#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ পাঁচ
যখন মসৃনের দেওয়া ক্ষত সামলাতে ব্যস্ত সুখোবতী তখনই খুবই উপকার করতে উপকারী মন নিয়ে হাজির হয় তার ফুপি লিলুয়া। সুখের ভবিষ্যৎ বাচ্চা আর সুখের কথা ভেবে তার ছেলে রেদোয়ানের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয় লিলুয়া।
সুখোবতীর বাবা মারা গেছে আজ প্রায় একমাস হতে চলল।পরিস্থিতি কিছুটা যখন স্বাভাবিক তখনই সেই স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অস্বাভাবিক করতে হাজির হয় লিলুয়া।
আজ শুক্রবার, সকাল সকাল লিলুয়া হাজির হয় তার ভাইয়ের বাড়ি।সব ভাই আর ভাবীদের একত্র করে ড্রয়িং রুমে আলোচনায় বসে।সেই আলোচনার মধ্যমনি সুখ।কথাবার্তার এক পর্যায়ে লিলুয়া সুখের সৎমায়ের পানে তাকিয়ে বলল
-‘ভাবী আমি একটা আবদার নিয়ে এসেছি।’
সানজিদা বেগম ভ্রু কুঁচকায় কিন্তু একটু পর গদোগদো কন্ঠে বলল
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ লিলু বলো না কী আবদার?’
-‘আসলে ভাবী সুখের তো কপাল টা পুঁড়ালো সেই ছেলে, এখন ওর দায়িত্ব কে নিবে? তাই আমি একটা সমস্যার সমাধান বা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি বললেই হয়।’
বাবার বাড়িতে লিলুয়ার সম্মানও বেশ ভালো কারণ লিলুয়ার স্বামী বেশ সুনামধন্য ব্যবসায়ী, রাজ প্রাসাদের মতন ভীষণ বড় বাড়ি।লিলুয়ার বড় শ্বশুর বাড়ি,লিলুয়াকে বাবার বাড়িতে এত আপ্যায়ন দিতে পেরেছে।আজকাল সমাজটাই এমন।টাকায় সম্মান এনে দেয়,ভালোমানুষির দাম নেই।
সানজিদা বেগম যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতন খবর পেলো।খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললেন
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ লিলু বলো না কী খবর? কী প্রস্তাব?’
-‘আসলে ভাবী আমার ছেলে রেদোয়ানের জন্য আমরা একটা ভালো মেয়ে খুঁজছি আর সুখ যেহেতু আমারই ভাইয়ের মেয়ে আমরা ওকে কাছ থেকে দেখেছি তাই আমি চাচ্ছি আমার ভাইঝিকে আমার বাড়ির বউ করে নিতে।’
লিলুয়া যে এমন প্রস্তাব দিতে পারে উপস্থিত কেউ ভাবতেই পারে নি।আকষ্মিক বজ্রপাত হলো মনেহয়।সানজিদা বেগমের হাসিহাসি মুখ নিকোষ কালো আধাঁরে ছেয়ে গেলো। লিলুয়ার মেঝো ভাই সৈকত ইসলাম অবাক কন্ঠে বলল
-‘তুই কী পাগল হলি লিলু? যদি ভাইয়ের মেয়েকে বউ করে নিতে হয় তাহলে তো আমার মেয়ে শুকতারা আছে, ছোটনের মেয়ে দিপা, লীলাবতী আছে।ওরা তো সুন্দরীও।সুখের কপালে তো কলঙ্কের কালী সেই কালীতে নিজেদের সম্মানও বিভীষিকাময় করে তুলতে চাইছিস? আমরাই তো পারছি না ওকে উগড়ে ফেলতে, গলায় কাটার মতন বিঁধে আছে জেনো। ওর জন্য লজ্জায় বাইরে যেতে পারি না।সবাই ছিঃ ছিঃ করে।’
লিলুয়া নিজের দাদাকে একবার ভালোভাবে পরখ করে বেশ শান্ত স্বরেই বলল
-‘তুমি হয়তো ঠিক আমার কথা বুঝো নি ভাইজান। আমি বলেছি ভালো মেয়ে সুন্দরী মেয়ে না।আর সুখও অবশ্য মাশাল্লাহ। তোমাদের ওগুলো মেয়ে? কথার যা শ্রী এদের বাড়ি নিলে আমাদের পথে বসতে হবে।’
সবাই ই লিলুয়ার কথায় ফুঁশে উঠলো।সানজিদা বেগম রুষ্ট চোখে চেয়ে বলল
-‘নাহ্ লিলু সুখও তোমার ভাইঝি ওরাও তোমার ভাইঝি।তুমি এই কলঙ্কীনি মেয়েকে এত মাথায় তুলছো আর বাকিদের খারাপ বলছো?
