#সুখের_অ-সুখ
#মম_সাহা
ভয়ংকর পর্বঃ দশ
(লেখিকার অনুমতি ব্যাতিত কপি করা নিষেধ)
‘প্রেমের শহরে পা ডুবালে,
হয়তো রঙিন জীবন না হয় আমরণ মৃত্যু কুড়িয়ে আনতে হয়।রমনীরা জানে না তাদের চলে যাওয়া প্রেমিকদের আজীবন আধাঁরে ডুবিয়ে দেয়।আমি না হয় আমরণ মৃত্যু কুড়িয়ে আনলাম।আমার বেঁচে থাকাটাই হবে চিরদিনের নির্বাসন।’
~”প্রেমে মরেছে অনেক প্রেমিক,কেউবা নির্বাসনে রয়,,
প্রেম বাজিতে হারলে প্রিয়,জীবন হয় আধাঁরময়।”
ইউসুফ দরজার কিনারায় দাঁড়িয়ে মনযোগ দিয়ে শুনলো তার বড় ভাই রূপ স্যার এর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ গুলো।গতকাল যখন শুনেছিলো সুখের বিয়ে তখন থেকে এ অব্দি এক ঘরের কোণায় আটকে রয়েছে।মাঝে একবার বের হয় সুখের যাবতীয় খোঁজ খবর নিয়েছিলো।খবর নিয়ে যতটুকু জেনেছে সবটাই সুখের পোড়াকপালের ইতিহাস।বিয়েটা ভাঙানোর ইচ্ছে থাকলেও শেষ মুহূর্তে মেয়েটার দুঃখী জীবনের এমন করুণ দশার কথা শৃনে নিজের সিদ্ধান্ত বদলিয়ে ফেলেছে।সে নাহয় চিরজীবন না পাওয়ার আফসোসে পুড়বে তবুও প্রিয়তমা সুখোবতী, সুখের মুখ দেখুক। তার মাধ্যমে না হোক কারো না কারো মাধ্যমে সুখের সুখ আসুক।
ইউসুফ স্যারের এমন নির্বাসন মানতে না পেরে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠে বলল,
-‘কী বলছেন আপনি এসব স্যার? সব কিছু কী এত সহজ? নির্বাসন শব্দটার ভার আপনি বহন করবেন না কখনোই। এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।’
মেঘ ভ্রু কুঁচকালো।হাতে সিগারেট টার শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলো।পৃথিবীতে চিরপরিচিত একটি প্রথা আছে,”প্রেমিকার অভাব পুরুষরা একমাত্র নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়িয়ে ভুলে থাকতে চায়।তাদের মতে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা নিকোটিনের ধোঁয়া ভুলিয়ে দেয়। প্রেমিকার বিকল্প হিসেবে বিচ্ছেদে আচ্ছাদিত প্রেমিক নিকোটিনকে বেছে নেয়।”
এই চিরপরিচিত নিয়মের বাহিরে যায় নি মেঘও।কাল থেকে এ অব্দি তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ করেছে। এসবে অভ্যস্ত না থাকা মেঘও তিন প্যাকাটে দুঃখ উড়িয়েছে।
এবার ইউসুফের দিকে তাকিয়ে মেঘ গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘কী করবে তুমি ইউসুফ?’
-‘মেম এর যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে রেদোয়ান, উনার সাথে কথা বলবো।’
ইউসুফের কথায় গম্ভীর মেঘ হঠাৎ করে হেসে উঠলো।এই পরিস্থিতিতে এমন হাসি বোধগম্য হয়নি ইউসুফের।অহেতুক হাসার মানুষ মেঘ না,তাহলে সে কী মজার কিছু বলে ফেলেছে?
ইউসুফের চোখের ভাষা বুঝতে পারে মেঘ।হাসি থামিয়ে আবারও কন্ঠটা গম্ভীর করে ফেলল।ভরাট কন্ঠে বলল
-‘তোমার কী মনে হয় আমি তার সাথে কথা না বলে এতকিছু বলেছি?’
