সাঁঝক বাতি পার্ট ১০

0
420

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[১০]

পরেরদিন, সিগ্ধপূর্ণ সকালের আবির্ভাব হলো। মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া! সূর্য কেবল মিষ্টি রোদ ছড়িয়েছে। সোনালি রং! দেখতে ঠিক সোনার’ই মতো। এজন্যই বুঝি বলা হয়, কাঁচা সোনা মিষ্টি রোদ! থাই জানালা ভেদ করে তীর্যকভাবে রোদ রুমে ছড়িয়ে গেছে। এতে অন্ধকার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। তাদের আয়ু এখানেই শেষ! এখন দিনের রাজত্ব শুরু।

রুমে নিষ্প্রাণ হয়ে শুয়ে আছে এক অর্ধনগ্ন মানবী। হিসাব কষছে! নিজের জীবনের হিসাব! তবে হিসাবের ফল ঘুরে-ফিরে শূন্যের কোঠাতেই এসে থামছে। বোধগম্য হচ্ছে না; জীবন ধোঁকা দিচ্ছে নাকি হিসাব ভুল হচ্ছে। সে হিসাবে বেশ পটু! তাহলে ফল শূন্য আসছে কেন? এমন তো হওয়ার কথা না! এই ফল যে মনমতো হচ্ছে না।
মানবী ঘাড়’টা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। অদূরে মানুষটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নিষ্পাপ মুখ! নিদারুণ মুখের অবয়ব! সুঠাম দেহে অধিকারী।
আর ধূর্ততার কথা না বললেই নয়। সে কুটিল ও দয়াশূন্য চিন্তা-ভাবনার মাস্টার! নির্দয় মানব।তবে মানুষটার ঠোঁট দু’টোতে প্রাণবন্ত নয়; বরং ফিচেল হাসিই বেশি মানায়। যে হাসি সর্বদা ওর ঠোঁটে লেপ্টেই থাকে। দেখতেও বেশ লাগে! সব পুরুষের ঠোঁটে মুচকি হাসি শোভনীয় নয়। কারো কারো ফিচেল হাসিও নজরকাড়া! যেমন; দিগন্ত! সুদর্শন মানুষরা অহংকারী হয়! কথাটার সত্যতা দিগন্তের মধ্যেই স্পষ্ট। মানবীটার অর্থাৎ শিফার দৃষ্টি এখন পাশের শ্যামবর্ণ পুরুষটার নগ্ন বুকের দিকে! বুকটা কালো পশমে ঢাকা। আদুরে ভাব! একটু ছুঁইয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে। এটা নিষিদ্ধ ইচ্ছে! একটা প্রবাদে প্রচলিত আছে, পুরুষদের বুকে পশম থাকলে তারা উদারচিত্তের হয়। বুকে অসীম ভালোবাসা সঞ্চিত’ও রাখে। হৃদয়বল্লভ হয়! তবে প্রবাদটাকে দিগন্ত ভুল প্রমান করেছে। উদাহরণস্বরূপ দেখিয়েও দিয়েছে; সব বানোয়াট!
কারণ ওর কালো পশমে ঢাকা প্রশস্ত বুকে, মায়া, দূর্বলতা, টান, প্রণয়, কিচ্ছু নেই। যা আছে শুধু নিষ্ঠুরতা!

শিফা ভাবনার ছেদ কাটিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসল।
ভেবে লাভ নেই! এই পরিস্থিতিকেই মানতে হবে!
আর এটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া উপায় নেই। শিফা রান্নাঘরে গিয়ে কাজে হাত লাগাল।
নিহা পরোটার খামির তৈরি করছে। ভেজা চুল দেখে নিহা হাসি-ঠাট্টা করল। খোঁচা মেরেও কথা বলল। শিফা প্রত্যুত্তরে হাসল। নিষ্প্রাণ হাসি!
তারপর ওরা নাস্তা বানাতে মনোনিবেশ করল।

