#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
পর্বঃ তেরো
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি নিষেধ)
সময়টা ঠিক গ্রীষ্মের ক্লান্ত বিকেল। চারদিকে আধাঁর করে ঝড় উঠেছে। কৃষ্ণচূড়ার তৃষ্ণাতুর দেহ ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির কণা গুলো। ইউসুফদের পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষজন। ইউসুফ, তার মা, বোন, দাদীজান। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। এইতো ঘন্টাখানেক আগে সুখের দারুণ অনিচ্ছায় হয়ে গেলো তার বিয়েটা। সত্যিই কী দারুণ অনিচ্ছা ছিলো? মনের কোণে বুঝি একটুও ইচ্ছে ছিলো না? ছিলো বোধহয়, কিন্তু রমনী সেটা স্বীকার করবে না। বরাবরই বিয়ের লাল বেনারসী যখন সাদা কাপড়ে রূপান্তরিত হচ্ছিল তখন কোন রমনীরই বা বিয়ে করার ইচ্ছে জাগ্রত থাকে? তারও ছিলো না ইচ্ছে। আবার হয়তো জীবন সঙ্গী টা মেঘ সাহেব ছিলো বিধায় তমুল বাঁধাও প্রদান করে নি।
তখন যখন মেঘ রাগান্বিত স্বরে বলল কাজি আনার কথা তখন প্রতিবাদ করে উঠে সুখ। সুখের অমতেও ইউসুফ দাদীজানকে আনতে চলে যায়। দাদীজানও এক কাপড়ে চলে আসে সেখানে। একটু ভালো থাকার আশায় বৃদ্ধ মানুষটাও হয়তো ছটফট করছিলো। সানজিদা বেগম তখন বাড়ি ছিলো না, লীলাবতীও ছিলো নিদ্রায়। খালি বাড়িটা খুলে রেখে চলে এসেছে সে। পিছে ফিরে তাকায় নি। সে একটা অপরিচিত ছেলের আশ্রয়কে নিরাপদ মনে করেছে নিজের বাড়ি থেকেও।
সুখ দাঁড়িয়ে আছে নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমটায়। মেঘ বাহিরে গিয়ে ছিলো কোনো একটা কাজে। ড্রয়িং রুম থেকে কথার শব্দ আসছে। বেশ আলোচনা বলা চলে। দাদীজানের পরিষ্কার কন্ঠ ভেসে আসছে। সে ইউসুফকে জিজ্ঞেস করছে,
-‘তুমি আমাগো সুখোবতীরে কেমনে পাইলা?’
-‘আসলে দাদী আমার ঘুম আসছিলো না। পানি খাওয়ার জন রান্নাঘরে আসতেই জানালার দিকে চোখ যায়। বাহিরে রাস্তায় তাকিয়ে দেখি একটা লাল বেনারসী পড়া মেয়ে বসে আছে ফুটপাতে। জানালা দিয়ে কেবল পিছন টুকু দেখা যায়। এক মিনিট,দু মিনিট,তিন মিনিট এমন করে আমি ঠাঁই দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম কোনো মেয়েটার কোনো নড়চড় দেখলাম না। অবশেষে খোঁজ নিতে নিচে গিয়ে দেখি আমাদের মেডাম।’
-‘জানো,মাইয়াডা যখন বাইর হইয়া গেলো তহন কলিজাডা আমার এট্টুক হইয়া গেছিলো। কাইল চাইলে আমি ঝগড়া ঝামেলা কইরা ওরে হেই বাড়িতে রাখতে পারতাম কিন্তু সত্যি কইতে আমার আর ইচ্ছা জাঁগে নাই ওরে হেই বাড়ি রাখতে। তাই নিজেরে কঠিন কইরা এত রাইতে বাড়ির বাইরে পাঠাইলাম। যদি বাইচ্চা থাহে তাইলা শক্ত হইবো আর নাইলে মরুক। পোঁড়া কপাল নিয়া বাইচ্চা থাকার চাইয়া মরা ভালো।’
তারপর ড্রয়িং রুমে আরও কথোপকথন চললে কিন্তু তা কর্ণগোচর হলো না সুখের। এমন করে বদলিয়ে যাবে তার জীবনটা সে ভাবে নি। জীবন যুদ্ধে এখন সে আর একা না। আরও একটা শক্ত হাত আছে তার হাতের মুঠোয়। আদৌ হাতটা শক্ত তো?