-‘ভাবী চাঁদেরও আলো আছে তারাদেরও আলো আছে।তারাদের কিন্তু কলঙ্ক নেই আর চাঁদের কলঙ্কে লেপা তার ঐশ্বর্য তবুও কিন্তু চাঁদ চাঁদই আর তারা তারাই।চাঁদ কেবল একটা আর তারা অগণিত।’
সানজিদা বেগম কতক্ষণ অমত পোষণ করলো।সে এ বিয়ে দিবে না আসলে সুখের জন্য তথাকথিত এত ভালো সম্বন্ধ সে মানতে পারছে না।কোনো রকম ভাবে না পেরে অবশেষে লিলুয়া বললো
-‘ভাবী রেদোয়ানের বাবা বলেছে এই বিয়ের যাবতীয় খরচ তার আর তোমাদেরও যা খরচ হবে তারজন্য আট লাখ টাকা তোমার হাতে সে তুলে দিবে।তোমরা চাইলে এক শুক্রবারে ঘরোয়া ভাবেও এই আয়োজন সেড়ে ফেলতে পারো।’
এবার টাকার কথা শুনে লোভে সানজিদা বেগমের চোখ চকচক করে উঠলো।সে আর এক মুহূর্তও ব্যয় না করে দ্রত গতিতে সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়ে বলল
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি রাজি।আসলে কয়দিন হলো তোমাদের ভাইকে হারিয়েছি এখনই বিয়ের আয়োজনের সামর্থ্য আমার নেই তাই না করছিলাম যেহেতু তোমরাই যাবতীয় খরচ দিবে তাহলে আর আপত্তি করে কী লাভ।’
লিলুয়া বাঁকা হাসলো।কোন রোগের কোন ওষুধ সে জানে তাই সঠিক জায়গায় সঠিক ওষুধটা দিলো।আর আমরণ পাপের বোঝা বহন করার চেয়ে একটু পূণ্য করে যদি সে বোঝা কমানো যায় সেটাও ভালো ।
এর মাঝেই হুলস্থুল কান্ড শুরু হলো।আজই সুখকে আংটি পড়িয়ে যাবেন ফুপি।এসবই এতক্ষণ সুখের অনুপস্থিতিতে হয়েছিলো অবশেষে যখন সুখের প্রয়োজন হলো তখন সুখের দাদীকেই সুখের ফুপি পাঠালো কারণ একমাত্র দাদীই সুখকে রাজি করাতে পারবে।
সুখ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ শেষ করে পড়াশোনা করেছে কিছুক্ষণ তারপর আবার ঘুমিয়েছিলো।দাদী ধীর পায়ে সুখের রুমে গেলো, সুখ তখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো।দাদী সুখের পাশে গিয়ে বসলো।এতটুকু একটা মেয়ে কিন্তু দুনিয়ার সকল কষ্ট জেনো তার পায়ের নিচে অবতীর্ণ হয়েছে। যেনো বিধাতা ঠাট্টার হাসি হেসে বলছে
~”সুখোবতী নারী তুমি
দুঃখ তোমার বাসভূমি।”
দাদী হতাশার শ্বাস ফেলে খুব নরম স্বরে সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকলো
-‘ও সুখোবতী উঠো,বেলা হইলো যে।আকাশ পরিষ্কার হইছে লগে বোধহয় তোমার ভাগ্যও পরিষ্কার হইবো।উঠো।’
দাদীর এমন কথার মানে ঘুমিয়ে থাকা সুখের বোধগম্য হয় না কিন্তু ঘুম ভাঙে ঠিকই। ঘুম ভাঙতেই সে ধড়ফড় করে উঠে বসে।দাদী ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল
-‘ধীরে উইঠো,ভয় পাইছো লাগে? আমি খেয়াল করছি ঘুমাও না রাইতে আবার মাঝে মাঝে ঘুমের মাঝে কেমন জানি করো।’
সদ্য ঘুম থেকে উঠা সুখের মস্তিষ্ক তখনও সচল হয় নি।তাও কতক্ষণ চুপ থেকে মস্তিষ্ক আর চোখের ঘুম কাটিয়ে নিভু নিভু কন্ঠে বলল
-‘বাবার মৃত্যুর পর থেকে ঘুমাতে পারি না দাদীজান মনে হয় কে জেনো ঘুমের মাঝেই মারতে আসতাছে।চোখ মেলে তাকিয়ে থেকেও মানুষ চেনা যাচ্ছে না সেখানে ঘুমিয়ে থাকলে কেউ মেরে ফেলবে এমন ভাবনা আসাটাও স্বাভাবিক। প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করি মরে যাওয়ার কিন্তু সেই প্রার্থনায় বেঁচে থাকার কী যে সুপ্ত আশা।একটু নিজের সুখ নামটার স্বার্থকতা দেখার কী যে তৃষ্ণা দাদীজান।এ জনমে মিটবে তো আমার সেই তৃষ্ণা?’