শিফার বাবা-মায়ের সঙ্গেও আর কথা হয় না। সেই বলে না। ইচ্ছে করে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। ওর গোপন ফোনটা নেই। হঠাৎ উধাও!
সব জায়গায় হন্ন হয়ে গুঁজেও পায় নি। দিগন্তেরই কাজ এটা! হয়তো কোনোভাবে দেখেছিল। তাই
সরিয়ে ফেলতে সময় নেয় নি। ঐ ফোনটা থাকা মানে; দিগন্তের বিপদে পড়া। জেনেশুনে কে বা বিপদে পড়তে চায়? কেউ’ই না। তেমনি দিগন্তও! ওর মতো ধূর্ত ছেলের ফোনটা দেখেও নিশ্চুপ না থাকাই স্বাভাবিক। ফেঁসে যাওয়ার ভুল সে করবে না। তাই হয়তো.. ! যদিও এখন কিচ্ছু করার’ও নেই।ওর লড়াইয়ের সর্বশেষ ফলাফল; পরাজয়। হুম, সে সত্যিই গো হারান হেরেছে। আফসোসও করে না। বিনাবাক্যে সে পরাজয় মেনে নিয়েছে।
কারণ যতবার’ই কিছু করেছে, ততবার’ই কিছু না কিছু হারিয়েছে। ওর হারানোর সংখ্যাও কম নয়। ওগুলো ত্যাগ করেছিল সুমিষ্ট সমাপ্তের আশায়। অথচ হয়েছে বিপরীত। অনেক তো হলো; আর কত! এখন ছোট্ট তনয়ও আঙ্গুল তুলে বলে,

-‘ফুপি খুব পঁচা। তুমি দুষ্টমি করো এজন্যই ওরা
আমার হাত কেটে দিয়েছে। কষ্টও দিয়েছে। আমি কাঁদছি ফুঁপি, আমার হাত এনে দাও, প্লিজ ফুপি! হাত ছাড়া আমাকে পঁচা দেখায়। আমার সাথে কেউ খেলে না। কিসব পঁচা, পঁচা, নামেও ডাকে।
আমার হাতটা ঠিক করে দাও, প্লিজ ফুপি প্লিজ।’

তনয়ের এই কথাগুলো শিফাকে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। তার হৃদয়ে অদৃশ্যভাবে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। কাউকে দেখাতেও পারে নি; বলতেও পারে নি। নিরবে শুধু অশ্রু ঝরিয়েছে! ভেতরের আতনার্দের কথা জানে নি, বুঝেও নি। নিশ্চুপ হয়ে সবার অভিযোগ কাঁধে নিয়েছে সে। সত্যিই, সব দোষ ওর। ওর জন্যই সবার জীবন ঝুঁকিতে। হঠাৎ তনয়ের জীবনের রং বদলে গেল। প্রানবন্ত বাচ্চাটা মুখের হাসি হারিয়ে ফেলল। দুষ্টুমি ভুলে গেল। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে হলো। সারাজীবন ওকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
নির্দোষ তবুও। ওদিকে স্বপ্নীলও নিঁখোজ! সাফার বাবা-মায়ের করুণ অবস্থা। ওদের সুখ-সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ পরিবারকে নিঃশেষ হতে দেখা। নিজের
বড় ভাইয়ের কাছে অপরাধী হওয়া। ভাবির সঙ্গে
কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলা। বাবা-মায়ের কাছে ছোট হয়ে যাওয়া। তনয় তো সবার আগে পর করেছে। সে শিফার সঙ্গে কথাও বলে না। শিফাকে দেখলেই হাতের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। যেন বোঝায়; তুমি পঁচা।
তোমার জন্য আমার হাত নেই।’ যতক্ষণ শিফা বাসায় থাকে, তনয় রুম থেকে বের হয় না। ওর অবুজ মনে অনেক অভিমান জমেছে। অভিমান কবে ভাঙবে? বলাও মুশকিল। এসবের কারণেই শিফার জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। সে নিজেকে সম্পূর্ণরুপে বদলে নিয়েছে। কাউকেই বিপদমুক্ত রাখতে পারছে না। বরং দিন দিন পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রতিকূলে যাচ্ছে। এরচেয়ে পরাজয় শ্রেয়। অন্তত আপনজনরা বিপদমুক্ত থাকবে। তাছাড়া এটাও বুঝেছে; জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা বোকামি ছাড়া কিছু নয়।