তমুল ঝড় হলে বিদ্যুৎ যাবেই প্রচলিত প্রথা। ইউসুফদের ঘরেও বিদ্যুৎ নেই। যেহেতু চারপাশ নিকোষ কালো আধাঁরে ছেয়ে গেছে তাই পুরো ফ্লাট টাও অন্ধকারে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে ইউসুফের মা আমেনা রহমান মোমবাতি জ্বালিয়ে আধাঁর কিছুটা নিবারণের চেষ্টা করেছে।
সুখ বাহিরে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার উদাস। বিষন্নতার মায়াজালে ঘিরে আছে সে। হঠাৎ তার ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো কেউ,ধ্যানে বিঘ্ন ঘটলো রমনীর। বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুমের ভিতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। থমকে গেলো চোখের পলক,মনের গহীন কোণে একটা ভালো লাগার স্রোত বয়ে গেলো বোধহয়, মনের মণিকোঠা থেকে আনমনেই কেউ বলে উঠলো-“সামনের সুপুরুষটি সুখের। কেবল মাত্র সুখের।”
ইশ্, মনটা কেমন নিলর্জ। এত জোড়ে বললে সামনের মানুষটি শুনে ফেলবে তো। মনকে ভীষণ রকমের সাবধান বাণী দিয়ে চোখ নামালো সুখ। এ পুরুষটির ভিতর কোনো মায়া আছে বোধহয়, নাহয় একমাস আগেও যে পুরুষটিকে ভালো লাগতো তাকে আজ মনে পড়ছে না কেনো? গতকালও যে পুরুষের জন্য বউ সেজেছিলো তাকে স্মৃতির কোণাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেনো? সব গুলো মানবকে ছাপিয়ে কেবল একজন মানুষ সবটা জায়গা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। আর সে হলো, “মেঘ সাহেব”।
সুখকে ভাবনায় ডুবতে দেখে মেঘ ভ্রু কুঁচকে তাকায়, গলা পরিষ্কার করে বলে,
-‘আধাঁর রুমে বসে আছেন যে? ড্রয়িং রুমে গেলেও তো পারতেন আর নাহয় রুমে মোম দিতে বলতেন।’
কথাটা বলেই নিজের হাতের মোমটা টেবিলের কোণায় রাখলো মেঘ। সুখ জবাব দেয় না, আজ চুপ থাকতেই ভীষণ ভালো লাগছে।
সুখের জবাব না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেলে মেঘ। অপরিচিতা যে তার প্রশ্নের উত্তর দিবে না সে ভালো করেই জানে। তবুও মেঘ উত্তরের আশা না করে আবার নিজে নিজেই বলা শুরু করলো,
-‘ আপনি তখন আশ্রিতার কথাটা বলে ভালোই করেছেন,নাহয় বিয়েটা এত দ্রুত হতো না।’
সুখ আর চুপ করে রইলো না। তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-‘দয়া করলেন?’
সুখের বলা দুইটা শব্দ আগুন জ্বলালো মেঘের শরীরে। রাগ হলো চরম, মেয়েটা কী আবেগ অনুভূতি বুঝে না? পরক্ষণেই রাগটা নিজের মাঝে চেঁপে দিয়ে বলল,
-‘দয়া করার হলে বিয়ে করতাম না। বিয়ে করেছি জেনো দয়াটা না করা লাগে। নিজেকে এত ছোট কেনো ভাবেন আপনি? আপনি এমন ভাবেন বলেই মানুষ আপনাকে ছোট করে। আগে নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার হোন।’
মেঘের কথায় বেশ রুক্ষতা ছিলো কিন্তু সাথে সত্যতাও ছিলো। সুখ মেঘের রাগী কন্ঠ শুনে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো মেঘের পানে। সে কী ভুল কিছু বলে ফেলে ছিলো?