দাদী সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে দন্তহীন মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল
-‘এইবার তোমার নামের স্বার্থকতা পাইবা সুখোবতী। সময় যে হইলো স্বার্থকতা পাওয়ার।’
সুখ দাদীর কথার সঠিক মানে বুঝে না।প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘কী বলছো দাদীজান? কিসের সময় হয়েছে?’
-‘তোমার সুখ পাওনের সময় হইছে গো সুখোবতী। তোমার জন্য রাজপুত্র আইছে।’
দাদীর কথায় চমকে গেলো সুখ।রাজপুত্র আসছে মানে? সে বিস্ফোরিত নয়নে বলল
-‘রাজপুত্র আসছে মানে? কে আসছে?’
-‘তোমার ফুপির ছেলে রেদোয়ান দাদুভাই তোমার রাজপুত্র গো।উঠো নিচে চলো তোমার ফুপি তোমাকে তার ঘরের বউ কইরা নিয়া যাইবো।উঠো দেখি।’
সুখ যেনো আকাশ থেকে পড়লো।সকাল বেলা সকালে এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলো না সে।শেষমেশ বাঁদড়ের গলায় মুক্তার মালা হবে সে? নাহ্ এ কিছুতেই হতে দিবে না।সুখ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল
-‘নাহ্ দাদীজান এসব কী বলছো! এটা কখনোই হবে না।রেদোয়ান ভাইয়ার সাথে আমি? না না অসম্ভব।’
দাদী মুখ কালো করলো তারপর অসন্তুষ্ট স্বরে বলল
-‘কোনো কিছুই অসম্ভব না।তোমার সবকিছু মাইনা যে তোমারে গ্রহণ করতে চায় তারে মাইনা নেও।জীবন তোমারে ভালো কিছু দিতে চাইতাছে। যাও হাত মুখ ধুইয়া আসো তাড়াতাড়ি।’
সুখ অনড় বসে রইলো।আর যাই হোক রেদোয়ান নামক মানুষটার সাথে সন্ধি সম্ভব না।কোনো একদিন রেদোয়ান ভাই এর ভালোবাসা প্রত্যাখান করেছিলো সে যার তেজ এখনো মিটাচ্ছে রেদোয়ান তাহলে আজ এসব কেন? সেই প্রতিশোধের জন্য নাকি ভালোবাসা টা এ অব্দি আছে বলে?
সুখকে চুপ থাকতে দেখে দাদী নিবিড় স্নেহে নাতনিকে বললেন
-‘সবাই তোমারে ভুইলা নিজের স্বার্থ খুঁজচ্ছে।আমি বুড়িই পারি নাই তোমারে ভুইলা একলা থাকতে।আইজ আছি কাইল নাই,যাওয়ার আগে তোমার পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত কইরা দিতে চাই।এই বুড়ির অনুরোধটা রাখো।তুমি চইলা যাও এ বাড়ি ছাইড়া।দেহো বাইরের আকাশ যেমন স্বচ্ছ হইছে পরিষ্কার একদম, তোমার জীবনও এমন পরিষ্কার আর সুখে ভরপুর হবে।যাও রেডি হও আমি আইতাছি।’
মনোয়ারা বেগম শুষ্ক হাত পা গুটিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন দরজার বাহিরে তখনই সুখ বাহিরে তাকিয়ে দেখে বাহিরের সাদা স্বচ্ছ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেলো,আচমকা ভীষণ বাতাস শুরু হলো,ধূলোবালিতে ভরে উঠলো পুরো ঘর,এসব জানান দিচ্ছে প্রকৃতিতে ঝড় আসার পূর্ব মুহূর্ত। শুধুই কী প্রকৃতির ঝড় আসবে নাকি সুখের জীবনেও আসতে চলেছে নতুন ঝড়?
__________
হাতে একটা ছুড়ি নিয়ে অনবরত একটা ছবির উপর কেউ আঁচড় কাটছে আর পাগলের মতন বিড়বিড় করতে করতে বলছে
-‘আমি ঠকেছি কিন্তু হারবো না।এক বিয়ের আসরে অপমানে জর্জরিত সুখোবতী আবার বিয়ের আসরে বসার আগেই ঝলসে যাবে তার পৃথিবী। তার জন্য আমার সুখের এক অংশ আমি ত্যাগ করবো না।তাতে যাই করা লাগে করবো।
________
অন্যদিকে রেদোয়ান ক্ষীণ স্বরে মাকে প্রশ্ন করলো
-‘আচ্ছা আম্মু, তুমি সুখপখির সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছো কেনো?’
ছেলের প্রশ্নে লিলুয়া আফসোসের শ্বাস ফেলে বলল
-‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য।’
রেদোয়ান অবাক আর চমকে যায়। কিসের পাপের কথা বলছে তার মা?
#চলবে
[মাত্র রহস্য শুরু।ধৈর্য ধরতে পারবে তো পাঠকমহল? ভালোবাসা নিও।]