#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ চব্বিশ
লীলাবতী রেদোয়ান’কে এত নৃশংস ভাবে খুন করেছে এটা ভাবতেই সবার শরীরে’র রক্ত হিম শীতল হয়ে যাচ্ছে। সানজিদা বেগম মেয়ের ডান গালে শক্ত এক চড় বসালেন। বাহু ঝাঁকিয়ে বেশ রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
-‘যখন যা ইচ্ছে তখন তা করছো, তা-ই বলছো! কী ভেবেছো তুমি! মহান সাজতে আসছো! খুনের দায় নিজের ঘাঁড়ে নিয়ে মহান’তা দেখাচ্ছো?’
-‘মহান’তা না মা, কেবল সত্যি টা বলেছি। খুনটা আমি’ই করেছি।’
আবার পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। সুখ অস্থিরতাময় কণ্ঠে নিজের বোন’কে শুধালো,
-‘সত্যিই তুই এটা করেছিস! কিন্তু কেনো লীলা?’
-‘কারণ দাদী সবসময়ই বলতো, “অসৎ পুরুষের বেঁচে থাকা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়”।
লীলাবতী’র এহেন কাটখোট্টা জবাবে সবাই হতবাক। পুলিশ অফিসার বেশ শান্ত স্বরে বললো,
-‘রেদোয়ান অসৎ পুরুষ ছিলো! কী করেছে সে?’
-‘কী করে নি সে, সেটা বলুন! এইযে আমার ছ’মাসের উঁচু পেটটা দেখছেন, সেটাও তার কৃতিত্ব।’
লীলাবতী’র কণ্ঠ স্থল থেকে উচ্চারিত প্রতিটা কথা জেনো একেক টা পারমাণবিক বোমা’র মতন শব্দ করে বিস্ফোরিত হচ্ছে।
সানজিদা বেগম নিজের মেয়ে’কে টেনে তার দিকে ঘুরান। বিষ্মিত, হতবাক দৃষ্টি জোড়া মেয়ের দিকে নিবদ্ধ করে থম মেরে যাওয়া কণ্ঠে বলে,
-‘পাগল হলি লীলা? একের পর এক, এসব কী বলছিস? মাথা খারাপ তোর?’
-‘না মা, আমার মাথা খারাপ না। তবে মস্তিষ্কের আগা গোঢ়া পুরোটাই নষ্ট হয়েছে, ঘূণে ধরেছে। সাথে শরীরটার ভিতরে লাল বর্ণা হৃদপিণ্ডটাতেও ভীষণ বড় ক্ষত হয়েছে। এবার আমাকে আমার পুরোটা দোষ স্বীকার করতে দেও? আমি সবটা খুলে বলি!’
সানজিদা বেগম ভাষাহীন, শব্দহীন হয়ে যায়। আজ তার অনেক কিছু বলার থাকলেও কেবল চুপ রয়। কী’ই বা বলবে! এত বছর তো অনেক কিছু বলেছে। এবার চুপ করার পালা। চুপ করতে হবে। একটা কথা আছে না! সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেন না।
লীলাবতী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। তার দেহের ভিতর থাকা ছোট্ট প্রাণটা’কে একটু ছুয়ে দিলো চামড়া’র উপর দিয়ে। কিছুটা সময় চুপ করে রইল। চোখের কার্নিশ ঘেষে গড়িয়ে পড়লো কয়েক বিন্দু অশ্রুকণা। তপ্ত শ্বাস ফেলে সেই অশ্রুকণা’কে বোধহয় একটু বারণ করলো অসময়ে না গড়ানোর জন্য। নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
-‘রেদোয়ান ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় বছর খানেক গড়াবে। আপাই রেদোয়ান ভাই’কে ততটা পছন্দ করতো না। আমিও আপাই’কে ততটা পছন্দ করতাম না, তাই আমার পছন্দের তালিকায় যুক্ত হলো রেদোয়ান ভাই। প্রথমে তার সাথে গড়ে উঠলো আমার মনের সম্পর্ক আর সেটা গিয়ে থামলো সর্বনাশ অব্দি। চোখের সামনে রঙিন দুনিয়ায় এই মানুষটা’কে ভীষণ রঙিন লেগেছিলো। আপু’র প্রতি তার বিদ্বেষ আমাকে তার প্রতি আরো কয়েক দাপ ভালো লাগা সৃষ্টি করে দিয়েছিলো কারণ আপুকে আমারও পছন্দ ছিলো না। আমার কল্পনার অসাধারণ পুরুষটি হঠাৎ অতি নগন্য