সুখের অ-সুখ পর্ব-৪

0
1827

#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা

পর্বঃ চার

সুখ কে বাড়ির উঠানে টেনে হাজির করলো তার সৎমা।উনার হাতে সুখের জামাকাপড়ের কালো ব্যাগটা।ভীষণ ক্রোধে ব্যাগটা উঠানের মাঝে ছুঁড়ে মেরে ফেলে চিল্লিয়ে বলল
-‘এখনো কোন আক্কেলে এবাড়ির ভিতর আছিস? কী ভেবেছিস কলঙ্ক নিয়ে এ বাড়িতে থাকবি? কখনোই না।এ বাড়ি থেকে এখনই বের হয়ে যাবি।তোর মতন মেয়েকে এ বাড়িতে এক মুহূর্তেও টিকতে দিবো না।যা বের হ।’

বাড়ি ভর্তি লোক কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।সুখের ফুপি কতক্ষণ চেষ্টা করেছিলো এই মহিলাকে থামানোর কিন্তু কোনো লাভ হলো না। সুখ মাথা নিচু করে কেবল দাঁড়িয়ে আছে।আজ সুখ কাঁদছে না।

সুখকে চুপ থাকতে দেখে দ্বিগুণ ক্রোধে তার সৎমা ধাক্কা দিয়ে উঠোনে ফেলে দেয়।রেদোয়ান নামের ছেলাটা আৎকে উঠে বলে
-‘কী করছে মামী? সুখ কিন্তু এখন একা না,ওর বাচ্চার যদি ক্ষতি হয়ে যায় তখন কী হবে?’

সুখ অবাক চোখে তাকায় রেদোয়ানের দিকে।সুখকে তাকাতে দেখেই রেদোয়ান বাঁকা হাসি দিলো।সুখ বুঝলো আসলে রেদোয়ান এমন মিষ্টি ভাষায় আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করলো কেবল।

সুখের বৃদ্ধা দাদী সুখের কাছে গিয়ে সুখকে ধরে উঠায়।নরম কন্ঠে বলে
-‘বাপ মা হারা মাইয়াটা কোথায় যাইবো বউ? তুমিই তো তার আশ্রয়।’

শাশুড়ির সুখের হয়ে পক্ষপাতিত্ব পছন্দ করলো না সানজিদা বেগম। রেগে গিয়ে বলল
-‘আপনার তো এক পা কবরে গেলো আম্মা,এমন পাপীর হয়ে কীভাবে কথা বলছেন? পরকালের ভয় নেই? পাপীর হয়ে কথা বললে আপনিও পাপী হবেন।একটু তো ভয় করেন পাপের সঙ্গ ছাড়েন,পাপের মুখে থুথু ফেলেন।’

বৃদ্ধা মনোয়ারা বেগম পড়নের সাদা থান কাপড়টার আঁচলটা টেনে হাসি মুখে বলল
-‘তাহলে প্রথম থু টা তোমার মুখেই মারি বউমা? তোমার সঙ্গ দেওয়ার মতন পাপ এ দুনিয়ায় আর নাই।’

ফুঁশে উঠলো সানজিদা বেগম শাশুড়ির দিকে তেড়ে গিয়ে শাশুড়ির বাহু ধাক্কা দিয়ে বলল
-‘বাহ্ বুড়ি মহিলা আমার টা খেয়েই আমাকেই পাপ বলছেন? আপনিও বের হন বাড়ি থেকে।এই বাড়িতে আপনার ঠাঁই নেই?’

-‘এ বাড়ি থেকে যদি কাউকে বের হতে হয় তাহলে সবার প্রথমে আপনি বের হবেন।’

সুখের এহেন কথায় আকাশ থেকে জেনো পড়ে সানজিদা বেগম। শুধু সানজিদা বেগম না উপস্থিত সবাই ই আকাশ থেকে পড়লো জেনো।সেখানে সুখের দুই চাচা, চাচী আর চাচাতো ভাইবোনও উপস্থিত ছিলো কিন্তু সানজিদা বেগমের এহেন আচরণে কোনো প্রতিবাদ করলো না।কিন্তু সুখের তেজী রুপ তাদেরকেও৷ অবাক করেছে।

সানজিদা বেগম অবাক কন্ঠে বলল
-‘এই এই তোর মুখে বুলি ফুটেছে বেশি? আমি বাড়ি থেকে বের হবো মানে? বেশি সাহস হয়েছে তোর?’
-‘আপনি বাড়ি থেকে কেনো বের হবেন সেটা আশাকরি বুঝতে পেরেছেন,আমি নাহয় খুলে নাই বললাম।আর এ মানুষটাকে বের হতে বলছেন কোন সাহসে? এ বাড়ি উনার ছেলের আপনি বের হতে বলার কে?’

