সরোবরে প্রেম পর্ব ১৭

0
828

সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১৭

সেলিনা বেগমের ঘুম আসছে না। শরীরে অদৃশ্য জ্বলন হচ্ছে। অস্থির লাগছে। তিনি মেয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলেন বারকয়েক। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সেলিনা বেগমের বুক কেঁপে উঠলো। তিনি কাব্যকে ডাকেন। প্রিয়তার সাড়া পাওয়া যায় না অনেকক্ষণ। অবশেষে দরজা ভাঙা হয় ঘরের কোণায় পড়ে থাকা শাবল দিয়ে। সেলিনা বেগম হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকেন। ফ্লোরজুড়ে লাল রক্ত, তার মেয়ের নিথর দেহ লুটোপুটি খাচ্ছে। পাশেই কাগজের টুকরো, সেটাতেও রক্তের ছিটেফোঁটা লেগেছে। কাব্য দৌড়ে অ্যাম্বুলেন্স ডাকে। সেলিনা বেগম মেয়ের মাথা নিজের কোলে নেন। চিৎকার করতে থাকেন অপ্রকৃতস্থের মতো।

হসপিটালের বেডে প্রিয়তার পলকা দেহ পড়ে আছে। ইতোমধ্যে চার ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ব্লাড লসের কারণে শরীর সাদা হয়ে গিয়েছিল। ব্যাথায় এবং ভীষণ মানসিক চাপে প্রিয়তা অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরেনি এখনো। সেলিনা বেগম পাঁচশ রাকাত নফল নামাজ মানেন আল্লাহর নিকট। বিনিময়ে মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা চান। তিনি একনাগাড়ে দোয়া দুরুদ পড়ে যাচ্ছেন।
অর্ণব ছুটে আসে হসপিটালে। সেলিনা বেগম তাকে জানাননি। হয়তো কাব্য ফোন করেছে। অর্ণবের শার্ট কুঁচকে আছে, মাথার চুল এলোমেলো, চোখেমুখে অপরাধবোধ। সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,

“মা, আমার প্রিয়ু কোথায়?”

সেলিনা বেগম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটান। তিনি কষে থাপ্পড় বসান অর্ণবের গালে। অর্ণব মাথা নিচু করে রাখেন। তিনি প্রিয়তার লেখা চিঠিটা অর্ণবের মুখে ছুড়ে ফেলেন। অর্ণব নিজেকে সামলে লেখাগুলো পড়ে। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। প্রিয়তার মনে এতোটা কষ্ট জমে ছিল সে বুঝতেই পারেনি। সে কাতর কন্ঠে বলে,

“মা, আমি ওকে একবার দেখতে চাই। ওর সাথে কথা বলতে চাই।”

“সেই অধিকার তোমার নেই। তোমার জন্য আজ আমার মেয়ের এই অবস্থা। পারবে আমার সুস্থ প্রিয়তাকে ফিরিয়ে দিতে?”

“আমায় ওর কাছে যেতে দিন, মা।”

“আমি চাই না প্রিয়তার সাথে তোমার আর কোনো কথা হোক। এতোদিন আমি নিজের মেয়ের দোষ খুঁজে চলেছি। কখনো ওর মনের খবর জানতে চাইনি। আরে কেমন স্বামী তুমি, নিজের স্ত্রীর মন বুঝতে পারো না? আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না। বিদায় হও। প্রিয়তাকে দিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দিব তোমার কাছে।”

অর্ণব এবার সেলিনা বেগমের পায়ে ধরে। হাসপাতালের মানুষরা এক শক্তপোক্ত, বলিষ্ঠ পুরুষকে আকুল হয়ে কাঁদতে দেখে। অর্ণব অনুনয় করে বলে,

“আমায় একটা শেষ সুযোগ দিন, মা। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।”

“তাহলে ওকে আমার কাছে দিয়ে গেলে কেন? এতো গুমর তোমার? তুমি হারিয়ে বুঝবে আমার মেয়ে কি ছিল!”