কাপুরুষে পরিণত হলো। বাবার মৃত্যুর দিন আমি জানতে পারি আমার শরীরে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব। যখন ঐ মানুষটা’কে জানালাম তখন সে খেললো নোংরা খেলা। হ্যাঁ, তার কথা’ই আমি আপাই’কে বলেছিলাম এ সন্তানের বাবা সে না আপুর হবু স্বামী। জেনো আপু অনেক ভেঙে যায় তাই তার এ প্ল্যান। আমিও তখন স্বার্থে অন্ধ হয়ে একাজ টাই করলাম। তারপর তার কথা’ই বাড়িতে রটালাম আপু প্রেগন্যান্ট। সবটা ঠিকই ছিলো। সে বলেছিলো তার কথা শুনলেই একমাত্র সে আমাকে বিয়ে করবে৷ আমিও সবটা করলাম। ততদিনে আমার আপুর প্রতি যে মিছে অপছন্দের দেয়ালটা ছিলো তা খসে পড়ে গেলো। তবুও সন্তানের জন্য তো মায়েদে’র কত কিছুই করতে হয়।
কিন্তু, আমার সবটা সাজানো দুনিয়াকে একবারে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সেদিন ফুপি আপুকে বউ বানানোর প্রস্তাব দিলো। ভেঙে গেলাম আমি। যতটা ভেঙে গেলে একটা গাছ আর বড় হয় না। তার কাছে যখন জবাব চাইতে গেলাম সে বাঁকা হেসে বললো, সবটাই তার খেলা। আপু’কে সে বিক্রি করে দিবে চওড়া দামে। আর আমি যদি তিড়িংবিড়িং করি তবে পতিতা’র খাতায় যুক্ত হবে আরেকটা নামও। সেদিন ঘিন ঘিন করে উঠলো শরীরটা। কার রক্ত আমি গর্ভে ধরে বড় করছি! একটা নর্দমার কীট সে।
নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু এই অদম্য ইচ্ছে টাকে গলাচাপা দিয়ে মেরে ফেললাম দাদী’র মতন তেজী মানুষের কথায়। নাহ্, আমি কেনো মরবো! মরতে হলে সে মরবে। নিজের মতন সাজিয়ে নিলাম সবটা প্ল্যান। বিয়ের দিন কারেন্টের সুইচ বন্ধ করে আমিই কোপ দিয়ে ফেলে দিলাম তার গলা। কতটা ঘৃণা জমলে এতটা নৃশংসতা জন্মেছিলো ভাবো এবার! ভেবেছিলাম লুকিয়ে ফেলবো এ খুনের কথা কিন্তু পারলাম না। কারণ আমার জন্য আবারও আমার আপার ক্ষতি হবে তা আমি চাই নি।”
কারো মুখে টু শব্দও নেই। কেবল ফোঁপানোর শব্দ আসছে। সানজিদা বেগম মেয়ের এমন আধাঁর ভবিষ্যৎ দেখে ফুপিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ অফিসার মহিলা কনস্টেবল’কে ইশারা করতেই সে সামনে এসে দাঁড়ালো।
অফিসার গলা পরিষ্কার করে বললো,
-‘আমারও তোমার উপর সন্দেহ হয়েছিলো। যদিও বা মেঘ রেদোয়ানের নারী পাচারের কথা জানতো কিন্তু সন্দেহটা তোমার উপর হয়েছিলো। খুনের পরে একমাত্র আমি তোমার চোখে কোনো কান্না,ভয় কিছু দেখি নি। খুব সাধারণ ভাবেই তোমার চলাফেরা ছিলো। সবার শেষে তুমিই নাকি রুম থেকে বের হয়েছিলে। পাড়ার কোণার দোকান থেকে একটা রামদা অনেক শান দিয়ে এনে ছিলে নাকি তুমি। একে একে সব হিসেব দুই করলাম। মেঘ জানালো সে নারী পাচারের কথাটা জেনেছিলো বিয়ের দিন। কিন্তু সে বলার আগেই এত কিছু হয়ে গিয়েছিলো। সুখোবতী ভেঙে পড়বে দেখে সে আর কাউকে এটা জানায় না। তারপর সব রহস্য ঘুরে তোমার দিকে আসলো। শেষমেশ তোমার কল হিস্টোরি দেখে সন্দেহ পরিষ্কার হলো। তোমার মুখ থেকে স্বীকার করানোর জন্য’ই একটু অন্য রকম ভাবে প্ল্যান করলাম।’
লীলাবতী নিরবে হাসে কিন্তু কোনো প্রতিত্তোর করে না। নিজের মায়ের কাছে গিয়ে করুণ স্বরে বললো,