সুখের তেজী কন্ঠে থতমত খেয়ে গেলো উপস্থিত সবাই।সানজিদা বেগম আমতা-আমতা স্বরে বলল
-‘কী বলছিস তুই? পাগল হলি নাকি? এই তোর লজ্জা নেই তাই না? বাপ হীন বাচ্চা গর্ভে নিয়ে ঘুরছিস আবার বড় বড় কথা বলছিস, এ লজ্জায় মরা উচিৎ তোর।গলায় দঁড়ি দে।’

বৃদ্ধ মনোয়ারা ছেলের বউয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললেন
-‘যে সত্যিকার অর্থে কলঙ্কীনি সে গলায় দড়ি দিলে খুশি হবে তো বউমা?’

সানজিদা অটল কন্ঠে বলল
-‘হ্যাঁ অনেক খুশি হবো।’

মনোয়ারা এবার লীলার দিকে তাকিয়ে দন্তহীন মুখে মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বলল
-‘লীলাবতী তোর মা কী বলেছে শুনেছিস?’

লীলাবতী আকষ্মিক নিজের নাম শুনে চমকে উঠে। তাড়াতাড়ি চলে যায় নিজের রুমে।একে একে সবাই নিজের নিজের ঘরে চলে গেলো,সানজিদা বেগম কিছু না করতে পেরে নিজেও ঘরে চলে গেলো।আপদ বিদেয় করতে না পারার দুঃখে সানজিদা বেগম ফুশঁ ফুঁশ করতে ঘরে চলে গেলেন।

দাদী আফসোসের শ্বাস ফেলে বলল
-‘দেখলা সুখোবতী আমার মাইয়া পোলার কাহিনী? তাগো সামনে তাদের মারে এত অপমান করলো একটা মানুষ একটা কুলাঙ্গারও মুখ খুললো না।মুখ খুললে যদি আমার খাওয়ানোর দায়িত্ব তাদের উপর পরতো সেই ভয়ে।এগুলা আমার গর্ভের কলঙ্ক। বাপের রক্ত শরীরে আছে তো।বুঝলা সুখোবতী “বৃদ্ধা নামক সময়টা জীবনের আরেকটা অপরাধ”। পৃথিবীতে সব মানুষ জেনো বৃদ্ধ হওয়ার আগে মইরা যায়।বাইচ্চা থাইকা মরার চেয়ে একবারে মরা ভালো।বৃদ্ধরা তো অহন কুত্তার আসনও পায় না।বয়স্ক মানুষ মরলে তার পরিবার বাইচ্চা যায়।এ হইলো যুগ।’

সুখ দাদীকে জাপ্টে ধরে।দাদীজান সুখের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
-‘কিগো মেয়ে,স্রোতের বিপরীতে গাঁ ভাসানো শুরু করে দিয়েছো?’

সুখ টলমলে চোখে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘দেখিনা একবার বিপরীতে গিয়ে, হয় অতলে তলিয়ে যাবো নাহয় রাজা হবো।’

দাদী হেসে দেয়।মেয়েটা যে এত সহজে শক্ত হবে ভাবতে পারে নি সে।
—–

অন্ধকার রুমে বসে লীলাবতী কারো সাথে ফোনে বাক বিতর্কে যুক্ত।করুন স্বরে লীলাবতী বলছে
-‘আমর বাচ্চার দায়িত্ব তুমি নিবে না? তুমি কী তাকে স্বীকার করবে না?’

অপরপাশের মানুষটি বাঁকা হেসে বলল
-‘হ্যাঁ স্বীকার করবো আগে যা বলেছি তা করো।’

লীলাবতী কেঁদে দিয়ে বলল
-‘জানো তোমার কথায় ভালোর অভিনয় করতে গিয়ে দেখলাম ভালো হয়ে বাঁচার মাঝে কী তৃপ্তি।ইশ,কেনো যে ভালো হলাম না।খারাপ হয়ে যুগ যুগ বাঁচার চেয়ে ভালো হয়ে একদিন বাঁচার মাঝে রাজ্যের তৃপ্ততা।’

অপরপাশের মানুষটা বিরক্ত স্বরে বলল
-‘তাহলে তুমি ভালো সাজো আর তোমার বাচ্চা নাজায়েজ পরিচয় পাক।’

লীলাবতী আৎকে উঠে বলল
-‘না না তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।’

অপরপাশের মানুষটা উচ্চস্বরে হেসে বলল
-‘এই না হলো রঙলীলা।মাই জান।’

লীলা ফোনটা কেটে নিজের পেটের মাঝে হাত বুলিয়ে ছোট্ট প্রাণটাকে বলল
-‘তুই পাপের ফল হয়ে আসবি না কথা দিলাম।দরকার হয় আমি আরও পাপ করবো।’

