#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ ষোলো
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি নিষেধ)
বর্ষার মৌসুম, ঝড় বৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে ঢাকার মতন শহরে কারেন্ট চলে গিয়ে আধাঁরে ডুবে যাওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক লাগলো সুখের। এই দেশের রাজধানী, ঢাকা। যা অধিক জনসংখ্যার শহর এবং উন্নতও,কিন্তু সেখানে এমন অনুন্নত ঘটনায় বেশ অবাক সুখ। বাথরুম’টা যেনো ভয়ঙ্কর আধাঁরে নিমজ্জিত হলো। নতুন জায়গা,নতুন পরিবেশ, পুরোনো শত্রু- একটু ভয় হওয়াটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু ততক্ষণে ঝর্ণার পানিতে সে ভিজে গেছে অনেকটা। বাহিরে গিয়ে দাঁড়ানোরও উপায় নেই। রুমে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া গেলো,এতে ভয়টা দ্বিগুণ হলো সুখের ৷ মানুষটা মসৃন নয়তো?
সুখ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন তুললো,
-‘কে আছে বাহিরে?’
বিপরীত দিক থেকে কোনো উত্তর আসলো না। সুখ বুঝলো ঝর্ণার শব্দ, বাহিরের তুমুল বর্ষণ ছাপিয়ে তার কথা হয়তো বিপরীতে থাকা ব্যাক্তির কর্ণগোচর হলো। সুখ গলার স্বর আরেকটু উঁচুতে তুলল,ভয়ে ভয়ে বলল,
-‘বাহিরে কী কেউ আছেন?’
তবুও কোনো আশানুরূপ সাড়া পেলো না সুখ। মনে মনে ভয়টা প্রকোপ হলো। মেঘ হলে এতক্ষণে সাড়া দিতো। সুখের মনের ভয়টা আরও গাঢ়ো হলো যখন বারান্দার দরজাটা ঠাস করে শব্দ হলো। সুখ আর টিকতে পারলো না নিকষ,কালো আধাঁরে। কোনোরকমে বাথরুমের ছিটকিনি টা খুলেই বাহিরে এলো। এতটুকু সময়েই যেনো ভীষণ ঘামিয়ে গেলো, হাপিয়ে উঠলো পুরো শরীর।
সুখের শরীর তড়তড় করে কাঁপছে। বারান্দায় কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে সে কোনোরকম অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলো,
-‘মেঘ সাহেব হ্যাল্প মি। আ’ম এফরেইড। মেঘ সাহেব প্লিজ কাম। প্লিজ।’
তুমুল ঝড় হচ্ছিলো বিধায় মেঘ নিজের ঘরের চারা গাছ গুলো বারান্দার তাক থেকে নামিয়ে নিচে রাখতে এসেছিলো যেনো বাতাসে পরে ভেঙে না যায়। হঠাৎ রিনরিনে মেয়েলী কন্ঠ ভেসে আসে রুম থেকে। পরিচিত কন্ঠ। অপরিচিতার আতঙ্ক বিরাজিত স্বর এটা। মেঘ এক মুহূর্ত সময় অপচয় না করে দ্রুত রুমে প্রবেশ করলো। রুমে ঢুকতেই ওয়াশরুমের পাশে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখলে এক সিক্ত নারী দেহ’কে। দু’হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছে তার ছোট্ট মুখমন্ডল। দেহভঙ্গি বলে দিচ্ছে রমনী বেশ ভীত।
মেঘ এগিয়ে গেলো, নিজের পুরুষালী সুঠাম ডান হাতটা দিয়ে আশ্বাসের ছোঁয়া দেয় সুখের বাহুতে। সুখ আরও আৎকে উঠে। কেঁপে উঠে আরও বেশি। চিৎকারের আগেই মেঘ আশ্বাসের স্বরে বলে,
-‘কাম অন অপরিচিতা, ইট’স মি। মেঘ সাহেব। ওপেন ইউ’র আই’স। কুল ডাউন।’
রমনী’র কম্পিত শরীর থেমে যায়। বিশ্বাসের হাত’টা পেয়ে বোধহয় ভয় গুলো গুটিয়ে যায়। মুখ থেকে হাতটা সরায়। কাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে দেহ জুড়ায়। শরীরটাকে স্বাভাবিক করার জন্য উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে পুরুষটিকে। বাহিরে ভারী বর্ষণ। রুমের এক কোনায় বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে খুব স্বল্প আলো নিয়ে টিকে থাকা মোমবাতি আর প্রেমিক পুরুষের বুকের বা’পাশে তার সাত জন্মের প্রেয়সী। মাটির থেকে উঠে আসা ভেজা স্নিগ্ধ ঘ্রাণ,বারান্দায় দুষ্টু বেলীর মোহনীয় সুভাস, আর বাতায়নের (জানালা) ফাঁকা দিয়ে শুভ্র রাঙা অবগুন্ঠন (পর্দা) গুলো উড়িয়ে শীতল বাতাস’টা পরিবেশ’কে করেছে মোহনীয়। মনের সুপ্ত কোণে এক গুপ্ত ইচ্ছের উদয় হয় প্রেমিক পুরুষের। সিক্ত তার অপরিচিতার কোমলতায় তার প্রেমিক হওয়ার লুকায়িত গুন গুলো বের করতে চাচ্ছে।
