সরোবরে প্রেম পর্ব ১১+১২

0
660

সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১১

অর্ণবের কাজে ধারাবাহিকতা আসছে না। সে একের পর এক কেস হিস্ট্রি লিখে যাচ্ছে প্যাডে। তবে মাথায় চক্রাকারে ঘূর্ণন করছে প্রিয়তা। মোবাইল হাতে নিয়ে কল টেক্সট করতে গিয়ে ব্যাকস্পেস চেপে সব মুছে ফেলল। প্রিয়তার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। এবার অর্ণব ওকে কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

প্রকৃতিতে বর্ষার ঘনঘটা। হুট করেই আকাশ কালো হয়ে আসে। যেন নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ অপপ্রয়াস। দিনভর জুড়ে চলে একটানা বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দে প্রিয়তার ঘোর লেগে যায়। সে একমনে আকাশপানে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকে। নিজের জীবনের সমীকরণগুলো মেলানোর চেষ্টা চালায়। প্রিয়তার স্বপ্ন ছিল উকিল হওয়া। লজিক দিতে বেশ পারদর্শী সে। সে জন্যই ‘ল’ নিয়ে পড়ছে। থমকে যাওয়া পথিকের মতো সে পড়াশোনার ইতি টানতে পারবে না। তাকে লড়াকু হতে হবে। সে লড়াই বেশ কাঠিন্যতা দেখাবে। প্রিয়তা ঠিক করলো সে শক্ত হাতে সব সামলাবে। সে আসমা চৌধুরীর রুমের দিকে পা বাড়ালো।

আমিন চৌধুরী চা খেতে খেতে পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজে চোখ বুলাচ্ছিলেন। আসমা চৌধুরী কাপড় গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন।
প্রিয়তা কেশে গলা পরিস্কার করে নিল। গলার স্বর যথাসম্ভব দৃঢ় রেখে বললো,

“আমি পড়াশোনা করবো, বাবা। আপনাদের আপত্তি থাকলে আমার নিজের টাকায় পড়ব। সংসার সামলে আমি ভার্সিটি যাব, কথা দিলাম।”

আমিন চৌধুরী নড়েচড়ে বসলেন। বললেন,

“অবশ্যই পড়বে, মা। আমি তোমার পাশে আছি।”

আসমা চৌধুরী খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,

“আমার ছেলের ইনকামে তোমার ভালোই চলবে। তোমার পড়াশোনা, চাকরি এসব করার দরকার টা কি?”

প্রিয়তা জবাব দেয়,

“আমি নিজের মানসিক স্বাধীনতা আর শান্তির জন্য পড়তে চাই, মা। আমি জানি ওনি আমার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু আমিও এই সংসারে কন্ট্রিবিউট করবো।”

আসমা চৌধুরী স্বামীর সামনে মুখ ফুটে সব বলতে পারলেন না। কথা জমিয়ে রাখলেন।

অনি কলেজে যাওয়ার পথে রোজ একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মাথায় কোকড়া চুল, হাইটে মোটামুটি। দেখতে আহামরি সুন্দর নয়। তবে চোখের গভীরতা বিশাল। যে কেউ ডুবে মরবে। অনি কয়েক হাত এগোতেই ছেলেটা কাগজের একটা চিরকুট অনির হাতে গুঁজে দৌড়ে স্থান ত্যাগ করে। অনি দু ঠোঁট প্রসারিত করে। দুরুদুরু বুকে চিরকুট খোলে। সেখানে লেখা,

“তোমার মুখটা পৃথিবীর সব সব মায়াকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাখে। আমি কি সমগ্র জীবন আমার একান্ত ব্যাক্তিগত চাঁদকে নিজের বুকে জায়গা দিতে পারবো?”

অনির শরীর আবেশে অবশ হয়ে আসে। এতো সুন্দর কথা! কতো ছেলেই তো ওকে পছন্দ করে। কারো কথায় তো এমন মাদকতা ছিল না। এ তবে কেমন অঘটন।

ধীর পায়ে কলেজের রাস্তা ধরে অনি।

রাতে প্রিয়তা খিচুড়ি রান্না করে। সাথে গরুর মাংস। সবাই খেতে বসে। অর্ণব একবারও প্রিয়তার দিকে তাকায় না। আসমা চৌধুরী খানিকক্ষণ গজগজ করেন। অর্ণব জবাব দেয় না। নীরবে খেয়ে রুমে চলে যায়।

রুমের ভেতরটা ধোঁয়াময়। অর্ণব একের পর এক সিগারেট টানছে। খুব বেশি অভ্যস্ত নয় বলে কাশছে। প্রিয়তা সপাটে এক চড় বসায় অর্ণবের গালে। সিগারেট ছিটকে পড়ে খানিক দূরে। অর্ণব ম্লান চোখে বদলে যাওয়া প্রিয়তাকে দেখে। প্রিয়তা ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে থাকে। তারপর বলে,

“মেরে ফেলছেন না কেন আমায়। এভাবে কষ্ট দিতে পারলেন?”