মেঘের শরীর তখন ভিজে চুপসে আছে। মাথা থেকে টপটপ পানি পড়ছে। সুখ আর কিছু বলার আগে মেঘ ঘরের কোণা থেকে সুখের জামা কাপড়ের ব্যাগটা উঠিয়ে নিলো। সুখ অবাক হয়ে বলল,
-‘এমা,কী করছেন? ব্যাগ নিচ্ছেন কেনো? আর শরীরটা মুছেন আগে।’
মেঘ একঝলক সুখের দিকে তাকায় তারপর কন্ঠ একটু উঁচু করে বলে,
-‘আগে বাড়িতে চলুন তারপর সব হবে। এখানে আর থাকার প্রয়োজন নেই। পরে মনে হবে এখানেও আপনাকে দয়া করে রাখা হচ্ছে।’
সুখ অবাকে ‘হা’ হয়ে যায়। সামান্য কথাতে এত রিয়েক্ট করার কী হলো?
মেঘ ততক্ষণে ব্যাগ হাতে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো। মেঘ ড্রয়িং রুমে আসতেই সবার কথাবার্তায় ভাঁটা পরলো। ইউসুফ তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেঘ কন্ঠ কোমল করলো। শান্ত স্বরে বলল,
-‘ইউসুফ এখন আমাদের যেতে হবে। বিয়ের প্রথম রাত অপরিচিতা শ্বশুর বাড়ির বাহিরে থাকবে সেটা দেখতে ভালো লাগছে না। আদৌও শ্বশুর বাড়ি না স্বামীর বাড়ি বলা চলে। তাই চাচ্ছি আজ বাড়িতে চলে যেতে।’
ইউসুফ মেঘের দিকে ভালো করে তাকায়। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার সুবাধে মেঘের অঙ্গভঙ্গি দেখে এতটুকু আঁচ করতে পারে যে কিছু একটা হয়েছে।
আমেনা রহমান ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলল,
-‘সে কী বাবা? কী বলছো? এই ঝড়বৃষ্টিতে কোথায় যাবে? এখানেই থাকবে। গরীবের ঘর বলে অসুবিধা হচ্ছে তাই না? একটু কষ্ট করে ম্যানেজ করে নেও বাবা।’
সুখ আমেনা রহমানের এমনে কথা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল,
-‘এসব কী বলছেন আন্টি? এমন বলবেন না। আপনারা কত ভালো।’
আমেনা রহমান সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ইউসুফ নতজানু হয়ে বলল,
-‘মা স্যারকে আজ যেতে দেও, আরেকদিন মেম সহ এসে স্যার থাকবে নাহয়। বিয়ের প্রথম দিনই বাড়িছাড়া থাকবে কেমন জানি দেখাচ্ছে।’
আমেনা রহমান চোখ রাঙিয়ে বলল,
-‘ তোর লজ্জা করে না এসব বলতে? এই ঝড়বৃষ্টি তে বাড়ির মানুষ বাহিরে যায়?’