প্রশান্তের ডাক শুনে নিহা রুমে চলে গেল৷ আর শিফা মৃদু পায়ে দিগন্তকে ডাকতে এলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে। অফিসের যাওয়ারও সময় হয়ে যাচ্ছে। এখন ডেকে না দিলে পরে ওকেই বকবে।
দিগন্ত ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। জেগেই আছে। তবে ইচ্ছে করেই চোখ খুলছে না। শিফা বিরক্ত না হয়ে পুনরায় ওকে ডাকল। তবুও সাড়াশব্দ নেই! যেন শুনতেই পাচ্ছে না। শিফা আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল,
-‘সাড়ে আটটা বাজে, উঠুন।’

দিগন্ত চোখ খুলে কিছুক্ষণ শিফার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা অনেক বদলে গেছে। এই শিফাটা যেন অন্যকেউ। কিছু বললে কাঁদে। তবুও জবাব দেয় না। অথচ আগে কিছু বললেই ফোঁস করে
উঠতো। সময় কি মানুষকে বদলে দেয়? হয়তো।
শিফা এত সহজে হার মানবে সেও ভাবে নি। ওর বাঘিনী শিফাকেই বেশ লাগত। আর এখনকার
শিফা যেন প্রাণহীন কেউ। প্রতিপক্ষ শক্তপোক্ত
ও ধূর্ত না হলে খেলাতে আগ্রহ আসে না। ওর’ও তাই! দিগন্তকে তাকাতে দেখে শিফা মুচকি হেসে কফির মগটা ধরিয়ে দিলো। যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দিগন্ত বলল,
-‘অবশেষে হেরেই গেলে!’
-‘হুম।’
-‘এত দাপট আর তেজ কোথায় গেল?’
-‘ আত্মসমর্পণ তো করেছি। তাহলে…!’
-‘সাহস দেখানোর জন্য শাস্তি পাওনা আছে।’
-‘কি শাস্তি?’
-‘শান্তিস্বরুপ কখনো যদি তোমাকে চাই, দিবে?’
-‘মন সমেত নাকি শরীর?’
-‘মন সমেত তোমাকে।’
-‘কখনো না।’
-‘কেন? চাঁদের গায়ে যেমন কলঙ্ক আছে; তেমনি আমারও। কঙ্কল নিয়ে চাঁদ তার আলো ছড়ায়।নিকষ কালো রাতকে পরিপূর্ণ করে তোলে। চাঁদ কলঙ্ক নিয়ে এত কিছু পারলে, আমি কেন পারব না?’

শিফা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ রুপ বদলাচ্ছে কেন মানুষটা? নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি এটেঁছে। ওর মুখে এসব বুলি শোভনীয় নয়।বরং
এসব শুনে মনে হচ্ছে কেউ ওর কানে গরম সিসা ঢেলে দিয়েছে। দিগন্তের কাছে এসব আশা করাও যায় না। শিফাকে তাকাতে দেখে দিগন্ত সেদিকে এগিয়ে গেল। মুখে তার মুচকি হাসি বিদ্যামান।
শিফার বিষ্ময়কর চাহনি! দিগন্ত শিফার গলায় নাক ঘষতে ঘষতে মৃদু স্বরে বলল,

-‘এসব বলব আশা করেছিলে বুঝি? উফ, খুব শখ, না? আমার মন এতটাও সস্তা নয়। বুঝলে হটি? থুক্কু শত্রু, আরে ধুর কীসব যে বলছি! তুমি
আমি তো ভীতু বউ, তাই না?’

শিফা দিগন্তের দিকেই তাকিয়ে আছে। আর কত রুপ দেখবে? একটা মানুষ কত রুপই বা থাকতে পারে? এরা আদৌ মানুষ? মানুষের তো বিবেক থাকে। এর নেই। অথচ ওকে সবাই মানুষ বলে।
শিফা দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে রইল। তখন দিগন্ত শিফাকে খুব কাছে টেনে ফিসফিস করে বলল,

-‘ভেবেছিলাম তুমি নন-ভার্জিন। কিন্তু না…..! অদ্ভুত সুন্দর তোমার শরীরের গঠন। এতদিন খেয়াল করিনি। তবে কালকে রাতে…..!

To be continue……!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here