অর্ণব রুমের দরজা লাগিয়ে বলে,

“স্বামীর পরিপূর্ণ অধিকার তুমি আমায় দিয়েছ?”

“আমি একটু সময় নিতে পারি না?”

“দুজন দুজনকে ভালোবাসলে সময়ের প্রয়োজনীয়তা কোথায়?”

অর্ণব প্রিয়তার হাত নিজের হাতে নেয়। বলে,

“তুমি আমায় জ্বালিয়ে অঙ্গার করেছো। পুরুষ মানুষের কষ্ট বোঝো? যদি সত্যি ভালোবেসে থাকো তবে সত্যটা বলো। নাহয় আমায় হারাবে।”

প্রিয়তা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। সে প্রভুর নাম স্মরণ করে অর্ণবকে সবটা বলে।

অর্ণবের আগুন রাঙা চোখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়তা আরেকবার কেঁপে উঠে। অর্ণব প্রিয়তার বাহু ছেড়ে দেয়। তারপর বলে,

“তোমায় আমার আগে অন্য কেউ ছুঁয়েছে। ছিহ! আমি তোমায় কখনোই আর ভালোবাসতে পারব না, প্রিয়তা। আমার সামনে থেকে চলে যাও।”

কল্পনার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়তা। সে অনুভূতিশূন্য অনুভব করে। উহু, অর্ণবকে কখনোই সত্যটা বলা যাবে না। থাকুক না একটু রহস্য। প্রিয়তা গ্লাস থেকে খানিকটা পানি খায়। এরপর আলমারি থেকে লাল রঙের একটা শাড়ি বের করে।

প্রিয়তা শাড়ি পড়তে জানে না। বাসায় থাকতে মা পড়িয়ে দিত। খানিকটা এলোমেলো ভঙ্গিতে সে শাড়ি প্যাঁচিয়ে নেয়। মেয়েদের একটা বিশেষ ধর্ম আছে। তারা সমসময় ভালোবাসার মানুষের জন্য সাজতে পছন্দ করে। প্রিয়তা হালকা সেজে পায়ে আলতা লাগায়। কপালে ছোট লাল টিপ বসায়। এরপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে চুড়ি পড়ে দু’হাতে।

অর্ণব রুমে ঢুকতেই প্রিয়তা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। শার্ট খামচে বলে,

“আজ রাতে কোনো চুপকথা নেই। ”

অর্ণবের রাগ যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে যায়। সে চোখ মেলে প্রিয়তাকে দেখে। হুট করে বলে,

“এতো কষ্ট করে শাড়ি পড়লে, আমি যদি খুলে ফেলি তুমি কি খুব বেশি রাগ করবে, প্রিয়ু?”

প্রিয়তার বুক শুকিয়ে যায়। ভয়ে সে হাসফাস করতে থাকে। তবুও মনে জোর রেখে বলে,

“আমি তো আপনারই। আপনার উপর কখনো রাগ করতে পারি!”

অর্ণব প্রিয়তার নরম গালে চুমু খায়। প্রিয়তার শরীর কাঁপতে থাকে। আজ মানুষটা যাই করুক সে বাঁধা দেবে না। একটুও না।

চলবে?
সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১২

প্রিয়তা পিঠসমান লম্বা চুলগুলো থেকে পানি ঝারছে। অর্ণব তাকিয়ে দেখে। সে ভালোবাসে বলেই কি মেয়েটাকে এতো সুন্দর লাগে? নাকি মেয়েটা আড়ালে একটু বেশি সুন্দর! প্রিয়তার গোলাকার মুখ, বড় বড় চোখ, ঈষৎ চাপা নাক,নাকের উপরদিকটায় মানানসই একটা তিল। নরম পেলব গালে হালকা ক্রিমের ছাপ। চোখের দৃষ্টি গভীর। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় অর্ণবের। সে এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে জানায়,

“উফ,ছাড়ুন তো।”

অর্ণব ছাড়ে না। প্রিয়তা অর্ণবকে খানিকটা জ্বালানোর সুরে বলে,

“ভাবছি, চুলগুলো খানিকটা ছোটো করবো।”

অর্ণব ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বলে,

“আমায় মেরে ফেলো, তবুও চুলে হাত দেবে না। লম্বা চুল আমার ভীষণ পছন্দ। ”

“তার মানে আপনি আমার চুলকে ভালোবেসেছেন, আমাকে না!”

অর্ণব প্রিয়তার দু বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তারপর বলে,

“তোমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কি,প্রিয়ু?”