এক, দুই, তিন মিনিট করে অতিবাহিত হলো নিরব,মোহনীয় কিছু সময়। অপরিচিতা এখন কিছুটা নিজেকে ধাতস্থ করেছে। প্রেমিক পুরুষ সংযত করেছে নিজেকে। রমনী তো তারই,গুপ্ত ইচ্ছে গুলো একদিন পূর্ণতা পাবে প্রকৃতির সাথে সাথে রমনীর সম্মতিতে।
নিরবতা ভেঙে শীতল কন্ঠে মেঘ বলল,
-‘অপরিচিতা! ভয় পেয়েছিলেন? এইতো,আমি এখানে। উঠুন তো একটু,ভেজা শরীরে আছেন ঠান্ডা লাগবে। উঠুন। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি,আপনি ভিতরে গিয়ে জামা কাপড় বদলে আসুন।’
সুখের মস্তিষ্কের নিউরন গুলো হঠাৎ করে সজাগ হলো। মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার লজ্জাহীন কার্যের কথা। ভয় পেয়ে মাথার ভেতর যে ভয়ানক কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিলো, তার’ই প্রমাণ হিসেবে সে এই পুরুষটার বুকে।
সুখ তড়িঘড়ি করে সড়ে যায়। শাড়ি’টা ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। আশ্চার্যজনক ভাবে হলেও এটাই সত্যি যে,এখন আর তার ভয় লাগছে না। সুখের মস্তিষ্ক রসিকতা করে বলে উঠলো যেনো- ওগো সুখপাখি, তোর বুঝি নির্লজ্জতার বাঁধ ভেঙেছে? এ আবার কেমন ভয় রে! উষ্ণ আলিঙ্গনে উধাও হয়ে যায়? নাকি সব আলিঙ্গনের বাহানা?
সুখ চোখ বড়বড় করে তাকায়। তার মন’টা ভীষণ বাজে বকছে আজকাল। ভীষণ ভাবে শাসায় তার মনকে। সে কী আজগুবি কান্ড করছে আজকাল? পাগল হলো না তো?
মেঘ গোপনে হাসে কিন্তু বুঝতে দেয় না সুখকে। মেয়েটা যদি অতি লজ্জায় তার সাথে পরে কথা না বলে তখন কী হবে?
মেঘ উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
-‘হয়েছে আপনার ভাবনাচিন্তা? হয়ে থাকলে তাড়াতাড়ি শাড়ি’টা বদলিয়ে আসুন, তাড়াতাড়ি।’
সুখ ড্যাবড্যাব করে তাকায়। মেঘ এবার কেমন জেনো অদ্ভুত কন্ঠে বলল,
-‘এখন আপনার জন্য আমি শাড়ি’টা পাল্টাতে বলি নি, আমার জন্যই বলেছি। আপনার সিক্ত রূপ রক্তাক্ত করছে আমার হৃৎপিণ্ড। স্নিগ্ধতা দিয়ে মেরে ফেলার ইচ্ছে আছে? এই পুরুষটার করুণ অবস্থাও বুঝুন। না আছে আপনাকে এ রূপে দেখার অনুমতি, না চোখ শুনে বারণ। আমি পড়েছি সব জ্বালায়।’
সুখের চোখ যেনো বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিজের অবস্থানের কথা তৎক্ষণাৎ মাথায় খেলে গেলো। গাল গুলো লাল হয়ে গেলো। দ্রুত বাথরুমে প্রবেশ করলো সে।বুকে হাত দিয়ে ভাবছে, এ কেমন মিষ্টি লজ্জা?
দীর্ঘক্ষণ মিষ্টি নিরবতার এই রজনী মেঘের কাছে যেনো স্বপ্ন ছিল। অপরিচিতা’কে এতটা অনুভব করার রাত এ জীবনে তো প্রথম। মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বলল,
-‘রমনীরা কী জানে, তাদের কোমল প্রতিচ্ছবি ভীষণ বিপর্যয় ঘটায় শক্ত প্রেমিকের বুকে? হাজার জনমের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয় তাদের গালের লাল আভা। রমনীরা জানেনা, প্রেমিক’রা তাদের সব রূপে আহত-নিহত হয়। আর যদি দেহ থাকো সিক্ত,হৃদয় হয় ভীষন রক্তাক্ত।’
বেশ খানিক’টা সময় পর সুখ ওয়াশরুমের বাহিরে আসে। ততক্ষণে মেঘ নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করে নেয়। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
-‘আপনি একটু খাটে বসুন অপরিচিতা, আমি জামা’টা পাল্টে আসি। ভয় পাবেন না তো?’