______

সুখ উত্তপ্ত রোদে হেঁটে যাচ্ছে।বাবার মৃত্যুর পর এ অব্দি ভার্সিটির চত্তরে পা রাখে নি সে।আজ চারটা দিন পর বাহিরের সূর্যের উত্তপতা পেলো।কলেজ থেকে সুখ যাবে মসৃনের মেসে।যেভাবেই হোক লীলাবতীর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

নিজেদের এলাকার লোকজন কেমন বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সুখের দিকে,সবাই হয়তো ভাবছে এই নির্লজ্জ মেয়ে কীভাবে এই মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হঠাৎই রোদ্র তপ্ত আকাশ ভেঙে কালো মেঘ হানা দিলো।সুখ দ্রুত বড় রাস্তায় উঠে গেলো।টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।সুখ কোনো রকম একটা সিএনজি থামিয়ে উঠে গেলো দ্রুত।সিএনজিতে উঠতেই পাশে তাকাতে চমকে উঠে সুখ।তার পাশেই এক ভদ্র লোক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুখের পানে।সুখও থতমত খেয়ে গেলো।ব্যতিব্যস্ত স্বরে বলল
-‘দুঃখীত দুঃখীত আপনাকে খেয়াল না করেই উঠে গেছি।আমি নেমে যাচ্ছি।’

সুখের কথা থামতেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো।সুখ আকষ্মিক আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে আহাম্মক হয়ে গেলো।সিএনজিতে থাকা লোকটা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।সুখ ঘুরে তাকালো।লোকটা হাসি থামিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বলল
-‘দুঃখীত দুঃখীত আমি হাসতে চাই নি।আসলে সমস্যা নাই আমার সাথে আপনি যেতে পারেন।আমারও গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে সিএনজি দিয়ে যাচ্ছি।’

সুখ কোনো উপায় না পেয়ে শেষমেশ রাজি হলো অপরিচিত লোকটার সাথে যেতে।নিজের কলেজের ঠিকানা দিতেই সিএনজি ছুট লাগালো নিজের গতিতে। সুখকে এক অস্বস্তিতে ঘিরে ধরলো।কোনো রকম বসে রইলো সিএনজির এক কোণায়। কোনো মতে রাস্তা টা শেষ হলে সে বাঁচে।

________

-‘মসৃন তো এখান থেকে চলে গেছে সেই কবে। এখানে তো ও থাকে না।’

সুখ অবাক হয়।মসৃন যে ফ্লাটে থাকতো কলেজ শেষে সেইখানেই এসেছিলো মসৃনের খোঁজে তখনই রুমমেট এই খবর জানালো।সুখ আবার জিজ্ঞেস করলো
-‘আচ্ছা মসৃন কোথায় থাকতো গ্রামের বাড়ি কই কিছু জানেন?’

রুমমেট ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘না তেমন কিছু তো জানিনা।আমাদের এক বড় ভাই দু’মাস আগে মসৃনকে আমাদের বাসায় দিয়ে যায়। তারপর ছেলেটা তত মিশুক না তাই কিছু জানতেও পারি নি।’

সুখ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে।দু’মাস আগেই মসৃনের সাথে তাদের আলাপ হয়েছিলো।সব তাহলে প্ল্যান মাফিকই ছিলো।সুখ আবার জিজ্ঞেস করলো
-‘আচ্ছা আপনার ঐ বড় ভাইয়ের ঠিকানা দেন বা ফোন নাম্বার আমি যোগাযোগ করতাম।’

এবারও ছেলাটা নম্র স্বরে বলল
-‘না আপু বড় ভাইয়া এখন দেশে নেই যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই।সে বাহিরের দেশে গেছে।সে দেশে আসলেই আপনার সাথে যোগাযোগ করতে বলবো।’

সুখ আর কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই রুমমেটের ছেলেটা ডাক দিয়ে বলল
-‘আপু মসৃনকে আমি এতটা খারাপ ভাবতে পারি নি।মানুষ চেনা সত্যিই কঠিন।আপনার সাথে ও কাজটা ভালো করে নি।বিয়েটা ভেঙে ও কাপুরুষের পরিচয় দিলো।’

সুখ আর কিছু বলে নি।চুপচাপ বের হয়ে গেলো।কিছু না করেও আজ তার দারুণ বদনাম চারপাশে। উপরওয়ালার দুনিয়াতে সত্যি প্রকাশ পাই ই একদিন কেবল ধৈর্য ধরতে হবে।

একদিকে একজন সুখের ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠলো,একদিকে একজন সুখকে ধোঁকা দিয়ে দিব্যি সুখেই আছে হয়তো,আরেকদিকে একজন প্রভাতে বৃষ্টিতে ভেজা এক অপরিচিতার মুগ্ধতায় হারিয়ে গেলো।আর হাজারো গোপন তথ্য লুকিয়ে আছে সুখের আড়ালে।সুখের অতীতটা সত্যিই কী শক্ত অতীত না সবটাই কেবল মিথ্যে ঘেরা?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here