“ছেড়ে না যাওয়া।”

“উহু, ভালোবাসা মানে তাকে ঘিরে সবকিছুকেই ভালোবাসা। যে পুরুষ একবার এক নারীর মায়ায় পড়ে সে কখনোই আর সে মায়া কাটাতে পারে না। ”

প্রিয়তা মুগ্ধ চোখে অর্ণবের পানে চায়। মানুষটা কি স্নিগ্ধ! ভোরের প্রথম শিশিরের মতো। কিশোরীর বেলি মালার মতো। মানুষটার ছোঁয়া ওকে ব্যাকুল করে তোলে। কথা বুকে আছড়ে পড়ে। কি মৃদু সুখ সুখ অনুভূতি। প্রেমে না পড়লে কখনোই জানা হতো না।
প্রিয়তা মায়াভরা কন্ঠে ডাক দেয়,

“অর্ণব।”

“হু।”

“ছাড়ুন, ভার্সিটি যাব তো।”

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে প্রিয়তা খেতে বসে। আমিন চৌধুরী খেয়ে রুমে বিশ্রাম করছেন। আসমার চোখে বিস্ময় এবং রাগ। তিনি জিজ্ঞেস করে,

“তোমায় ভার্সিটি যেতে বারণ করেছিলাম।”

প্রিয়তার সব উত্তর সাজানো। সে হাসিমুখে বলে,

“আমি পড়াশোনা ছাড়বো না, মা।”

অর্ণব মাকে বলে,

“মা, তুমি তোমার মানসিকতা বদলাও। তাছাড়া প্রিয়তার পড়াশোনা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। স্বামী হয়েছি বলেই ওকে আটকে রাখতে হবে না। বরং ওর মতামতকেও প্রাধান্য দেয়া উচিত।”

আসমা চৌধুরী নীরব হয়ে যান। ছেলের কথায় তার বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিন অর্ণব তার কোলে ছিল। নরম পাখির ছানার মতো। ধরতে গেলেই হাত ফসকে যেত। আসমা সারাক্ষণ ছেলেকে বুকে চেপে রাখতেন। সেই ছেলে আজ মায়ের মুখের উপর জবাব দেয়। তিনি ধীর পায়ে রুমের দিকে যেতে থাকেন।

অবনী বসেছে ব্লু রাডিসনের আভিজাত্যপূর্ণ এক রুমে। গ্লাসে ওয়াইন জাতীয় একটা পদার্থ। সে একটু পরপর চুমুক দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। এবং পরিচিত ভঙ্গিতে তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ছে। সে পা দুটো কাচের টেবিলের উপর তুলে দেয়। কাউকে ফোন দিয়ে বলে,

“প্রিয়তার আপডেট কি?”

“আজ ভার্সিটি গিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ওর সব ঠিকঠাক। ”

অবনী রাগের চোটে হোয়াইনের গ্লাস ছুড়ে মারে। ফ্লোরে পড়ে সেটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। অবনী ভাবছে, সত্যিই সে প্রিয়তার ক্ষতি করতে পারবে? নাকি টাকাগুলো জলে গেল!

কিছুদিন ধরেই অর্ণব খেয়াল করছে প্রিয়তার শরীর হলুদ হয়ে আছে। চোখদুটো ভয়ানক লাল। শুরুতে অর্ণব জন্ডিস ভেবে SGPT টেস্ট করায়। পরপর দুবার করার পরেও রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। অর্ণব ভাবছে প্রিয়তাকে ভালো কোনো মেডিসিন ডাক্তার দেখাবে।

রাতে ঘুমের মধ্যে প্রিয়তা ছটফট করে। বারবার অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমায় ছেড়ে যাবেন না, প্লিজ।”

অর্ণবের বুকে মোচড় দেয়। সে কাতর কন্ঠে বলে,

“আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাব না, প্রিয়ু।”

বলেই প্রিয়তার মাথাটা নিজের শক্তপোক্ত বুকে আগলে নেয়। তবুও প্রিয়তা কাতরাতে থাকে হিস্টিরিয়ার রোগীর মতো। অর্ণব উঠে প্রিয়তার হাত-পা মালিশ করে। কিছুতেই প্রিয়তা স্বাভাবিক হয়না। থাকতে না পেরে অর্ণব আসমা চৌধুরীকে ডেকে আনে। তিনি এসে সূরা ফাতিহা আর দূরদ পড়ে প্রিয়তার মাথায় ফু দেন। খানিকটা পানি খাওয়ান। খানিকটা শান্ত হয় প্রিয়তা।

অর্ণব মাকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখে পানি চিকচিক করছে। চাঁদের আলোয় তা আরো স্পষ্ট। অর্ণব মাকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে। বলে,

“ওর কিছু হলে আমি মরে যাব, মা।”

আসমা চৌধুরী ছেলেকে শান্ত করেন। বলেন,

“নামাজ পড়ে বউয়ের জন্য দোয়া কর।”

চলবে?

খুব ছোটো পার্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত। একটু পরপর বাবুকে কোলে রাখতে হচ্ছে। লিখার সময় পাচ্ছি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here