সুখ দৃষ্টি ফ্লোরে’র দিকে নিবদ্ধ করে মাথা নাড়ালো, যার অর্থ ‘না’। মেঘ মুচকি হাসলো সুখের কান্ডে,মেয়টা এত লজ্জা পাচ্ছে কেন? লজ্জা নারীর ভূষণ বলে তার এত বহিঃপ্রকাশ করতে হবে নাকি! নিজের ভাবনায় আবার হাসে মেঘ। তারপর আরেকটা টি-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওয়াশরুমের দরজা’টা লাগানোর আগ মুহূর্তে টিটকারি মেরে বলল,
-‘ওহে অপরিচিতা, এই আহত পুরুষের বুকের বা’পাশ থেকে শুরু করে পুরোটা মানব’ই আপনার। এতে লজ্জা না, অধিকারবোধ রাখুন। নিজের অধিকার একটু ছুঁয়েছেন পর মানুষের তো না। আমি পুরোটাই আপনার মানুষ।’
সুখ মুখ ভেংচি দিলো। একটা গম্ভীর পুরুষের উচ্চস্বরের হাসি ভেসে এলো। সুখও মুচকি হাসলো ক্ষানিকটা।
বেলী ফুলের গন্ধে শেষমেশ নিজেকে আটকে রাখতে পারে নি সুখ। আধাঁরের মাঝেও তার মনে বেশ ইচ্ছে জাগলো নিশি’র বেলীফুল গুলোকে একটু ছুঁয়ে দেখার। যেমন ভাবনা,তেমর কাজ। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো,বারান্দার দিকে। তাদের বারান্দা’টা বাড়ির পিছের দিকে। সুখ ভেজা শীতল বেলীফুল গুলোর সুগন্ধি একটু শুসে নিলো,ছুঁয়ে দিলো একটু শীতলতা। একদম মুগ্ধ মনে যখন বাহিরের দিকে দৃষ্টি দিলো তখন হঠাৎ করেই তার চোখ আটকে গেলো তাদের রুম বরাবর বাহিরে কিছুটা দূরে একটা আধাঁরিয়া কুঠিরের মতন ঘর দেখে। সুখের ভ্রু আপনা-আপনি কুঁচকে এলো। বেশ গভীর দৃষ্টি দেয় কুঠিরের দিকে। হঠাৎ চমকে উঠলো সুখ,মনে হলো ভারী বর্ষণের শব্দ ভেদ করে একটা দুর্বল নারীকন্ঠ আর্তনাদ ভেসে এলো কোথা থেকে যেনো। সুখের মনে হলো ঐ ঘরটা থেকেই শব্দ এলো। তারপর আবার সব চুপ। এর মাঝেই কুঠিরের থেকে কেউ একজন গটগট পায়ে বেড়িয়ে এলো বোধহয়। সুখ আৎকে উঠে। এই বৃষ্টির মাঝে একটা মানুষের অবয়ব কেবল বোঝা গেলো কিন্তু কে এ মানুষ? আর ঐ কুঠির’ই বা কী?
হঠাৎ তার পিছে উপস্থিত হয় মেঘ। ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-‘অপরিচিতা,চলুন খেতে ডাকছে। আসুন।’
সুখ রহস্যময় কুঠিরটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো মেঘের দিকে,
-‘আচ্ছা মেঘ সাহেব, ঐ ঘরটাতে কে থাকে?’
মেঘ সুখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
-‘ ওহ্ এটা, এটা পরিত্যক্ত এখন। আগে আমাদের স্টোর রুম ছিলো৷ এখন অবশ্য খালি’ই।’
-‘কেউ যায় না সেখানে?’
-‘নাহ্ যায় না। কিছু নাই তো সেখানে। কেনো বলুন তো?’
সুখ গভীর কিছুর সংমিশ্রণ উপলব্ধি করে। এ বাড়ির পিঠ পিছে গভীর খিচুড়ি পাকানো হচ্ছে কিন্তু সেটা সবাই জানেনা। কিছু তো একটা আছে এ বাড়িতে। তারপর কোনো কথা না বলে মেঘের সাথে সে খেতে চলে যায়। নিবিড় ভাবে খুঁটি বসিয়ে বাড়ির খুঁটিনাটি বের করতে হবে।
খাবার টেবিলে মসৃন বাদে সবাই ই আসলো। কাজের মেয়েটা সুখের দিকে একবারও তাকালো না বরং ওড়না দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে রাখলো। কেমন যেনো একটা পালায় পালায় ভাব। কিছু লুকানোর গভীর চেষ্টা তার অঙ্গভঙ্গিতে। সুখের যেনো মনে হলো আস্ত এক রহস্যের গোডাউনে সে এসে পড়েছে তবে,মেঘ সাহেব সব কিছুর বাহিরে।
________
সকালে ঘুম ভাঙতেই হিমা’র চেহারাটা দর্শন করলো সুখ। হা হয়ে গেলো বিষ্ময়ে। সকাল সকাল সর্বনাশের সংবাদ শুনতে হবে না তো?
#চলবে