু মিথ্যে নেই।” ক্লান্ত শরীরে, অবচেতন মনে কারো হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়ত ঘটল।
রাতের সমস্ত আঁধার কেটে নতুন ভোরের সূচনা ঘটেছে। তিমির রাতের গ্লানি ঝেড়ে নব্য দিনের সুন্দর সূচনা। বিছানায় আড়মোড়া কাটাতে ব্যস্ত রূপক আহসান। দীর্ঘ কয়েক দিনের কাজের চাপ আর ধকল পেরিয়ে আজকে তার ছুটির দিন। ছুটি কী ঠিক বলা যায়! সে যাই হোক, শহুরে ব্যস্ততা থেকে হয়ত এবার মুক্তি পেতে চলেছে সে। তাই তো গত পরশু যখন সে চাকরি স্থানান্তরের সংবাদ পেল মুহূর্তেই যেন তার চেহারার ক্লান্তি উবে যায়। অবশেষে তার ইচ্ছে আর প্রচেষ্টা তার সফলতা হয়ে ধরা দিল। সচারচর সকালে রূপকের ঘুম না ভাঙলেও আজকের সকালটা যেন একটু অন্যরকম। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশ, ঘন কুয়াশার চাদরে আবৃত একটি সকাল। ব্যস! আর কী প্রয়োজন প্রশান্তি পেতে? সত্যিই কী তাই! বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল সে। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো রূপক। দূর নীলিমায় চোখ বোলালো সে। পাখিদের আনাগোনা দেখতে লাগল সে। চোখ বন্ধ করে সেকেন্ড কয়েক বড়ো করে শ্বাস ছাড়ল সে, তারপর নির্মলচিত্তে পুনরায় শ্বাস গ্রহণ করল। অতঃপর চোখ খুলল রূপক। হঠাৎই একাকিত্বের মরণ ছোবল যেন গ্রাস করল তার হৃদয়কে। মুহূর্তেই বিষণ্ণ চিত্ত আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলল তার উৎফুল্ল মনকে। আজ হয়ত এই প্রকৃতির নির্মল রূপ সে তার প্রেয়সী সান্নিধ্যে কাটাতে পারত। কিন্তু হায়! সুখপাখি যে বড্ড হৃদয়হীনা। পোষ্য মানতে সে যেন বড্ড নারাজ, তাইতো রূপকের দিন কাটে আজ একলা একলা, প্রেয়সী বিনা। চোখের কার্নিশ বেয়ে তপ্ত জলের ফোঁটা গড়িয়ে কপোল স্পর্শ করল। তারপর সে আকাশের পানে চেয়ে বলল,
“তুমি কী আর কখনো আমার জীবনে ফিরে আসবে না!”
তারপর খানিকটা সময় জুড়ে নিরবতার পায়চারি। আবার রূপক মুখ খুলল। সে অজানা শ্রোতার উদ্দেশ্যে পুনরায় বলল,
“তুমি না চাইলেও তোমায় ফিরতে হবেই। আমি জানি তুমি এখানেই আছো। তোমার জন্যই আমি এখানে এসেছি। তোমাকে সাথে নিয়েই আমার পথচলা পুনরায় শুরু হবে।”
রূপকের গলা কেঁপে উঠল। সত্যিই কী সে আছে! নাকি সবটাই কল্পনার প্রভাব। নিজেকে সামলে নিয়ে বারান্দা ছাড়ল সে। নিজের প্রতি বিরক্ত হলো বেজায়। এতো অল্পতেই ভেঙে পড়লে কী চলবে! নিজেকে শক্ত হতে হবে। তবে দিনের শুরুটা তো রোজই ঘটে প্রেয়সীর স্মৃতি হাতরে।
২.
পাহাড়িদের সকাল শুরু হয়েছে ভোরের আলো উঁকি দেয়ার সাথে সাথেই। শীতের সকাল হলেও তাদের মাঝে যেন অলসতার লেশমাত্র নেই। মারমা আদিবাসী নারীরা বেরিয়ে পড়ছে জল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আর পুরুষেরা বেরোচ্ছে তাদের কৃষিভূমির উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কুঁড়েঘর গুলো যেন অন্যরকম সৌন্দর্যের হাতছানি। অবাক বিস্ময়ে কর্মঠ মানুষগুলোকে দেখছে রুথিলা তাবাস্সুম। আদিবাসী বাচ্চারা তাদের নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনায় খেলা করছে। বাচ্চাগুলো আধো বাংলায় কথা বলে, যা শুনতে বেশ লাগে। রুথিলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে পা চালালো। সকালের নাস্তা তৈরি করতে হবে যে!
“এ কি মেইয়ে, তুমি রান্না কইরছো কেনে? আমি আছি তো।” নুরা মারমা চিন্তিত কণ্ঠে বলল।
“দিদি রোজ তো তুমিই করো। আজকে না হয় আমি করি। আমার হাতের রান্না খাবে না বুঝি?” মিষ্টি হেসে বলল রুথিলা।
“আহা তা হবে কেনে? আমি তো তুয়ার কষ্ট হবে ভেবে বলছি।”
“আমার কোনো কষ্ট হবে না। আপনজনের জন্য কিছু করতে পারলে শান্তি লাগে গো দিদি, বড্ড শান্তি লাগে।”
“এককান কতা কই বুবু, মনে কিচু নিও না। তুমি কী আর ফিরবে না তুয়ার সোয়ামীর কাছে?”