অর্ণব কাঁদতে থাকে। সে চোখের পানি মুছে বলে,

“সিদ্ধান্ত পড়ে নেবেন, মা। আমায় শুধু একটাবার ওর কাছে যেতে দিন।”

সেলিনা বেগমের পাথর মন গলে না। মেয়ের কষ্ট সিধা তার অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তিনি মেয়েকে আর কষ্ট দিতে চান না। তিনি ডাক্তারদের সাথে কথা বলেন যেন প্রিয়তার কাছে অপরিচিত কাউকে ঢুকতে না দেওয়া হয়।

অর্ণব নিজের চুল টেনে ধরে। সে কেন প্রিয়তাকে একটু বোঝার চেষ্টা করল না? মেয়েটা কি খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছে? ওর কিছু হয়ে গেলে অর্ণব কিভাবে থাকবে? অর্ণবের সেসব সুখের দিনের কি তবে সমাপ্তি ঘটলো? আর কখনো তার প্রিয়ুকে সে বুকে জড়িয়ে ঘুমুতে পারবে না? ভাবতে গেলেই তার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসে। অর্ণব নামাজের জন্য অযু বানায়। জায়নামাজ বিছিয়ে নেয় করিডোরের ফাঁকা জায়গায়। মোনাজাতে প্রিয়তমা স্ত্রীর জীবন ভিক্ষা চায় রবের নিকট।

খানিকবাদে আগমন ঘটে আসমা চৌধুরী আর আমিন চৌধুরীর। সেলিনা বেগম তাদেরকেও প্রিয়তার কাছে ঘেঁষতে দেন না। শুনিয়ে দেন কয়েকটা কটু কথা। বলেন সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার কথা। আমিন চৌধুরী বেয়ানকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। সেলিনা বেগম মানতে নারাজ। বাধ্য হয়ে তারা চলে যান।

প্রিয়তার পালস রেট অস্বাভাবিক। হার্টবিটও এবনরমাল। ইসিজি কার্ভ হুটহাট থেমে যাচ্ছে। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে আইসিইউ তে শিফট করেন। সেলিনা বেগমের কাছে এসে বলেন,

“মনে হয় না আপনাদের রোগী সারভাইব করবে। কারণ সে নিজেই বাঁচতে চাইছে না। আপনারা আল্লাহকে স্মরণ করুন।”

অর্ণবের কর্ণপাত হয় কথাগুলো। তার শরীর অবশ হয়ে আসে। সেলিনা বেগম অচেতন হয়ে যায়। কাব্য এসে মাকে ধরে। অর্ণবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আপনি আপুর কাছে যান, ভাইয়া। আম্মুকে আমি দেখবো।”

অর্ণব ডাক্তারের সাথে কথা বলে নিজের পরিচয় দেয়। নির্ধারিত পোশাক পড়ে নেয়। প্রিয়তার রুমে ঢুকতেই তার বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়। কি হাল হয়েছে মেয়েটার? বুক হাপড়েের মতো উঠানামা করছে। প্রিয়তা যেন নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে রবের দুয়ারে। পৃথিবীর সমস্ত মায়া ত্যাগ করে পারি জমাচ্ছে অন্যত্র। অর্ণব সাবধানে প্রিয়তার মুখ ছুঁয়ে দেয়। হাতটা বুকের কাছে নিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। বলে,

“আ’ম সরি, সোনা। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও, প্রিয়ু। আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দেব না। তোমার দোষ থাকলেও আমি কিছু বলবো না। তবুও আমায় একা করে যেও না, প্রিয়ু। আমি বাঁচতে পারব না। প্লিজ, সোনা।”

এমন হাহাকার হয়তো সহ্য করতে পারলো না প্রিয়তা। ঝুপ করে চোখ থেকে তপ্ত জলের ফোঁটা ছাড়লো। অর্ণব সন্তপর্ণে প্রিয়তার চোখের পানি নিজের শুষ্ক ঠোঁট দিয়ে শুষে নেয়। অর্ণব আবার বলে,

“তুমি আমার বাঁচার কারণ, প্রিয়ু। যদি তোমার কিছু হয়ে যায় আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করবোনা।”

অচেতন হলেও প্রিয়তার অবচেতন মন কথাগুলো শোনে। বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যায় ক্রমাগত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here