-‘আন্টি প্রমিস আমরা পরে এসে থাকবো কিন্তু আজ না।’
মেঘের কথায় সুখ নাক কুঁচকালো। এবার মানুষটা বেশি বেশি করছে। কোন কথার কী রিয়েক্ট করলো।
অতঃপর তুমুল কথাবার্তার পর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঝড় মাথায় বের হয়ে আসে মেঘেরা। দাদীর কাছে এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয় মেঘ, মানুষটাকে বৃষ্টির মাঝে এভাবে টানা-হেঁচড়া করাটা অপরাধ হচ্ছে বলে। মেঘের এহেন আচরণে মুগ্ধ দাদী। তাদের সাথে সঙ্গী হয় ইউসুফও। সে তার স্যার মেমকে বৃষ্টিতে একা ছাড়বে না।
প্রচন্ড বৃষ্টি দেখে ধীর গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে ইউসুফ। সামনের সিটে বসে আছে মেঘ। পিছনের সিটে আছে দাদীজান আর সুখ। নতুন অধ্যায়ে পা রাখছে সুখ। অধ্যায়টা সুখকর হবে তো?
_________
দীর্ঘ দু’দিন পর ভার্সিটির গেইটে পা রাখলো সুখ। বাস দিয়েই এসেছে। মেঘদের বাড়ি থেকে ভার্সিটির দূরত্ব অনেক। কিন্তু মেঘের গাড়ি চড়ে বিলাসিতা করে সে আসে নি। যেহেতু মেঘের সাথে মানিয়ে নিতে তার সময় লাগবে তাই সে সময় দিচ্ছে নিজেকে। মেঘও সুখকে যথেষ্ট স্প্যাশ দিচ্ছে।
ভার্সিটিতে ঢুকতেই হিমা আর অণুর দেখা মিললো। সুখকে দেখেই অণু আর হিমা দ্রুত এগিয়ে আসলো। তাদের অবশ্য সুখ ফোনে সব বলেছে কিন্তু চেপে গেছে বিয়ের ব্যাপারটা। তারা দুজন তো মেঘ আর ইউসুফের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
অফিসের কেবিনে প্রবেশ করতেই মেঘের ফোনটা উচ্চশব্দে বেজে উঠলো। মেঘ ফোনটা বের করতেই ফোনের স্ক্রিনে বড় করে ভেসে উঠলো “মা” নামটা। মেঘ একটু ঢোক গিললো। দুই দিন যাবত মায়ের সাথে কোনোরূপ কথা হয় নি। বিয়ের কথা টা ঠিক কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারে নি।
হাতের ফোনটা রিং হতে হতে কেটে গেলো। মিনিট এক এর মাঝে আবার ফোনটা তুমুল শব্দে বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ হতেই অপরপাশ থেকে মহিলার তীব্র কন্ঠ ভেসে আসলো,
-‘বাবু,তুই মাকে ভুলে গেলি?’
মেঘ মুচকি হাসলো। আদুরে কন্ঠে বলল,
-‘না মা ভুলি নি,একটু ব্যস্ত ছিলাম।
অপরপাশের মহিলা শাসনের সুরে বলল,
-‘দেখবো তো মায়ের বেলা এত ব্যস্ততা বউ এলে কোথায় যায়। শোন বাবু, মোহিনীর বাবা তাড়া দিচ্ছেন। সেই সাত মাসে আগে এংগেইজমেন্ট করে রেখেছি তার মেয়েকে কবে ঘরে তুলবো। তুই একটু সময় করে তাড়াতাড়ি আয় বাবা। বিয়েটা সেড়ে ফেলতে হবে। মেয়েটাকে আর কত অপেক্ষা করাবো?’
মেঘ ভড়কে যায়। ভুলেই গেছিলো মোহিনী নামের মেয়েটার কথা। তবুও আমতা-আমতা কন্ঠে বলল,
-‘হ্যাঁ মা আসবো। ভুলি নি ওর কথা।’
_________
খাটের নিচ থেকে ধারালো রামদা টা বের করে রাতে আধাঁরে কেউ একজন ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আধাঁরে এক জায়গায় মাটি খুড়ে ভীষণ গোপনে লুকিয়ে ফেলল অস্ত্রতা। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠলো পাঁচদিন পুরোনো রক্ততা। যা দেখে রহস্য হাসি হাসে গোপন মানুষ। আনমনেই বলল “অসৎ পুরুষের মৃত্যু শ্রেয়”।
#চলবে