-‘তার মানে? আপনি উনার কাছেও গিয়েছিলেন?’
ইউসুফের প্রশ্নে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেঘ।মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘হ্যাঁ গিয়েছিলাম।’
-‘সে কী বলেছে স্যার?’
-‘তোমার মেম নাকি তাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না।তাকেই বিয়ে করবে।আর সেও অপরিচিতাকে ভালোবাসে।তাই তাদের পথের মাঝে কাটা হয়ে আমি জেনো না দাঁড়ায়।’
ইউসুফ বলার মতন আর ভাষা খুঁজে পেলো না। যে আশাটুকু ছিলো সেটাও নিভে গেলো।গম্ভীর মানুষটাকে হাসানোর মানুষটা আবার হাসি কেড়ে নিয়ে চলে যাবে।ভাগ্য বুঝি এত নির্মম খেলা’ই খেলবে?
পুরো ঘরময় নিরবতা জেঁকে ধরলো।আর কেউ কেনোরূপ কথা বললো না।মেঘের ফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো,জানান দিলো নতুন বার্তার আগমন।মেঘ ধীর গতিতে আলস্য নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করতেই চক্ষুচড়ক গাছ।অলসতা হঠাৎই চাঞ্চল্যে রূপদান করলো।উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ইউসুফের পানে তাকিয়ে বলল
-‘তোমার মেম আমারই হবে ইউসুফ।খোদার ভেদ বুঝা অসাধ্য। কাল একটা জায়গায় যেতে হবে।তথ্য টা যাচাই করতে হবে তারপরই বিয়ে বাড়িতে যেতে হবে।বি রেডি ইউসুফ। হয়তো নতুন কিছু হবে কাল।’
নিজের স্যারের এমন বদলে অবাক হয় ইউসুফ। তবে মনে মনে সেও চাচ্ছে কাল নতুন কিছু হোক,শুভ কিছু হোক।
________
আজ শুক্রবার কাঙ্খিত দিন,
ছোট করে বিয়ের আয়োজন হলেও বাড়িঘর অনেকটা সাজানো হয়েছে আর এ সবটাই লীলাবতীর আর দাদীর আগ্রহে।লীলাবতী জানালার কোণ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের পরিবারে সবচেয়ে ছুটন্ত ও চঞ্চল মেয়ে সে কিন্তু ছোট্ট কিশোরীর অহেতুক মোহ আর ভুলে সবটা কেড়ে নিয়েছে।
‘আজকাল তোর কী হয়েছে লীলু? এমন চুপচাপ থাকিস কেন?’
কর্কশ কন্ঠে লীলাবতীর ধ্যানে বিঘ্ন ঘটলো।কন্ঠের অধিকারীনিকে না দেখেও বুঝতে পেরেছে কে সে।লীলাবতী কোনো আগ্রহ দেখালো না।আগের ন্যায় বাহিরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাচ্ছিল্য স্বরে বলল
-‘তাহলে এতদিনে তোমার চেখে আমার বদল ধরা পড়লো আম্মা? যাক তবুও তো ভাবলে আমার কথা।’
এবার সানজিদা বেগম দু’কদম এগিয়ে আসলো দ্রুত গতিতে তারপর বলল
-‘তোর কী হয়েছে লীলু? আগে তুই এমন ছিলি না।যে সুখরে দুই চোক্ষে তুই দেখতে পারতি না এখন সে সুখের হয়ে কথা বলিস,ওর পক্ষ ধরিস।তাবিজ টাবিজ করলো না তো?’
