সরোবরে প্রেম শেষ পর্ব

0
1302

সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১৮

বেঁধে দেয়া সময় পেরিয়ে যেতেই অর্ণব নিস্তব্ধ পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। সেলিনা বেগম এখনো অচেতন। অর্ণব একটা স্ফিগমোম্যানোমিটার যোগাড় করে তার পেশার মাপল। কাব্যকে একটা ওষুধের নাম বলে দোকানে পাঠালো। নিজের ভারী মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরলো। তার মানসপটে প্রিয়তার সাথে কাটানো সুখের স্মৃতিগুলো ভাসছে।

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে বলেন,

“মিসেস প্রিয়তার লিগ্যাল গার্ডিয়ান কে?”

অর্ণব এগিয়ে এসে বলে,

“আমি ওর হাসবেন্ড। ”

“ওনার অবস্থা বেগতিক। ব্রিদিং প্রবলেম হচ্ছে। আরও কিছু কম্পলিকেশন আছে। ওনাকে আমরা ঢাকা মেডিকেলে রেফার করছি। দ্রুত প্রস্তুতি নিন।”

অর্ণব তাড়াহুড়ো করে রিসেশনে গেল। আধা ঘন্টার মাঝেই প্রিয়তাকে নেয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল। ততোক্ষণে সেলিনা বেগমের জ্ঞান ফিরে এসেছে। তিনি অর্ণবকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন,

“দয়া করে আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকো।”

অর্ণব শুনলো না। সে প্রিয়তাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলো। পিছু পিছু সেলিনা বেগম আসতে লাগলেন কাব্যকে নিয়ে।

অবনী বসে আছে ল্যাবএইডের এয়ারকন্ডিশন দেয়া রুমের মধ্যে। এসির টেম্পারেচার বিশ এ দেয়া। তবুও ঘামে তার মুখ ভিজে আছে। হাতের ভাঁজ থেকেও ভেজা গন্ধ আসছে। চেয়ারের ওপাশে বসে থাকা ডাক্তার রাশভারি কন্ঠে বললেন,

“আপনি এইচআইভি পজিটিভ। রেসকিউ করার সব উপায় বন্ধ। ”

অবনী কেঁপে উঠলো। রাসিফের সাথে ইন্টিমেট হওয়ার পর থেকেই সে শরীরের পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল। তবে কি অতিরিক্ত লোভ তাকে জীবনের শেষ দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করালো। অবনী রিপোর্ট হাতে ধীর পায়ে উঠে পড়লো। হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে অনিকে ফোন দিল। বলল,

“আমায় আর প্রিয়তার খবর দিতে হবে না। এই পৃথিবীতে আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে।”

অনি খানিকটা আশাহত হলো। ভাবীর খবর বাইরে পাচার করে সে বেশ আয়েশেই ছিল। এখন আর বিনা খাটুনিতে টাকা পাওয়া যাবে না। তবুও অবনীর শেষ লাইনের অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,

“সময় শেষ মানে?”

অবনী সস্তা হাসি দিয়ে বললো,

“পরের খারাপ করতে গিয়ে নিজেকেই হারিয়ে ফেললাম।”

অনি আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। আরও খানিকক্ষণ অবনীর হেয়ালিমাখা কথা শুনে কল কেটে রাখলো।

সেলিনা বেগম প্রিয়তার অবস্থা দেখে চুপ করে আছেন। আরও রক্ত লাগবে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার। অর্ণব ছোটাছুটি করে রক্ত জোগাড় করছে। সেলিনা বেগম রবকে ডাকছেন। ডাক্তার এসে জানান,

“প্রিয়তার অবস্থার উন্নতি নেই। তাকে যেন অন্য কোথাও নেয়া হয়। নাহয় ওরা রোগীকে জেনারেল ওয়ার্ডে দিয়ে দেবে।”

সেলিনা বেগমের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তিনি ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন। অর্ণব এসে সামলে নিল। সে ইউনাইটেডে আইসিইউ বুক করলো। সেলিনা বেগমকে রাজি করিয়ে গাড়িতে উঠলো। প্রিয়তার নিস্তেজ শরীরটা এক কোণায় পড়ে আছে। গা থেকে উজ্জ্বল আভা বের হচ্ছে। সে অক্সিজেন মাস্ক এর ভেতর দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। অর্ণব বুঝতে পেরে মুখটা আলগা করে দিল। প্রিয়তা হালকা গলায় অর্ণবের দিকে চেয়ে বললো,

“আমায় ক্ষমা করে দিয়েন। আপনার সাথে জান্নাতে একসাথে থাকা হলো না।”

অর্ণব ইশারায় প্রিয়তাকে চুপ করতে বলে। প্রিয়তা হাঁপিয়ে বলে,

“একটু পানি খাব।”

অর্ণব মিনারেল ওয়াটারের মুখ খুলে প্রিয়তাকে পানি দিল। প্রিয়তা এক ঢোক খেয়ে মুখ কুঁচকে বললো,

“তিতা লাগছে।”

অর্ণব প্রিয়তার মুখ মুছিয়ে পুনরায় অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিল। দুমিনিট যেতেই প্রিয়তা ইশারা দিল গাড়ির জানালা খুলে দিতে। অতঃপর নীরবতা।

অর্ণব একদৃষ্টে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভারকে বলল,

“গাড়ি ঘুরিয়ে নিন। ও আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ”

হুট করে মাঝরাস্তায় থেমে গেল গাড়ি। সেলিনা বেগমের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠলো বাতাস। তিনি ঘটনা বুঝতে পেরে বলে যাচ্ছেন,

“আমার কলিজার টুকরা! আমার মা! আল্লাহ! আমি কি নিয়ে বাঁচবো।”

অর্ণব চুপচাপ প্রিয়তার মুখ থেকে মাস্ক খুলে দিল। কপালে শুষ্ক ঠোঁট ছোঁয়ালো। প্রতিবারের মতো প্রিয়তা আর কেঁপে উঠলো না। গাল রক্তিমাভ হলো না।

প্রিয়তার মা বিলাপ করে যাচ্ছেন,

“ওরে আমার মেয়ে কোথায়? আমার মেয়ে ফিরিয়ে দাও। মাগো, তুমি কেন এতো অভিমান করলে?”