-‘মা, বাঁচতে হলে অনেক কারণ লাগে। আমারও সেই অনেক কারণ আছে। এই যে আমার গর্ভের সন্তানটা আমার বাঁচার কারণ। তোমাকে একদিন বলেছিলাম তুমি মা হতে পারো নি। কিন্তু যখন তুমি সব ভুলে আপা’কে বুকে টেনে নিলে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তুমি মা হয়ে উঠেছো। কেঁদো না মা। তোমাকে দেখার লোকের অভাব নেই। যাকে একদিন তুমি দেখতে পারো নি, আশা রাখো সে’ই তোমাকে দেখবে।’
সানজিদা বেগমের কান্নার গতি আরও বাড়লো। লীলাবতী ধীর গতিতে সুখের কাছে যায়। সুখ তখন নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত। লীলাবতী সুখের হাত’টা নিজের পেটের মাঝে রাখে। আদুরে স্বরে পেটের দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘এই যে বাবু,এটা তোর মা। মনে রাখিস তুই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বাচ্চা। কারণ তোর মা এই যে এই নিঃস্বার্থ মানুষটা। আপা,রাখবে না আমার সন্তানটা’কে তোমার কাছে! এই হতবাগা মেয়েটা’র কথাটা রেখো।’
সুখ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে। তাকে বাঁচানোর জন্য সবার এত বিসর্জন, কীভাবে সে শোধ করবে এ ঋণ! সুখ বোনকে শক্ত করে জাপ্টে ধরলো। লীলাবতীও কেঁদে দিলো। এই ছোট্ট মেয়েটা হঠাৎ করে কতটা বড় হয়ে গেলো!
নিয়ে যাওয়া হলো অষ্টাদশী’র মৃত মনের মেয়েটাকে। যার আবেগের বশে করা একটা ভুল মানুষকে বেছে নেওয়া তার সুন্দর জীবন’কে কেড়ে নিলো। কারো খারাপ করে আদৌও কেউ ভালো থাকতে পারে! তাই হয়তো ভালো থাকতে পারলো না লীলাবতী।
লীলাবতী’র সাথে সাথে শেষ হলো এই বাড়ির সকল রহস্য। বিচ্ছিন্ন হলো ক্ষীণ যোগাযোগ। সানজিদা বেগম স্বামী’র শেষ আশ্রয়টা’কে বেছে নিলেন নিজের ঠিকানা হিসেবে।
—–
বাবা’র বাড়ি থেকে ইউসুফে’র সাথে ঘরে ফিরিছে সুখ। আজ মেঘ একটু ছোট মায়ের কাছে যাবে। টানা এতদিনের অশান্তি প্রতিটি মানুষ’কে ধ্বংস করে দিলো।
রুমে ঢুকতেই সোফায় বসে থাকা মানুষটা’কে দেখে তাজ্জব বনে গেলো সুখ। অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে আসলো,
-“ধীশক্তি!”
সোফায় থাকা মানুষটাও সুখ’কে দেখে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘আরে সুখোবতী! আপনি এখানে! আপনিও কী মেঘের কাছে এসেছেন! আমিও আপনার ব্যাপারে আলাপ করতেই এসেছিলাম।’
ইউসুফ অবাকে হা হয়ে যায়। অবাক কণ্ঠেই বলে,
-‘মানে! শক্তি ভাইয়া, আপনি ভাবী’কে চেনেন! উনার ব্যাপারে কী কথা বলবেন!’
ধীশক্তি নামের ভদ্র লোক জেনো বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
-‘ভাবী!’
-‘হ্যাঁ ভাবী। মেঘ ভাইয়ার ওয়াইফ।’
ইউসুফের কথায় ভদ্র লোকের জন্য বোধগম্য হলো না কিছু। সে সুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো বিষ্ময়ে আকাশ পানে তুলে বলে,
-‘বিহঙ্গের ব্যাপারটা জেনেই কী মেঘ আপনাকে বিয়ে করেছে? শুনেছি বিহঙ্গ নাকি আর বেঁচে নেই সাথে আন্টি আর বিহঙ্গ বাবাও! হয়তো এ জন্যই বিয়েটা করেছে আপনাকে মেঘ, ছোট ভাইয়ের ক্ষতিপূরণ করতে!’
#চলবে
[মাঝ রাতে বা কাল সকালের মাঝেই আরেকটা পর্ব পেয়ে যাবেন। পুরোটা দিলে অনেক বড় হয়ে যাচ্ছিলো তাই বাকিটুকু পরে দিবো।]