সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:০৯
অর্ণব আলতোভাবে প্রিয়তার গালে হাত রাখলো। মিষ্টি কন্ঠে শুধালো,
“কাঁদছ কেন, প্রিয়ু?”
প্রিয়তা যেন পাখির ছানার ন্যায় মিইয়ে গেল। কাঁপা ঠোঁটে উচ্চারিত হলো,
“আপনার সারাদিন কাজ থাকে। আমার কথা একটুও মনে পড়ে না।”
অর্ণব হালকা হয়ে আসলো। মেয়েটার অভিমান হয়েছে। সে প্রিয়তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বললো,
“আমার কাজ আমার দায়িত্ব। আর তুমি আমার দুনিয়া। তোমায় আমি কিভাবে ভুলি, প্রিয়ু। একটু বুঝবে না আমাকে?”
অর্ণবের কথায় প্রিয়তার অভিমানের পাল্লা খানিকটা হালকা হলো। সে কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হলো।
রাতে প্রিয়তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। অর্ণব প্রিয়তার শরীর মুছে দেয়। মাথায় নরম পাতলা কাপড় পানিতে ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে থাকে। হুট করে অর্ণবের ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠে। অর্ণব খানিকটা বিরক্ত হয়ে দেখে হাসপাতালের কল। সে ধরে কর্কশ গলায় বলে,
“হ্যালো।”
উপাশ থেকে কেউ তাড়াহুড়ো করে বলে,
“ইমারজেন্সিতে কোনো ডাক্তার নেই,অর্ণব। ইমিডিয়েট সি-সেকশন করতে হবে এমন একজন রোগী এসেছে। আপনি এসে হ্যান্ডেল করুন।”
অর্ণব দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় প্রিয়তার কপালে চুমু দিয়ে যায়। অনিকে বলে যায় ভাবীর খেয়াল রাখতে।
ওদিকে জ্বরে কাঁপতে থাকা প্রিয়তার চোখ থেকে দুফোঁটা তপ্ত আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
ভোর ছয়টার দিকে অনেক চেষ্টার পর গ্রাম্য এক অল্পবয়সী বউয়ের ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান হয়। অর্ণব খুব সাবধানে অম্বিলিকাল কর্ড কেটে বাচ্চাকে মা থেকে আলাদা করে নেয়। এরপর হ্যাঁচকা টানে পুরো গর্ভফুল হাত দিয়ে বের করে নিয়ে আসে। মায়ের মুখে এখন বিশ্বজয়ের হাসি। চোখের কোণায় পানি। ভারী অদ্ভুত দৃশ্য।
অর্ণব নার্সের হাতে বাচ্চাকে দিয়ে বেরিয়ে যায়। যেতে যেতে শুনতে পায় সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চার বাবার মুখে আজানের মিষ্টি ধ্বনি। খানিকপরে মা আর বাচ্চাকে চেক-আপ করতে আসে। এসে মায়ের হাতে নীল শিরা বের করে আইভি স্যালাইন পুশ করে। আরেক হাতে রক্তের ক্যানোলা লাগায়। ফিরে যেতেই গ্রাম্য মহিলা চোখ নামিয়ে বলে,
“স্যার, জীবনেও ভাবি নাই এই পোলা নরমালে হইব। আফনার লাইগা সম্ভব হইছে। আফনে তার নাম রাইখা দেন।”
অর্ণব বাচ্চার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আবদুল্লাহ। ”
প্রিয়তার জ্বর বেশ কমেছে। তবে শরীর দুর্বল। সে পরনের জামা পাল্টে নাস্তা বানায়। অনিকে ডেকে খেতে বসায়। অনি পরোটা চিবুতে চিবুতে বলে,
“ভাবি, তুমি খাবে না?”
“আমার খিদে নেই। তুমি খাও।”
“ভাইয়া তোমার খেয়াল রাখতে বলেছে। তুমি না খেলে আমিও খাব না।”
অনির বাচ্চামোতে প্রিয়তা হাসার চেষ্টা করে। এরপর প্লেটে পরোটা নিয়ে খানিকটা খেয়ে উঠে যায়।
বাসায় ফিরে ঘামে জবজবে শরীরে অর্ণব প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
“রাগ করো না, প্রিয়ু। আমি না গেলে ভীষণ সমস্যা হতো রোগীর।”
প্রিয়তা শ্বাস ফেলে বলে,
“কাপড় পাল্টে আসুন,খাবার দিচ্ছি। ”
“এমন অভিমান করো না,প্রিয়ু। আমার কষ্ট হয়।”
প্রিয়তা নিজের ব্যস্ততা গোছাতে থাকে। অর্ণব পেছন থেকে একটা বেলির গাঁজরা প্রিয়তার চুলে গুঁজে দেয় আনাড়ি হাতে। প্রিয়তা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
“ছাড়ুন তো।”
অর্ণবের হাত আরো শক্ত হয়। সে প্রিয়তার নরম শরীরটাকে যত্নে জড়িয়ে রাখে। যেন একটু হাত আলগা হলেই পালিয়ে যাবে।
প্রিয়তা কেঁদে ফেলে। হুট করে সামনে ফিরে অর্ণবের গলা জড়িয়ে বলে,
“আমায় একা ছেড়ে কেন চলে যান আপনি? আমি থাকতে পারি না। দম আটকে আসে।”
অর্ণব প্রিয়তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বলে,
“তোমায় ছেড়ে আমি কোথায় যাব, প্রিয়ু। আমার ইচ্ছে করে সারাক্ষণ তোমার সাথে মিশে থাকি। কিন্তু ডাক্তারি না করলে বউকে খাওয়াবো কি?”