লীলাবতী অবাক হলো,ভীষণ অবাক।তার মা মানুষটা যে এমন নগন্য ভাবতে পারে নি সে।নিজের মেয়ের মন খারাপ,হঠাৎ শান্ত হয়ে যাওয়া টা তাকে ছুঁতে পারে নি বরং মেয়ে কেনো তার সৎ বোনের সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা! লীলাবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-‘এ জন্যই বোধহয় মায়ের আগে সৎ ট্যাগ টা যুক্ত করে জন্মদাত্রী মায়ের থেকে বাবার দ্বিতীয় বউকে আলাদা করে! মা তো মা’ই হয় আর সৎমা সৎমা’ই হয়।কখনো আপাই এর সাথে ভালো ব্যবহার করে দেখেছিলে আম্মা? আমি যোগ্য সন্তান না আম্মা সে-ই যোগ্য সন্তান।একটু মায়ের স্নেহ পাওয়ার জন্য মানুষটা সব করে।এমনকি তোমার মুখের উপর একটা কথাও বলে না।আম্মা চোখ থাকতেও অন্ধ না হলেও পারতে।একটু ভালো হয়ে দেখতে আম্মা,পৃথিবীতে ভালোবাসা নামক একটি স্বর্গসুখ আছে।’
সানজিদা বেগম অবাক হয়,বিষ্মিত ও হতবাকও হয়।সে এতকিছু কার জন্য করছে? এই মেয়েটার জন্যই তো আর তার মেয়ে কিনা তাকেই এত গুলো কথা বললো?
সানজিদা বেগমের চোখ লাল হয়ে গেলো অপমান আর রাগে।তেড়ে গিয়ে বলল
– ‘যার জন্য করি চুড়ি,সেই বলে চোর।বাহ্ রে বাহ্।এসব আমি কেনো করছি? তোর জন্যই তো।আর ঐ মেয়েটাকে কিসের স্নেহ দিবো? জন্মের পাঁচ মাসের মাথায় ওর নিজের মা-ই তো ওর কথা ভাবে নি চলে গেছে নতুন নাগরের সাথে তবে আমি পরের মাইয়ার কথা ভাববো কেন?’
-‘কারণ সারাদিন তোমার বীভৎস অত্যাচার সহ্য করার পরও মেয়েটা একটু শান্তির খুঁজে তোমায় মা বলে ডাকে।ঐ ডাকটার মর্মও তো রাখলে পারো আম্মা।আজও মানুষ চিনলে না।আম্মা তুমি আজও মা হয়ে উঠতে পারলে না যে।’
নিজের অষ্টাদশী মেয়ের এমন কথায় সানজিদা বেগম ভাষা হারিয়ে ফেললেন।তবে কী সে সত্যিই মা হয়ে উঠতে পারে নি!মনে পড়লো তার সেই অতীত যেদিন সে এই বাড়িতে লাল টুকটুকে বউ সেজে এসেছিলো, এসেই খাটের উপর থাকা ছোট্ট পুতুলের মতন বাচ্চাটার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলো।খুব ইচ্ছে ছিলো বাচ্চাটাকে কোলে নিতে আদর করতে কিন্তু তার মা তাকে বলে দিয়েছিলো এটা তার সৎ মেয়ে অত আদিক্ষ্যাতা দেখানোর কিছুই নেই।নিজের স্বামীর প্রথম ঘরের সন্তানকে সংসারে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে নেই তাহলে সংসার হাতের বাহিরে চলে যাবে তাই তো সে পুতুলের মতন মেয়েটাকে আর কোলে নিলো না,আদর করার ইচ্ছে টাকে মাটিচাপা দিয়ে সৎমা হিসেবে আবির্ভূত হলেন।দোষ তো তার ছিলো না।তার মা’ই তো সৎমেয়ে বলে অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরী করে দিয়েছিলো।তাহলে তার মাও বুঝি মা হতে পারে নি? নিজের মেয়ের এমন কথা শোনার জন্য বুঝি সংসারে হাল তিক্ত হাতে ধরেছিলো? নিজের সংসারটা তাসেরঘর বানালো শেষমেশ?
সানজিদা বেগম হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। দীর্ঘ কত গুলো বছরের হিসেব মেলাতে লাগলো।সত্যিই তো,এত রুক্ষতা তাকে কী দিলো? সবই তো শূণ্য।
________
আবার নতুন করে লাল শাড়ি জড়িয়েছে নিজের শরীরে সুখ।সেদিন সেজেছিলো একটা বিশ্বাসঘাতকের জন্য কিন্তু আজকের মানুষটা কী সঠিক? এসব ভাবনা সুখের মাথায় নেই,এসব ভাবনা ছাপিয়ে একটা ভাবনা’ই তার মাথায় মেঘ সাহেব আসবেন তো? তার সাথে আর দেখা হবে তো?