আশেপাশের গাছে বসে থাকা পাখিগুলো দুঃখীনি মায়ের চিৎকার সহ্য করতে না পেরে উড়ে পালাল।

প্রিয়তাকে তার শ্বশুর বাড়ি আনা হয়েছে। সেলিনা বেগম বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। সজাগ হতেই বিলাপ করছেন। তার গলা ভেঙে গিয়েছে। অর্ণবের বাবা-মা হতভম্ব। আসমা চৌধুরী দুঃস্বপ্নেও এমন পরিস্থিতি কল্পনা করেননি। প্রিয়তাকে তার অপছন্দ হলেও তিনি জানতেন প্রিয়তার মতো অর্ণবকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। তিনি মেয়েটার মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। অপরদিকে তার ছেলে স্বাভাবিক। সে কাঁদছে না।

অর্ণব উপস্থিত মহিলাগণের সামনে বললো,

“আমার স্ত্রীকে আমি শেষ গোসল করাবো।”

কেউ বাঁধা দিল না। অর্ণব কাপড় টানানো উঠানে প্রিয়তার শরীরে নয়া সাবান লাগাচ্ছে। এইখানটায় বৃষ্টির সময় সে প্রিয়তাকে চুমু খেয়েছিল। কি সুন্দর ছিল সেসব মুহূর্ত। অর্ণব প্রিয়তার হাতের উপর পিঠে চুমু খায়। গোসল শেষে অর্ণব প্রিয়তার চোখে কালো সুরমা লাগিয়ে দেয়। ইশ্! মেয়েটা এতো সুন্দর!

আসরের আজান হয়ে গিয়েছে। লাশ মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুত। সেলিনা বেগম খাটিয়া আগলে বসে রইলেন। তিনি কিছুতেই মেয়েকে যেতে দিবেন না। তিনি বলছেন,

“আমার মায়েরে নিও না তোমরা। আমার মা ভয় পাবে। আমার মায়েরে আমার বুকে দিয়ে যাও।”

কয়েকজন মহিলা এসে সেলিনা বেগমকে ভেতরে নিয়ে যায়। ইতোমধ্যে কিছু মানুষ বলছে জানাজা পড়ানোর কি দরকার। মেয়েটা তো আত্মহত্যা করেছে। নিশ্চয়ই জাহান্নামি। অর্ণবের কানে কথাগুলো এলো। সে কপট জবাব দিল,

“ও আত্মহত্যা করেনি। ওকে আমি মেরেছি। জাহান্নামি হলে আমি হবো। আপনারা দয়া করে আমার স্ত্রী সম্পর্কে বাজে কথা বলবেন না।”

কিছুক্ষণের মাঝে লাশ জানাজা হয়ে গেল। অর্ণব খাটিয়ার হাতল কাঁধে নিয়েছে। নিজ হাতে প্রিয়তমা স্ত্রীকে কবরে শুইয়ে দিল। মুঠো মুঠো মাটি কবরের উপর ফেলতে লাগলো। একসময় মাছের পেটের মতো কবর ভরাট হয়ে আসল। সব লোকজন বিদায় নিল। অর্ণব কবরের পাশে ঠায় বসে রইলো। মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলে অর্ণব ছাতা নিয়ে এসে কবরের উপর ধরে। মিষ্টি কন্ঠে বলে,

“ভয় পেয়ো না, প্রিয়ু। তোমার অর্ণব সবসময় তোমারই আছে। তুমি থাকলেও আছে না থাকলেও আছে। কারণ তুমি যে আমায় জিতে গিয়েছ।”

পৃথিবীর ভয়ঙ্কর কাজের মধ্যে একটি হলো একজন পুরুষকে সারা জীবনের জন্য এক নারীতে আসক্ত করে দেয়া। অর্ণব হয়তো সেই ব্যাতিক্রম এবং ভাগ্যবান পুরুষদের একজন। তাইতো জীবনের সত্তরটা বসন্ত পেরিয়ে গেলেও তার একমাত্র শান্তির স্থান প্রিয়তার কবরের পাশটা। আজও সে প্রিয়তাকে আগের মতো অনুভব করতে পারে, ইচ্ছে হলে কল্পনায় ছুঁতে পারে। তার ধারণা প্রিয়তা মরে যায়নি। তাকে শাস্তি দিতে চোখের আড়াল হয়েছে শুধু। অর্ণব বিড়বিড় করে বলে,

“আমি বুড়ো হয়ে গেলাম, অথচ তোমার বয়স তো আটকে গেল, প্রিয়ু। তুমি কি আগের মতোই আমাকে ভালোবাসো?”

অর্ণব কবরে কান পেতে রইলো। তার মনে হলো ভেতরে কোনো যুবতী ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here