“আমার কিছু লাগবে না। শুধু আপনি আমার সামনে সবসময় থাকবেন।”
“তুমি এতোটা দুর্বল কবে হলে,প্রিয়ু?”
“জানি না, আপনি আমার থেকে দূরে যেতে পারবেন না। আর কোনো কথা শুনবো না আমি।”
অর্ণব প্রিয়তাকে নিজের কোলে বসায়। পিঠের চুলগুলো একপাশে সরিয়ে কাঁধে থুতনি ঠেকায়। বলে,
“কাল থেকে ভার্সিটি যাওয়া শুরু করো। তখন আর এমন একা ফিল হবে না। ”
প্রিয়তা মুখ বাকিয়ে বলে,
“সব আমার থেকে দূরে যাওয়ার ধান্দা। বুঝি আমি।”
অর্ণব হাসে। সেই হাসির ছোঁয়া প্রিয়তার কাঁধে খেলতে থাকে। প্রিয়তার হুট করে মনে হয় এই মানুষটার উপর সে কখনো রেগে থাকতে পারবে না। কখনোই না।
অবনী খানিকক্ষণ ধরে একটা কথা ভাবছে। এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। তবে এর জন্য তাকে বেশ টাকা এবং পরিশ্রম ব্যায় করতে হবে। অবনীর কুৎসিত হাসিতে ভরাট হয়ে আসে ঘরের আবহাওয়া।
ঘুমের সময় প্রিয়তা পাতলা একটা জামা পড়ে। এতে বেশ আরাম লাগে। অর্ণব বারান্দায় বসে আছে। তার গায়ে ধূসর রঙের টি-শার্ট। গোসল সেরে আসায় চুলে সামান্য পানির ঝাপটা লেগে আছে। বাইরে মেঘ ডাকছে। কালবৈশাখী ঝড় হবে হয়তো। প্রিয়তা একটা পাতলা চাদর নিয়ে আসে। অর্ণবের কাছে গিয়ে বলে,
“এটা গায়ে জড়ান। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
অর্ণব চাদর গায়ে জড়িয়ে প্রিয়তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। অর্ণবের গায়ের উষ্ণতায় আর চেনা পুরুষালি গন্ধে প্রিয়তার অন্তর কেঁপে উঠে। খানিকক্ষণ বসে বৃষ্টির আমেজ গিলে খায় কপোত-কপোতী। অর্ণব হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলে,
“তোমার চুলে কি দাও, প্রিয়ু। আমার নেশা ধরে যায়। খুব ছোটবেলায় একবার ভুল করে সিগারেট খেয়েছিলাম। অনেক কষ্টে সে নেশা ছাড়িয়েছি। তুমি কি সিগারেট ফ্লেভারের শ্যাম্পু মাখো, প্রিয়ু।”
“ছিহ, আপনি সিগারেট খেতেন!”
“সব ছেলেই কম-বেশি খায়। এখন তো আর খাই না। ”
প্রিয়তা চোখ রাঙিয়ে তাকায়। অর্ণব অনুনয়ের সুরে বলে,
“আজ একটা ভুল করবো,প্রিয়ু। তুমি কি অনুমতি দিবে?”
প্রিয়তা হুট করে উঠে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে,
“আমি এখনো ওসবের জন্য প্রস্তুত নই।”
চলবে?
সরোবরে প্রেম
লেখনীতেঃশ্যামকন্যা
পর্ব:১০
অর্ণবের ভারী নিশ্বাসের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়তার চোখের কোণায় পানি। সে যখন ক্লাস ফোরে পরে তখনকার ঘটনা:
খুব ধীরে প্রিয়তা বড় হচ্ছে। চারপাশের সবকিছু শেখার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে একদিন ওর খালাতো ভাই বাসায় বেড়াতে আসলো। প্রিয়তা ওর সাথে ছোটাছুটি করে খেললো। খানিক পরেই সবাই যখন দুপুরের ভাতঘুম দিচ্ছে তখন প্রিয়তার খালাতো ভাই আর প্রিয়তা টিভি ছেড়ে দিল। টিভি ছাড়তেই বাংলা সিনেমার টিউন বাজতে থাকলো। সেখানে ছিল আপত্তিকর এক দৃশ্য। দুজনেই চোখ বড় করে গিললো খানিকক্ষণ দৃশ্যটা। এরপর ভাইটা প্রিয়তাকে বললো,
“এই খেলাটা খেলবি?”