নিজের ভাবনায় অবাক হয় সুখ।মেঘ সাহেবের কথা তার মনে আসলো কেন! সে কী নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে?
সুখের ভাবনার মাঝেই হুড়মুড় করে তার ঘরে হাজির হলো অনু আর হিমা।পাত্র পক্ষ বসে আছে।একটুপর বিয়ের কাজ আরম্ভ হবে তাই তো সুখকে নিতে এসেছে।সুখের মনের সুপ্ত কোণে সুখের অজান্তেই প্রশ্ন জাগলো,বিয়েটা তে তার মন টানছে না কেন? মেঘ সাহেবের জন্য কি মনের অসুখ জাগছে?
ড্রয়িং রুম জুড়ে মানুষ বসে আছে।সুখের মাথায় বড় করে একটা ঘোমটা টানা।মেঘেরা এখনো তাদের বাড়িতে আসে নি।সুখের মন বেশ হাঁসফাঁস করছে।সুখ হিমাকে সবার অগোচরে ডেকে আনমনেই জিজ্ঞেস করল
-‘কিরে মেঘ সাহেব আসবেন না?তোর কথা শুনে তো সেদিন দাওয়াত দিলাম।’
হিমা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল
-‘কি জানি। দাঁড়া ফোন দেই।ইউসুফ ভাইয়ার নাম্বারটা আমি রেখেছিলাম। কল দিচ্ছি।’
সুখ মাথা নাড়ালো।সেদিন মেঘদের সাথে কথা বলার সময় মসৃনের রুমমেট কল দিয়েছিলো মসৃনের খবর জানাবে বলে কিন্তু দেখা করে বলবে বিধায় আর সুখ যেতে পারে নি কারণ রুমমেট নাকি কোনো প্রয়োজনে তাদের গ্রামে গেছে।এসে আবার কল দিবে বলেছে।তারপর সুখ না চাইতেও মেঘকে দাওয়াত দিয়ে এসেছিলো।মেঘ তো দাওয়াত রেখেছিলো।তাহলে আসছে না কেন?
মেঘ আর ইউসুফ জ্যামে আটকে আছে।খুব দ্রুতই সুখদের বাড়িতে পৌঁছাতে হবে।তাদের হাতে যেই প্রমাণ আছে সেটা খুব শীগ্রই সুখদের বাড়ি অব্দি পৌঁছাতে হবে নাহয় খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।এর মাঝেই ইউসুফের ফোন বেজে উঠলো। হিমা ফোন করে জানালো বিয়ের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে তারা কোথায় আছে সেটা জেনেই ফোন কেটে দিলো।
মেঘের ভয় হচ্ছে বড় ক্ষতিটা না হয়ে যায়। তাহলে সে কী করবে?
_______
বিয়ে পড়ানো শুরু হওয়ার সাথে সাথে পুরো বাড়ির কারেন্ট চলে গেলো।ড্রয়িং রুম হওয়াতে বাহিরের আলো প্রবেশ করতে পারছে না।দিনের বেলাতেও কেমন আধাঁর হয়ে গেছে।হঠাৎ সুখ অনুভব করলো তার সামনে কেউ দাঁড়িয়েছে।
পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে কারো ভয়ংকর আত্মচিৎকার ভেসে আসলো।অনেকের শরীরে ছিটকে একটা তরল জাতীয় কিছু পড়লো অনুভব করলো।আত্মচিৎকারের পর নিস্তব্ধতা আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করলো।আধাঁর আর নিস্তব্ধতা জেনো মৃত্যুপুরীর মতন মনে হলো।
#চলবে
[আমাদের তথাকথিত সমাজে সৎমা আর সৎমেয়ের মাঝে দেয়াল তৈরী করে তথাকথিত সমাজই।দোষ মানুষের মানসিকতায়।ভালোবাসা পাঠকমহল]