“দিদি আমি ভাপা পিঠে আর চিতই পিঠে তৈরি করছি কিন্তু। আর ঘরে তো খেঁজুর গুড় আছেই। যদি চাও তো অন্য কিছু তৈরি করি।” প্রসঙ্গ পাল্টাতে রুথিলা জিজ্ঞেস করল।
“তুয়ার যা খুশি কর। তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নটার উত্তর দিলা না।” নুরা মারমা ধীর কণ্ঠে বলল।
রুথিলা নিঃশব্দে হাসল খানিক। তারপর কাজে মন দিল। আর নুরার দিকে দৃষ্টি ক্ষেপ করল। আর দেখতে পেল নুরা মারমা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। মেয়েটা অবাঙালি হলেও বাঙালিদের মতো অতিথি পরায়ণ। বেশ অনেকটা দিন তাদের সাথে কাটিয়েছে রুথিলা। খুব কাছ থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করার সুযোগও পেয়েছে সে। বিধায় নুরা মারমার স্বভাবের সাথে অনেকটাই পরিচিত হয়েছে সে।
৩.
“কী বলছেন আরো একটা খুন? এবার সবটা অসহ্য লাগছে।” রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন শামীম উদ্দিন।
“স্যার এসব কী নিছকই খুন নাকি অন্য কিছু!” চিন্তিত কণ্ঠে বলল সাগ্রত।
“কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। এসবের সমাধান করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমাদের ডিকেক্টিভ রূপক আহসানের শরণাপন্ন হতে হবে। উনি বোধহয় দু-একদিনের মাঝেই বান্দরবান সদর থানায় আসবেন। ওনার সাহায্য এখন খুবই প্রয়োজন।” এক নিঃশ্বাসে সবটা বললেন শামীম।
“তাহলে তো নিশ্চিত হতেই পারি। তার অনেক সুনাম রয়েছে। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের এই উটকো ঝামেলা থেকে উদ্ধার করবেন।” উৎফুল্ল হয়ে বলল সাগ্রত।
“তা ঠিক তবে আমাদেরকেও তো কিছু ক্লু এগিয়ে রাখতে হবে। নতুবা আমাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তো। আর ভালো লাগে না। বান্দরবানে যখন ট্রান্সফার হয়েছিলাম কতটা খুশি ছিলাম, যে প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করব। অথচ কে জানত প্রকৃতিকন্যা তার কোণায় কোণায় রহস্য লুকিয়ে রেখেছে।”
সাগ্রত মাথা হেলিয়ে শামীমের কথায় সায় দিল। তবে সেও উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে রূপক আহসানের আগমনের। এবার হয়ত সিরিজ খুনের রহস্যজটের মিমাংসা ঘটবে। এই নিয়ে অষ্টম খুনের ঘটনা ঘটল নীলগিরিতে। তবে হত্যাকান্ডের পেছনের কারণ কিংবা কোনো কূলকিনারা উদঘাটন করতে পারছে না কেউ। আর তার চাইতে বড়ো কথা হচ্ছে যে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি এলাকায় একের পর এক খুন করার সাহস কোথায় পাচ্ছে খুনিরা? তবে খুনি নাকি খুনিরা ঠিক কী বলা যায়? এরকম একটা পর্যটন এলাকায় ক্রমাগত খুনের ঘটনা তো কোনো সুখকর কিছু বয়ে আনতে পারে না। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আর সবগুলো খুনের শিকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিশোরী মেয়েরা। অদ্ভুত হলেও সত্য যে হত্যার পর কারোর লাশ অক্ষত ভাবে পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র কাটা মাথা উদ্ধার করা গিয়েছে। তাও চোখ বিহীন লাশ। ভাবা যায় কী বিভৎস! ধারণা করা হয় মেয়েগুলোকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। সে যাই হোক এই নিয়ে আর অযথা মাথা ঘামাতে চাইল না সাগ্রত। তার কপালের রগ উত্তেজনায় দপ দপ করছে। বিগত তিনমাস যাবৎ এসবের কূলকিনারা খুঁজতে গিয়ে তার মাথার ভেতরে যেন সকল ঘটনাগুলো জটলা পাকিয়ে ফেলেছে। এখন প্রয়োজন একটু প্রশান্তি। তাই সে শামীমের উদ্দেশ্যে বলল,
“স্যার চলেন একবেলার জন্য নীলাচল থেকে ঘুরে আসি। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের হাতছানিতে কিছুটা সময় কাটালে হয়ত আমরা খানিকটা স্বাভাবিক চিন্তা ভাবনায় মনোনিবেশ করতে পারব।”
“প্রস্তাবটা মন্দ নয়। আমি তাহলে নীলাচল নীলাম্বরি রিসোর্টে আমাদের থাকার জন্য একটা কটেজ বুকিং করে রাখছি। কেসটার বাকি হিসাব নিকাশ ওখানেই করব না হয়। চল আজকে দুপুরে খেয়েই বেরিয়ে পড়ি। কী বল!” শামীম মুখে বিশাল হাসি ঝুলিয়ে বলল।
“হ্যাঁ স্যার তাই করুন। আর রাতের ডিউটিতে রমিজ স্যার তো থাকবেন। আমরা বরং আজকের রাতটা কাটিয়ে আসি।”
অতঃপর ভাবনা অনুসারে এসআই শামীম ও কনস্টেবল সাগ্রত দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বান্দরবান সদর থেকে নীলাচল নীলাম্বরি রিসোর্টের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। তাদের গন্তব্য এখন টাইগারপাড়ার পাহাড় চূড়া।
~ চলবে ইনশাআল্লাহ ~
#সূচনায়_সমাপ্তি
#সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_নুসরাত_তাবাস্সুম_মিথিলা
[রেসপন্স করার অনুরোধ রইল। ভুলক্রটি মার্জনীয়। কপি করা নিষেধ।]