প্রিয়তা ভয়ে ঢোক গিলে বলল,
“আয়,খেলব।”
বদ্ধ ঘরে ঘটেছিলো অপ্রীতিকর এক ঘটনা। যা প্রিয়তা কখনোই মুছে ফেলতে পারবে না।
প্রিয়তা একবার ভাবলো অর্ণবকে সব জানাবে। পরক্ষণেই ভাবলো, স্ত্রীর ভয়ংকর অতীত স্বামী থেকে দূরে থাকাই ভালো। অর্ণব যদি সেই ঘটনার রেশ ধরে প্রিয়তাকে ছেড়ে দেয়!
ঘুমের মাঝে প্রিয়তা অর্ণবকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে শক্ত পুরুষালি হাত প্রিয়তাকে বাঁধা দেয়। প্রিয়তা গলার স্বর নামিয়ে বলে,
“এখনো রাগ করে আছেন? আমার ঐসব দিন চলছে তো।”
অর্ণব খানিকটা শান্ত হয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করে। তারপর উল্টোদিকে ফিরে ঘুমুতে উদ্যোত হয়। প্রিয়তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে চাপা দীর্ঘশ্বাস। প্রিয়তা কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে তার কালো অতীত কখনো অর্ণবকে জানাবে না। পুরুষ মানুষ সব সহ্য করকেও রূপবতী স্ত্রীর অপ্রীতিকর অতীত মেনে নেয় না। তা সে যতোই ভালো মানুষ হোক না কেন।
ঘুম থেকে উঠে অর্ণব হাসপাতালে যাওয়ার জন্য নিজেকে গোছাতে থাকে। প্রিয়তা প্রেমময় চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। অর্ণবের খাড়া নাক। জোড়া ভ্রু। মাথায় সাজানো চুল। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। প্রিয়তার ভেতরটা নড়ে উঠে। এই সুদর্শন মানুষটা তার একান্ত সম্পত্তি। আচ্ছা, অর্ণবের কোনো ভয়ঙ্কর অতীত নেই তো?
প্রিয়তা গোসল করে অফ হোয়াইট কালারের একটা জামা পড়ে গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে নেয়। অর্ণবের রাগ তাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে। এটাকে বলে ঠান্ডা রাগ। যে রাগে অন্তর জ্বলে-পুড়ে যায় না, জমে যায়।
আসমা চৌধুরী সকালে উঠে দেখেন এখনো নাস্তা তৈরি হয়নি। তিনি মিনিট কয়েক চুপচাপ বসে রইলেন। ততোক্ষণে প্রিয়তা কাছাকাছি এসে বললো,
“মা, আমি ভার্সিটি যাচ্ছি। ”
আসমা চৌধুরী হতভম্ব চোখে তাকালেন। বললেন,
“ঘরের বউ হয়ে বাইরে আবার কি? তার উপর আজ নাস্তাও বানাও নি।”
“আজ শরীরটা একটু খারাপ, মা।”
“এসব কথা আমায় বলে লাভ নেই, প্রিয়তা। আমার ছেলে না খেয়ে বের হওয়ার জন্য বউ এনেছি? সংসার সামলাও। এবাড়িতে থেকে তুমি পড়াশোনা করতে পারবে না।”
“বিয়ের আগে তো আমার পড়াশোনা নিয়ে আপনাদের সমস্যা ছিল না।”
“বিয়ের আগে পরে আসমান-জমিন ফারাক। এখন গিয়ে নাস্তা বানাও। তার আগে তোমার শ্বশুরকে এক কাপ চা করে দাও।”
প্রিয়তা চোখের পানি গোপন করে রুমে গেল। তার গলার কাছে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে আছে। সে রুমের দরজা লাগিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদলো। হুট করে মনে হলো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করাটা পাগলামি ছিল। বিয়ের পর সেটা বুঝতে তার দেরী হয়ে গিয়েছে।
অবনী অনেক খুঁজে নিস্তব্ধ জায়গায় একজন মানুষের সাথে দেখা করে। তার কাছে মূল্যবান কিছু উপাদানের সমাহার। প্রিয়তার ঝরে যাওয়া চুল, তার কেটে ফেলা নখের টুকরো, এঁটো করা ভাত।
বেঁটেখাটো মানুষটার থুতনিতে লম্বা দাড়ি। পরনে জোব্বা। চোয়ালে পান খাওয়া লাল দাঁত। সে গর্জনের সুরে বলে,
“কাজ শেষ হওয়ার পর বাকি টাকা দিবেন। আমার কাজ একশভাগ ফলপ্রসূ। ”
অবনী কুৎসিতভাবে হাসে।
শহর থেকে খানিকটা দূরে শান্ত একটা নদী। কোনো কূজন নেই। ধীর বহমান নদীর কাছে এসে বেঁটেমতো লোকটা দা-য়ের মধ্যে তাবিজ বেঁধে ফেলে দেয়। এরপর ফিরে যায় নিজ আস্তানায়। সেখানে কাগজে নানান নকশা আঁকা। লোকটা কিছু একটা পড়ে কাগজে ফুঁ দিতে থাকে। সেই কাগজ পুঁতে দিতে হবে অবনীকে কোনো একটা পরিত্যক্ত কবরে।
চলবে?